somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ The Replicator

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ৩:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এই শহরে হুবহু আমার মতো দেখতে একজন লোক আছে। প্রথমে ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এক সময় নিজেই এর প্রমাণ পেলাম। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুশি হবো নাকি বিচলিত হবো সেটি বুঝতে কিছু সময় লেগে যায়। যখন বুঝতে পারি ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঘটনার শুরু হয় মাস খানেক আগে। আমার রোজ ভোরবেলা মর্নিং ওয়াক করার অভ্যাস। এক শুক্রবার ভোরে হাঁটতে বের হলে সামনে এক পরিচিত মুরুব্বি চাচার সাথে দেখা হলো। চাচার ছেলেটা আমার সাথে স্কুলে পড়তো। তার নাম ফজল। আমাদের এলাকাতেই বাস করে তাই দেখা সাক্ষাৎ ভালই হয়। আর্থিক সমস্যার কারণে ছেলেটা মাধ্যমিকের পরে আর পড়াশুনা চালাতে পারেনি। সে এরপর এটা সেটা সামনে যে কাজ পায় তাই করে উপার্জনের চেষ্টা করে। চাচাকে সালাম দিয়ে কেমন আছি জিজ্ঞাস করলে তিনি কেমন জানি বিরক্ত হয়ে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভাল।” তারপর একটু ঠোঁট বাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন “কাল রাতে দেরি করে বাড়ি ফিরেও ভোরবেলা উঠলা ক্যামনে?!” আমি একটু অবাক হলাম। বললাম, “চাচা রাতে তো দেরি করে ফিরিনি। অফিস শেষে রাস্তায় যেটুক সময় তারপর তো সন্ধ্যার পরেই বাসায় ফিরেছি। জানেন তো দেরি করলে বাসায় আম্মা আর আপনার বৌমা কতো চিন্তা করে।” চাচা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “বাড়ি বৌ আছে তারপরেও এরকম আকাজ করো! আবার মিছা কথাও কও! আল্লাহ্‌রে ভয় করো একটু।” কথাটা বলেই চাচা মুখ ঘুড়িয়ে হাঁটা শুরু করলেন আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। আমি নিজেও কি বলবো কিছু বুঝে পারছিলাম না। চাচা এমনভাবে এসব কথা কেন বললেন আর আমি কি করেছি কাল রাতে কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি প্রতিদিনের মতোই অফিস শেষে বাড়ি ফিরি। বাইরে অহেতুক আড্ডাবাজি করে বা চা সিগারেট খেয়ে সময় নষ্ট করিনা। সিগারেটের অভ্যাসটাও নেই আমার। কখনো কিছু কেনার বা বাজার করার দরকার হলে সেগুলো কিনেই বাড়ি ফিরি। এমনকি বন্ধু বা কলিগদের সাথেও বাইরে খুব বেশি সময় নষ্ট করিনা। সেখানে চাচা আমাকে কোথায় কতো রাতে দেখেছে আমি হাজার চিন্তা করেও বুঝতে পারলাম না।

সেদিনে জুম্মার পরে মসজিদের বাইরে ফজলের সাথে দেখা হলে তার দিকে এগিয়ে যাই আমি। সেও হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে সবগুলো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। আমি কিছু বলার আগেই সে আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁত বের করে বললো, “কি খবর বন্ধু! কেমন আছো? কাল রাতে মজা কেমন করলা?” ফজলের কথার মধ্যে কেমন একটা বিশ্রী ভাব দেখলাম। ভাল লাগলো না আমার। আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, “কিসের কথা বলিস? কিসের মজা?”
সে একটু আমার কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো, “কাল রাতে আব্বায় তোরে দেখছে। এসে তারপর খুব আফশোস করে তোর কথা বলছিল।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “চাচার কথা ভোরেও খুব অদ্ভুত লেগেছিল। কি হয়েছে? চাচা আমাকে কোথায় কি করতে দেখেছে?”
ফজল আমার হাত ধরে টেনে একটু দূরে যেখানে আশেপাশে কেউ নেই এমন জায়গায় নিয়ে বলে, “আব্বার কথাটা আমিও বিশ্বাস করতে চাই নাই। ভাবছি কিনা কি কারে দেখতে কারে দেখছে! কিন্তু আব্বায় এত্তো জোর দিয়া কথাটা কইলো যে বিশ্বাস না করেও উপায় পাইতেছিলাম না। আব্বায় নাকি তোরে কাইলকা নদীর ধারে এক মাইয়ার লগে হাত ধইরা হাঁটতে দেখছে। তাও মেলা রাতে প্রায় ১১ টার দিকে। জানোস তো আব্বায় ট্রলার চালায়া শেষ খ্যাপ মাইরা ঐ টাইমে বাড়ি ফেরে। তখনি ঘাটের কাছে তোরে দেখছে। আর সে একশ ভাগ নিশ্চিত যে মানুষটা তুই। তোরে ছোটবেলা থাইকা মেলা ভালা জানে তাই ব্যাপারটা মোটেও মানতে পারতাছে না।”

ফজলের গল্পটা শুনে আমি যারপরনাই অবাক হলাম। ছোটবেলা থেকে কোনো রকম বাজে অভ্যাসের দিকে নিজেকে নিয়ে যাইনি। এলাকার সবাই আব্বার সুবাদে আমাকে চেনে আর ভাল ছেলে হিসেবেই জানে। সেখানে এমন একটা অপবাদ শুনে গলার ভিতর থেকে কেমন একটা জমাট বাঁধা কিছু একটা বের হয়ে আসতে চাইলো। বিয়ে করেছি খুব বেশিদিন হয়নি, এই জন্যে বাইরে অহেতুক সময়ও বেশি নষ্ট করিনা। তাহলে এমন ধরণের অপবাদ কিভাবে মেনে নিবো! প্রচণ্ড রাগ উঠতে লাগলো আমার। দাঁত চেপে ফজলকে বললাম, “চাচার কি চোখে কোনো সমস্যা হইছে? আমারে সে কেমনে অতো রাতে ওরকম জায়গায় ওরকম অবস্থায় দেখে? আমি কালকে অফিস ছুটির পরে সোজা বাসায় আসছি। আর কোথাও যাইনি আর অন্য মেয়ে নিয়ে ঘোরার তো প্রশ্নই আসেনা। কোত্থেকে এসব পায় উনি?”
