অফিস থেকে ফিরে সদর দরজা পেরোতেই রাবেয়ার চিৎকার, "দুপুর হলো। অমনি আসছে জমিদার বাবু গিলতে! ঘরে বাজার নাই; মনে আছে? নাই তো!! খাওয়ার কথা তো ঠিকই মনে থাকে!”
.
ওকে পাত্তা না দিয়ে রুমে ঢুকলাম। উত্তর না পেয়ে আরো বিরক্ত হয়ে কি যেন বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল ও। দাঁড়িয়ে থেকে ওর চলে যাওয়া দেখলাম আমি। পুরোনো শাড়ির আঁচলে ঘরের চাবির গোছাটা দুলছে। বেশ লাগছে ওকে। রান্নাঘরে চলে গেল রাবেয়া। ছাল উঠে যাওয়া পুরোনো র্যাক্সিনের ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে কোণার টেবিলটায় রাখলাম। রান্নাঘর থেকে থালবাসন আছড়ানোর শব্দ কানে আসছে। রাগটা তাহলে থালাবাসনের উপর ঝাড়ছে ও। বেচারা থালবাসন।
.
মুখে একটু পানি ছেটানো দরকার। বৈশাখ এসে পড়েছে। বেশ গরম বাইরে। অসহনীয় গরম বলতে যা বোঝায় আরকি।
.
বাথরুমে ঢুকলাম। বালতি থেকে মগে করে পানি নিয়ে ফ্রেশ হলাম। পয়সার অভাবে বেসিন লাগানো হয়নি । যে সংসারে মাসের ১৫ তারিখ পেরোবার আগেই অর্থের টান পড়ে, সেখানে বেসিন হচ্ছে বিলাসিতা। মধ্যবিত্ব পরিবারগুলোর এই এক ধরাবাঁধা গল্প। বিলাসিতার সুযোগ একেবারেই থাকেনা এদের। বাঁচতে হয় ভিখারীর মত। কিন্তু ভাবটা দেখাতে হয় জমিদারী টাইপের।
মুখে পানি দিয়ে বের হতেই ছোট ছেলে এসে বললো, "বাবা, দুই মাসের বেতন বাকি স্কুলে। স্যার প্রতিদিন অপমান করে। আমি আর স্কুলে যাবোনা।"
.
মহিম কে কিছু না বলে গামছাটা নিয়ে মুখ মুছতে লাগলাম। কারো সাথে কথা বলে কিংবা ঝগড়া করে মজা পাওয়া যায় ওপাশ থেকে উত্তর এলে। কিন্তু উত্তর না পেলে বিরক্তিটা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। একা একা কথা বলা যায়না। ঝগড়াও হয়না। উত্তর না পেয়ে ছোট ছেলে মহিমও নিরাশ হয়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে কোণার ঘরটায় চলে গেল।
.
মুখ মুছতে গিয়ে দেখলাম, গামছাটায় বেশ বড় বড় দুটো ফুটো। কিছুদিন আগেই ছোট ছিল। আস্তে আস্তে বড় হয়ে গেছে। বয়সের ভারে বেশ পাতলাও হয়ে গিয়েছে গামছাটা। নতুন একটা যে কিনবো, সেটাও ভাবতে পারিনা। গামছার টাকায় একবেলার বাজার হবে। সবে মাসের ২০ তারিখ আজ। পকেট ফাঁকা। তাই গামছা নিয়ে চিন্তা এখন না করাই ভাল। গামছাটা ঘরের কোঁণায় লাগানো দড়িতে মেলে দিয়ে মেঝেতে পাটি পেতে বসলাম। রাবেয়াকে বললাম, "কিছু খেতে দেবে রাবেয়া? সকালে খাইনি। খুব ক্ষধা লেগেছে।"
.
ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেলনা। মাথা নিচু করে বসে আছি। ক্ষিধায় চোখমুখ জ্বলছে। শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে। এখানেই ঘুমিয়ে পড়বো হয়তো।
.
