তিথিদের বাসার দু'বাড়ি পরেই থাকতাম আমরা। মাঝখানের বাড়ি দুটো একতলা হওয়ায় খুব একটা বেগ পেতে হয়নি আমাদের। আমি থাকতাম আমাদের বাসার তৃতীয় তলায়। আর ও চারতলায়।
.
ওকে যখন প্রথম দেখলাম, তখন আমরা দুজনেই হাফপ্যান্ট পরা বয়সের। শীত পেরিয়ে বসন্তের শুরুর কোন এক দিনে। পাতাঝরা গাছের নতুন সবুজ পাতা হয়ে ও এসেছিল আমার জীবনে। সাহিত্যের ভাষায় বলতে গেলে, বলতে হতো; "আমার এলোমেলো জীবনটা গুছিয়ে দিতে এসেছিল তিথি"। কিন্তু আমি তা বলতে পারবোনা। আমার গোছালো জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল।
সেদিনের দুপরবেলা, বারান্দায় বসে পোষা মিনির সাথে খেলছি। থমকে গেলাম। চোখ আটকে গেল দুই বাড়ি পরের চারতলার বারান্দায়। নতুন ভাড়াটে এসেছে। পুরোনা বাড়ির লম্বা বারান্দায়, লাল ফ্রক পরা একটা মেয়ে; এপাশ থেকে ওপাশ ছোটাছুটি করছে।
কে ও? কি করছে ? নতুন ভাড়াটেদের কেউ? এখন থেকে কি ওরা এখানেই থাকবে? থাকলে কি খেলবে আমার সাথে? আমার বন্ধু হবে তো ও? হাজার প্রশ্নে সময় কাটলো। হ্যাঁ, লাল ফ্রক পরা মেয়েটা ওখানেই থাকলো।
.
আমাদের বারান্দাটাও ওদের বারান্দারই সামনে। মুখোমুখি। যেন এক স্বর্গীয় নির্দেশেই বানানো হয়েছে বারান্দা দুটো। বারান্দাকেন্দ্রিক হয়ে গেলাম আমি। মিনিকে প্রশ্ন করতাম,
"মিনি, মেয়েটা কি আমার বন্ধু হবে? বল...না।" মিউ মিউ শব্দে উত্তর দিতো মিনি । কোলে তুলে নিতাম ওকে। মিনিও দেখতো আমার মত, দুই বাড়ি পরের ঐ বারান্দায়। ফ্রক পরা সেই মেয়েটাকে।
সময়ের সাথে আমরাও কাছে এলাম। বন্ধু হলাম। বেস্ট ফ্রেন্ড হলাম আমরা। কখনও আমি যেতাম ওদের বাসায়। কখনও আসতো ও। মিনিকে সাথে করে খেলতাম আমরা।
.
মাথার দুপাশে দুটো ঝুটি করে রাখতো তিথি। ও দুটোকে শিং ভেবে হাসতাম খুব। খ্যাপাতাম প্রচুর। ওকে মারার সময় ঝুটিদুটো বেশ কাজে আসতো। ঝুটি ধরে আচ্ছাসে পিটাতাম।
আর ও আমাকে মারতো কিল আর ঘুষি। ঝাড়ু দিয়ে মেরে খুব আরাম পেতো হয়তো মেয়েটা। "লাল টুকটুকে ফ্রক পরা একটা মেয়ে, হাতে একটা ঝাড়ু।" কেমন যেন একটা শিহরণ কাজ করে যেত আমার মাঝে। হুশ ফিরতো ঝাড়ুর বাড়িতে। মাথায় তো একবার আলু বানিয়ে দিয়েছিল মেরে। জ্বরে ভুগেছিলাম তিনদিন। আমার অবস্থা দেখে নিজেই কেঁদেছে। আর ওর কান্না দেখে হেসেছিলাম আমি।
.
বড় হলাম। স্কুলের উঁচু ক্লাসের বইগুলোও পুরোনো হতে লাগলো আমাদের। বাড়তে থাকলো আমাদের একসাথে থাকার সময়টাও।
.
