somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাপানি ভূত আর শঙ্খনীল কারাগার

২২ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৪:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হল্যান্ড থেকে ফিরে কেমন যেন আদর আদর লাগছিল ঢাকার সব কিছু। সব সময় ঢাকায় ফিরলে আমার এমনই মনে হয়। রিক্সায় চড়ে মনে হচ্ছিল এটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বাহন। কাজিন ভ্যালি কে বললাম "রিক্সায় চড়তে অনেক মজা তাই না? খুব মিস করেছি রিক্সা" সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। বয়স আমার আর কত তখন.....মনে হয় ৭ বা ৭.৫। আটে পা দেই নাই তখনও এটুকু মনে আছে।

ক'দিন ছোট চাচার বাড়িতে থাকলাম আমরা। আব্বু একটা বাড়ি খুজে পেল শেষ পর্যন্ত বনানিতে। ঠিকানাটা আজ আর মনে নেই। বাড়িটা নতুন বাননো। আমরা একতলায় আর উপরে দোতলা'টার কন্সট্রাক্শন শুরু করে টাকার জন্য মনে হয় শেষ হয়নি তখনো, ছাদ আর দেয়াল গাঁথা হয়েছে তবে তাতে জানালা দরজার পাল্লা বসেনাই, প্লাস্টারও পরেনি ইটের উপর। ডান পাশের প্লটাটা খালিই ছিল। মটর শুটির বুনো জঙ্গল তাতে। বা'দিকের প্লটে রাস্তার কোনে বেশ সুন্দর একটা একতলা বাড়ি ছিল। মাঝের বাড়িতে আমরা, এই বাড়িটাতে আমরা ৬ মাস ছিলাম মাত্র। এর পরে আমরা আবার দেশের বাইরে চলে যাই।

আমাদের সেই বাড়িতে তিনটে বেডরুম ছিল, আর প্রতিটা বেডরুমের সাথে ছিল বিশাল বিশাল ব্যালকনি। বলা চলে বাড়িটার তিন কোনে তিনটে L প্যাটার্নের বিশাল ব্যালকনি, নেট দিয়ে ঘেরা। তবে এক ব্যালকনি থেকে আরেকটাতে যাওয়া যায় না, যেতে হয় ঘরের ভেতর দিয়ে। বাড়িটাতে অনেক বড় বড় জানালা, আমার খুব পছন্দ ছিল বাড়িটা। চারপাশে নিচু প্রাচির দিয়ে ঘেরা। ডান দিকের খালি প্লট আর আমাদের বাড়ির মাঝে যে প্রাচির তার গা ঘেসে একটা কাঠাল গাছ। কিচেনের ব্যালকনি থেকে উঠোনে নামলেই গাছটা সামনে পরে। আমি স্কুল থেকে ফিরেই গাছে উঠে বসে থাকতাম। বসে বসে কচি কচি কাঠাল বাচ্চা গুলো কে লবন আর শুকন ঝালের গুরো দিয়ে খেতাম। আম্মা বলত গলায় কাশি হবে....... আমি সে কথায় কান দিয়েছি বলে কখনও মনে পরে না যদিও ;)। প্রাচিরে উপর বসে পাশের প্লটের বুনো মটর শুটি ছিড়ে খেতাম। গাছে চড়ার জন্য আব্বু শুধু বকে নাই আমার গলায় একদিন ছুড়িও ধরেছিল :P

পড়তাম বনানি বিদ্যানিকেতনে। সামনের মাঠে একদল ছেলেমেয়েদের এক টিচার কাঠের ড্রাম্বেল নিয়ে এক্সার্সাইজ বা নাচানাচি করাতেন ;)। আমার কোন বন্ধু ছিল না বলে আব্বু একদিন আমাকে সামনের মাঠে নিয়ে গিয়ে টিচার কে বললেন আমার মেয়েটাকে আপনার বাচ্চাদের দলে নিন।




তো আমার রুটিন ছিল সকালে স্কুল, এর পর গাছ আর দুপুর গড়ালে বিকেলে সেই ড্রাম্বেল ক্লাসে নর্তন কুর্দন করা। সন্ধ্যায় পড়তে বসা, রাতে ৯ টার পর টিভির সামনে বসা, ১০টায় টিভি'র সামনে ঘুমিয়ে পরা, এর পর আব্বু কোলে করে আমার ঘরে আমাকে আমার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসত।