খানিক বাদে গরম ভাতের প্লেট হাতে রাবেয়া এলো। পাটশাক আর ঢেঁড়স ভাজি প্লেটের কোঁণায়। আর ছোট্ট একটা পিরিচে দুইটা কাঁচা মরিচ, আর একটা পেঁয়াজ দু ফালি করে কাটা। প্লেট আর পিরিচ সামনে রেখে, গ্লাস আর জগটা দিয়ে শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে চলে গেল ও। ওর মুখে মায়া নাকি বিরক্তি, ঠিক বোঝা গেল না। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেটটা খালি করে ফেললাম। হাত ধুয়ে ঘরে এসে জানালার পাশে দাঁড়ালাম। বেশ ক্লান্ত লাগছে। ঘুম পাচ্ছে। ঘুমোনো দরকার। বছর সাতেক আগে মেহগনি কাঠের বানানো খাটটায় বসতেই ক্যাচক্যাচ করে উঠলো। এটারও হায়াত শেষ। জানালার পাশটায় এসে শুলাম। শেষ দুপুরের রোদটা গায়ে এসে পড়ছে। বেশ আরাম পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, শরীরের সব রোগ জীবাণু রোদের তাপে মরে যাচ্ছে। আর হালকা বাতাস থাকায় গরমও লাগছেনা। আবেশে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, টেরই পাইনি।
.
মাগরিবের আযান কানে আসছে। বড় মেয়ে মৃদুলা হালকা করে ডাকছে, "বাবা উঠবেনা? সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। ওঠো..."
উঠে বসলাম। শুকনো একটা হাসি দিলো মেয়েটা। চশমাটা এগিয়ে দিলো। আমি চশমাটা পড়ে ওর মিষ্টি হাসিটা দেখলাম। হাসিমুখেই বললো মেয়েটা,
"বাবা, চা দেবো?"
"না রে। এখন চা খাবোনা। পানি দে।"
"আচ্ছা" বলে পানি আনতে চলে গেল মেয়েটা। দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেছে মেয়েটা। বাবার খেয়াল রাখতে শিখে গেছে।
খানিক বাদে পানি নিয়ে ঘরে ঢুকলো মেয়েটা। হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে পানিটুকু শেষ করে বললাম,
"মা, ঘরে চা পাতা নেই। তাইনা রে?"
কিছু বলতে পারলোনা মেয়েটা। হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেল। আনমনেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চাপাতা ঘরে তুলিনি। চা আসবে কোত্থেকে! ঘরের কর্তা হয়ে ঘরের কোন খোঁজই রাখিনা। সংসারটা কিভাবে চলছে, কিভাবে চালাচ্ছে মা-মেয়ে মিলে; কে জানে!!! প্রথম প্রথম রাবেয়া অনেক অভিযোগ করতো। এখন কিছু বলেনা। বলে লাভ হয়না, তাই হয়তো বলেনা। মেয়েটারও কোন আবদার নেই। খুব প্রয়োজন ছাড়া কিছু চায়না মেয়েটা। সংসার ঠিকমত চালাতে না পারা একটা পুরুষ যে নিজের কাছে কতটা নিচু, কতটা লজ্জিত; সেটা শুধু সেই ব্যাক্তিই জানে।
.
চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। একটু বের হবো। রোদে জ্বলে হলুদ হয়ে যাওয়া সাদা পাঞ্জাবীটা গায়ে দিলাম। মৃদুলাকে দেখলাম চায়ের কাপ হাতে আসছে।
"বাবা, চা খাও" খুশিতে ওর চোখ চকচক করছে।
"চা পাতা কোথায় পেলি রে মা?"
"বাবা আমার কাছে দশটাকা ছিল। ওটা দিয়ে পাশের দোকান থেকে এনেছি।"
হালকা হাসি দিলাম। হাসিতে হয়তো কিছুটা কষ্ট লুকোনো ছিল। মেয়েটা সেটা বুঝতে পারলো। কিন্তু কিছু বললোনা।
"মা, তোর মাকে চা দিয়েছিস? আর মহিম?"
"হ্যাঁ বাবা।"
"আর তুই?"
