সিল্ট বেল্ট বেঁধে নেয়ার আগে আসুন চট করে দেখে নেই উদ্ভিদ এবং প্রাণী’র বসবাসের উপযোগী বিশ্বে কোথায় কোন স্থান রয়েছে। গত পর্বে তাইগা’র (বোরিয়াল ফরেস্ট) কথা বলেছিলাম- মনে আছে? দেখে নিন তো- কোথায় ছিল ঐ জায়গা?
বড় করে দেখুন এখানে
কিছুদিন আগেও আমি ভাবতাম যাহাই পর্বত তাহাই পাহাড়। আসলেই কি তাই? ইংরেজিতে আলাদা আলাদা শব্দ দিয়ে বোঝালেও বাংলাতে দ্বিরুক্ত শব্দ ‘পাহাড়-পর্বত’ আমাকে সন্দিহান করে দিত। সত্যি বলতে কি এই দুয়ে’র কোনো সুনির্দিষ্ট সর্বজন গৃহীত সংজ্ঞা নেই। যুক্তরাজ্য কিংবা যুক্তরাস্ট্রে উচ্চতার ভিত্তিতেই এই দুইয়ের পার্থক্য করা হয়। মোটামুটি ১০০০ ফিটের উপরের উচ্চতা হলে পর্বত (মাউন্টেইনস) আর এর নিচে পর্বত (হিলস) বলবো আমরা।
আমাদের দ্বিতীয় পর্ব- পর্বতরাজি।
পর্বতের ব্যপারে আগে খুব বেশি একটা না থাকলেও ইদানিং আমাদের আগ্রহ এর উচ্চতার মতই আকাশচুম্বী। আর হবেই বা না কেনো? অল্প কিছুদিনের মাঝেই মুসা, মুহিত, নিশাত, ওয়াসফিয়া রা দিয়েছে আমাদের সর্বোচ্চ শৃংগ জয়ের আনন্দ।
উম্মম্মম...দাঁড়ান দাঁড়ান...এক মিনিট! আমি কি “জয়” বললাম? তাহলে ভুল বলেছি! কেন? উত্তর টা শেষেই দিচ্ছি।
শুরুতেই ঘুরে আসা যাক সমুদ্রপৃষ্ঠের ১০০ মিটার নিচে অবস্থিত ইথিওপিয়ার ডানাকিল ডিপ্রেশান (ভূপৃষ্ঠের নিচু স্থান) থেকে। এই স্থান পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু এবং সবচেয়ে উষ্মতম স্থানগুলোর একটি। স্থানে স্থানে সালফিউরিক এসিডে ভরা গর্ত দেখে আপনাকে বুঝে নিতে হবে এর নিচেই জন্ম নিতে যাচ্ছে কোনো এক বিশাল পর্বত। ভূগর্ভস্থ টেকটোনিক প্লেটের পরষ্পর সংঘর্ষ কিংবা ভূগর্ভস্থ গলিত লাভার শক্তিশালী ধাক্কায় ভূপৃষ্ঠের শিলাগুলো সোজাসুজি জেগে ওঠে গড়ে তোলে বিশালাকার একেকটা পর্বত। মুভি তে মাঝে মাঝে দেখায় না- মুখোমুখি দুটো গাড়ি ধাক্কা খেয়ে খাড়া হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য- ব্যপারটা অনেকটা সেরকমই। কে জানে হয়তো ১০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে একটানা উদ্গিরিত হওয়া আগ্নেয়গিরি ‘এর্টা আলে’ও হয়তো অদূর ভবিষ্যতে জন্ম দিতে পারে ইথিওপিয়ান পর্বতরাজির মত কোন পর্বতের!