প্রচুর গল্পের বই পড়তাম তখন। আমার এক চাচা রাশান ম্যাগাজিনে কাজ করতেন তিনি যতবার আমাদের বাড়িতে আসতেন ততবার আমার জন্য একটা রাশান বই থাকত তাঁর হাতে বা একটা নতুন ম্যাগাজিন। উনি ছারাও যে কেউ আমাদের বাড়িতে এলে আমার জন্য বই অবশ্যই থাকত তাঁদের হাতে। আমি ছুটির দিনে আমার বিছানার তলে ঢুকে মেঝেতে শুয়ে বই পড়তাম। বাইরে থাকলে এ ও ডাকাডাকি করে.......বা "এটা এনে দাও তো বাবা ওটা দিয়ে আসত বাবা" এসব শুনতে শুনতে শান্তি মত বই পড়তে পারতাম না। একদিন বই পড়তে পড়তে খাটের নিচে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। সবাই খুজতে খুজতে যখন পাগল অবস্থা আমি তখন ঘুম ভেঙ্গে বেরিয়ে এলাম চোখ কচলাতে কচলাতে........:P

ওই বাড়িটাতে ওঠার কিছুদিন পর থেকে কোন এক বিশেষ কারনে আমি খুব ভয় পেতাম রাতে। হল্যান্ডে আমি যখন আরো ছোট ছিলাম তখন থেকেই আমি আমার আলাদা ঘরে শুতাম। টয়লেটেও আমি একা একা যেতাম। কখনও কাউকে ডাকি নাই সাথে আসবার জন্য। এই বাড়িটাতে আমাকে এই একটা ব্যাপার খুব ঝামেলায় ফেলল। মনে হয় কে যেন সারাক্ষন আমার সাথে সাথে। মনকে বোঝাই আমার তো অনেক সাহস আমি তো ভয় পাই না একদমই :-*। তবু ভয় কমে না, দিনে দিনে বাড়তেই থাকে। আম্মা বা আব্বু না দেখলে রাতে শেফালি কে নিয়ে টয়লেটে যাওয়া শুরু করলাম। ওকে দরজার সামনে দাড় করিয়ে রাখতাম। এর পর ওকে একদিন বললাম আমার ঘরে এসে শুতে....তাতে আম্মা আব্বু দু'জনেই না বলে দিল, বলল "শেফালি কেন তোমার ঘরে শোবে।" আমি লজ্জায় বলতে পারি না যে রাতে আমার ভয় করে :(। তবু রাতে টয়লেটে যেতে হলে শেফালি কে তার ঘর থেকে ডেকে নিয়ে আসতাম মাঝে মাঝে। একদিন আব্বু তা জেনে আমাকে বকে বলল "শেফালিকে কেন ডাক টয়লেটে যেতে, ওর রাতে ঘুমাতে হয় না?" আমি লজ্জায় বলতে পারি না আমার ভয় লাগে.......।

একদিন স্বপ্ন দেখি একদল সাদা হাড়ের কঙ্কাল গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা সাদা আলখোল্লা পরে মিছিল করে পশের খালি মটরশুটির প্লট থেকে আমাদের বাড়ির দিকে আসছে আর আমি রান্না ঘরের ব্যালকনিতে দাড়িয়ে তা দেখছি। ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে আমি খুব চেষ্টা করছি দৌড়ে ব্যালকনি থেকে ডাইনিং রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে.....কিন্তু আমার পা তখন মেঝেতে গ্লু দিয়ে আটকে গেছে। কিছুতেই আর পারছি না ঘরে ঢুকতে, এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে করে ঘরের দিকে আসছি আর ওদিকে কঙ্কালের মিছিল বেশ জোরে সোরে হেটে হেটে আমাদের প্রাচিরের প্রায় কাছেই পৌছে যাচ্ছে......। আমার বুক ধক ধক করছে....। আমি নিঃস্বাস নিতে পারছি না, চিৎকার করে আম্মাকে ঢাকতে পারছি না :(........... এরকম একটা সময় আমি ঘেমে ভিজে উঠে বসি ঘুম থেকে। এর পর এই একই স্বপ্ন আমি রোজ দেখা শুরু করলাম। এমন কোনো রাত ছিল না ওই বাড়িতে যে আমি এই একই স্বপ্ন আর দেখি নাই।

