দিন – ১
তারা কতটুকু গভীরে নেমেছে তা সামনের মনিটরে দেখা যাচ্ছে। ১০০০ মিটার। এর বেশি সূর্যেরর আলো আসতে পারে না। সমুদ্রের গভীরে তারা নেমেই যাচ্ছে, মনিটরে এক এক মিটার করে বেড়েই যাচ্ছে সমান তালে।
ড. ডেভ এ্যাটেন।
একজন এক্সপ্লোরার। কয়েক বছর আগে একটা ডকুমেন্টারি পড়তে পড়তে সেখানে একটা লাইন তার মনে গেঁথে যায়, “….সমুদ্রের গভীরের অধিকাংশ রহস্যই এখনও আবিষ্কার হয় নি….” তারপর আরও একটি লেখা দেখলেন “….সমুদ্রের গভীরে রোবটিক অনুসন্ধানের সময় বিজ্ঞানীরা এক রহস্যময় গুহার সন্ধান পেয়েছে। যেটার গভীরে কিছুদুর যাওয়ার পর তাদের রোবট নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে। এবং রোবটটিকে আর কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রনের আওতায় আনা যায় নি। রোবটটি হারিয়ে যাওয়ার আগেও মুহূর্তে এক ঝলক সাদা আলো দেখা গিয়েছিল। তারপরই রোবটটি নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে যায় ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়….” সমুদ্রের রহস্য খোঁজার নেশা তার। এই লেখা দু’টো তার মনে দাগ কাটে। দিনরাত মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে যে, সেই আলোর উৎস কিসের? সেটা আগ্নেয়গিরি হতে পারে না, কারণ আগ্নেয়গিরি হলে আলো লালচে বা হলদেটে হত। তাহলে কিসের আলো হতে পারে সেটা। সেই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে তার সবকিছু। এই প্রশ্নর উত্তর খুঁজতেই তিনি জীবনের সব পুঞ্জী ব্যয় করে ডুব দিলেন সমুদ্রের গভীরে।
তার এই যাত্রার সঙ্গী পুরাতন সহকর্মী ড. নাকাতো কানজো ও ডিপ সী ভ্যাসেল মেকানিক জনি।
তার ভ্যাসেল খুব একটা বড় না। ১০’/৮’ এর আয়তাকার একটা যান, উচ্চতা ৭’। সর্বাধুনি যন্ত্রপাতি নিয়ে ভিতরটা সজ্জিত করা। সাত দিনের পরিমাণ শুকনো খাবার আনা হয়েছে সাথে, যদিও এতদিন থাকার কোন পরিকল্পনা নেই। পানি আলাদা আনা হয় নি, সমুদ্রের পানিকেই প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে খাবার উপযোগী করার ব্যবস্থা আছে। সমুদ্রের পানি থেকে অক্সিজেনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ভ্যাসেলের সামনে দিকে বড় একটি পুরু কাচের জানালা। তার বাহিরের দুইদিকে দুটি উচ্চশক্তি সম্পন্ন লাইটের জ্বলছে। সমুদ্রের গভীরের অন্ধকার ভেদ করে কিছুদূরের অসীমে আবার মিলে যাচ্ছে। তারপর শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। এর সাথে সাথে সার্বক্ষনীক দু’টা ক্যামেরা চলছে। একটা ভিতরের জন্য ও অন্যটা বাহিরের জন্য। সমুদ্রের গভীরে যে চাপ কাজ করে, সেই চাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রুপান্তরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করা আছে। সাতদিন যেন কোন সমস্যা না হয় কোন কিছুতে।
ড. এ্যাটেন, ড. কানজো ও জনি উৎসুক দৃষ্টিতে সেই অন্ধকারের দিকেই তাকিয়ে আছে। যদি কিছু দেখা যায়।
এই যাত্রায় ড. এ্যাটেন ও জনির পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলেও ড. কানজো একদম অনভিজ্ঞ। এই প্রথম কোন অভিযানে তিনি এসেছেন। তাও সমুদ্রের গভীরে যাওয়ার মত দুঃসাহসী কোন অভিযানে। যেখানের প্রতি মুহূর্তেই অনিশ্চয়তা কাজ করছে। যে কোন সময় যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে। তাও তিনি সাহস করে এলেন।
