নাচোগো নাচো কালী
আমারই বুকে নাহয় শিবেরই বুকে
নৃত্য বা নৃত্যকলার নৃত্য শব্দটি সাধারণত শারীরিক নড়া চড়ার প্রকাশ ভঙ্গীকে বোঝায়। এ প্রকাশ ভঙ্গী সামাজিক, ধর্মীয কিংবা মনোরঞ্জন ক্ষেত্রে দেখা যায়। নৃত্যকলার সংজ্ঞা নির্ভর করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নন্দনতত্ত্বিক, শৈণ্পিক এবং নৈতিক বিষয়ের উপর। প্রাচীন মানুষের ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন বস্তু নিদর্শনের মতো নৃত্যকলার তেমন কোন বস্তু না পাওয়া গেলেও নৃত্যকলা প্রাচীন মানবের বিভিন্ন আচার উৎসবে নৃত্যের প্রমান পাওয়া যায়।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে প্রগৈতিহাসিক কালে নৃত্যকলার প্রমাণ পাওয়া যায়। খৃষ্টপূর্ব ৩৩০০ সালে মিশরীয় দেয়াল চিত্রে এবং ভারতের গুহা চিত্রে নৃত্যকলার ভঙ্গী উৎকীর্ণ রয়েছে। দেয়াল চিত্রে খোদিত ভঙ্গীগুলো হতে মনে হয় যে কিংবদন্তীর কাহিনী পরিবেশনের জন্যই ঔ চিত্রগুলো উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে লিখিত বর্ণমালা প্রচলনের আগে নৃত্যকলার এই পদ্ধতির মাধ্যমেই এই সব গল্প বংশ পরম্পরায় চলে আসতো। নৃতকলার আরো একটি প্রাচীন প্রকাশ দেখা যায় অতীন্দ্রিয় চেতনায় বিভিন্ন কু-প্রভাব হতে মুক্ত করার আচার অনুষ্ঠানে। আজো নৃত্যকলার এই ব্যবহার ব্রাজিলীয় চিরহরিৎ বনাঞ্চলেরসংস্কৃতি হতে কালাহারি মরুভুমিরসংস্কৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত।
নৃত্যকলার ইতিহাসে ভারতীয় নৃত্যকলা হচ্ছে প্রাচীন নৃত্যকলার অন্যতম। খৃষ্টপূ্র্ব প্রথম সহস্রাব্দের বহু ভারতীয় গ্রন্থে ভারতীয় নৃত্যকলার বিষয়ে বর্ণনা দেখা যায়।
পৌরাণিক যুগ থেকেই নৃত্য ও সঙ্গীতের সঙ্গে নটরাজ বেশে শিবের যোগ বিদ্যমান। সারা ভারতে, বিশেষত তামিলনাড়ুতে, নটরাজের পাশাপাশি নৃত্যমূর্তি নামে শিবের নানান নৃত্যরত মূর্তি পাওয়া যায়। শিবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দুটি নৃত্যের নাম হল তাণ্ডব ও লাস্য। তাণ্ডব ধ্বংসাত্মক ও পুরুষালি নৃত্য; শিব কাল-মহাকাল বেশে বিশ্ব ধ্বংসের উদ্দেশ্যে এই নাচ নাচেন এবং মধুর ও সুচারু নৃত্যকলা লাস্যকে তাণ্ডবের নারী সুলভ বিকল্প মনে করা হয়; এই আবেগময় নৃত্যকে পার্বতীর নাচ রূপে কল্পনা করা হয়। তাণ্ডব ও লাস্য নৃত্য যথাক্রমে ধ্বংস ও সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
নটরাজ মূর্তি
লাস্য নৃত্য
