somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ দেশে ধর্ষিতার পাশে দাঁড়াবে কে?

২০ শে মে, ২০১৩ সকাল ৮:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এ দেশে ধর্ষিতার পাশে দাঁড়াবে কে?
লিখেছেনঃ শামীমা মিতু

১০ ডিসেম্বর, সকাল ৭টা। টাঙ্গাইলের রসুলপুর এলাকার রেললাইনে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল ১৫ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রী। স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তির পর জানা গেল, তাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। এর পর কেটে গিয়াছিল ২০ দিন। এ অবস্থায় মা ছাড়া তার পাশে দাঁড়ায়নি কেউ-ই।
ঘটনার জন্য মেয়েটিকে দায়ী করে নির্মম নির্যাতনের পর বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন তার বাবা। এলাকার প্রভাবশালীরাও খারাপ মেয়ে আখ্যা দিয়ে তাকে সমাজচ্যুতির ঘোষণা দিয়েছেন। সে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেলেও প্রকাশ্যে ঘুরছে ধর্ষণকারীরা। ব্যবস্থা নেয়নি থানা পুলিশও।
মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নয়াদিল্লিতে যাত্রীবাহী বাসে গণধর্ষণের শিকার হন এক মেডিকেল ছাত্রী। টানা ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হার মানেন এ 'ভারতকন্যা'। তারএ মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ক্ষোভে উত্তাল ভারত। দোষীদের শাস্তির রায় না হওয়া পর্যন্ত অনশনের ঘোষণা দিয়েছে তার পরিবার। ঘটনার প্রতিবাদে সরকার থেকে শুরু করে বিরোধী দল সবাই এক কাতারে। মেয়েটির মরদেহ গ্রহণ করতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ছুটে যান এয়ারপোর্টে।
নির্যাতিত এ ভারতকন্যার পাশে দেশ এবং পরিবার দাঁড়ালেও বাংলাদেশে এ চিত্র উল্টো।
এখানে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ সাম্প্রতিক সময়ে খুব একটা চোখে পড়ে না।
৬ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের মেয়েটিকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে একটি বাসায় ৪ দিন আটকে রেখে গণধর্ষণ করে ৬-৭ যুবক। এর পরই মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ফেলে যায় রেললাইনে। প্রথমে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও চিকিৎসকরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু লোকচক্ষুর ভয়ে তাকে বাসায় নিয়ে যান মা। তখনই বাদ সাধেন বাবা। মেয়েটি এবং তার মাকে শারীরিক নির্যাতন করে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেন। নিরুপায় মা মেয়েকে নিয়ে আবার হাসপাতালে হাজির হন। এলাকার প্রভাবশালীরা মেয়েটির মাকে জানিয়ে দিয়েছেন, 'চরিত্রহীন' মেয়েকে নিয়ে তিনি গ্রামে প্রবেশ করতে পারবেন না।
এই মেয়েটির মতো বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত অনেকেই ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়লেও কেউই তাদের পাশে দাঁড়ায় না। এমনকি পরিবারগুলোও চায় ঘটনাটি আড়াল করতে। বাংলাদেশে কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের ভয় এবং সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে পরিবারই তথ্য গোপন করতে চায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মেতে ওঠে ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র হননে। আর মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয় এসব তথ্য। বাদ যায় না নির্যাতিতার নাম-ঠিকানাও।
আমাদের সমাজে ধর্ষিতার দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। ধর্ষণের মতো বর্বর সহিংসতার শিকার হয়ে আরও নির্মম পরিস্থিতিতে পড়েন তারা বিচার চাইতে গিয়ে। ধর্ষণ প্রমাণের নামে মেয়েটিকে দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করা হয়। হাসপাতাল থেকে কোর্ট প্রতিটি স্তরে সে বারবার ধর্ষিত হয়। তা ছাড়া মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে হাল ছেড়ে দেন।
পত্রিকার পাতা খুললে প্রতিদিনই চোখে পড়ে এক একটি লোমহর্ষক ঘটনা। এক বছরের শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউই রেহাই পায় না নরপশুদের পৈশাচিক তাণ্ডব থেকে।
চলতি বছরের ১ এপ্রিল রাজধানীর কাফরুল থানাধীন ইব্রাহিমপুরে ২ বছর ৪ মাস বয়সী এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ১ আগস্ট লৌহজংয়ে ধর্ষণের শিকার হয় এক বাক প্রতিবন্ধী। ওই দিনই ধর্ষিতার পরিবারকে হুমকি-ধমকি দিয়ে থানায় বসেই ঘটনার রফা করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ২৭ সেপ্টেম্বর রামগড়ে পৈশাচিকভাবে গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় ধর্ষণ করা হয় ১২ বছরের এক শিশুকে। ২১ জুন মিরসরাইয়ে ৬ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ২ জুন রাজধানীর হাতিরপুলে নাহার প্লাজার ১৩ তলায় ১৭ বছর বয়সী এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। তার ২৬ টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। যা ছিল ২০১২ সালের নারী নির্যাতনের মধ্যে আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম।
এমন হাজারো পৈশাচিক ঘটনা চোখে পড়ে প্রতিদিন প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমগুলোতে।
পত্রিকার পাতায় উঠে আসা খবরের ভিত্তিতে তৈরি করা এক পরিসংখ্যান মতে, ২০১২ সালে সারাদেশে ৯৪০ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গণধর্ষনের শিকার হয়েছেন ১১৯ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৮৯ জনকে। পত্রিকায় পাতায় খুব কম ঘটনাই উঠে আসে। ফরেনসিক পরীক্ষার ঝামেলা, আলামত সংগ্রহ এবং অভিযুক্তকে পুলিশের কাছে উপস্থিত হতে বাধ্য করায় অনেকেই লোকলজ্জায় ঘটনা এড়িয়ে যেতে চান। পত্রিকার পাতা থেকে কিছুটা আঁচ করা যায় বাস্তবে এ চিত্র কতটা ভয়াবহ! ধর্ষণের শিকার হলেও বেশির ভাগ নারী বিচার চাইতে যান না। যেসব নারী বিচার চাইতে যান, তাদের পুলিশ, প্রশাসন, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে যথেষ্ট হেনস্তা হতে হয়।
পুলিশ সদর দফতর থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালে ৩ সহস্রাধিক নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বছরের প্রথম ৬ মাসে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক হাজার ৮৬৯ জন। এদের মধ্যে ১৩ জনকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে। পরিচয় নিশ্চিহ্ন করতে পুড়িয়ে মারার মতো পৈশাচিক ঘটনাও রয়েছে। ২০১২ সালে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীতে। ধর্ষণ ছাড়াও নারী নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যায় পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যানে। তাদের তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১০ হাজার ২৯ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০১১ সালে এর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩৪৪।
দিল্লির ঘটনায় দলমত নির্বিশেষে সবাই রাস্তায় নেমেছে। আমাদের দেশে এমনটা হয় না। উল্টো রাজনৈতিক শক্তি থানাকে প্রভাবিত করে, ভিকটিমের বাবা-মাকে প্রভাবিত করে ঘটনা চাপা দিতে চায়। রাষ্ট্র যদি ধর্ষিতার পক্ষে না দাঁড়ায়, আইন যদি তার কলুষতা থেকে মুক্ত হতে না পারে, তাহলে সমাজে এ ধরনের ঘটনা বাড়বেই। প্রশাসনকে অবশ্যই ধর্ষিতার পাশে শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে। যে কোনো ধর্ষণের ঘটনার পর মিডিয়ায় সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। ধর্ষিতা নয়, ধর্ষকের ছবি বড় করে ছাপিয়ে তাকে সামাজিকভাবে বর্জন করা উচিত।
ধর্ষণের মামলা বিচার করার জন্য আদালতে ক্যামেরা ট্রায়ালের কথা বলা থাকলেও নারী ভিকটিমদের ক্ষেত্রে এটি ঘটছে না। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে বিভিন্ন ধরনের আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না।
১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে ইয়াসমিন ধর্ষণের পর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সারাদেশে। আন্দোলনের মুখে অপরাধীদের গ্রেফতার এবং শাস্তি নিশ্চিত করে প্রশাসন। এর পর ১৯৯৮ সালে শিশু তানিয়া ধর্ষণের ঘটনারও প্রতিবাদ হয়েছিল। কিছুদিন আলোচনায় থেকে তা আড়ালে চলে যায়। এর পর ধর্ষণের আর কোনো ঘটনায় জোরালো প্রতিবাদ হয়নি।
ধর্ষণ অপরাধ সারাবিশ্বেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দিল্লির ঘটনার যেভাবে প্রতিবাদ হয়েছে তাতে সরকার ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের নেতানেত্রী সবাই এ ঘটনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন; বিচার দাবি করেছেন। এটাই আমাদের জন্য বড় শিক্ষা। আমরাও যদি সবাই মিলে ধষণ নামক বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারি, তবেই জাতি এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইনকিলাবের বীজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪


সদ্য শিশু জন্ম নিয়ে সদ্য খুলেছে আঁখি,
মা বলে, কথা দাও বাছা—হাদি হবে নাকি?
শিশুর মুখে কান্নার রোল, হাদি হবার দায়,
বাবা বলে, এই তো হাদি—বুকে আয়, বুকে আয়।

ঘরে ঘরে আজ হাদির... ...বাকিটুকু পড়ুন

=একটি ডায়াটের গল্প, যেভাবে ওজন কমিয়েছিলাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৮


১৬ ডিসেম্বরের খাবার ছিল। উপরের চায়ের ছবিতে ফেসবুকের দুই গ্রুপে দুটো পুরস্কার পেয়েছি প্রতিযোগিতায় আলহামদুলিল্লাহ।

মোবাইলে পোস্ট, ভুল ত্রুটি থাকিতে পারে, মার্জনীয় দৃষ্টিতে রাখবেন।

জব করি বাংলাদেশ ব্যাংকে। সারাদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

'আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান'

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৯



১। মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।
আমাদের মহাত্মা গান্ধীর কর্মকান্ড লুথার খুবই পছন্দ করতেন। ১৯৫৫ সালে লুথার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ফিলোসোফি ডিগ্রি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে ভারতের কি করণীয় ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:১৭


গত মে মাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ফটোকার্ডে দেখানো হয়েছিল ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের তালিকা। তখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও এখন পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। গত ১১... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৈয়দ কুতুবের পোষ্ট: ভারতের করণীয় কি কি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৩



বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য ভারতের করণীয় কি কি?

০) শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো।
১) বর্ডার থেকে কাঁটাতারের ফেন্চ তুলে নেয়া।
২) রাতে যারা বর্ডার ক্রস করে, তাদেরকে গুলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×