কিছু দিন পর এসবের সাথে শুরু হল আরেক জ্বালা......রাতে মনে হয় একটা মেয়ের ডেড বডি আমার খাটের নিচে রাখা। মেয়েটা ওয়েস্টার্ন, ব্লন্ড, একটা সাদা রং এর মিনি স্কাটর্ট পরা উপরে গোলাপি টি শার্ট, পায়ে কনভার্স গোলাপি রংএর।


তকে কে যেন মেরে একটা জলা মত জায়গায় ফেলে গেছিল। সে এখন আমার খাটের নিচে থাকে কারন জলায় পচা পানি জমেছে। আমি রাতে খাট থেকে নামলেই সে তার ডান হাতটা দিয়ে আমার পায়ের গোরালি চেপে ধরবে। এই ভয়ে খাট থেকে নামাই একটা ভয়াবহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল, তবু সাহস করে নেমে যেতে হত, দৌড়ে টয়লেটে যেতাম আবার দৌড়ে এসে বিছানায় উঠতাম। তখন এক একটা রাত আমার জন্য ছিল খুবই আনএক্সপেক্টেড.... রাত হলেই টেনশনে অস্থির থাকতাম। চেষ্টা করতাম রাতে টয়েলেটে যেন রাতে আর না যেতে, কিন্তু ছোট বেলা থেকেই আমার রাতে কয়েকবার টয়লেটে যাওয়ার অভ্যাস....আজও তাই।

তখন গরম কাল, একদিন গভীর রাতে আমার ঘুম ভাঙ্গল প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাসে, আমার গায়ে একটা চাদর, আমি ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে ছিলাম। আমার বাম কানের উপর বরফ ঠান্ডা বাতাস এসে পড়ছে......ব্যাপারটা বুঝতে আরো একটু সময় লাগল, ঘর অন্ধকার, কোথাও কোন শব্দ নেই....... শুধু একটা ফোস ফোস শব্দ কানে এলো। বুঝলাম কে যেন বরফ ঠান্ডা নিঃস্বাস ফেলছে আমার বাম কান আর ঘাড়ের উপর। প্রতিবার নিঃস্বাস ফেলার শব্দে আমার ঘারে ঠান্ডা বাতাস পরতে লাগল। আমি প্রথমে ভাবলাম শেফালি কি উঠে এসেছে আমাকে টয়লেটে নিয়ে যাবার জন্য? সে সেটা মাঝে মাঝে করত.....ও রাতে টয়লেটে গেলে আমার ঘরে এসে আমাকেও উঠিয়ে সাথে নিয়ে যেত টয়লেট করাতে। আমি ভাবছি ও যদি এসেই থাকে তবে আমাকে ডাকছে না কেন? নড়াচড়া না করে আমি ওর ডাকের অপেক্ষায় থাকি কিছুক্ষন, ৫/৬ মিনিট পেরিয়ে গেলেও যখন সে ডাকল না আমি তখন, ভয় পেলাম। চাদর টেনে মাথা ঢেকে নিলাম আস্তে আস্তে। তবু চাদর ভেদ করে ঠান্ডা বাতাস লাগতে থাকল আমার ঘারে। তখন ভয়ে জমে গেছি, আমার সারা গা ভিজে গেছে ঘামে..... চাদরে মাথা ঢেকে দেয়ায় নিঃস্বাস নিতে পারছিলাম না......আমি মাথা ঢেকে ঘুমাতে পারি না আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কিছুক্ষন পর চাদর সরাতে বাদ্ধ হলাম......জানালা দিয়ে আসা বাইরের আবছা আলোয় দেখি এক জাপানি ভুত আমার মাথার পাশে দাড়িয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর ফোস ফোস করে ঠান্ডা নিঃস্বাস ফেলছে। তার বোচা নাকের, কুতকুতে চোখের গোল মুখটাতে অনেক খতের দাগ। মনে হয় কখনও তার মুখটা কেটেকুটে গিয়েছিল। সারামুখে কাটাকুটির দাগ। মাথায় তার চুল নেই বললেই চলে, যা আছে তাও খুব ছোট করে ছাটা। পরনে তার লাল, কালো, খয়রি রং এর প্রিন্ট করা সিল্কের জাপানি স্টাইলে জামা এমনটা দেখতে অনেকটা, তার সাথে ঢোলা পাজামা।