সুন্দরী নারীদের অপ্সরা উপমায় ভূষিত করার অনেক বাক্য হয়তো আমরা অনেকেই শুনে থাকব। অপ্সরা সুন্দরী, রূপে, গুণে অতুলনীয়া। সংগীতে পারদর্শী, নৃত্যে পটিয়সী। তারা স্বর্গের হুর। দেবতাদের আসরে নৃত্য গীতে মনোরঞ্জন করেন। মুনি, ঋষিদের সাধনা ভাঙ্গাতে দেবতাদের চক্রান্তে অপ্সরাদের রুপ মাধুরীতে ছল চাতুরীর কাহিনীও পাওয়া যায় পৌরাণিক কাহিনীতে। এই যেমন, অপ্সরা মেনকার রূপে কামনা গ্রস্থ হয়ে বিশ্বামিত্রের সাধনা ভঙ্গ হয়, আর জন্ম হয় শকুন্তলার। এভাবেই, পৌরাণিক কাহিনীতে মেনকা, রম্ভা, উর্বশী এবং আরও আরও অপ্সরাদের কার্যকলাপের অভাব নেই। বলতে গেলে ইনারা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন।
বিশ্বামিত্র কঠোর সাধনায় রপ্ত হলে দেবরাজ ইন্দ্র ভীত হলেন। বিশ্বামিত্র না আবার স্বর্গ রাজ্য কেড়ে নেন তার কাছ থেকে। তাই সাধনা ভঙ্গের জন্য পাঠালেন অপ্সরা মেনকাকে। মেনকা তার রূপ, রস, গন্ধ, কলা নিয়ে এলেন। ধ্যানরত ঋষির পাশে মেনকা শুরু করলেন কামনা মদির নৃত্য ও সংগীত, কাম শৃঙ্গার। একদিকে দেবরাজ ইন্দ্রের চক্রান্ত। অন্যদিকে কামনার মেনকা, মোহিনী সংগীত, মোহনীয় নৃত্য; আর কাম দেবতার ফুলশর।
বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙ্গে না। মেনকাও হাল ছাড়েন না। বরফ গলল। আগুন দাউদাউ করল। কামশাস্ত্রের সকল কলা নৈপুণ্য মেনকা প্রয়োগ করলেন। বিশ্বামিত্র পুরোদমে কামনাতুর প্রেমিক হয়ে গেলেন। বিশ্বামিত্র ও মেনকার মিলনে শকুন্তলার জন্ম হল। বিশ্বামিত্র দায়িত্ব না নিয়ে চলে গেলেন সাধনা ভঙ্গের যন্ত্রনা নিয়ে। অপ্সরা মেনকাও চলে গেলেন শকুন্তলাকে ফেলে।
বর্তমান কম্বোডিয়ার একটি বিখ্যাত স্থান হচ্ছে অ্যাংকর, প্রাচীন খ্মের সাম্রাজ্যের প্রধান নগর ছিল। এই সাম্রাজ্যের সম্রাট জয়বর্মন নিজেকে দেবতা হিসেবে ঘোষনা দিয়েছিলেন তাঁর পরবর্তি সম্রাটরাও মননে এমন ছিলেন। আর স্বর্গের আদলে গড়া হয়েছিল নগর। স্বর্গের রাজা ইন্দ্র, ইন্দ্রের আসরে অপ্সরা আছেন, দেবতা হিসেবে আখ্যায়িত সম্রাটেরও তো অপ্সরা থাকতে হবে। সম্রাটের অপ্সরা আনয়ন কামোদীপ্ত কর্ম ছিল, না ভক্তিবাদী কর্ম ছিল। যদিও বর্তমানে অপ্সরা নৃত্যকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে পবিত্র হিসেবে দেখা হয়, প্রার্থনার অংশ হিসেবে, এখনও পালন করা হয়।
এভাবেই অপ্সরা নৃত্য থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ইত্যাদি দেশের সংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে। মালোয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ছিল শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের। খ্মের রাজ্য মালোয়েশিয়ার অংশ বিশেষ, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া প্রভৃতি অংশ জুড়ে ছিল। খ্মের এর রাজধানী ছিল যশোধাপুরা, হরিহরলয়া, অ্যাংকর। চম্পা রাজ্যের রাজধানী ছিল ইন্দ্রপুরা, বিজয়া। খ্মের সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সামান্য উপাত্ত আর মানচিত্র দেখে সহজেই অনুধাবন করা যায় অপ্সরা নৃত্যের ব্যুৎপত্তি।
