বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র কিন্তু জনবহুল রাষ্ট্র। জনসংখ্যার অধিকাংশ বাঙালিহলেও অনেকগুলো আদিবাসী গোত্রও রয়েছে। বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠির সংখ্যা ৮৯৭৮২৮ প্রায়; সমগ্র জনগোষ্ঠির এক শতাংশ মাত্র। বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠির সিংহভাগ পাবর্ত্য চট্রগ্রাম এবং ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহী অঞ্চলে বসবাস করে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উপজাতিক গোষ্ঠী হল চাকমা।
এছারাও রয়েছে ওঁরাও, খাসিয়াবাখাসি, খুমি, গারো, চাকমা, টিপরা, পাংখো, পাংগোন, মগ, মণিপুরী, মুরং, রাজবংশী, সাঁওতাল, হাজং উপজাতি ।
উপজাতিদের নৃত্য তাদের ধর্ম আর জীবন বোধের বার্তা বহন করে । তাদের জীবন যাত্রার জন্য জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে নিত্যদিন অনেক শ্বাপদসংকুল পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে চলতে হয় । তারা জঙ্গলের পশু - পাখি শিকার করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে । শিকারে যাবার আগে তারা তাদের শরীরে রং দিয়ে চিত্র একে নৃত্য পরিবেষণ করে তাদের পবিত্র আত্মার নামে । এটাকে তারা তাদের প্রার্থনা হিসাবে মনে করে ।
উপজাতিদের এসব নৃত্যের স্বরূপ হিসাবে থাকে শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষ্যা, ফসলের জন্য বৃষ্টির আকুতি , রগ বালাই থেকে আরোগ্য লাভ, বিভিন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষ্যা , সামাজিক অবক্ষয় থেকে পরিত্রান চেয়ে তাদের দেবতাদের প্রতি প্রার্থনা । জন্ম, মৃত্যু , বিয়ে জীবনের এই তিন সত্যের সাথে মিশে আছে তাদের নাচ । উপজাতিরা তাদের ভাষায় লেখা নিজস্য সংগীত পরিবেষণ করে এমনকি বাদ্য যন্ত্র গুলো তাদের নিজেদের তৈরি করা । তাদের নাচের পোশাক ও অলঙ্কার তাদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির ধারক ও বাহক । বাদ্য যন্ত্র যেমন বাঁশি , মাদুলি , ঢোল হচ্ছে তাদের প্রধান বাদ্যযন্ত্র । খাসিয়াদের মধ্যে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে “ যত ভালো নৃত্য, তত ভালো শস্য" তাদের নৃত্যের নামকরন হয় তাদের জাতের নামানুসারে ; যেমন সাঁওতাল নৃত্য , গারো নৃত্য , মনিপুরি নৃত্য ইত্যাদি ।
চাকমাদের বাঁশ নৃত্য খুব জনপ্রিয় । আঞ্চলিক ভাবে এই নৃত্য চেরালাম নামে পরিচিত। এই নৃত্যে নারীপুরুষদের মাঝে দুই দল বিভক্ত হয়ে দুটি বাঁশ হাতে ধরে নৃত্য শিল্পীদের দুই দিকে বিভক্ত হয়ে থাকে । তারা বাঁশগুলো দিয়ে একধরনের সুরেলা ছন্দের সৃষ্টি করে । সেই ছন্দের তালে নৃত্য শিল্পীরা বাঁশের ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে নাচে । এমন ভাবে পা ফেলে যেন বাঁশের সাথে পায়ের পাতা না লেগে যায় দুটি বাঁশের ঘর্ষণে ।এভাবে তারা নাচতে থাকে যতক্ষণ তাদের মাঝে ক্লান্তি চলে না আসে ।
মুরুং নৃত্যের মধ্যে ছেলে মেয়েরা গালে, ঠোঁটে ও কপালে রংয়ের প্রলেপ লাগায়। নৃত্যের আগে ১৫ থেকে ২০ জন মুরুং যুবক-যুবতী মুখোমুখী দাড়িয়ে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি রচনা করে। এরপর তাদের তৈরী বাঁশির সুর ও বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশ করে থাকে। নাচে ও গানে বিবাহিত মেয়েদের অংশ নিতে দেয়া হয়না। মুরুং সম্প্রদায় নিজেরাই ‘‘প্লুং” নামের একটি বাঁশিতৈরী করে। পাহাড়ে উৎপন্ন ‘‘বুদুম’’ (এক ধরণের পাহাড়ী লাউ) এর শুকনো খোলের সাথে ৫/৬ বা ততোধিক “কাও” (বাঁশের কঞ্চি) এর টুকরা দিয়ে এ বাঁশীটি তৈরী করা হয়।
মণিপুরীদের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী। মণিপুরী সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম দিক হলো মণিপুরী নৃত্য যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
মণিপুরীদের মধ্যে ঋতুভিত্তিক আচার অনুষ্ঠান বেশি। বছরের শুরুতে হয় মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের বিষু এবং মৈতৈদের চৈরাউবা উৎসব। আষাঢ় মাসে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ও কাঙ উৎসবের সময় প্রতিরাত্রে মণিপুরী উপাসনালয় ও মন্ডপগুলোতে বৈষ্ণব কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ নাচ ও গানের তালে পরিবেশন করা হয়।
কার্ত্তিক মাসে মাসব্যাপী চলে ধর্মীয় নানান গ্রন্থের পঠন-শ্রবন। এরপর আসে মণিপুরীদের বৃহত্ম উৎসব রাসপূর্ণিমা।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র প্রবর্তিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলানুকরন বা রাসপুর্ণিমা নামের মণিপুরীদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে প্রায় দেড়শত বছর ধরে (আনুমানিক ১৮৪৩ খ্রী: থেকে) পালিত হয়ে আসছে। কার্ত্তিকের পুর্ণিমা তিথিতে দুরদুরান্তের ল ল ভক্ত-দর্শক মৌলবীবাজার জেলার সিলেটের কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়ামন্ডবের এই বিশাল ও বর্ণাঢ্য উৎসবের আকর্ষনে ছুটে আসেন।
বসন্তে দোলপূর্ণিমায় মণিপুরীরা আবির উৎসবে মেতে উঠে। এসময় পালাকীর্ত্তনের জনপ্রিয় ধারা "হোলি" পরিবেশনের মাধ্যমে মণিপুরী তরুণ তরুণীরা ঘরে ঘরে ভিক্ষা সংগ্রহ করে। এছাড়া খরার সময় বৃষ্টি কামনা করে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়ারা তাদের ঐতিহ্যবাহী বৃষ্টি ডাকার গান পরিবেশন করে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৫ রাত ১২:৩৫