আমার রাগ দেখে ফজল আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। “রাইগো না বন্ধু। আব্বার কথাগুলা আমারও বিশ্বাস হইতেছিল না। তোমারে তো আমি চিনি। আমি আব্বারে বুঝাবুনি যে ঐটা তুমি ছিলা না। আর আব্বারে তো তুই চিনিসই। সে কথা ছড়ানোর মতো মানুষ না। আমি তোর বন্ধু আর তার পোলা তাই আক্ষেপ কইরা কইছে। আর কাউরে সে কিছু কবে নানে। আমি তারে আরো ভাল করে বুঝায় কবানি।”

আমার আর বেশি কথা বলার ইচ্ছা ছিলনা। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম। বাড়ি এসে আমার স্ত্রী শিউলী আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“ঘরে চলো। তারপর বলছি।” বলে ওকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে এসে খাটের কোনে বসে পড়লাম। মাথা নিচু করে হাতের উপর রেখে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। শিউলী আমার ঘাড়ে একটা হাত আলতো করে রেখে পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে আমি কিছু নিয়ে আপসেট থাকলে এভাবে কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেই বলা শুরু করবো। কিছুক্ষণ পর ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বলতো কাল রাতে আমি কখন বাড়ি ফিরেছি?”
শিউলী একটু অবাক হয়ে বললো, “”কেন? সন্ধ্যার পর। যেমনটা রোজ ফিরো।”
“রাতে কি আমাকে আবার বাইরে বের হতে দেখেছিলে?” জিজ্ঞাসা করলাম ওকে।
“নাতো!!” ওর সোজা জবাব। “কেন কি হয়েছে?”
এরপর ওকে সব খুলে বললাম ভোরে চাচার সাথে আর একটু আগে ফজলের সাথে কি কি কথা হয়েছে। সব শুনে শিউলী এতোটা অবাক হল তা বলার মতো না। একটু রাগ হয়ে বললো, “এগুলো কেমন কথা! এসব কোত্থেকে পান উনি? তোমার বন্ধুকে বলো চাচাকে চোখের ডাক্তার দেখাতে।”
“থাক বুড়া মানুষ কি দেখতে কি দেখেছে! আর কখনো এসব না বললে হয়। আর ফজলও আশ্বাস দিয়েছে সে চাচাকে বুঝাবে আর উনি কাউকে কিছু বলার মতো মানুষও না।”

এরপর সপ্তাহ খানেক পার হয়ে যায়। এই ঘটনা যখন ভুলতে শুরু করেছি তখনি ঘটলো আরেক ঘটনা। সেদিন অফিসে অনেক কাজের চাপে ছিলাম। একগাদা ফাইল সামনে নিয়ে সেগুলা চেক করছি তখন আমার মোবাইলটি বেজে উঠলো। একটু বিরক্ত হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি আমার ভার্সিটির একটা বন্ধু আবিরের নাম্বার। একটু অবাক হলাম কারণ আবিরের সাথে আমার কথা হয়নি অনেকদিন। তার সাথে আমার বন্ধুত্ব খুব বেশিও না। কি কারণে হঠাৎ আমাকে কল করলো বুঝে পেলাম না। জরুরী হতে পারে ভেবে ব্যস্ততার মধ্যেও রিসিভ করলাম। হ্যালো বলে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি খবর দোস্ত কেমন আছিস?”