অস্পরাদের চিত্তাকর্ষক নৃত্যরতা ছবি
সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ধারণ করা অপ্সরা নৃত্যের জন্য নৃত্যশিল্পীদের কঠোর শ্রম ও অনুশীলনের প্রয়োজন হয়। প্রাচীন কালের ইতিহাস এক রকম হলেও, আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অহমিকার মাপকাঠিতে থাই ও কম্বোডিয়ানদের মধ্যে বেশ রেশারেশি চলে। ইতিহাসের উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে এসব আসে, পৃথিবীর আরও বিভিন্ন ইতিহাস এবং বর্তমান পটভূমিতে তা দেখা যাবে।
ওড়িশি পূর্ব ভারতের ওড়িশা রাজ্যের একটি শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী। এটি ভারতের আটটি ধ্রুপদী নৃত্যশৈলীরও অন্যতম। ভারতীয় নৃত্যের আদিগ্রন্থ নাট্যশাস্ত্র এই নৃত্যশৈলীটিকে ওড্র-মাগধী নামে অভিহিত করেছে।
ভুবনেশ্বরের নিকটস্থ উদয়গিরি পর্বতে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে নির্মিত একটি খোদাইচিত্র থেকে এই নৃত্যের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয়। অনুমিত হয়, ব্রিটিশ আমলে এই নৃত্যশৈলীটি কিছুটা অবদমিত হয়েছিল; কিন্তু স্বাধীনতার পর আবার এর পুনরুজ্জীবন ঘটে। ওড়িশি নৃত্যে ত্রিভঙ্গি (মাথা, বুক ও শ্রোণীর স্বতন্ত্র সঞ্চালনা) এবং চৌকা (মৌলিক চতুষ্কৌণিক ভঙ্গিমা) এই দুয়ের উপর অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ ওড়িশিকে অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী থেকে পৃথক করেছে। ওড়িশি সংস্কৃতিতে তিনটি ঘরানার উপস্থিতি লক্ষিত হয়ঃ মহারি, নর্তকী ও গোতিপুয়া। ওড়িশার মন্দিরগুলিতে দেবদাসীদের মহারি নামে অভিহিত করা হত। শব্দটির উৎস মহা ও নারী শব্দদ্বয়; দুয়ে মিলে মহারি বা নির্বাচিত কথাটি এসেছে। এই দেবদাসীরা মূলত পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের নর্তকী ছিলেন। ভিতরি গৌণী মহারিরা মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেন। কিন্তু বাহারি গৌণী মহারিরা মন্দিরে প্রবেশ করতে পারলেও গর্ভগৃহে তাঁদের প্রবেশাধিকার নেই।