সে কোন কথা বলেনি আমার সাথে... তবু কেমন করে যেন সে তার গল্প বলতে থাকল আমাকে। সে একজন জ্যাপানিজ স্পাই, ওয়ার্লড ওয়ার ১ এ বোমার আঘাতে মারা যায়। তার একটা ছোট্ট মেয়ে ছিল, সে তাকে খুজে পাচ্ছে না কোথাও। এখন ব্যাপার হলো আমি এই কাহিনী শুনে কি করব আমার পেয়েছে টয়লেট। আমার মাথার পেছনে জাপানি ভূত আর খাটের নিচে ওয়েস্টার্ন সাদা চামড়ার ব্লড চুলের মরা মেয়ে X((। এখন এই অবস্থায় কেমন করে যাই টয়লেটে, এই মহা সমস্যায় পেট ফেটে মারা যাবার যোগার আমার তখন.....:((:(( । তবু এই জাপানি ভূত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল মাথায় পেছনে আর ফোস ফোস করে ঠান্ডা নিঃস্বাস ছারতে থাকল।

সেই রাতটা অনেক কস্টে কাটালাম। একটু পর পর ঘুমিয়ে পরি আর স্বপ্ন দেখি আম্মা বা শেফালি এসেছে আমাকে টয়লেটে নিতে। আমাকে টয়লেটে নিয়ে গেছে কিন্তু আমি দাড়িয়ে আছি হা করে........এমন করে রাত টা গেল......।

পরের রাতেও একই অবস্থা...........শুধু পরের রাতে নয় এর পর এই তিন জিনিস নিয়ে আমার রাত কাটতে থাকল। মাঝে মাঝে সাহস করে একাই এসবের মাঝ দিয়ে টয়লেটে যাই, আবার মাঝে মাঝে শেফালি কে ফিস ফিস করে ডাকি। একদিন আম্মার ঘরে গিয়ে আম্মাকে ঢেকে বললাম আমার সাথে টয়লেটে যেতে। আম্মা আর আব্বু আমাকে বোঝাল টয়লেটে যেতে কাউকে ডাকতে হয় না একাই যেতে হয়, আমি বড় হয়ে গেছি এখন, ভয়ের কিছু তো নেই। আর ভূত বলে তো কিছু নেইই, তো আমার আর ভয়ের কি আছে?

একদিন বললাম আমি ড্রয়িং রুমে ঘুমাব। কারন ঐ ঘড়ে আমার ভয় লাগত না। কিন্তু আব্বু বলল "ড্রয়িংরুমে কেন ঘুমাবে ওটা কি ঘুমানোর ঘর? তুমি তোমার ঘরে ঘুমাবে" আমি মহা ঝামেলায় পরলাম। কত দিন ড্রয়িং রুমে ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে থেকেছি, কিন্তু আব্বু পরে কোলে করে আমার বিছানায় দিয়ে এসেছে। কি আর করা এভাবেই আমার রাত যায় ভূত ভূতনীদের সাথে। মাঝে মাঝে দিনেও গা রিমঝিম করত ভয়ে।

একদিন জাপানি ভূত বাবাজি বেশি ফোস ফোস করায় আমি আর টয়লেটে যেতে পারলাম না, ভূতের ভয়ে আর স্বপ্নে বার বার টয়লেট দেখে বিছানায় টয়লেট করে ফেললাম :(:P :(( আব্বু খুবই রাগ করল, খুবই বকা দিল :(। আমি ভয় পেয়েছি শুনে আরো রাগ করল :(, বলল এত বড় মেয়ে বিছানায় টয়লেট করে নাকি? :| এর পর একদিন দুপুরে আমি আম্মার বেডরুমের পেছনের ব্যালকনিতে পরে গেলাম পা পিছলে, মাথায় এত জোরে ব্যাথা পেয়েছিলাম যে সাথে সথে ঘুমিয়ে গেছিলাম বা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম মনে হয়। ঘুম থেকে উঠেছি রাতে, দেখি আব্বু আমার বিছানার পাশে বসে। আমার মনটা ভাল হয়ে গেল তখন, আব্বু আমার বিছানার পাশে এসে তো বসেনি আগে কখনও তাই ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লাগল। মনে হলো এমন করে রোজ কেন আমি পরে যাই না, ব্যাথা পাই না........।