“এইতো ভাল। তোর কি খবর? সমস্যা মিটেছে?” আবিরের উত্তর।
অবাক হলাম ওর কথা শুনে। একে তো অনেকদিন পরে ফোন করছে আবার এমনভাবে জিজ্ঞাসা করছে যেন ওর সাথে খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে কথাও হয়েছে। “কিসের সমস্যা?” জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“কিসের সমস্যা মানে? সেদিন যে খুব বড় একটা সমস্যার কথা বলে টাকা নিলি। সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে সমস্যাও ভুলে যাস নাকি?” ওর কন্ঠে বিস্ময়। কিন্তু তার থেকেও বড় বিস্ময় কাজ করছে আমার মধ্যে।
“টাকা নিয়েছি? কিসের টাকা? আর কিসের সমস্যা? তোর সাথে তো আমার কথাই হয়নি প্রায় দুই বছর।” ওকে বললাম।
“নাটক করছিস নাকি মজা করছিস আমার সাথে? তুই তো জানিস টাকা পয়সা নিয়ে আমি অনেক সিরিয়াস। আমার সাথে এতোগুলা টাকা নিয়ে মজা করিসনা।” আবিরের কন্ঠে একটা শীতল ভাব।
টেবিলের কাজ থেকে মন পুরোটা উঠে গেল। “দেখ দোস্ত আমি সত্যিই বুঝতে পারছিনা তুই কি বলছিস। তোর সাথে আমার যেহেতু অনেকদিন দেখাই হয়নি সেখানে তোর কাছে থেকে টাকা নেয়ার প্রশ্নই আসেনা। আমি বুঝতে পারছিনা এমনটা কেন বলছিস তুই। আমাকে সবটা খুলে বল। আর কতো টাকার কথা বলছিস?”
“তুই আমার ভার্সিটির বন্ধু বলে ভাবিসনা যে টাকা পয়সার ব্যাপারে মশকরা করলে আমি ছেড়ে দিব। পুরো পাঁচ লাখ টাকা আমাকে আগামী সপ্তাহের মধ্যে ফিরিয়ে দিবি। নাহলে তোর খবর আছে।” এই বলে শাসিয়ে ফোনটা কেটে দিল আবির।
কিন্তু আমার মাথা এদিকে আর কাজ করছে না। আবির কেন এমনটা বললো আমি মোটেও বুঝতে পারছিনা। এতোগুলো টাকা আমি কেনই বা নিবো তার কাছে। আবির কাপড়ের ব্যবসা করে ভালই টাকা কামিয়েছে। অনেক পরিশ্রম করে অল্প ক’দিনেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। টাকার মূল্য তার কাছে অনেক। কিন্তু এভাবে আমাকে না শাসালেও পারতো। আর যেখানে আমি কোনো টাকা নেইনি সেখানে আমাকে শাসাবেই বা কেন! আবিরের মাথা এখন গরম এখন কল ব্যাক করলে শান্ত ভাবে কোনো কথা বলতে পারবেনা। ওর সাথে পরে কথা বলতে হবে। অফিসের কাজে আপাতত মন দিলাম। কিন্তু সারাদিনে মাথা থেকে ব্যাপারটা গেলনা। অফিস থেকে বাসায় এসে শিউলীকে সব খুলে বললাম। তখন সে বললো, “এই ব্যাপারটার সপ্তাহ খানেক আগে ফজল ভাইয়ের বাবা যেমনটা বলেছিল তার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই তো?” কথাটা শুনতেই সেদিনের কথাটা আবার মনে পড়ে গেল। চাচা আমাকে দেখেছিল এমন জায়গায় এমন কারোর সাথে যেখানে আমার থাকার কথা না। আবার আজ আবির এমন একটা কথা বললো যেটা আমার করার কথা না। ব্যাপারটা আমি প্রায় ভুলেই গেছিলাম। শিউলীর কথা শুনে ভাবতে শুরু করলাম, আসলেই তো! এই ঘটনাগুলো কোনো ভাবে রিলেটেড নাতো? তাহলে তো অনেক বেশি সিরিয়াস ব্যাপার। কেউ কি আমার মতো দেখতে এই শহরে আছে যে আমার নাম করে এই কাজ গুলো করছে?

রাতে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ এলো। মেসেজটা ওপেন করে দেখি একটা ভিডিও ক্লিপ। থাম্বনেলে একটা মানুষকে দেখা যাচ্ছে যার চেহারা একদম আমার মতো। নিজের চেহারা দেখে ভিডিও টা ওপেন না করে থাকতে পারলাম না। দূর থেকে ভিডিও টা করা হয়েছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন আড়ালে থেকে ভিডিও টা করছে। দূরে যাকে দেখা যাচ্ছে তাকে দেখে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। দূরে যাকে দেখা যাচ্ছে তাকে দেখে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সে আর কেউ না আমি নিজে। একটা চিকন কানা গলির ভিতর আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে আরেকটা লোক। লোকটা পিছন ফিরে থাকায় তার চেহারাটাও আমি দেখতে পাচ্ছিনা। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম আমার মতো দেখতে লোকটা সামনের লোকটার হাত থেকে কিছু একটা নিয়ে বেশ কিছু টাকার একটা মোটা বান্ডিল তার হাতে দিল। হাত বদলের সময় ক্যামেরার লেন্সটা জুম করে হাতে ফোকাস করা হলে দেখা গেল আমার হাতে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে সাদা পাউডারের মতো কিছু। সামনে থেকে কখনো চোখে কখনো না দেখলেও বুঝতে পারলাম জিনিসটা আর কিছু না, আফি*ম বা হেরো*ইন জাতীয় কিছু। টিভিতে অনেক দেখেছি। আমার মতো দেখতে লোকটা প্যাকেটটা দ্রুত প্যান্টের ভিতরের সাইডে সম্ভবত আন্ডারওয়্যারের মধ্যে ঢুকিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রুত পিছন ফিরে হেঁটে গলি থেকে বেরিয়ে গেল। এমন একটা দৃশ্য দেখে নিজেকে ধরে রাখা অনেক কঠিন হয়ে গেল। ভিডিওতে যাকে দেখলাম সে হুবহু আমার কপিক্যাট। চোখ মুখের ধাঁচ, চুলের কাটিং, দাঁড়ির স্টাইল এমনকি চলাফেরার ধরণটাও সেম। আমার পিছনে কখন যেন শিউলী এসে দাঁড়িয়েছে আমি টের পাইনি। ভিডিওটা সেও দেখে ফেলেছে। মুখে হাত চাপা দিয়ে একটু ফুঁপিয়ে উঠলো সে। ওর সাড়া পেয়ে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পিছনে ঘুরলাম। ওকে ধরে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, “শিউলী বিশ্বাস করো, ওটা আমি না। আমি কখনো এমন কাজ করিনি।”
শিউলী একটু চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে একটু ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আমার গালে হাত রেখে বললো, “আমি জানি ওটা তুমি হতে পারনা। তুমি এমন কাজ করতে পারনা। তোমাকে আমি বিয়েরও চার বছর আগে থেকে চিনি তাইনা?” বলে একটু শুষ্ক হাসি দিল। “আমার মনে হয় এইটা সেই লোক যে তুমি সেজে আবির ভাইয়ের কাছে থেকে টাকা নিয়েছে। আর একেই ফজল ভাইয়ের বাবা দেখেছিলেন। এই লোকটা যেই হোক না কেন সে তোমাকে ফাঁসাতে চায়। কেন চায় আমি জানিনা। কিন্তু খারাপ কিছু হওয়ার আগে আমাদের উচিত পুলিশকে জানানো।” শিউলীর কথা শেষ হতেই হোয়াটসঅ্যাপে যে নাম্বার থেকে ভিডিও এসেছে সেই নাম্বার থেকেই কল এলো। রিসিভ করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতে শিউলী বললো রিসিভ করে লাউডে দিতে। কি বলে শুনতে। কল রিসিভ করে লাউডে দিতেই অপাশ থেকে একটা কন্ঠ ভেসে এলো। “হ্যাললোউ আরাফ! কি খবর? কেমন লাগলো ভিডিও টা? নিজের পারফরম্যান্স কেমন লেগেছে?”
“কে আপনি?” কন্ঠ যতটা শান্ত রাখা সম্ভব রেখে বললাম। “এই ভিডিওর মানে কি? কে ঐ ভিডিওতে?”
“কেন নিজেকে চিনতে পারছোনা?” হাসতে হাসতে বললো ওপাশের লোকটা। “এসব বেআইনী কাজ করে কি সব ভুলে যাও আবার? হা হা হা হা!!”
“এইটা যে আমি না সেটা আপনিও ভাল করে যানেন। কিন্তু এটা কে? আর আমাকে এই ভিডিও পাঠিয়েছেন কি জন্যে? আপনার নামে আমি মামলা করবো।” রাগ দেখিয়ে কথাগুলো বললাম।
আমার কথা শুনে লোকটা আরো জোরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। কেমন জানি বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতো লাগলো হাসিটা। হাসি থামিয়ে বললো, “মামলা করলে করতে পারো। কিন্তু একটু বুদ্ধি খাঁটিয়ে চিন্তা করো। এই ভিডিও দেখলে পুলিশ কি তোমার কথা বিশ্বাস করবে? উলটে তোমাকে মাদ*ক মামলায় সোজা হাজতে ঢোকাবে। সো যা করবা সেটা ভেবেচিন্তে করতে পারো।”
কথাটা শুনে এখন কপাল ঘেমে গেল আমার। মারাত্মকভাবে ফাঁসানো হচ্ছে আমাকে। শিউলীর মুখটা দেখলাম ভয়ে একদম শুকিয়ে গেছে। কান্না করবে করবে ভাব। ওর গালে হাত রেখে শান্ত হতে ইশারা করলাম। “আপনি কি চান আমার কাছে? কেন আমাকে ফাঁসাতে চান? আর এই আমার মতো দেখতে লোকটাই বা কে? নাকি আপনিই এই লোক। নাটক সাজাতে দূর থেকে ভিডিও করিয়েছেন?” একবারে এতোগুলো কথা জিজ্ঞাসা করে থামলাম।
“এইতো এবার এসেছো লাইনে।” বললো লোকটা। “বুদ্ধি আছে তোমার বলতে হবে। কিন্তু এতো কথা ফোনে বলা যাবেনা। তোমাকে দুদিন সময় দিলাম। পঞ্চাশ লক্ষ টাকা নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে হবে তোমার। নাহলে এই ভিডিও টা পুলিশের কাছে চলে যাবে তোমার নাম ঠিকানা সহ। তোমাকে আমি সবসময় নজরে রাখবো। তুমি পুলিশের কাছে যেতে গেলেও তোমার আগে এই ভিডিও চলে যাবে। তখন পুলিশ তোমার আর কোনো কথাই শুনবে না। পরশু কোথায় কখন দেখা করতে হবে সব আমি টেক্সট করে দিবো তোমাকে।” আমি কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল। বারবার কলব্যাক করলেও ফোন অন পাওয়া গেলনা। এদিকে শিউলী মুখে আচল চাপা