গোতিপুয়া ঘরানার উদ্ভব হয় খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে। এই ঘরানার উদ্ভবের অন্যতম কারণ ছিল বৈষ্ণবধর্মে নারীর নৃত্য স্বীকৃত ছিল না। গোতিপুয়ারা ছিল ছোটো ছোটো ছেলে; যাদের মেয়ে সাজিয়ে দেবদাসীদের দ্বারা নৃত্যশিক্ষা দেওয়া হত। এই সময় বৈষ্ণব কবিরা ওড়িয়া ভাষায় অনেক রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদ রচনা করেন। গোতিপুয়ারা এই সকল পদের সঙ্গতে মন্দিরের বাহির প্রাঙ্গনে নৃত্য করত। নর্তকী নৃত্যশৈলীটির উদ্ভব প্রাক-ব্রিটিশ যুগে। ওড়িশার রাজপ্রাসাদে এই নৃত্য উপস্থাপিত হত। এই সময় দেবদাসী প্রথার অবমূল্যায়ণ ভীষণভাবে সমালোচিত হয়। এই কারণে মন্দির থেকে দেবদাসী প্রথার উচ্ছেদ করা হয় এবং রাজসভাতেও এই প্রথা অপ্রচলিত হয়ে পড়ে। কেবলমাত্র গোতিপুয়া ঘরানার কিছু উদাহরণ টিকে যায়। এই নৃত্যর পুনরুজ্জীবনের সময় প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। যার ফলে বর্তমানে এই নৃত্যশৈলীতে শুদ্ধতাবাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা হয়।
সনাতন ওড়িশি নৃত্য নিম্নলিখিত অঙ্গ ও শৈলীগুলির সমন্বয়ে গঠিতঃ
মঙ্গলাচরণঃ একটি সম্ভাষক নৃত্যাঙ্গ। জগন্নাথ প্রণামের পর দেবদেবীর স্তবগানবাচক একটি শ্লোক গাওয়া হয়, যার অর্থ উপস্থাপনা করা হয় সমগ্র নৃত্যের মাধ্যমে। মঙ্গলাচরণে ভূমিপ্রণাম করা হয়, মাতা বসুমতীর কাছে তাঁকে পদদলিত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে। এছাড়া করা হয়ত্রিখণ্ডী প্রণাম বা তিন অঙ্গের প্রণাম। এই প্রণামে মস্তক দ্বারা ঈশ্বরকে, মুখাগ্র দ্বারা গুরুদের এবং বক্ষাগ্র দ্বারা দর্শকদের প্রণাম করা হয়।
বাট্টু নৃত্যঃ এটি ওড়িশির একটি বিশেষ নৃত্যশৈলী যা নটরাজ শিবের বটুকভৈরব রূপটিকে উদ্দেশ্য করে নিবেদন করা হয়।
পল্লবীঃ এটি একটি বিশুদ্ধ নৃত্যশৈলী যা কোনো একটি রাগকে চক্ষুসঞ্চালন, দেহভঙ্গিমা ও জটিল পদচালনা দ্বারা ফুটিয়ে তোলে।
অভিনয়ঃ এই শৈলীটিতে কবিতার মাধ্যমে কোনো একটি কাহিনি দর্শকের সামনে উপস্থাপনা করা হয় এবং নৃত্যশিল্পী মুদ্রা বা হস্তভঙ্গিমা, মুখাভিব্যক্তি ও দেহচালনা দ্বারা সেই কাহিনিটির নৃত্যায়ন ঘটান।
দশাবতারঃ এটি একটি নৃত্যশৈলী যার মাধ্যমে জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দম্ কাব্যের বিষ্ণুর দশাবতার বর্ণনাটিকে ফুটিয়ে তোলা হয়।
মোক্ষঃ এটিকে মুক্তির নৃত্য বলে অভিহিত করা হয়। এটি একটি বিশুদ্ধ নৃত্যশৈলী যা মাদল ও পাখোয়াজের সঙ্গতে উপস্থাপিত হয়ে থাকে।
মোহিনীঅট্টম দক্ষিণ ভারতের কেরল রাজ্যের একটি ধ্রুপদী নৃত্যশৈলী। এই রমণীয় নৃত্যকলাটি সাধারণত মহিলারাই এককভাবে উপস্থাপনা করে থাকেন। "মোহিনীঅট্টম" শব্দটির আক্ষরিক অর্থ "মুগ্ধকারিনীর নৃত্য"। শব্দটির উদ্ভব "মোহিনী" ( যে নারী নিজরূপে সকলকে মুগ্ধ করে ) এবং "অট্টম" ( সৌন্দর্য ও লাস্যময়ী অঙ্গভঙ্গি ) শব্দদ্বয়ের সংযোজনে। মোহিনী সংক্রান্ত দুটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। দুটিই