ড. এ্যাটেন এর আগে একবার মারিয়ানা ট্র্যান্সে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় সাবমেরিনে করে ঘুরে বেড়িয়েছেন নিজ দেশের নৌবাহিনীর সাথে। সবাই এই সুযোগ পায় না। কিন্তু, ড. এ্যাটেন নিজের জন্য ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, কারণ দেশের বিশিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বিভিন্ন সময় সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। তার বিভিন্ন প্রত্যক্ষ ভুমিকার কারণে তার দেশ ও সরকারের অনেক উপকারও হয়েছে। যথা কারণে সরকার তার কোন আবেদনে না করতে পারে না। এভাবেই তিনি নৌবাহিনীর সাবমেরিনে অতিথী হিসেবে অনেকবার ঘুরে বেড়িয়েছেন।
নৌবাহিনীর সাবমেরিনে ঘুরে বেড়ানোর সময়ই ড. এ্যাটেনের সাথে পরিচয় হয় জনির। তারপর যখন ম্যারিয়ানা ট্র্যান্সে তিনি প্রথমবারের মত অভিযান করলেন, তখন তার সঙ্গী হয়েছিল জনি। ডুবুরি জাহাজ পরিচালনা ও যান্ত্রিক বিভিন্ন বিষয়ে জনি যথেষ্ঠ অভিজ্ঞ। আর ড. এ্যাটেনের সাথে তার সম্পর্কও ভাল ছিল। যথা কারণেই, ড. এ্যাটেন যখন প্রথম তাকে ম্যারিয়ানা ট্র্যান্সে অভিযানের জন্য অফার করলেন, সে না করতে পারেনি। এবং পরে সে বিষয়টা যথেষ্ঠ উপভোগও করেছে।
“আমরা এগার’শ মিটার নিচে নেমেছি। এখন পর্যন্ত তেমন কোন কিছুর দেখা পেলাম না।” কাচের বাহিরের সমুদ্রের বিস্তৃত অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল ড. কানজো।
“কয়েকটা শার্ক তো দেখেছো। মাছের পালও দেখেছো।”
“হা, তা দেখেছি। কিন্তু সেগুলো তো রেগুলার জিনিস। অপ্রত্যাশিত কিছু দেখতে চাচ্ছি।”
“সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে যে। আমার হাতে এর কোন নিয়ন্ত্রন নেই।” বলে হো হো করে হেসে উঠলো ড. এ্যানেট।
“হাসছো তুমি। অসীম তলের দিকে তলিয়ে যাচ্ছি দেখে ভিতরটা আমার ভয়ে গুরমুর করছে। আর তুমি হো হো করে হেসে যাচ্ছো।” বলতে বলতে ড. কানজো তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসল।
“কানজো, আমরা একটা অপ্রত্যাশিত অভিযানে এসেছি। এই অভিযানে হয় তো কিছুরই দেখা পাবো না। আবার অনেক কিছুরই দেখা পেতে পারি। একটু ধৈর্য ধরো….. সবে তো কয়েক ঘন্টা হল।”
“কো-অর্ডিনেটস গুলোর মত আগাচ্ছো তো?”
“হুম, আগাচ্ছি। গন্তব্যে পৌছতে আমাদের দুই দিন সময় লাগতে পারে।”
“এত সময় কেন? আমরা কি সেই যায়গা বরাবর উপরে নামি নি?”
“নেমেছি। কিন্তু, যে গুহার সন্ধানে আমরা এসেছি, সেটাতে তো সব সময় আলো নাও জ্বলতে পারে। এছাড়াও, সেটার আশেপাশে আরও অনেক গুহাও থাকতে পারে। যদি আলো না জ্বালানো অবস্থায় সেখানে গিয়ে পৌছাই, তাহলে কো-অর্ডিনেটস ঠিক থাকলেও আসলে কোনগুলা সেটা তো বের করা সহজ হবে না। তাই না?”
“হুম, তা ঠিক বলেছো।” একটু চুপ থেকে ড. কানজো আবার বলল, “আমি ঠিক করেছি, যদি ফিরতে পারি, তাহলে একটা বই লিখবো এই অভিযান নিয়ে।”
“ফিরে না যাওয়ার কোন কারণ আছে কি?”
“অনিশ্চয়তার তো কোন ঠিকানা নেই। যে কোন সময় যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারে। তাই না?”
“হ্যা, তা পারে। মৃত্যু তো আর আমাদের হাতে না। আমাদের চেষ্টা শুধু জীবন বাঁচিয়ে যতটুকু রাখা যায়।”
“বাহ্… দার্শনিক হলে কবে থেকে?”
