somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খাদ্যের জন্য প্রতিক্ষা

৩০ শে নভেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৬:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাগেরহাট থেকে:
"ছেলেটা ডানকোলে ছিলো। মেয়েটা বাম হাত ধরেছিলো। ঝড় আর বাতাসের তান্ডবের মধ্যে আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তায় বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে যেনো পানির ঢেউ এসে আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। মেয়েটিকে ধরে রাখতে পারিনি। তবে ছেলেকে কোলে নিয়েই প্রায় আধাঘন্টা সাতরাই। অন্যরা যখন আমাকে উদ্ধার করে তখনও ছেলেটা কোলেই ছিলো। তবে তার প্রান ছিলো না। বাড়ীর কাছ থেকে আধা কিলোমিটার দুরে মেয়েটাকে পেয়েছিলাম। সাইক্লোনের চারদিন পরে ফুলে ওঠা একটা মৃতদেহ ছিলো সেটা। এখন কি নিয়ে বাঁচবো আমি ...

কথাগুলো ইয়াসমিন আক্তারের। চোখ দুটো অশ্র“শিক্ত তার। প্রতিবেশীদের শত সান্তনাও তাকে থামাতে পারেনি একমুহুর্তের জন্য। প্রিয় সন্তান দুটির স্মৃতি প্রতিমুহুর্ত আকড়ে আছে তাকে। ইয়াসমিনের বাড়ী বাগেরহাটের সাউথখালি ইউনিয়নের খুড়িয়াখালি গ্রামে। স্থানীয়দের দাবি শুধু খুড়িয়াখালিতে নাকি মৃতের সংখ্যা ৩০০ জন।

খুড়িয়াখালিতে যাবার রাস্তাঘাট অধিকাংশই ভারী যানবাহন চলাচলের অনুপোযোগী। তবে একটি খাল আছে সেখানে যাবার জন্য। আর তাই ছোট্ট একটি ইঞ্জিন চালিত বোটে করে রওয়ানা দেই সেখানে। বিভিন্ন পশুপাখি’র মরদেহ ভাসছিলো সেই খালে। আর মাঝে মাঝেই দেখা মিলছেলো মানুষের লাশের। কখনো ছোট শিশু, কখনো মহিলা’র লাশ। সাইকোনের কিছুদিন পরেও লাশগুলো তুলে নেয়ার উদ্যোগ নেয়নি কেউ। পচন ধরে ফুলে উঠেছে সেগুলো।

খুড়িয়াখালি গ্রামে পৌছাঁতে খুব বেশি সময় লাগেনি। এই গ্রামে আমার যাতায়াত নতুন নয়। তবে এবার নতুন করে চিনতে হয়েছে সেটাকে। মনে হচ্ছিল কোন প্রাগঐতিহাসিক ডাইনোসরের পাল হেটে গিয়েছে এখান থেকে। তাদের পায়ের তলে পরে পিষ্ঠ হয়েছে গাছপালা, ঘরবাড়ী। রক্ষা পেয়েছে কিছু নারিকেল গাছ। ঘরবাড়ী হারানো মানুষ তাই রাস্তার পাশে ডালপালা, জীর্ন শির্ন কাপড়-চোপড় দিয়ে গড়ে তুলেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবাস।

খাবারের জন্য হাহাকার চলছে খুড়িয়াখালি গ্রামে। এখন পর্যন্ত তেমন কোন সরকারী বা বেসরকারী সাহায্য জোটেনি তাদের। কেন এই অবস্থা? জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল জলিল জানান, আমাদের গ্রামটা হচ্ছে মাঝখানে। এর একপাশে সাউথখালি আরেকপাশে স্বরনখোলা। এখন নদী পথে যেসব ত্রান আসে সেগুলো আমাদের গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছায় না। আর হেলিকাপ্টার নামার মতো জায়গাও নেই। এজন্য নাকি আমরা সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছি না।

আসলেই কি আপনাদের এখানে আসা অনেক কঠিন? এমন প্রশ্নের জবাবে জলিল জানান, খাল দিয়ে নৌকায় করে ত্রান সামগ্রী নিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু সেটাতো কেউ করছে না।