ভগবান বিষ্ণুর মোহিনী নারীমূর্তি ধারণ সংক্রান্ত। প্রথম কাহিনি অনুসারে, সমুদ্র মন্থনকালে উত্থিত অমৃতের ভাগ হতে অসুরদের বঞ্চিত করার লক্ষ্যে বিষ্ণু মোহিনী নারীর বেশ ধারণ করে তাদের প্রলুব্ধ করেন। দ্বিতীয় কাহিনি অনুসারে ভষ্মাসুরের হাত থেকে শিবকে রক্ষা করতে বিষ্ণু মোহিনী মূর্তি ধারণ করেন। সম্ভবত, "মোহিনীঅট্টম" নামটি বিষ্ণুর এই উপাখ্যানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ, এই নৃত্যের মূল উপজীব্য ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তি, যেখানে নায়ক সাধারণত বিষ্ণু বা কৃষ্ণ।
সেকালে দেবদাসীরা মন্দিরে এই নৃত্য উপস্থাপনা করতেন। যদিও এই নৃত্যে কথু ও কোট্টিয়াট্টমের অনেক উপাদানই রয়েছে। এটি আসলে নৃত্য ও কাব্যের সমন্বয়ে সৃষ্ট এক নৃত্যনাট্য। দক্ষিণ ভারতের অপর দুই ধ্রুপদী নৃত্যশৈলী ভরতনট্যম ও কথাকলি নাচের অনেক উপদান ও প্রভাব এই নাচে পরিলক্ষিত হয়। মোহিনীঅট্টমের রূপায়ন হয়েছিল তাঞ্জাভুর চতুষ্টকের অন্যতম ভাদিভেলুর রাজা স্বাতী তিরুনলের রাজসভায়। এই নৃত্যের বৈশিষ্ট্য প্রসারিত নিতম্বের দোলন এবং বিভিন্ন অঙ্গের পাশাপাশি মৃদু সঞ্চালন। এটি মোহিনীঅট্টমের দেশ কেরলের নদী তীরে অবস্থিত তাল গাছের পত্রসঞ্চালনের রূপক। মোহিনীঅট্টমে চল্লিশটি পৃথক মৌলিক ভঙ্গিমা রয়েছে। এগুলিকে 'অটভুকল' বলা হয়। ইন্দ্রিয় প্রলোভন ব্যাতিরেকে মনের মুগ্ধতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নর্তকী তাঁর চোখ দুটি লজ্জিত অথচ মনোমুগ্ধকর ভঙ্গিতে সঞ্চালনা করেন। মোহিনীঅট্টম নর্তকীর পরিধেয় হল শাড়ি। এই শাড়ির প্রান্তভাগে উজ্জ্বল সোনালি রঙের সূচিকর্ম অঙ্কিত থাকে। এই ধরনের প্রান্ত 'কসভু' নামে পরিচিত। মোহিনীঅট্টমের উপস্থাপনা হস্ত লক্ষণদীপিকা নামক এক ধ্রুপদী গ্রন্থ অনুসারে হয়ে থাকে। এই গ্রন্থে বিভিন্ন মুদ্রার হাতের তালু ও আঙুলের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি বিস্তারিত বিবরণী পাওয়া যায়। মোহিনীঅট্টমের সঙ্গতে গীত কণ্ঠসংগীতে চোল্লু নামে পরিচিত এক ছান্দিক গঠনের রূপভেদ লক্ষিত হয়। গীতিকাগুলি সংস্কৃত ও মালয়ালম ভাষার সংমিশ্রণে গঠিত মণিপ্রভালম এ রচিত। এই গীতিকাগুলির সঙ্গতে নর্তকীর সূক্ষ্ম অঙ্গভঙ্গি ও পদসঞ্চারণার মাধ্যমে মোহিনীঅট্টম নৃত্য উপস্থাপিত হয়।
কত্থক
কথাকলি
কুচিপুড়ি
ভরতনাট্যম
মনিপুরী
