তোমাকে শেষবার খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম ফেরী পারাপারে,
কিছু একটা ছিলো সেদিন তোমার চোখের মায়ায়,
হয়তো নদীর স্রোত ধারায় বিষণ্ণ বিকেলের কোলাহল;
খুঁজে ফিরছিলো কচুরিপানার ভীরে মেঠো ফুল।
তারপর কতকাল ধরে আমি খুঁজে ফিরেছি তোমাকে;
কখনও শীতলক্ষ্যা, কখনোবা মেঘনার তীরে,
কখনোবা জেলা হাসপাতালের করিডোরে,
যেখানে দাঁড়িয়ে তুমি সূর্যস্নাত হতে।
রোগীদের আর্তনাদ তোমাকে বেঁচে থাকার সাহস যোগাত,
নরক যন্ত্রণায় কাতর রাত্রিগুলো কখনোবা হয়ে যেতো;
জোছনায় রূপকথার অলীক সহবাস কোনো,
প্রেশক্রিপশনে লেখা হিজিবিজি ওষুধের নামের ভীরে;
যখন আমি ক্লান্ত,
ভোরের প্রহসনে নিজেকে কতইনা অসহায় বলে মনে হতো।
শেষবার তোমাকে খুঁজেছিলাম আমার প্রিয়ার শব যাত্রায়;
মাটির স্পর্শ আমাকে খুব করে কাঁদতে শিখিয়েছিলো,
বিষণ্ণ সময়ের দ্রাঘীমা জুড়ে;
আমি সযত্নে আমার পুকুর সাজিয়ে রেখেছি,
আজও সেই কচুরিপানা ফুলে।
*******
কালীবাজারের শেষ মোড়টায় ছিলো মৌবন অলংকার হাউস,
মনে পড়ে যাকে তুমি দিদি বলে ডাকতে ?
সেই মৌবন দাস রানী এখনও আছেন,
আধুনিক কারুকাজে কত-শত নাকের নোলক আর নূপুরের সাঁজে রমণীরা হাসে,
শুধু তুমি নেই মালতী !
তুমি নেই তাই;
রেললাইন ধরে জমেছে আজ শাক-সবজির বাজার,
তুমি নেই তাই;
নদীপথে ওপারে আজ আর যাওয়া হয়ে ওঠেনা আমার।
মালতী, বলতে পারো কি ?
কতটা মৃত্যু পেরুলে নদীটা আকাশ হবে !
শকুনের ডানায় চড়ে ভেসে বেড়াবে স্বপ্ন,
রক্তজবার গর্ভাশয়ে জন্ম নেবে পাঞ্চালী।
যুধিষ্ঠিরের মুঠো হাতে আজো নীলপদ্ম ফোঁটে,
নির্লজ্জ জোছনার ভাঁজে জেগে ওঠে কাশবন;
রোদের পথ ধরে হেটে চলে যায় ছায়ামানবী,
তারপর একসময়-
নরক প্রভাতের আগেই হারিয়ে যায় শূণ্যতায়।
কচুরিপানার থোকায় থোকায় জলজ শব্দ বিষণ্ণতার সুর তোলে,
পচা পাটের গন্ধে হলুদ সন্ধ্যা-
ধীরে ধীরে বিমূর্ত বধূ বেশে ক্লান্ত হয়ে ফেরে;
দূর পবনের বেশ্যালয়ে,
যেখানে লাল বেনারসি শাড়িটা পড়ে আছে অযত্নে-অবহেলায়।
*******
বিকেলে তোমার চোখে পাখি হয়ে উড়ে যেতে না পারার চঞ্চলতা দেখলাম,
দেখলাম খোঁপার বাঁধনে জড়িয়ে থাকা নিষ্প্রাণ জড় পদার্থ এক;
সোনালী প্রজাপতি-
তারে আমি ধরতে চেয়েও ধরতে পারিনি;
সেটা আমারই লাজুক সরলতা।
কুহেলিকা,
তোমার পুকুরে রাজহাঁসের ক্লান্ত অবসর যাপন দেখলাম,
আমাকে এক ছটাক ছুঁয়ে দেয়ার এমন কপটতা;
মেনে নেয়া যায়না,
মেনে নিতে পারিনা বলেই,
অপেক্ষায় তোমার, বণিক মন আমার;
উদাস হয়ে পথ হেটে চলে-
কোমল ঘাসের গোধূলি মায়ায়।
চেয়ে দেখ কেমন করে কুয়াশা তার লজ্জার আবরণ খুলে বেহায়া সেজেছে;
অপার্থিব অভিসারে।
শুধু তোমাকেই শোনাতে চাই কতটা নির্ঘুম রাত আমি স্বপ্ন কুড়িয়েছি;
নোলকের উষ্ণ শ্বাস পাওয়ার আশায়,
যেখানে আমার অজস্র কথা জমে আছে-
তোমাকে বলার।
তুমি সেই অস্থির মেঘের মতো,
যার জানালার ফাঁকে সাতার কাটে অলকা নন্দিনী চাঁদ।
তুমি সেই প্রবীণ গণিকা বধু,
যার নগ্ন পায়ে কুর্নিশ করে বেঁচে থাকে পাললিক বাউল সাধক।
পারিনি তার সুরে সুর মেলাতে,
পারিনি ঈশ্বর বিমুখ মূর্তি হতে,
তোমার জন্য যতটা সম্ভব পেরেছি;
তৃষ্ণার্ত পর্ণমোচী এক উদ্ভিদ হতে।
আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও...
*******
ভালোবাসার এখনই নিখাদ সময়;
একটু উষ্ণতার জন্য আকুতি নয়,
নিঃসঙ্গতায় কুয়াশার চুম্বন চাই,
চাই চোখের অবাধ্যতায় বেহায়া হতে।
ধীরে ধীরে আরও ধীরে;
শীতের কাছে সুখের পরশ খুঁজে ফিরি।
নদীর চলার বাকে গুমড়ে উঠার এখনই সময়;
এক বিন্দু শিশিরের জন্য হাহাকার নয়,
ভেজা ঘাসের শোদা গন্ধ চাই,
চাই ঠোঁটের কম্পনে শীতার্ত হতে।
ধীরে ধীরে আরও ধীরে;
রাতের কাছে দহনের গ্রহণ খুঁজে ফিরি।
*******
জল সাতারু আমি এক নিভৃতচারী দাস তোমার,
ডোবা-নালায় জমে থাকা কচুরিপানার আবেশে জড়াতে চাইনি বলে;
কুয়াশায় শ্যাওলার পিচ্ছিল প্রলেপে সিক্ত হয়েছি,
প্রভু তোমার মোহে বাদামী মখমলে রক্তের নাব্যতা মেপেছি।
এসো জড়তা ভুলে জলের গহীনে,
যেখানে জেগে থাকে সরীসৃপ মন আমার;
যুগল চাঁদ হাসে মিহি পরশে তোমার,
ভুলে থাকতে চাই;
তবু ভুলতে পারিনা তোমায়,
হয়ত আমাকে চাও না ঘৃণায়,
তবু দাসত্বের শেকলে এই অর্ঘ আমার,
তোমার বেদীতে।
শিরোনামহীন এই পাঁচটি কবিতা উৎসর্গ করছি শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় ব্লগার আশরাফুল ইসলাম দূর্জয় ভাইকে যার অনুপ্রেরণায় এখনও মাঝে মাঝে টুকটাক কবিতা লেখা হয়ে উঠে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৩২