আতাউর রহমান কাবুল, লামা, বান্দরবান থেকে
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে বান্দরবানের লামা উপজেলার গহিন অরণ্যে এক ব্যতিক্রমী ঈদ উৎসব হয়ে গেল। ১৮৪ পশু কোরবানির মাধ্যমে সার্বজনীন উত্সবে মেতেছিল এ পাহাড়ি জনপদের অনাহারি মানুষ। তিনবেলা যেখানে অন্ন জুটে না, সেখানে মাংস তাদের জন্য আকাশকুসুম ভাবনা। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন তাদের সেই স্বপ্নকে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও সত্যে পরিনত করলো। জানা গেছে, এই লামা কোরবানী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কোরবানীর আয়োজন। যা সৌদি আরবের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কোরবানীর আয়োজন হিসেবে ধরা হচ্ছে। আবার শুধুমাত্র গরু কোরবানীর হিসেবে এটাই নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আয়োজন, যেখানে একসাথে এতগুলো গরু আনুষ্ঠানিকভাবে জবেহ করা হয়।
মুলত: কোরবানির মাংস প্রকৃত দুস্থদের মাঝে বিতরণের উদ্দেশেই বান্দরবানের লামার কোয়ান্টাম পল্লী '‘কোয়ান্টামম’'তে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় দেশের বৃহত্তম কোরবানির অনুষ্ঠান। গত ১৭ নভেম্বর ২০১০ বুধবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এবার ১৮৪টি পশু কোরবানি করে প্রায় অর্ধলাখ অভাবী মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়।
গত নয় বছরের মতো এবারের কোরবানিতেও পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা থানার সরই ইউনিয়ন ও আশপাশের এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষ এসেছিলেন কোরবানির মাংস নিতে। এবার ১৬৫টি গরু, ৫টি মহিষ ও ১৬টি ভেড়া কোরবানি করা হয়। এখান থেকে ১৭ হাজার ২৬৭ কেজি মাংস বিতরণ করা হয় সাড়ে আট হাজার পরিবারের মধ্যে। সারা বছর যাদের মাংস খাওয়ার কোনো সুযোগই হয় না, এমন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এবার ঈদের সন্ধ্যায় কোরবানির মাংস দিয়ে খাবার সারেন।
পরিবারগুলোর মাঝে বেশ কয়েকদিন আগেই পরিবারের সদস্য অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি গিয়ে টোকেন দিয়ে আসা হয়। সে টোকেন নিয়ে পরিবারের একেকজন সদস্য ঈদের দিন দুপুরে সমবেত হন পাহাড়ঘেরা কোরবানির মাঠে। টোকেন দেখে প্রত্যেককে মাংসের প্যাকেট দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, গত ২০০৯ সালের ঈদুল আজহা উপলক্ষে এখানে ১২০টি পশু কোরবানি দেয়া হয়। তার মধ্যে ৯৭টি গরু, ৫টি মহিষ ও বাকিগুলো ছাগল কোরবানি দেয়া হয়। ২০০৮ সালে ৮২টি গরুসহ মোট ৯২টি পশু কোরবানি দেয়া হয়। কোয়ান্টাম পরিবারের শত শত সদস্য ও তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয় দিয়ে এ কোরবানি উত্সব পালন করা হয়।
প্রসঙ্গত গত ২০০২ সাল থেকে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন লামার সরই ইউনিয়নের কোয়ান্টাম মেডিটেশন রিসোর্ট ‘কোয়ান্টামম’ থেকে এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে কোরবানির মাংস বিতরণ করা হচ্ছে। যাদের অধিকাংশ বছরে এ একবারই এরকম মাংস খাওয়ার সুযোগ পান। অভাবী মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয় বলে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের প্রায় ১২০০’র বেশি স দস্য ঘরে বসেই ‘কোয়ান্টামম’-তে অনুষ্ঠিত কোরবানির উত্সবে অংশ নেন। সশরীরে উপস্থিত না থেকেও তারা কোরবানির অর্থ পাঠিয়ে দেন লামার ‘কোয়ান্টামম-’তে। তাদের পাঠানো সামষ্টিক অর্থে প্রতি বছর আয়োজন করা হচ্ছে এ কোরবানির। পশু সংখ্যা, মাংসের পরিমাণ ও মাংসগ্রহীতা মানুষের সংখ্যার দিক দিয়ে যা প্রতি বছরই বৃহত্ থেকে বৃহত্তর হচ্ছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যন শহীদ আল বোখারী মহাজাতকের সার্বিক নির্দেশনায় সংগঠনের প্রায় ৩ শতাধিক কোয়ান্টিয়ার (স্বেচ্ছাসেবী) ১২টি বাসে করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লামায় গিয়ে কোরবানি কর্মকাণ্ডে অংশ নেন।
কোয়ান্টাম শিশুকানন : শত ফুল ফুটছে যেথা
বান্দরবানের লামার দুর্গম পাহাড়ে সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুদের মেধা ও দক্ষতা বিকাশের লক্ষ্যে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছে ‘কোয়ান্টাম শিশুকানন’। আর এ শিশুকাননকে ঘিরেই এখানে বসে প্রতিবছর কোরবানি উৎসব। ২০০১ সালে মাত্র ৭টি মুরং শিশু নিয়ে যাত্রা শুরু। ২০০৯ সালে এসে এর ছাত্রসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০০। বর্তমানে প্রায় ৫০০ শিশু এখানে পড়াশোনা করছে। প্রতিবছরই লিখিত, মৌখিক ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে ৪ থেকে ৬ বছর বয়সী আবাসিক ছাত্র হিসেবে ৫০ জন করে নতুন শিশুকে নেয়া হয় শিশুকাননে।
বলা যায়, এ এক অনন্য আয়োজন। সমাজের বঞ্চিত-অবহেলিত শিশুদের জন্য একটা নিরাপদ নীড় এ শিশুকানন। এখানকার শিশুরা স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় এরই মধ্যে যথেষ্ট সাফল্যের যে সোপান রচনা করেছে তা এই অবহেলিত জনপদের শিশুরা কোনো দিনই দেখাতে পারেনি। বঞ্চিত এ শিশুরাই শিক্ষা ও ট্রেনিংয়ের ফলে ২০০৩ থেকে বিজয় দিবসের প্যারেড ও ডিসপ্লেতে বান্দরবান ও লামায় এবং গত বছর চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে ১ম স্থান অধিকার করেছে। এবার প্রথম এখানকার শিশু জিপিএ ৫ পেয়েছে এবং মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ওয়েটিং লিস্টে প্রথম স্থানে আছে। এই এলাকার মানুষের জন্য এসব ইতিহাস যা আগে কখনও সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশি ছাড়াও মুরং, মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, বম, খুমি, চাক, খিয়াং, লুসাই, খিওসহ ১১টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর শিশু রয়েছে এ শিশুকাননে। ২০০৯ সালে নেত্রকোনা থেকে গারো ও তংচঙ্গ্যা জাতিগোষ্ঠী থেকেও ৪ শিশু ভর্তি হয়। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্রামা, খ্রিস্টান, প্রকৃতিপূজারিসহ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী শিশুদের এমন সহাবস্থানের উদাহরণ পার্বত্য এলাকার অন্য কোথাও আর নেই। তাদের থাকার জন্য শিশুকাননে এখন রয়েছে দুউ জাতীয় অধ্যাপকের নামে ২৯৭০ বর্গফুটের নূর হল এবং ১৬৫০ বর্গফুটের খান হল।
আমরা ঢাকা থেকে ঈদের পর দিন কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট ৩৮ জনের একদল সাংবাদিক পরিবার লামায় গিয়েছিলাম। গুরুজী শহীদ আল বোখারী মহাজাতকের সরাসরি তত্তাবধান ও সান্নিধ্যে লামার সবচেয়ে উচু পাহাড়ে চাঁদনী রাতে খোলা আকাশের নীচে মোডটেশন করার সে কি অনুভূতি!!! তবে সবচেয়ে ভাল লেগেছে-শিশু কাননের অসহায় পিতামাতাহীন এতিম শিশুদের সান্নিধ্য। গুরুজীকে ধন্যবাদ যে এমন একটি অসাধারন সুন্দর কাজ তিনি করেছেন।
সূত্র: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৫৭