রাসলীলায় যে নৃত্য পরিবেশন করা হয় সেটাই রাসনৃত্য নামে পরিচিতি। রাসপূর্ণিমা উৎসব বাংলাদেশেরমনিপুরীআদিবাসীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী উৎসব। প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালন করা হয়। রাস উৎসব উপলক্ষে আয়োজন করা হয় রাসনৃত্যের। রাসনৃত্য মনিপুরী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধ্রুপদী ধারার এক অপূর্ব শৈল্পিক সৃষ্টি। অদৃশ্য রসের দৃশ্যমান রূপই হলো রাস। রাসনৃত্য পাঁচ ভাগে বিভক্ত ; যথাঃ "মহারাস", "বসন্ত রাস", "কুঞ্জরাস", "দিব্যরাস" ও "নিত্যরাস"। এর মধ্যে "মহারাস" জাঁকজমকপূর্ণ।
ভগবত পুরাণের পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণিত কৃষ্ণ অভিসারে রাধা, গোষ্ঠী অভিসার, গোপীগণের রাগ আলাপ, কৃষ্ণর্তন, রাধানর্তন, গোপীদিগের নর্তন, শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান, প্রত্যাবর্তন, পুষ্পাঞ্জলি, গৃহগমন প্রভৃতি পর্যায়ে মহারাস অনুষ্ঠিত হয়। রাসনৃত্যে সাধারণত রাধা ও কৃষ্ণের ভূমিকা দেয়া হয় শিশুদের, যাদের বয়স পাঁচের কম। মনিপুরীদের বিশ্বাস, এই বয়সের পর শিশুদের দৈবশক্তি লোপ পেয়ে যায়। তবে প্রকৃত নাটনৃত্য ও গীত পরিবেশন করে তরুণীরা, যারা রাধার সহচরী হিসাবে মঞ্চে আসে।
রাসনৃত্যের কেন্দ্রবিন্দু ভঙ্গি পরেং অর্থাৎ নৃত্যমালিকা। রাসলীলা শুরু হয় নট সঙ্কীর্তন দিয়ে। গোবিন্দজীর মন্দিরের বিশাল মণ্ডপে আরাধ্য দেবতার মূর্তির সামনে শিল্পীরা মৃদঙ্গ ও করতাল সহযোগে সঙ্কীর্তন করে। বিশেষ পোশাকে সাজেন শিল্পীরা। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বন্দনা দিয়ে শুরু হয়ে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ব্যাপী রাসসঙ্গীত অনুষ্ঠিত হয়। রাসনৃত্যের মাধ্যমে ভক্ত-শিল্পীরা শ্রীকৃষ্ণের সাথে আবেগসূত্রে মিলিত হয়। বাংলা, মৈথিলী, ব্রজবুলি ও মৈতৈ কবিদের পদাবলি থেকে রাসনৃত্যের গীত গাওয়া হয়। মনিপুরী আদিবাসীরা নট সঙ্কীর্তন ও রাস আজও প্রতি বছর যথানিয়মে উৎসব ও ভক্তিসহকারে উদযাপন করে।
ভাংড়া ভারতও পাকিস্তানেরপাঞ্জাবঅঞ্চলের একটি একটি লোকনৃত্য। বৈশাখী উৎসবউদযাপনের অঙ্গ হিসেবে এই নৃত্যের জন্ম। বর্তমানে শিখসম্প্রদায় এই নৃত্যকেজাতীয় ও আন্তর্জাতিক দরবারে তুলে ধরে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছেন।
হাতের মুদ্রা
চোখের মুদ্রা
শারীরিক মুদ্রা
ব্যালে মুদ্রা
ব্যালে হচ্ছে নৃত্য ও নৃত্যকলা কৌশলের এক সমন্বিত রূপ। ব্যালেতে নাচ, মূকাভিনয়, অভিনয় এবং সঙ্গীতের (কন্ঠ ও যন্ত্র) সমন্বয়ে শিল্প সৃষ্টি করা হয়। ব্যালে একক ভাবে বা অপেরার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অভাবনীয় শারিরীক কৌশলের সাথে সঙ্গীতের এক অপূর্ব মিলন দেখা যায় ব্যালেতে। বিশেষ করে পায়ের কাজের তো তুলনাই হয়না।
পাশ্চাত্য এই শিল্পের ইতিহাসে দেখা যায় যে, দোমিনিকো ড্য পিয়াসেনজা ই (১৩৯০-১৪৭০) তাঁর ব্যালেটি বা ব্যালি তে সর্বপ্রথম নাচের এর পরিবর্তে ব্যালো শব্দটি ব্যবহার করেন; সেখান থেকেই ব্যালে শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।
তবে প্রথম সতিকারের ব্যালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫৮১ সালে। বালথাসার ড্য ব্যজ্যঁইইউ এর ব্যালে কমিক ড্য লা রোয়েন । ১৫৮১ সালে ফ্যাব্রিটিও কারোসো ব্যালে নৃত্যের উপর একটি টেকনিক্যাল ম্যানুয়েল প্রকাশ করেন । এর নাম ছিল ইল ব্যালেরিনো ।
সাম্বা একধরণের ব্রাজিলীয় গান ও নৃত্য। আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম আফ্রিকার দাস ব্যবসা ও আফ্রিকার ধর্মীয় সংস্কৃতি হয়ে এর উৎপত্তিগত বিকাশ লাভ ঘটেছে ব্রাজিলেরবাহাইএবং রিও ডি জেনিরোপ্রদেশে। ১৯২০ এর দশকে গান ও নৃত্যকলায়এটি সম্পৃক্ত হয়। এটি বিশ্বের সর্বত্র ব্রাজিলের প্রতীক এবং ব্রাজিলীয়ান উৎসবের স্বীকৃতি পায়। সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আবেগ-অনুভূতিসম্পন্ন সাংস্কৃতিকঐতিহ্য হিসেবে এটি ব্রাজিলের জাতীয় পরিচয় বহন করছে। সাম্বা কারিওকারপ্রধান শাখা বাহাইয়ের সাম্বা ডি রোডা বা বৃত্তাকারে নৃত্য ২০০৫ সালে ইউনেস্কোকর্তৃক মানবধর্মী হেরিটেজের মর্যাদা পায়। সাম্বা কারিওকা রিও ডি জেনিরোতে প্রদর্শন ও নাচা হয়।
সাম্বা শব্দের উৎপত্তি নিয়ে কয়েকটি মতবাদপ্রচলিত আছে। আরবি শব্দ জুম্বা বা জাম্বা থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিংবা অনেক আফ্রিকান ভাষার একটি কিমবুনদু থেকে শব্দের উৎপত্তি হয়েছে; যেখানে স্যাম অর্থ দাও এবং বা অর্থ গ্রহণ কর। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে সাম্বার দ্বৈত নৃত্য শহরাভিমূখী অগ্রসর হয়। ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে আন্তর্জাতিকভাবে এটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬০-এর দশকে নতুন, কিঞ্চিৎ জাজ টাইপের বসা নোভাসঙ্গীতের সুর, স্বর, ছন্দ ব্রাজিলে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। সাম্বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বার্ষিক উৎসবে যোগদানের জন্য প্রতি বছর পাঁচ হাজারেরও বেশী ব্যক্তিকে প্রতিযোগিতাকরার জন্য প্রশিক্ষণদিয়ে থাকে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে সাম্বা নামে কয়েকটি গান রচনা করেছিল। কিন্তু কোনটিই তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। ১৯১৭ সালে পেলো টেলেফোনে রেকর্ড করে যা প্রথম সত্যিকারের সাম্বা নামে পরিচিতি পায়।