"আমি খাবোনা। তুমি খাও বাবা"
"রান্নাঘর থেকে আরেকটা কাপ নিয়ে আয়। নাহলে খাবোনা কিন্তু"
চুপচাপ কাপ আনতে চলে গেল মেয়েটা। একটু পর ও কাপ আনলো। ওকে অর্ধেকটা দিলাম। আমি নিলাম বাকিটুকু। প্রথম চুমুক মুখে দিয়েই “ইইইইই…” করে উঠলো ও।
"বাবা! চিনি কম হয়েছে"
আমি চুমুক দিলাম। চিনি ঠিকই আছে, বলে আশ্বাস দিলাম। পুরোটা কাপ তৃপ্তি নিয়ে শেষ করলাম। চিনি আসলেই কম হয়েছে। কথা হলো, ঘরে চিনি ছিলনা। আমি সেটা জানি। কাপটা টেবিলে রেখে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বের হলাম। শহরের অনেকগুলো গলি হাঁটতে হবে আমাকে। রাতের শহরগুলো বেশ নীরব। এ শহরের বাতাস আমার কান্না শুনতে পায়। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো আমার কষ্ট দেখে। অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানো কুকুরগুলোও এখন অনেক চেনা আমার। দেখা হলেই মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ঘেউঘেউ করে তেড়ে আসেনা এখন। ওরাও বোঝে, সরকারি ছোট পোস্টের চাকরির টাকায় সংসার চলেনা। নিমতলা মোড়ের কালো কুকুরটা আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। ওর নাম কালু। নামটা আমারই দেয়া। চকচক করছে ওর চোখদুটো। কিছু একটা বলতে চাইছে ও। ওর চোখে এত এত মায়া আর অনুপ্রেরণা দেখলাম আমি। আমি ওর নীরব চোখের ভাষাগুলো বুঝলাম"।
অনেক রাত হয়েছে। কালুকে বিদায় দিয়ে চলে এলাম।
.
একটা মাস চলে গেল।
রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ। দরজায় কয়েকবার টোকা দিতেই ঘুমঘুম চোখে মৃদুলা এসে দরজাটা খুলে দিলো। প্রতিদিন এত রাত করে আসো বাবা! তারপর কিছু বলতে গিয়ে হাতের ব্যাগগুলো দেখে খানিক থেমে গেল ও...
"ওগুলো কি বাবা?"
"অনেক কিছু মা। তোদের জন্য সুখ কিনে এনেছি রে। তোর মা কই?"
"বারান্দায়। যাও"
মৃদুলা কৌতুহলী হয়ে ব্যাগগুলো নেড়েচেড়ে দেখছে। ওর ভেতর একটা ব্যাগ নিয়ে বারান্দায় এলাম। রাবেয়াকে দেখলাম মরচে পড়া গ্রিলে দুহাত ঝুলিয়ে দাঁড়ানো। পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও কিছু বললো না। ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, "কেমন আছো রাবেয়া?"
কিছু না বলে বুকটায় মাথা রাখলো এসে। কিছু বলতে পারছেনা রাবেয়া। ওর কষ্টগুলো আমি ধরতে পারি। ভালবেসে বিয়ে করেছিলো আমাকে। বিনিময়ে অভাব ছাড়া কিছু দিতে পারিনি ।
"রাবেয়া, তোমার জন্য শাড়ি কিনেছি দেখো। আর পুরোনো ছেড়া শাড়ি পড়ে ঘুরতে হবেনা তোমাকে। নতুন গামছাও এনেছি। মহিম আর মৃদুলার জন্যেও জামা কিনলাম। মহিমের স্কুলের বেতন বাইরের টেবিলের ড্রয়ারে রাখা। ওকে আর স্যারের বকা শুনতে হবেনা"
.
ভেজা চোখে রাবেয়া মুখ তুলে তাকালো। অবাক হয়ে জানতে চাইলো....
"এসব কোথায় পেলে? আর টাকা? সত্যি করে বলো"
"রাবেয়া, সরকারী চাকরিতে বেতন কম। চাকরির টাকায় সংসার চলেনা। তাই একটা কাপড়ের দোকানে কাজ নিয়েছি। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত। মাসে আট হাজার দেবে বলেছে। বেতন বেশ ভালই। তাইনা? সংসারে আমাদের আর অভাব থাকবেনা, তুমি দেখো। চাপাতা আর চিনিও এনেছি। প্রতিদিন আমরা নিয়ম করে চারজন মিলে বিকেল বেলা চা খাবো। ঠিকাছে?"
.
রাবেয়া হু হু করে কেঁদে ফেললো। তবে এ কান্না কষ্টের না। আমি জানি। এখন বেশ বুঝতে পারছি, মধ্যবিত্তদের সুখটা কোথায়।।
.
লেখাঃ #GMHimu