খুড়িয়াখালি গ্রামে বিশুদ্ধ পানি’র ভান্ডার বলতে ছিলো কয়েকটি পুকুর। কিন্তু ঘুর্নিঝড়ের পর সেগুলোর পানি আর খাওয়ার উপযোগৗ নেই। বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা আর গাছপালা’র পাতা জমে পানি হয়ে উঠেছে বিষক্ত। পাশের খালে এখনো ভাসছে লাশ। আর তাই খাওয়ার পানি জোগাড় করাও বেশ কঠিন কাজ তাদের কাছে। তাই বলে কি থেমে আছে জীবন? মোটেই না। তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত লাশ ভেসে বেড়ানো খালের পানিতেই গোসল করছে অনেকে। কেউ বা মাজছে থালা বাসন।

খুড়িয়াখালি গ্রামে বসবাসরত মানুষদের কাজ মুলত তিনটি। জমি চাষ, মাছ চাষ আর বাগান তৈরি। এবারের ঘুর্নিঝড় বাকি রাখেনি কিছুই। শত শত একর জমিতে সদ্য পাকন ধরা ধান গাছ নষ্ট হয়েছে। মাছ চাষীদের ঘেড়গুলো আছে তবে মাছেরা ভেসে গেছে ঘুর্নিঝড়ের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছাসের সাথে। আর বাগানের গাছগুলো মাথা ছুইয়ে দিয়েছে মাটির সাথে। ফলে শুধু গরীব নয়, অনেক মধ্যবিত্ত চাষীরা’ও এখন কপদর্কশুন্য, নিঃস্ব।

এই গ্রামের মানুষরা নাকি সাইক্লোনের খবর পেয়েও সাইক্লোন সেল্টারে যায়নি। কারন কি জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল জানান, কিছুদিন আগে আমাদের এলাকায় মাইকিং করে বলা হয়েছিলো যে সুনামি আসছে। সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে যান। সেই কথা শুনে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়েছে। কিন্তু পরে দেখা গেলে সুনামি দুরে থাক, সেই রাতে জোরে বৃষ্টিও হয়নি। একইরকম আরেকদিন মাইকিং করা হয়েছিলো তখনও কিছু হয়নি। তো দুই বার ভুল মাইকিং হওয়ার ফলে মানুষেরও ধারনা হয়েছিলো এবারো কিছু হবে না। আর তাই অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে যায়নি।
কামরুল আরো জানান, আমাদের গ্রামে কোন সাইক্লোন সেল্টার নেই। কাছে পিঠে যেটা আছে সেটাও প্রায় ২ কিলোমিটার দুরে। ঘুর্নিঝড় বা বন্যার আভাস পাওয়া’র পন এই এলাকার মানুষ সাইকোন সেল্টারে গিয়ে যায়গা পায় না। তাই আমাদের গ্রামে অন্তত্ব দুইটি সাইকোন সেল্টার প্রয়োজন। তাহলে ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা ঘটলে অনেক মানুষ রক্ষা পাবে।
ফাতেমা, স্থানীয় স্কুলের ক্লাস ওয়ানের শিক্ষাথী ছিলো সে। ঘুর্নিঝড়ের রাতে কোথায় ছিলো জিজ্ঞেস করায় বললো, আমি ঘরের মধ্যে মাচায় ছিলাম। ঘরের উপর থেকে টিন উড়ে গিয়েছিলো। তারপরও আল্লাহ বাচিয়েছে। স্কুলের খবর কি জানতে চাইলে ফাতেমা’র জবাব, স্কুলতো উইর‌্যা গেছে। এখনও ঠিক হয় নাই।

আশার কথা হচ্ছে, ঘুর্নিঝড় দুর্গতদের সাহাযার্থ্যরে এগিয়ে আসছে দেশী বিদেশী শত শত প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং অনেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগ। কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে দুর্গত এলাকাগুলোতে সুষম বন্টন হচ্ছে না সেগুলো। ফলে কিছু কিছু এলাকায় ত্রান পৌঁছাচ্ছে আবার কোন কোন এলাকা কিছুই পাচ্ছে না। খুড়িয়াখালি’র কথাই চিন্তা করুন না, পাশের এলাকা সাউথখালি’র মানুষেরা নিয়মিত বিভিন্ন সংস্থা’র কাছ থেকে ত্রান পেলেও মাত্র দুই কিলোমিটার দুরে থাকা খুড়িয়াখালি’র মানুষদের দিন কাটছে অর্ধাহারে, অনাহারে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সাহায্য পাবার অপেক্ষায় আছে তারা।
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×