দিয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলছে। পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আমার মতো সাধারণ চাকরী করা মানুষের পক্ষে মোটেও সম্ভব না। কিন্তু আমার মন বলছে এইসব কিছুর পিছনে শুধু টাকা নয়, অন্য কোনো কিছু একটাও আছে। সেটা কি আমি বুঝতে পারছিনা। কাছের বন্ধু কাউকে কিছু বলবো সেই ভরসাও করতে পারছিনা। কারণ এই ভিডিওটা দেখলে আমাকে কেউ বিশ্বাস করবেনা। শেষ পর্যন্ত চিন্তা করলাম দুজন মানুষের সাথে আমার কথা বলা জরুরী। ফজল এবং আবির। দুজনকেই আমি হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ করে কল করলাম। দু’জনে রিসিভ করলে আগে তাদের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দিলাম।
“তোদের দুজনকে আমি একসাথে কল করেছি খুব সিরিয়াস একটা কারণে। কারণ তোরা দুজনেই এই ব্যাপারটার সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত।” তারপর তাদের দুজনকে সবকিছুই আমি খুলে বললাম। ফজলের বাবা কি দেখেছেন তা আবিরকে জানালাম এবং আবিরের সাথে কি হয়েছে ফজলকে জানালাম। সব শুনে তারা হতভম্ব হয়ে পড়লো।

দুদিন পর সকালে আমি একটা বড় ব্রিফকেস নিয়ে বের হলাম। এই ব্রিফকেসে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আছে। গতকাল রাতেই সেই লোকটি যেখানে যেতে হবে তার ঠিকানা টেক্সট করে দিয়েছে। একটি অটোরিক্সা নিয়ে আমি প্রথমে গেলাম নদীর ঘাটে। তারপর একটি যাত্রীবাহী ট্রলারে নদীটি পাড় হলাম। তারপর একটি রিক্সা নিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী একটি পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে এসে নামলাম। ভাড়া মিটিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম রিক্সাটা চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত। ছুটির দিন হওয়াতে আজ রাস্তায় এমনিতেই লোক কম। শহরের বাইরে নদীর ওপাড়ে হওয়ায় এই এলাকাটা একেবারেই নির্জন। রাস্তায় এক দুজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। আমি চারপাশটা চোখ বুলিয়ে পুরনো বাড়িটার ভিতরে ঢুকলাম। নির্দেশনা অনুযায়ী আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতালায় চলে গেলাম। দিনের বেলাতেও বাড়ির ভেতরটা বেশ অন্ধকার হয়ে আছে। দোতালায় উঠে দেখলাম বেশ কিছু ঘরের দরজা পর পর রয়েছে। একদম শেষ মাথার ঘরের দরজা খোলা আর সেখান থেকেই হঠাৎ কেউ একজন জোরে বলে উঠলো, “ভেতরে এসো আরাফ!” ফোনে লোকটার কন্ঠ শুনে তেমন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারলাম লোকটার কন্ঠ অনেকটাই আমার মতো। সাবধানে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম ঘরটার সামনে। দরজায় পর্দা দেওয়া। পর্দা ঠেলে আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলাম। ঘরের ভিতরে একটা বাল্ব জ্বলছে আর টেবিল ফ্যান ঘুরছে। একটা টেবিল রাখা আর সামনে চেয়ার রাখা। এছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। আগে থেকে জানা থাকলেও টেবিলের অপাশে যে মানুষটা বসে আছে তাকে দেখে কয়েক সেকেন্ড তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ঠিক যেন আমি বসে আছি। নিজের চোখে দেখে যতোটা অবাক হয়েছি শুধু ভিডিও দেখেও এতোটা অবাক হতে পারিনি। একটা মানুষ এতোটা অবিকল কিভাবে হতে পারে আমার জানা নাই। আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সামনের মানুষটা মুখে একটা রহস্যময় হাসি ধরে রেখে বললো, “এখুনি এতো অবাক হলে চলবে? অবাক হওয়ার এখনো অনেক বাকি। বসো বসো।” সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে। অনেক কথা আমার জানার আছে। তাই তার সামনে বসে পড়লাম চেয়ারে।
“টাকা এনেছো?” সামনের জনের প্রশ্ন। ব্রিফকেসটা টেবিলের উপর রেখে তার দিকে ঠেলে দিলাম। সে সেটা খুলে দেখে হালকা করে একটা শিস বাজালো। “এতো টাকা তো তোমার কাছে থাকার কথা না। কিভাবে ম্যানেজ করলে?”
“সেটা না হয় আমাকেই ভাবতে দিন।” আমার উত্তর। “তবে এই পুরো ব্যাপারটা যে শুধু টাকার জন্যে না সেটা খুব ভাল করে বুঝতে পারছি আমি। তাই দেরি না করে আমাকে সবকিছু খুলে বলুন। কে আপনি? আর হুবহু আমার মতো দেখতে কিভাবে?”