ইথিওপিয়ার প্রায় তিন মাইল উচ্চতা বিশিষ্ঠ এই পর্বতও কিন্তু প্রাণী শুন্য নয়। এখানে বাস করে জেলাডা বেবুন নামের প্রাণী। বিশেষ আঙ্গুলের সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিমিষেই তারা বেয়ে উঠতে পারে খাড়া এই পর্বত। আর এই ধরাধামে তারাই একমাত্র সম্পূর্ণ তৃণভোজী বানর। রাতগুলো তাদের সতর্কাবস্থায় কাটাতে হয় নেকড়ের ভয়ে।
ওদিকে দক্ষিণ আমেরিকার ৫০০০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত আন্দিজ পর্বতমালা যেন তৈরি করে দিয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের ভিত। বিষুব রেখা থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের গা ঘেঁষে এ পর্বতরাজি ছুঁয়ে দিয়েছে এন্টার্কটিকা। আমাদের পরের গন্তব্য এরই শেষ ভাগে অবস্থিত প্যাটাগনিয়া পর্বত। আবহাওয়া এখানে তার খেয়াল খুশি মতই চলে। তাই ভর গ্রীষ্মে বলা নেই কওয়া নেই সূর্যটা টুপ করে ডুবে গিয়ে বৃষ্টি কিংবা তুষারপাত শুরু হলে আশ্চর্য হবার কিছুই থাকেনা। তারপর ভাগ্য ভালো থাকলে হেমন্তের মেঘমালার দেখাও মিলতে পারে বিকেলের দিকে। একদিনেই সব ঋতু! এর মাঝেই রাতের আঁধারে পুমা (বিড়ালসদৃশ প্রাণী)’রা সপরিবারে ব্যস্ত থাকে গুয়ানাকো (উট সদৃশ প্রাণী) শিকারে। আরো উত্তরে তখন ধ্বংসের চূড়ান্ত উন্মত্ততা নিয়ে ঘন্টায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসে তুষারঝড়।
ওদিকে পশ্চিম কানাডা আর দক্ষিণ-পশ্চিম যুক্তরাস্ট্রের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে বিস্তৃত রকি পর্বতমালা শীত কিংবা গ্রীষ্মে অসংখ্য প্রাণীদের নিজের বুকে আগলে রাখে। পাথরের এই সমুদ্রের মাঝেও যেখানে ঘাস কিংবা গাছের এর বালাই নেই সেখানে পাথরের নিচে তাপ থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নেয়া পোকা মাকড়ের মথ হল ভালুকের অন্যতম খাবার।
আর এদিকে ১৫ মিলিয়ন বছর আগে আফ্রিকা থেকে সরে গিয়ে ইউরোপে জুড়ে যাওয়া আল্পস্ পর্বতমালা এখনও শরীরে বয়ে বেড়ায় প্রাচীন সমুদ্রতলের চিহ্ন। বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আল্পসের এই আঁকা-বাঁকা, খাঁজ কাটা আকৃতি প্রচন্ড শক্তির অধিকারী তুষারস্রোতেরই (গ্ল্যাসিয়ার) অবদান। এদের ক্ষয়কারী শক্তি এতটাই যে, হিমবাহের জায়গায় জায়গায় তারা তৈরি করে ‘মলেন’ নামক গলিত পানির গভীর নদী।
পাকিস্তানের কারাকোরাম পর্বতের প্রস্তরময় ‘বাল্টারো গ্ল্যাসিয়ার’ আমাদের এবার পরিচয় করিয়ে দেয় আলপাইন গ্ল্যাসিয়ারের সাথে। ৪৩ মাইল দৈর্ঘ্য আর ৩ মাইল প্রস্থ নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতময় এই হিমবাহ মহাশুন্য থেকে পরিষ্কার দেখা যায়- ঠিক যেন সাদা রঙের প্রতি প্রচন্ড অনুরক্ত কোনো খ্যাপাটে চিত্রশিল্পীর মাস্টারপিস! আর এত সুন্দরের মাঝেও মৃত্যুর প্রকট হাতছানি! “কে টু ” আর তার বোনেরা যতটা জীবন নিয়েছে আর কেউ ততটা নেয়নি! এতটাই স্বার্থপরভাবে খাড়া আর বিপজ্জ্বনক আকৃতি এদের যে খুবই দক্ষ পর্বতারাহী ছাড়া বেঁচে ফেরাটা কঠিন। এত দুর্গম অঞ্চলেও পুরুষ ‘মার্খর’ (সর্পিল শিং বিশিষ্ট হিমালয়ের এক ধরণের হরিণ) মত্ত তাদের শক্তির পরীক্ষায়। আর আছে বিরল প্রজাতির ‘স্নো লেপার্ড’। এত কাছ থেকে স্নো লেপার্ড আর দেখেননি কেউ কখোনো! এখনও ওসব অঞ্চলে এদের নিয়ে প্রচলতি আছে হাজারো রুপকথা! আর রয়েছে সর্বোচ্চ স্তরের খাদক ‘গোল্ডেন ঈগল’। শিকারের প্রতিযোগীতায় ঘন তুষারপাতের মাঝেও হঠাৎ আবির্ভূত হয় নেকড়ে।
