বর্তমান বিশ্বে বহুল পরিচিত একটি নাম-জাকির নায়েক। চমৎকার স্মরণশক্তি, কোরআন-হাদিস থেকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উদ্ধৃতি দেয়া, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের তুলনামূলক আলোচনা, মিডিয়ার সফল ব্যবহার ইত্যাদি কারণে তিনি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। মনে করবেন না তাঁর জনপ্রিয়তায় আমি ঈর্ষান্বিত। আমি বরং শঙ্কিত সবাইকে মাকাল ফলের পেছনে কোন কিছু না বুঝে দৌড়াতে দেখে। এখন ঘরে-বাহিরে সর্বত্র ওয়াজ কিংবা লেকচারের ছড়াছড়ি, ধর্মীয় প্রকাশনাও বিকাশমান, মসজিদে (শুধু জুমার দিনে) নামাজীও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যাও দিনে দিনে বাড়ছে, দাড়ি-টুপির ব্যবহারও ক্রমবর্ধমান, ধর্ম এখন ইন্টারনেটেও সরগরম কিন্তু সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপকর্ম, অবাধ যৌনাচার, মাদক, সুদ-ঘুষ, খুন-রাহাজানি, অশ্লীলতা ইত্যাদি। কেন? ধর্মের প্রসার বাড়লে এগুলো তো কমার কথা, বাড়ছে কেন? বহু বছর ধরে মৌলভী-মাওলানা-পীর ছাহেবদের ওয়াজ কিংবা হালের জাকির নায়েকের লেকচার যদি কাজ দিত তবে তো আমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র শয়তানী আচরণ থাকার কথা না। কেন আমরা এখনো গোপন পাপে লিপ্ত, কেন আমরা নামসর্বস্ব ধর্মীয় কাজে লিপ্ত, কেন আমরা চলচ্চিত্র, খেলা, রং-তামাশা ইত্যাদি অনর্থক কাজ থেকে বের হতে পারছি না? কারণ ঈমান আমাদের মুখে, ভেতরে নেই; নামায আমরা পড়ি কিন্তু কায়েম তথা বাস্তব প্রকাশ নেই; উপবাস ব্রত পালন করি, রোযা নয়; হজ্ব-ওমরা করি আবার রঙিন চশমা পড়ি; টাকার যাকাত আদায় করি, শরীরের যাকাত ভুলে যাই।
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন মহানবী (সা.) মসজিদে প্রবেশ করে দেখলেন সেখানে হযরত হারিস বিন মালিক (রা.) অবস্থান করছেন। তিনি (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ঈমান আনার পর তোমার অবস্থা এখন কী? হযরত হারিস বিন মালিক (রা.) বললেন, এখন আমার মনে হচ্ছে আমি একজন পরিপূর্ণ মু’মিন। মহানবী (সা.) বললেন, প্রত্যেক কিছুর একটি বাস্তবতা থাকে, তুমি যে নিজেকে মু’মিন দাবি করছো এর বাস্তবতা কী? হযরত হারিস বিন মালিক (রা.) প্রত্যুত্তরে বললেন, আমি আল্লাহর আরশ দেখেছি, আরো দেখেছি জান্নাত এবং জাহান্নাম। মহানবী (সা.) খুশি হয়ে বললেন, তোমার হৃদয়কে আল্লাহ সত্যই আলোকিত করেছেন। [হায়াতুস সাহাবা ৩য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৫৮, মূল: হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ কান্দালভী, ইংরেজি অনুবাদ: মুফতী আফজাল হোসেন ইলিয়াস, জম জম পাবলিশার্স, পাকিস্তান]
হাদিসটি বর্তমানকার মৌলভী-মাওলানা-পীর ছাহেবদের ওয়াজে কিংবা জাকির নায়েকের লেকচারে মোটেও শুনতে পাবেন না। কারণ এখানে প্রমাণের কথা আছে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে মহানবী (সা.) এর নাম আছে কি নেই এটি জেনে আমার লাভটাই বা কী যদি আমি ”নবী” নামটির বাস্তবতা (অর্থাৎ আল্লাহ এত শক্তিশালী হওয়ার পরও কেন তাঁর ধর্ম প্রচারে নবীদের আশ্রয় নিলেন) না বুঝি। মৌলভী-মাওলানা-পীর ছাহেবদের ওয়াজ কিংবা জাকির নায়েকের লেকচার শুনে যেসব বিধর্মী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন তাদের মনে এ প্রশ্ন কি আসে না যে অন্য ধর্ম থেকে ইসলামের পার্থক্যটা কী? ওখানে আমি ভগবান কিংবা বুদ্ধ কিংবা যিশুর মূর্তি পূজা করতাম আর ইসলামে এসে কাবা নামক ঘরটির পূজা করছি। ওখানে আশ্বাস দেয়া হয়েছে ভাল কাজ করলে স্বর্গে আর মন্দ করলে নরকে। ইসলামও তাই বলছে, সৎকাজ করলে জান্নাত আর অসৎকাজ করলে জাহান্নাম। সবখানেই আন্দাজ আর আশা, বাস্তবতা কিংবা প্রমাণ নেই। উপরোক্ত হাদিসটিতে মু’মিন দাবির সপক্ষে নবীর সাহাবী কিন্তু বলেননি যে তিনি এখন নামায পড়েন, রোযা রাখেন বরং বলেছেন তিনি আল্লাহর আরশ দেখেছেন। একই প্রশ্ন যদি আপনাকে করা হয় যে ঈমানদার দাবী করে আপনি কী পেয়েছেন বা কী দেখেছেন? বলবেন, এসব কি আর আমরা দেখতে পাবো, আমরা তো পাপী। কেন? নবীর সাহাবারা তো পূর্বে ভিন্ন ধর্মের ছিলেন, তাঁরা যদি ইসলাম গ্রহণ করার পর আল্লাহর আরশ দেখতে পান তো আমার আর আপনার জন্য সেটা হবে না কেন? বলবেন, তারা তো নবী থেকে ঈমান গ্রহণ করেছেন তাই এত কিছু দেখতে পান। কেন? আপনার যুগে কি কোরআন নেই? নায়েবে নবী তথা নবীর উত্তরসূরি নেই? অবশ্যই আছে। আপনি যদি কোরআনকে শুধু তেলাওয়াত করা কিংবা নামাযে পাঠ করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখেন অথবা নবীর উত্তরসূরির খোঁজে ঘর থেকে বের না হন তবে কস্মিনকালেও ইসলাম ধর্মের বাস্তবতা বুঝবেন না। যতই নামায পড়ে ললাট কালো করুন আর রোযা রাখুন, আপনি যেই অন্ধ সেই অন্ধই থেকে যাবেন। আল্লাহ তাই বলেছেন, ”এবং যে ব্যক্তি এখানে (পৃথিবীর মধ্যে) অন্ধ হয়ে থেকেছে আখেরাতেও সে অন্ধ থাকবে” (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত ৭২)। এ অন্ধত্ব চোখের নয় হৃদয়ের, যা দিয়ে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত দেখা যায়। অবাস্তব কথা বলছি না কিংবা কোন গালগল্পও করছি না। সুতরাং আন্দাজে ওয়াজ কিংবা লেকচারে আন্দাজে নামাযী বাড়বে, আন্দাজে রোযাদার বাড়বে, আন্দাজে হাজী বাড়বে আবার অন্ধের সংখ্যাও বাড়বে।
আমার এ লেখাটি পড়ার পরও যদি আপনার মধ্যে অন্ধত্ব দূর করার প্রেরণা না জাগে তবে বুঝবো তকদিরের অমোঘ বিধানে আপনি দুর্ভাগা!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:১২