সামনের লোকটা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। লোকটা লম্বায়ও একদম আমার সমান। পিছনে হাত নিয়ে টিশার্টের নিচে থেকে হঠাৎ একটা পিস্তল বের করে হাতে নিলো। ভয় পেয়ে গেলাম কিন্তু সেটা প্রকাশ হতে দিলাম না। লোকটা বললো, “ভয় পেয়ো না। তোমাকে আমি এখুনি মারতে চাইনা। তবে আমি কথা বলতে বলতে যেন কোনো চালাকি করতে না পারো তাই সেফটির জন্যে হাতে রাখা।” লোকটা হাতে পিস্তল নিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে পায়চারী শুরু করলো। তারপর কথা বলা শুরু করলো। “আমার নাম আরিফ। একটু অবাক হলে তাইনা? তোমার সাথে চেহারা শারীরিক গঠন সব মিলে আবার নামটাও প্রায় মিলে যাচ্ছে! হা হা! প্রকৃতির কি খেয়াল তাইনা? ছোটবেলায় শুনেছিলাম পৃথিবীতে নাকি সেম চেহারার দেখতে সাতজন করে মানুষ থাকে। কথাটা এতোদিন জাস্ট একটা মিথ হিসেবে জানলেও তোমাকে যে এতোটা মিল পাবো তা আমি কখনোই ভাবিনি। বলতে পারো তোমার আমার যে এতোটা মিল সবটাই সৃষ্টিকর্তার অদ্ভুত একটা খেয়াল। অনেকটা শাহরুখ খানের সেই ডুপ্লিকেট মুভির মতো তাইনা? হা হা!! কিন্তু এই মিলটাই আমার জন্যে অনেক সুবিধার হয়ে গেল। তোমাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম একটা মেলায়। তোমার স্ত্রীর সাথে গিয়েছিলে। সত্যি বলতে তোমাকে দেখে আমি যেমন অবাক হয়েছিলাম, ঠিক তেমনি তোমার স্ত্রীকে দেখে ততোটাই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, তুমি যেটা বলেছিলে ঠিক তাই। ব্যাপারটা শুধু টাকার জন্যে না। টাকাটা ছিল তোমাকে এখানে নিয়ে আসার একটা অজুহাত। তোমার স্ত্রীকে দেখে এতোটাই ভাল লেগেছিল যে আমি অনেক চেষ্টা করেও মাথা থেকে তাকে সরাতে পারিনি। একটা সময় ভাবতে থাকি যে শিউলীকে আমার পেতে হবে। আরেকজনের স্ত্রী না আর কিছু এসব কিছু আমার মাথায় আর কাজ করছে না। তাই এতোকিছু করা শুধুমাত্র তোমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে তোমার স্ত্রীর কাছে তুমি হয়ে বেঁচে থাকা। প্রথমে আমি তোমাকে ফলো করতে থাকি। অনেকদিন অনেকভাবে ফলো করেছি। তোমার কথা বার্তা তোমার আশে পাশে মুখ লুকিয়ে থেকেই শুনেছি। সেভাবে নিজের কথা বলার অভ্যাস পরিবর্তন করেছি। তোমার চলাফেরা আয়ত্ত করেছি। তোমার বন্ধু, কলিগ, পরিবারের লোকজনদের চেনার চেষ্টা করেছি। নিজেকে তুমি হিসেবে গড়ে তুলেছি। তারপর ভেবেছিলাম তোমাকে তোমার বন্ধু, পরিবার, চেনাজানা সবার কাছে খারাপ বানাবো। তাই একটু নাটক করা লেগেছিল তুমি সেজে তোমার বন্ধুর বাবা এবং আরেক বন্ধুর সামনে। কিন্তু পরে দেখলাম এটাতে আমারই পরে প্লানের ক্ষতি হবে। তাই আমি তোমার সাথে ডিরেক্ট কন্টাক্ট করি। হ্যাঁ আমি এটাও জানি যে তোমার স্ত্রী সেদিন ফোনে লাউডে আমাদের কথা শুনেছে। কিন্তু তোমাকে মেরে লাশ গুম করে যদি আমি তুমি হয়ে তার কাছে যাই সে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারবেনা। তাইনা?” এতোকিছু বলে একটা শয়তানী হাসি দিল আমার দিকে তাকিয়ে আরিফ নামের লোকটা। এদিকে প্রচণ্ড রাগে আমার হাত নিশপিশ করছে তাকে খুন করার জন্যে। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রাখা লাগবে। ওর হাতের পিস্তল টাই যতো সমস্যা। এটাকে যদি হাতছাড়া করানো যায় তবেই ওকে ধরা সম্ভব।
“কিন্তু এতোকিছু করে তুমি কি সত্যিই পারবে হুবহু আমার মতো হতে?” বললাম আমি। “হাজার হোক সবকিছুই তুমি পারবেনা আমার মতো অবিকল করতে। আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনেক অভ্যাস তুমি জানোনা যা আমার স্ত্রী জানে। তখন তুমি তার কাছে ধরা খাবেই। তুমি কখনোই পারবেনা তার কাছে তার আরাফ হতে মিস্টার আরিফ!” দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বললাম আমি। কথাটা বলতেই অট্টোহাসিতে ফেটে পড়লো আরিফ। বললো, “তোমাকে তো আসল কথাটাই এখনো বলিনি। আমি কোথা থেক এসেছি, আমার পরিচয় কি। যাহোক, আমি একজন নিউরো সাইন্টিস্ট। আমি আগে ছিলাম অন্য একটা শহরে। সেখানে থাকতে আমি খুবই অভাবনীয় একটা ডিভাইস আবিষ্কার করি। সেই ডিভাইসটা আমি যদি তোমার মস্তিষ্কের সাথে কানেক্ট করে আমার ল্যাপটপে কানেক্ট করি, তাহলে তোমার মস্তিষ্কের একটি হুবহু নিউরাল কপি সেখানে একটা প্রোগ্রামের মধ্যে একটি মডেল তৈরি করে ফেলবে। তারপর একটি প্রবের মাধ্যমে আমার মাথার কিছু জায়গায় কানেক্ট করলে তোমার মস্তিষ্কের ঐ নিউরাল কপিটা আমার মস্তিষ্কে চলে আসবে। আর ফাইনালি মিস্টার আরাফ! আমি হয়ে যাবো তুমি!”