“তোমার সাথে থাকলে তো যে কেউ দার্শনিক হতে বাধ্য।” বলে আবার হো হো করে হেসে উঠল ড. এ্যাটেন।
“ভ্যারি গুড।” বলে আবার বাহিরের দিকের অন্ধকারে মনযোগ দিল ড. কানজো।
ড. এ্যাটেন হলোস্ক্রিনের ম্যাপের দিকে তাকিয়ে যাত্রা পথের দিক হিসাব করতে শুরু করল।
এতক্ষণ স্টিয়ারিং হুইলে বসে সবকিছু চুপচাপ শুনছিল জনি। সেও বাহিরের দিকের অন্ধকারে তাকিয়ে আছে। ড. এ্যাটেনের পথের দিক নির্দেশনা ঠিক করে দেয়া অনুযায়ী সে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো তাদের ভ্যাসেল। ড. এ্যাটেন শখ করে এই ভ্যাসেলের নাম দিয়েছেন “মিনি নটিলাস”। তার অত্যন্ত পছন্দের সাই-ফাই লেখক জুলভার্নের সৃষ্ট প্রথম সাবমেরিন জাহাজ “নটিলাস ”এর নাম। সেটার ক্যাপ্টেন ছিল “ক্যাপ্টেন নিমো”। জুলভার্ন যখন সাবমেরিনের ধারণা নিয়ে ১৮৭০ সালে প্রথম বই লিখেন “টোয়েন্টি থাউজেন লিগস্ আন্ডার দ্য সী”, তখন সেটাই ছিল সম্ভব প্রথম সাবমেরিনের ধারনা পাওয়া। তারপরের কয়েক দশক পর মানুষ সাবমেরিন বানাতে সক্ষম হয়। সেই থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে শখ করে নিজের ছোট সাবমেরিন জাহাজের নাম দেন “মিনি নটিলাস”।
মিনি নটিলাস তিনজনকে নিয়ে ধীরে ধীরে সাগরের গভীরে নেমে যাচ্ছে। গতি নিয়ন্ত্রন করছে দুই দিকের দুই মাঝারি আকারের ঘূর্ণায়মান পাখা ও পিছনের তিন মিটার ব্যাসের বৃহৎ পাখা। দুইদিকের মাঝারি পাখাগুলো ৩৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘুড়তে পারে। যার ফলে মিনি নটিলাস সুবিধা মত পথে চলতে পারে।
হঠাৎই ড. এ্যাটেন বললেন, “জনি, নটিলাস থামাও।”
“কেন স্যার?” বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল জনি। ড. কানজো’ও ছানাভরা চোখে তাকিয়ে আছে ড. এ্যাটেনের দিকে। দু’জনের মনে একটাই প্রশ্ন, হলটা কি?
“কোন সমস্যা, ডেভ? কিছু কি হয়েছে?”
“না, কোন সমস্যা না।”
“তাহলে থাকতে বলছো কেন?”
“অনবরত নেমে গেলেই তো হবে না। একটু একটু থেমে চারিদিক পর্যবেক্ষণও করতে হবে। যদি কিছু কাছে এসে পড়ে।”
“স্যার, এটা নিয়ে তো চিন্তা করার কিছু নেই,” বলল জনি, “কারণ আমাদের মিনি নটিলাসে তো লাইফ ডিটেক্টর সেট করা আছে। সেটার রেঞ্জও যথেষ্ঠ। দশ মাইল। এখন পর্যন্ত যা যা সেটাতে ধরা পড়েছে, সেগুলোও কিছু নিরিহ মাছ ছাড়া ভয়ংকর কিছু না। এছাড়া কয়েকটা বাচ্চা শার্ক, স্কুইডও ধরা পড়েছে।”
“ওহ্ হো, সেটার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম।” বলে হো হো করে হেসে উঠল ড. এ্যাটেন। “তুমি এতকিছুর খবর রেখেছো, এগুলো তো কানজো’র কাজ। তুমি কেন করেছো?”
“স্যার, কানজো স্যার অনেক তৃপ্তি নিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিল। তাই আমি একটু ডাটা আপডেট দেখে নিয়েছিলাম কিছুক্ষণ আগে।”
ড. কানজো একটু লজ্জা পেলেন যেন।
“আচ্ছা ঠিক আছে, সমস্যা না। মিলে মিশেই তো কাজ করতে হবে। কানজো তুমি বাহিরে দেখতে পারো নির্দিধায়।” বলে হাসতে লাগল ড. এ্যাটেন।
“ঠিক আছে, আর খোঁচা দিতে হবে না। তুমি তোমার কাজ করো।”
ড. এ্যাটেন তখনও হাসছেন। বিব্রত দৃষ্টিতে ড. কানজো তার দিকে তাকিয়ে রইল।
মিনি নটিলাস ধীরে ধীরে গভীরে নামছে। একই সাথে অন্ধকারের ঘনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই অন্ধকারের মাঝেই যেন অনন্ত অসীমতার কোন গল্প দেখা যাচ্ছে। তাপমাত্র ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। একই সাথে গভীরতার চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে।