ইমিগ্রেশনের ঝামেলা চুকিয়েই মালয়েশিয়ান সিমটা ওপেন করলো রাত্রি। অলিক চাচাতো ভাইয়ের কাছে অনেক কিছুর সাথে একটা সিমও পাঠিয়েছিল। সিম ওপেন করার সাথে সাথেই ম্যাসেজ। অলিকের। ‘রাত্রি প্লীজ, একদম সময় করতে পারলাম না, এই মুহূর্তে ছুটির কথা বললে আফিসের সামনে ঐ পামট্রির সাথে বেঁধে পেটাবে। প্লীজ, ড্রাইভার তোমায় খুঁজে নেবে। বাসায় গিয়ে গোছ গাছ করে নাও। আমি একটু দ্রুতই চলে আসবো’।
দেশে থাকলে এই কথা শোনার সাথে সাথে রাত্রির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ত। এখন আকাশের সাথে মালেশিয়ার মাটিও ভেঙ্গে পড়ছে। কার কাছে আসলো সে সব কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে? এ কি সেই অলিক? কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছে না। ড্রাইভার ব্যাটা বড্ড বজ্জাৎ। রাস্তার চেয়ে লুকিং গ্লাসেই বেশী তাকাচ্ছে। অনেক কষ্টে কান্না চাপছে রাত্রি। একটা ড্রাইভারের সামনে কাঁদা আর যাই হোক শোভন কোন কর্ম হয়না। অলিককে বলে এই ড্রাইভারের চাকরী হাতে ধরিয়ে দেব, ভাবছে রাত্রি। আমি কি পাগল হয়ে গেলাম? আগামী তিন মাস অলিক নামক মহা পাঁজিটার সাথে কথাই বলবো না। যাক ড্রাইভারের মেয়াদ তিনমাস বাড়ল তাহলে। অলিকের কঠোর শাস্তি পাওয়া উচিৎ, শালা একটা দিন ছুটি নিতে পারল না? আমি ওর জন্য বাংলাদেশ থেকে চলে এলাম আর ও কি না অফিস থেকে বিমান বন্দর পজ্জন্ত আসতে পারল না?
অলিকের সাথে বিয়ে হয়েছে ছয় মাস। বিয়ের বিশ দিনের মাথায় অলিক চলে এসেছে মালয়েশিয়া। সে ‘ইউনিভার্সিটি অফ মালয়’ এ মাস্টার্স করছে। সাথে একটা আন্তর্জাতিক নিউজ পেপারে জব। রাত্রির অনার্স আগেই শেষ হয়েছে। অলিক একটু গুছিয়ে নেবে সেই আশায় এতদিন দুজন দুই দেশে। অলিক বসদের বলে নিজ অফিসেই অ্যাকাউন্ট সেকশনে রাত্রির একটা জবের ব্যাবস্থা করেছে। এমবিএর পাশাপাশি জব ও সংসার, এমন স্বপ্ন নিয়েই মাতৃভূমি ছেড়েছে রাত্রি। ছেড়েছে বাবা-মাকে। কিন্তু অলিক কি সত্যি ব্যাস্ত নাকি ভালোবাসায় ভাটা পড়েছে? সুন্দরী কোন কলিগের... নাহ। এমনটা ভাবতে চায় না। এমন হলে রাত্রির জীবনটা সত্যিই অন্ধকার হয়ে যাবে। অনেক কষ্টে বাবা-ভাইকে বুঝিয়ে অলিকের সাথে নিজেকে জড়িয়েছে। সেই অলিক যদি বিশ্বাস ঘাতকতা করে?