লোকটার কথা শুনে প্রচণ্ড আতঙ্ক শুরু হলো আমার। ও যা বলছে তা যদি সত্যিই হয় তাহলে আমার বাঁচার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আর আমার শিউলী! শয়তানটার কথা শুনে ওকে নিয়ে অনেক চিন্তা শুরু হয়ে গেল। এখন শেষ চালটাই চালতে হবে আমার। বললাম, “কিন্তু এতোকিছু করেও তুমি পার পাবেনা। কারণ আমি যে ব্রিফকেসটা এনেছি সেটাতে একটা মাইক্রোফোন আর জিপিএস ট্রাকার চিপ বসানো আছে। তোমার সব কথা আমার বন্ধু আবির আর ফজলের কাছে ট্রান্সমিট হয়ে গেছে। এবং যেকোনো সময় পুলিশ নিয়েও তারা চলে আসতে পারে।” বলার পর দেখলাম শয়তানটার হাসি মুখ থেকে আস্তে আস্তে মুছে গেল। প্রচণ্ড আক্রোশে সে পিস্তল টা আমার দিকে তাক করে এগিয়ে এলো কাছে। কিন্তু ট্রিগার চাপতে গিয়েও চাপলো না। বললো, “তোকে এখুনি গুলি করে মারতে মন চাইছে। কিন্তু তুই মেরে গেলে তোর নিউরাল কপিটা আর পাবোনা আমি। চল তুই আমার সাথে। এখুনি তোর নিউরাল কপি করবো আমি। বেশি তেড়িবেড়ি করলে তোকে মারবো তারপর তোর বউকে না পেলে তাকেও মারবো।” তারপর পিস্তল তাক করে রেখে আস্তে আস্তে পিছনে গিয়ে ব্রিফকেসটা হাতে নিল। কোথায় চিপ আর মাইক্রোফোন লাগানো সেইটাই মনে হয়ে খুঁজবে এখন। এইটাই সুযোগ আমার। শয়তানটা যখন ব্রিফকেসের দিকে তাকিয়ে আছে তখনি স্কুল লাইফে শেখা কারাতের ট্রেনিং টা কাজে লাগালাম। আমার পাশের চেয়ারটা আস্তে করে হাত বাড়িয়ে ধরলাম। তারপর পা দিয়ে টেবিলের একটা অংশে জোরে ধাক্কা দিয়ে আরিফের কোমড়ের সাথে ধাক্কা দিলাম। হঠাৎ ধাক্কা লেগে তার পিস্তল ধরা হাত উপর দিকে উঠে গেল আর আমি হাত দিয়ে ধরে রাখা চেয়ারটা তুলে তার হাতের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। হাতে চেয়ারের আঘাত লেগে পিস্তলটা পড়ে গেল, কিন্তু আমি এদিকে থেমে থাকিনি। বসা থেকে উঠে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে চিবুক বরাবর একটা আপার কাট দিলাম। মাথায় প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লেগে পিছনের দেয়ালে একটা বাড়ি খেল। কিছুটা কাবু হয়ে আসাতে ওকে ধরে উঁচু করে ওর চেয়ারে বসালাম। প্রচণ্ড ব্যথায় কাৎরাচ্ছে সে। কিন্তু শিউলীকে নিয়ে বলা কথায় আমার মাথায় যে আগুন ধরে গিয়েছিল তা এখনো ঠান্ডা হয়নি। আরো জোরে জোরে দুই চোয়ালে দুইটা ঘুষি বসালাম। মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে। মেরে ফেললে আমি বিপদে পড়বো ভেবে পেটে আরো দুইটা ঘুষি দিয়ে শান্ত হলাম। নিচু হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা পিস্তলটা তুলতে গিয়েই বিপত্তিটা বাঁধল। শয়তানটা যতই ব্যথায় কাৎরাক না কেন আমাকে নিচু হতে দেখেই পা চালিয়ে আমার নাকে মুখে একটা লাথি দিল। লাথি লাগায় পিস্তলটা ধরতে না পেরে ছিটকে এক সাইডে পড়ে গেলাম। প্রচণ্ড ব্যথায় চোখে ঝাপসা দেখলেও খেয়াল করলাম আরিফ পিস্তলের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। তাই দেখে দ্রুত পা চালিয়ে ওর পেট বরাবর একটি লাথি দিলাম। ক্যোঁৎ করে একটা শুব্দ করে আবার চেয়ারে বসে পড়লো। এদিকে আমি পা দিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা পিস্তলটা আমার দিকে এগিয়ে নিয়ে আসলাম। হঠাৎ দেখলাম আরিফ টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছুড়ি বের করে আনলো। তারপর সেটি আমার দিকে