এর পর আম্মা আমাকে মাঝে মাঝে নানান রকমের বাংলা বই পড়ে শোনাতো দুপুরে তার বিছানায় শুয়ে শুয়ে। আব্বু যখন অফিসে থাকত আমি স্কুল থেকে ফিরলে লাঞ্চ করতেই আম্মা আমাকে আমার রুম থেকে ডেকে নিয়ে যেত তার ঘরে.....তার বিছানায় শুয়ে আমাকে বাংলা বই পড়ে শোনাত জোরে জোরে...বিছানায় ছিল সবুজ গোল গোল ঘর কাটা চাদর, আমি সেই গোল গোল ঘরে আঙ্গুল বুলিয়ে খেলতাম আর গল্প শুনতাম। আমার কেন যেন একদিন মনে হয়েছিল আম্মা ভয় পায় বলে আমাকে ডেকে নিয়ে যায় তার ঘরে। কিন্তু আবার ভাবলাম সেত এত বড় মেয়ে সে কেন ভয় পাবে? নিশ্চই আমি যেন গাছে বসে না খেলে দুপুরে ঘুমাই সে জন্য আম্মা আমাকে নিয়ে যায় গল্প শোনাতে তার ঘরে, আর আমিও বুঝে না বুঝে সেই গল্প শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়েও পরতাম।

এরকম এক দুপুরে আম্মা আমাকে ডাকল গল্প পড়ে শোনাবার জন্য। বলল খুব মজার একটা গল্প আছে..... বইটার কাভার এ ছিল নীল রংছবি....একটা মেয়ে চমৎকার করে শুয়ে আছে মতন একটা ব্যাপার। বইটা আম্মা তিন ঘন্টা ধরে পড়ে শেষ করেছিল মনে হয়, বা তার একটু বেশি হবে হয়ত, মনে নেই ঠিক তবে এক দুপুরে শেষ হয়েছিল বইটা, সেদিন আমি একবারও ঘুমিয়ে পরি নাই, পুরো গল্পটা শুনেছিলাম....পড়ার শেষে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে তার কোলে মুখ চেপে রেখে কেঁদেছিলাম খুব। বইটার নাম ছিল "শঙ্খনীল কারাগার"। তখন জানতাম না লেখক কে এত ছোট বেলায় লেখক নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা মাথায় আসে নাই গল্পটাই ছিল ইম্পর্টেন্ট। পরের ক'টা দিন সেই গল্প ভেবে ভেবে যে কত মন আমার খারাপ হয়েছে, কস্টে বুক ব্যাথা করেছে। একা একা কাঠাল গাছের ডালে বসে সেই গল্পের কথা ভেবেছি। তার দু একদিন পরে আম্মা আরেকটা গল্প শুনতে ডাকল। সেটা শুনে আমার আরো ভালো লাগল, কষ্টও লাগল.......সেই বইটার নাম ছিল "নন্দিত নরকে"। ওটা শুনেও অনেক কেঁদেছি। সেই আমার প্রথম হুমায়ুন আহমেদের বই পড়া বা আসলে শোনা বলা চলে। তার নাম আমি জানতাম না তখন। তাকে আমি চিনতাম না তখন। তবু সে আমার ছোট্ট মনটাকে ছুয়েছিল। বড় হয়ে যখন কোন এক দোকানে সেই বইটা দেখেছিলাম "শঙ্খনীল কারাগার" তার পর থেকে তার বই আমার পড়া শুরু হয়। সেই ছোট বেলায় ঐ বাড়িটাতে যখন আমার খুব ভূতের ভয় লাগত আমি সেই গল্প দুটোর কথা মনে ভাবতে ভাবতে ভয় কাটাতাম আর এক সময় ভাবতে ভাবতে ঘোরের মধ্যে টয়লেটেও চলে যেতাম একা একা।

বড় হয়ে সেই মানুষকেটা চেনা, জানা আর তার বই পরে অনেক সময় খারাপ মন ভাল হয়েছে আবার ভাল মন খারাপ হয়েছে। কখনও ইচ্ছে করেছে হিমুকে খুজে বের করে রুপা হয়ে স্যান্ডেল খুলে খালি পায়ে হিমুর হাত ধরে রাস্তায় বেরোই। কখনও আমার বাংলা মটরের বাড়ির সবুজ পাথরের মেঝের খোলা ব্যালকনিতে সারা রাত শুয়ে চন্দ্রস্নান করে মন ভাল করেছি। সময় অসময় অনেক বুদ্ধি দিয়েছেন তিনি মন ভাল করার। আমি একটা কাজ প্রায়ই করতাম ঢাকা থাকতে মন খারাপ হলে, সেটা হল চিড়িয়াখানায় গিয়ে হাতির পিঠে চড়ে বেড়াতাম। বুদ্ধিটা তিনি আমায় দেন নাই তবে তিনি আমাকে ভাবতে শিখিয়েছেন কি করলে মন ভাল হয়। ভেবে ভেবে বের করতে শিখিয়েছেন কি করলে মন টা ঠিক হয়ে যাবে.....। তার চলে যাওয়াটা মন না মানা খচখচানি একটা ব্যাথা দিয়ে গেল।