ভালবাসার অনুভূতি আসলেই কেমন জানি। আগে যখন অলিকের কথা ভাবতো, মেরুদণ্ডে শিরশিরে একটা অনুভূতি বয়ে যেত। সেকেন্ডের কয়েক ভাগের এক ভাগ সময় স্থায়ী হত অনুভূতিটা। ইচ্ছে করলেও ধরে রাখা যেত না। মেরুদণ্ড থেকে অচিরেই তা মিলিয়ে যেত শিরায় উপশিরায়।
আজও একটা অনুভূতির সাথে পরিচিত হল রাত্রি। বুকের বাম পাশটায়। কেমন জানি শিরশিরে ব্যাথা। ব্যাথায় আরাম ও আছে আবার কষ্টও আছে। ‘এ কি অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে অলিক? আমার কোমল হৃদয়ে সামান্যতম কষ্ট দিলেও তোমায় ক্ষমা করবো না’, গড়িয়ে পড়া পানি থুতুনি থেকে মুছতে মুছতে আপন মনে বলল রাত্রি।
রাত্রি বাসায় চলে এসেছে। তিন রুমের বাসা। এতক্ষন ভাবছিল ড্রাইভার ব্যাটা হারামজাদা। এখন বুঝল সাথে ‘বলদ’ যুক্ত করতে হবে। গেস্ট রুম আর ডাইনিং রুমের চাবি এনেছে। বেড রুমের চাবি ফেলে এসেছে অফিসে। ‘ফ্রেশ হয়ে গেস্ট রুমে আধা ঘনটা বস, আমি দুই ঘনটার মদ্ধেই চলে আসবো’ আবার অলিকের ম্যাসেজ। ‘মেজাজ খারাপের সর্বোচ্চ চেষ্টাই করছেন অলিক সাহেব, কোন লাভ হবেনা। রাগ পুষে রেখে মিনিটে মিনিটে ‘সাইজ’ দিবো আপনাকে’, আবারও মনে মনে বলল রাত্রি। দুই ঘনটা বসে থেকে কি করা যায়? টিভি দেখি? গেস্ট রুমে টেবিলের সামনেই রীমোর্ট রয়েছে। রাত্রি রিমোর্ট হাতে নিতে গিয়ে দেখে তার নিচে একটা চাবি! কোন রুমের হবে? বেডরুম? ট্রাই করে দেখি। চাবি ঘুরাতেই বেডরুমের দরোজা খুলে গেলো। মাঝারি আকৃতির ছিমছাম একটা রুম। মাঝে খাট। রাত্রির চোখ আটকে গেছে খাটের মাথা বরাবর দেওয়ালে। পুরা দেওয়াল জুড়ে বিশাল একটা ছবি। অলিক-রাত্রির প্রথম সিএনজি জার্নিতে তোলা একটা সেলফি। রাত্রি জীবনে অনেক ছবি তুলেছে কিন্তু এই ছবিটার মত মায়াবতী লাগেনাই কোন ছবিতে। মন খারাপ ভাবটা কাটার আগেই মনে পড়ে গেলো অলিক সাহেব রাত্রির আগমনের দিনেও অফিস করছে। ‘যতই ইমপ্রেস করার চেষ্টা করেন না কেন, তিনমাস কোন কথা হবেনা’ রাত্রির সিদ্ধান্ত পাক্কা। বেডরুমের অপর দেওয়ালে ৫২ ইঞ্চি এলইডি টিভি। দীর্ঘ জার্নির ধকল সামলাতে একটু রেস্ট দরকার রাত্রির। এছাড়া যদি প্রচণ্ড ঝগড়া করতে হয় তাহলে তো এনার্জিরও সঞ্চয় জরুরী। খাটের কিনারায় বসে টিভি অন করলো। কোল বালিশে হেলান দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যেতে পারে। রাত্রি দেহ এলিয়ে দিলো চাঁদরে ঢাকা কোল বালিশে। ‘বাঁচাও, মরে গেলাম গো...’ কোল বালিশের চিৎকারে ভয়ে লাফিয়ে উঠলো রাত্রি। দ্রুত চাদর টান দিয়ে দেখে অলিক মটকা মেয়ে পড়ে আছে কোল বালিশ সেজে। ‘এতো জোরে কেও বালিশে হেলান দেয়’? প্রায় কেঁদে দিলো অলিক। হতভম্ভ ভাব কাটিয়ে রাত্রি ঝাঁপিয়ে পড়লো অলিকের বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ‘তোমার সাথে তিন মাস কথা বলবো না’ অনেক কষ্টে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কথা গুলো বলল রাত্রি।
‘তা বুঝলাম, কিন্তু ম্যাডাম আমার টিশার্ট ভিজে যাচ্ছে তো। আজকের মত কন্না থামাও’ কাঁপা কাঁপা গলায় কোন মতে বলতে পারলো অলিক।