হাইস্কুল থেকে কলেজে ওঠার সময়। স্কুলের শেষ ক্লাস সেদিন। সবার গায়ে সুন্দর জামা। আমি পরেছিলাম পুরোনো ফ্যাঁকাসে রঙা একটা পাঞ্জাবী। আর তিথির পরণে ছিলো সাদা কালো রং মেশানো একটা শাড়ি। মনে হচ্ছিলো স্বর্গের অপ্সরী দেখছি। যেন প্রথম দেখছি ওকে। সেই প্রথম দেখাতেই ভালবাসলাম । ভালবেসে ফেললাম। মনে হচ্ছিলো কোথাও কেউ নেই। শুধু তিথি আর আমি। সবকিছু স্বপ্নের মতো চললো । স্বপ্নের মাঝেই সবার সামনে বলে দিলাম ওকে, "ভালবাসি"।। ঘোর ভাংলো সবার অট্টোহাসিতে।
.
হাত রাখার মত একজোড়া হাত পেলাম। তিথি আমার হলো। অগোছালো জীবনটা আবার গুছিয়ে দিলো মেয়েটা।
.
পড়াশুনা শেষ হলো আমাদের । চাকরী খুঁজতে থাকা বেকার যুবক আমি তখন। তিথির বিয়ের কথা চলছে। প্রতিটা মুহুর্ত আমার প্রাণ হারাবার ভয়ে কাটতো। দেহ থেকে হৃদয় চিরে নেবার ভয়।
.
দিনটা এলো। তিথির বিয়ে।
বারান্দায় এলাম। সারা বাড়ি আলো দিয়ে সাজানো।
প্রেমিকার বিয়ে। আমি কি কাঁদবো? কষ্ট পাবো? নাকি ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবো? আমি কিছুই করিনি। করতে পারিনি। অপদার্থের মত চুপ ছিলাম।
খানিক বাদে মা ডেকে গেল। বললো, "রেডি হয়ে নে। তিথিদের বাসায় যেতে হবে । সময় আর বেশি নেই।"
আমি কি যাবো? হ্যাঁ যেতে হবে । আমি যাবো। বউ সেজে বসে থাকা তিথিকে দেখতে হবে আমার। আমি গেলাম......
বিয়ে হয়ে গেল তিথির ।।
.
নাকের ডগার মোটা ফ্রেমের চশমাটা নামিয়ে রেখে বারান্দায় এলাম। সেই বারান্দা। যেখান থেকে তিথিকে প্রথম দেখেছিলাম আমি। ভালবাসার বীজ বুনেছিলাম । ওরা এখন থাকেনা ওখানে। পুরোনো বাসা ভেংগে নতুন করে বহুতল বাড়ি বানানো হয়েছে। চারতলায় নতুন একটা পরিবার উঠেছে। হয়তো কোন যুবতী মেয়ে আছে। সেদিকে আমার খেয়াল নেই। আমি শুধু দেখি সেই চারতলাটা । সেখানে নতুন করে বানানো ছোট ঝুল বারান্দাটা।
.
কর্কশ গলার চিৎকারে হুশ এলো।
"সারাদিন বারান্দায় দাড়িয়ে ঐ বাড়িতে কি? মেয়ে দেখা হচ্ছে? পুরোনো হয়ে গেছি আমি? আমাকে আর ভাল লাগেনা? চলে যাবো আমি আমার বাপের বাড়ি। থাকবোনা...."
তিথির হাতে ঝাড়ু। কোমরে শাড়ীর আঁচল গোজা। পরীর মত লাগছে ওকে। দু পা এগিয়ে তিথির কাছে গেলাম আমি। জড়িয়ে ধরলাম ওকে । কানে কানে বললাম, "সেই মেয়েটা এখনও তেমনই আছে। শুধু ফ্রকের বদলে শাড়ী পড়তে শিখে গেছে । তবে ভালবাসাটা কিন্তু কমেনি। বেড়েছে...।" তিথি কেঁদে দিলো।
বুকের বাম পাশটায় টেনে নিলাম ওকে। কাঁজল মাখা চোখের জল এসে আছড়ে পড়ছে আমার বুকে। ও কাঁদছে... কাঁদুক। এটা ভালবাসার কান্না। এ কান্নায় কষ্ট নেই। সুখ আছে। স্বর্গের সুখ....
.
বলা হয়নি, সেদিনের বিয়ের পাত্রটা আমিই ছিলাম।
ফেসবুকে আমি