আরেকটা কথা সেই ছোট বেলায় আমাকে বড়দের বই আম্মার পড়ে শোনানোর একটা কারন ছিল....... সে ভাবত আমি বাংলায় লেখা বড়দের গল্প কিছু বুঝব না, আসলে আম্মা নিজে ভয় পেত একা একা দুপুরে তার রুমে থাকতে....। ভয় কাটাবার জন্য আমাকে নিয়ে গিয়ে গল্প পড়ে শোনাত যে বই সে নিজের জন্য কিনত তা। কিন্ত সে জানত না যে আমি সেই বই এর সব বুঝতাম সব গুলো কথা, সব গুলো অনুভুতি গিলে গিলে খেতাম। হুমায়ুন আহমেদ হলেন সেই রকমের একজন লেখক। তার কথা সবাই বোঝে এমন কি আমার মতন ছোট্ট একটা মেয়েও বুঝেছিল।

এর কিছুদিন পরে আমরা সেই বাসা ছেড়ে চলে যাই। কারন আমরা তার ক'মাস পরে আবার বাংলাদেশ ছেড়ে বাইরে চলে যাই আমার আব্বুর কাজের জন্য। ওই বাসাটা ছেড়ে যাবার পরে আমি কখনও আর সেই কঙ্কালের স্বপ্ন দেখি নাই, সেই মরে যাওয়া ব্লন্ড চুলের মেয়েকেও দেখি নাই, দেখি নাই সেই জাপানি ভূতকে। আমাদের বাড়ির কাউকে কখনও বলাও হয়নি ব্যপারটা।

এর পর অনেক বছর পরে আমি তখন ১৫/১৬ একদিন আম্মাকে তার এক বান্ধবীর সাথে গল্প করতে শুনেছিলাম সেই বাড়িটার কথা, ওরা ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছিল। আমি পানি খেতে ডাইনিং এ গেছিলাম, ওভার হার্ড করেছিলাম কথা গুলো। আম্মা বলছিল যে ওই বাড়িতে নাকি কিছু একটা ছিল, সে খুব ভয় পেত সেখানে। রোজ দুপুরে সে তার বেডরুমের ব্যালকনিতে কেউ নাকি হাটছে তাই শুনত পেত। মাঝে মাঝে সে একটা মেয়ের ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুনত। সেই মেয়েটাই নাকি হাটত ব্যালকনিতে। তার লম্বা কালো কোঁকড়া চুল ছিল, তার হাতের কাঁচের চুড়ি রুনঝুন শব্দ করে বাজত। আমার তখন মনে পড়ল কোনো এক দুপুরে আম্মা আমাকে আর শেফালিকে বাড়ির পেছনে দিকে পাঠিয়েছিল দেখতে যে কেউ হাটাহাটি করছে কিনা......। আম্মা বলেছিল সে শুনেছে ঠিক কে যেন হাটছে পেছনের ব্যালকনিতে, তার হাতে চুড়ি, কিন্তু আমি আর শেফালি গিয়ে কাউকে খুজে পাই নাই। এটা নিয়ে আমি আর শেফালি অন্য আর কিছু ভাবি নাই। আমরা ভেবেছিলাম আম্মা বোধহয় চোর এসেছে ভেবেছে। এসে বললাম "কোন চোরটোর নেই"।

বড় হয়ে এত বছর পরে যখন শুনলাম আম্মা সেই বাড়িটাতে ভয় পেত তখন আমার নিজের কথা গুলোও মনে পড়ল। কিন্তু আম্মাকে আর বলা হয় নাই আমার জাপানি ভূত, কঙ্কাল আর ব্লন্ড মেয়েটার কথা। আমার গল্প আমার মাঝেই রেখে দিলাম।

আজ এত দিন পরে হুমায়ুন আহমেদের চলে যাওয়া আমাকে মনে করিয়ে দিল সেই জাপানি ভূত, সেই ব্লন্ড মেয়ে, সেই কঙ্কালের মিছিল, চুড়ি পড়া লম্বা চুলের মেয়ে, শঙ্খনীল কারাগার আর নন্দিত নরকে .......।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১২ দুপুর ১:০৯
৫৩টি মন্তব্য ৫০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×