এই দৈত্যাকার পর্বতমালার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল আমাদের এবারকার গন্তব্য। হিমালয়। ৫০ মিলিয়ন বছর আগে তিব্বতের সাথে ইন্ডিয়া’র সংঘর্ষে সৃষ্ট এ পর্বত আজো একটু একটু করে বাড়ছে! মৌসুমী বায়ুর জন্ম এখানেই। প্রচন্ড শীতে মোসুমী বায়ু যেখানে পেঁজা তুলোর মত বরফ হয়ে নামে সেই দেশে সকল রুপকথার সাক্ষী হয়ে আজো অসহায় দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে পান্ডা। চিনের সিচুয়ান প্রদেশের উচ্চভূমিতে বসবাসকারী পান্ডাদের তাদের অন্যসব জাতভাই ভালুকের মত এই বিরুপ আবহাওয়ায় লুকিয়ে থাকার জো নেই! সোনালী নাক বিশিষ্ট একপ্রকারের বানর এই উচ্চতায় পান্ডাড় একমাত্র প্রতিবেশী।
একদিন বরফ থামে। গাছে গাছে মেলা বসে সাদা আর গোলাপী চেরি ব্লসমের। কে জানতো কদিন আগের নিরস বর্ণহীন মাটি তার মাঝে এতটা রঙ লুকিয়ে রেখেছে- রডড্রেনডন! আচ্ছা, কার বেশি বৈচিত্র্য? ফুল না পাখি? হলফ করে বলতে পারি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবেন। দিন দিন সংখ্যায় কমতে থাকা জায়ান্ট পান্ডার সদ্যপ্রসূত সন্তান লালন পালনের প্রতিটা মুহুর্ত্ব আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় – পর্বতের জীবন মোটেও সোজা কিছু নয়!
পর্বতারোহীদের পরম আরাধ্য মাউন্ট এভারেস্ট। মর্ত্যের সর্বোচ্চ শৃংগ। নাহ- কোন প্রানীই স্থায়ীভাবে বাঁচতে পারেনা এখানে। নেপালীরা বলে থাকে- পাখিরও নাকি সাধ্য নাই অতটা উপরে ওড়ে! কিন্তু প্রতিবছর পঞ্চাশ হাজার ‘ডেমোজেল সারস’ প্রচন্ড বাতাসের মাঝে এই পথেই ভারতের দিকে মাইগ্রেট করে আসে! মাঝে মাঝে বাতাসের ঘূর্ণন কিংবা শিকারি ঈগল তাদের পিছু হটায় তবু নতুন দিন তাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখায়। ঠিক যেমন দেখায় পর্বতারোহীদের। এ পর্যন্ত প্রতি দশজন আরোহীর মাঝে একজন বঞ্চিত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিন্দুতে দাঁড়িয়ে ভাবতে- “লাইফ ইজ রিয়েলি বিউটিফুল”! যারা পৌঁছাতে পারে, তারাও থাকে অল্প কিছুক্ষণ মাত্র! তাই পর্বত ভ্রমণ হয়তো সম্ভব কিন্তু জয় করে নিজের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে কি মানুষ কখনও?
দ্বিতীয় পর্ব- মাউন্টেইনস (পর্বতরাজি) নামিয়ে নিন এখান থেকে।
পরিশিষ্টঃ ব্যস্ততার কারণে দ্বিতীয় পর্ব দিতে দেরি হয়েছে বলে দুঃখিত। ইচ্ছা আছে সামনে থেকে লেখার ব্যপ্তি কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে দুই পর্ব এক সাথে দেয়ার। কথা দিচ্ছি অতটা দেরি হবেনা আর।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:০৯