আধুনিক সাম্বা নৃত্য কোরাস গানসহযোগে বিংশ শতকের শুরুতে বিকাশ লাভ করে। ঐতিহ্যগতভাবে সাম্বায় তার সহযোগে ক্যাভাকুইনহো, বিভিন্ন ধরণের গিটারও নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রেরসংমিশ্রণ ঘটে। ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীনসময়ে আমেরিকান অর্কেষ্ট্রায় এটি প্রভাব ফেলে। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরসাংস্কৃতিক অঙ্গন সমৃদ্ধিতে সাম্বা নৃত্যে ট্রমবোন, ট্রামপেট, বাঁশীচোরো, বাদকইত্যাদির ব্যবহার শুরু হয়। ছন্দ ও তালেরপাশাপাশি সাম্বা বিভিন্ন বিষয়াদি তুলে এনেছে। তন্মধ্যে - ঐতিহাসিক খাদ্যসম্ভার, নানাবিধ নৃত্য (মিউদিনহো, কোকো, সাম্বা ডি রোডা এবং পেরান্দা), আমোদ-প্রমোদ, পোষাক হিসেবে লিনেন শার্ট ইত্যাদি অন্যতম। পাশাপাশি প্রাচীন চিত্রকর্মে নেলসন সার্গেন্তো, গিলহার্ম ডি ব্রিটো, হিতোর দোস প্রাজেরেসপ্রমূখ চিত্রকরদেরকে তুলে ধরা হয়েছে।
বৈশ্বিকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি এটি ফুটবলও উৎসবে জড়িয়ে পড়ে। এরি বারোসো'রএকুয়ারেলা দো ব্রাজিলের পর গেতুলিও ভার্গাসসরকার এবং মার্কিন প্রশাসনের সৎ প্রতিবেশী নীতির আলোকে কারম্যান মিরান্ডামার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাম্বার গুণগান তুলে ধরেন। অবশেষে বোসা নোভা দেশে জনপ্রিয়তার সাথে সাথে বিশ্বে সাম্বা সঙ্গীতরূপে পরিচিতি পায়। ভাষাগত দূরত্ব থাকা স্বত্ত্বেও ইউরোপ ও জাপানে এর অগণিত সমর্থকদের মন জয় করে।
মোশিং হচ্ছে এক প্রকার নৃত্য কৌশল যেখানে অংশগ্রহণকারী দর্শক শ্রোতারা একে অপরকে আক্রমণাত্বক স্টাইলে ধাক্কা বা আঘাত করে। যেসকল পন্থায় মোশিং করা হয় তার মধ্যে আছে স্টেজ ডাইভিং বা মঞ্চ থেকে কনসার্টে অংশগ্রহণকারীদের ওপর ডাইভ করা ঝাপিয়ে পড়া, ক্রাউড সাফিং বা দর্শকদের ওপর দিয়ে চলাচল করা, ইন্সট্রুমেন্ট স্ম্যাশিং বা গান শেষে বাদ্যযন্ত্র ভেঙে চুরমার করা, হেডব্যাঙ্গিং বা মাথায় আঘাত করা। সঙ্গীতের যেধরনের কনসার্টে মোশিং দেখা যায় তার মধ্যে আছে পাংক রক, হার্ডকোর পাংক, হেভি মেটাল, মেটালকোর, গ্রুঞ্জ, অল্টারনেটিভ, এবং সাধারণ রক। মোশিং সচারচর সরাসরি প্রদর্শিত কোনো সঙ্গীত অনুষ্ঠানে দেখা যায়, যদিও এটি রেকর্ডের সংঙ্গীত অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও করা হয়। ২০০০ এর দশকে বিভিন্ন প্রকার মোশিং-এর চল চালু হয় যেমনঃ ট্র্যাশিং , এবং বিভিন্ন প্রকার সঙ্গীতেই এই মোশিং স্টাইল ব্যবহৃত হত। মোশিং সচারচর করা হয় মঞ্চের সামনে, যা সাধারণত মোশিং পিট বা শুধু পিট নামে পরিচিত।
নাচ সম্পর্কিত আমার আরও একটি পোস্টঃ
কমলায় নৃত্য করে হেলিয়া দুলিয়া
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৪৬