বাগিয়ে ধরে এগিয়ে আসতে গেলে সাথে সাথে পিস্তল তাক করে ট্রিগার টেনে দেই। আগে কখনো আমি পিস্তল চালাইনি। কি হবে কোথায় গুলি লাগবে সেটাও আমি জানতাম না। সেফটি ক্যাচ আগে থেকেই অফ করা ছিল। তাই গুলি বেড়িয়ে সোজা গিয়ে লাগলো ওর ছুড়ি ধরা হাতের বাইসেপে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে সে হাত থেকে ছুড়ি ফেলে দিল। তারপর বাইসেপ চেপে ধরে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো। খেয়াল করে দেখলাম গুলিটা ওর বাইসেপের এক সাইডের কিছু মাংস ছিড়ে বেড়িয়ে গেছে আসলে। এরই মধ্যে বাইরে পুলিশের সাইরেনের শব্দ শুনতে পেলাম। এখনো কিছুটা দূরে আছে সম্ভবত। অতিরিক্ত উত্তেজনায় দৌড়ে জানালার কাছে গেলাম দেখতে। ভেবেছিলাম গুলির আঘাতে কাবু হয়ে গেছে আর কিছুই করতে পারবেনা। কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে হঠাৎ মাথার পিছনে ভারী কিছু একটার আঘাত পেয়ে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল।

জ্ঞান ফিরলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলাম। আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখি শিউলী পাশের চেয়ারে বসে কিছু একটা পড়ছে। মনে হলো দোয়ার বইয়ের মতো কিছু একটা। আমি একটু শব্দ করতেই সে উত্তেজিত হয়ে উঠে এলো আমার কাছে। আমার হাত ধরে নার্স নার্স করে চিৎকার করে ডাকা শুরু করলো। নার্স আর ডাক্তাররা এসে আমাকে চেক করা শুরু করলো। আমি সবকিছু এড়িয়ে শুধু আমার শিউলীর দিকে তাকিয়ে আছি। কতো সুন্দর লাগছে তাকে। এদিকে ডাক্তাররা চলে গেলে অনুমতি নিয়ে একজন পুলিশ আর আবির এসে আমার সাথে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। আবির বললো, “আমরা তো গিয়ে দেখি তোরা দুজনেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছিস। কিন্তু তোদের দুজনকে এক জায়গায় দেখে এতোটা অবাক হয়েছি তা বলার মতো না। এতোটা মিল কিভাবে হয়! জামা কাপড় আর তোর পকেটের আইডি মানিব্যাগ দেখে বুঝেছি যে তুই কোনটা। কিরকম সাইকো রে ভাই লোকটা! ভাবা যায়না আসলে।”
“একটা রুমে কিছু ডিভাইস আর ল্যাপটপ পেয়েছিলাম। মাইক্রোফোনের সাহায্যে যে কথাগুলো শুনেছিলাম সেগুলার সাথে মিল পাই আমরা। সবকিছু জব্দ করেছি। আপনি সুস্থ হলে একটা অফিসিয়াল স্টেটম্যান্ট নিবো। এখন রেস্ট করুন।” কথা গুলো বলে পুলিশ অফিসার চলে যান। আবির এগিয়ে এসে বললো, “যা একটা ফাইট দিয়েছিস না ব্যাটা!! পুরাই হিরো মার্কা! ট্রান্সমিটারে শুনে তেমনি মনে হলো। আরো মজার ব্যাপার জানিস? ঐ ব্যাটার জ্ঞান ফেরার পর বলে যে সে নাকি আরাফ। আমরা যা ভাবছি তা নয়। শালা ধরা খেয়ে এখন অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করছে ব্যাটা। যাতে ওকে ছেড়ে তোকে ধরে পুলিশ। তুই তাহলে থাক এখন ভাবীর কাছে। রেস্ট নে। আমিও গেলাম। পরে কথা হবে।” বলে আবিরও চলে গেল।

শিউলী এবার কেবিনের দরজা লাগিয়ে দিয়ে আমার পাশে এসে বসলো। ওর দিকে আমি কেমন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছি। যেন কতোদিন দেখিনি তাকে। ওর চোখে এখনো পানি। মুছে দেয়ার জন্যে হাত বাড়াতে গেলে ডান হাতের বাইসেপে প্রচণ্ড জোড়ে ব্যথা করে উঠলো।

সমাপ্ত।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ৩:৩৬
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×