1990 সালে আমি প্রথম পরিচিত হই সাহিত্যিক তিতাশ চৌধুরীর সঙ্গে। যখন প্রথম পরিচয় হয়, তখন তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। পরে একসময় এই কলেজেরই অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে অবসরগ্রহণ করেন।
‘সচিত্র বাংলাদেশ’ ম্যাগাজিনে 1990-... সালের দিকে তিতাশ চৌধুরীর প্রবন্ধ ও কবিতা প্রায়ই ছাপা হতো।
তখনই একদিন তাঁর বাসায় গেলাম। কুমিল্লা শহরের রানীরদিঘীর দক্ষিণপাড়ের ‘বৈশাখী’ নামের দোতলা বাসায়। পরিচয় হলো। বারান্দায় বসে কথা হলো। সম্ভবত তাঁর মেয়ে আলিফ লায়লা ভিনাস অন্য কক্ষে সংগীত সাধনা করছিলেন। বাংলা কবিতার ছন্দ নিয়ে আলাপ করলেন। উপন্যাসের গঠন ও শিল্পরূপ নিয়ে। কারণ আমি যাওয়ার সময়ে নিজের পান্ডুলিপি নিয়ে গিয়েছিলাম।
তারপর তাঁর সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও যোগাযোগ ছিল। তবে একটা সময়ে (1993-1996) তাঁর বিরুদ্ধে যত্রতত্র যথেষ্ট কথাবার্তাও বলেছি আমি শুধু এই কারণে যে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের ধারকবাহক নন তিনি। পরে অনুভব করলাম, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব ধারণ করেও যদি কেউ না সাহিত্যিক হোন, তার চেয়ে সাহিত্যিক বা কবি হওয়াই বরং অধিক জরুরি। 1990 সালে প্রথম দেখায় তিনি যে তাঁর সম্পাদিত সাহিত্যপত্রিকা ‘অলক্ত’ এর বিভিন্ন কপি আমাকে দিয়েছিলেন, পরে এসবের গুণগত মান আমি বিস্তৃতভাবে উপলব্ধি করি। কুমিল্লার কারো লেখা তিনি পারতপক্ষে প্রকাশ করেন না বলেই অভিযোগ ছিল। পরে দেখলাম সাহিত্যের মানের কাছে ঢাকা-কুমিল্লা আর কলকাতাই বা কী! শিল্পোত্তীর্ণ হলেই প্রকাশযোগ্য হয়। স্থান এখানে মানদন্ড কোনোভাবেই নয়। আমারও যদি কোনো কবিতা মানসম্পন্ন হয়েছে, তাঁর সম্পাদিত ‘অলক্ত’ সাহিত্যপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
1998 সালে প্রকাশিত আমার প্রথম কবিতা সংকলন ‘চাঁদের জ্যোৎস্না খসে গেছে’ এর ভূমিকায় তিতাশ চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘এই কবির কোনো কোনো কবিতার পংক্তি ঈর্ষনীয়। কিন্তু সম্পূর্ণ একটি কবিতা হয়ে ওঠেনি।’ তাঁর এমন বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা লেখার বিষয়ে অনেকেই আপত্তি করে আমাকে তাঁর ওই ভূমিকা প্রকাশ করতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু আমি জানতাম যে, তিনি আমার সঙ্গে শত্রুতা করে এই ভূমিকা লিখেননি। নির্মোহভাবেই লিখেছিলেন। তাই সেই ভূমিকা ছেপে দিয়েছিলাম আমি।
সাহিত্যিক তিতাশ চৌধুরীর মূল নাম ছিল আবু তাহের ভূঁইয়া। তিতাশ চৌধুরী নামেই লিখতেন। জন্ম 1945 সালে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ। লিখেছেন কবিতা, প্রবন্ধ, ফোকলোর, শিশুতোষ, স্মৃতিকথা ... ইত্যাদি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা তিরিশেরও বেশি।
2002 সালে অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে। তখন কলেজের একটি সংবর্ধনা সভায় সংবাদকর্মী হিসেবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। ‘অলক্ত সাহিত্য পরিষদ’ বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখকদের ‘অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করেছে। এই পুরষ্কার প্রদান নিয়ে তখন অনেক নেতিবাচক কথা প্রচারিত হলেও আজ হয়তো প্রায় সবাই অনুভব করবেন যে তিনি অপাত্রে কখনোই এই পুরষ্কার প্রদান করেননি। তবে তাঁর নিন্দা একদা আমরাও করেছিলাম। কিন্তু তাঁকে স্মরণে রাখবে তাঁর কাজই।
তিতাশ চৌধুরীর ‘দুঃস্বপ্নের রাজকুমারী’, ‘তুমি সুখেই আছো নন্দিনী’ কাব্যগ্রন্থ একদা পাঠ করেছিলাম। অনেক কবিতাই চমৎকার। ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক লেখাও পড়েছি তাঁর। বিশেষ করে ঢাকার জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পাঠাগারে কুমিল্লা জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘কুমিল্লা জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থ পাঠের সময় তাঁর ঋদ্ধ প্রবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হই। পরে ‘এবং নিষিদ্ধ নজরুল ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, ‘কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতি প্রেম ও পরিণয়’ ইত্যাদি গ্রন্থও...। ‘কুমিল্লা জেলার লোকসাহিত্য’ও পাঠ করেছিলাম ঢাকায় থাকার সময়ে। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর অনুবাদ করা কবিতাও পড়া হতো। শেষ দিকে তিনি কুমিল্লা ছেড়ে ঢাকাতেই বসবাস করতেন। আর এসব এখন সবই স্মৃতি। কারণ দৈনিক ডাক প্রতিদিন পত্রিকায় চাকরি করার সময়ে একদিন হঠাৎই খবর এলো ‘তিতাশ চৌধুরী আর নেই।’ 2014 সালের শেষের দিকের ঘটনা। মনে অবশ্যই কষ্ট পেলাম। কারণ তাঁর সঙ্গে তখন আমি ভেতর থেকেই সম্পর্কটি অনুভব করলাম। ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে অবসরগ্রহণের পর কুমিল্লা প্রেসক্লাবে আমরা তাঁকে একটি সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। ওই অনুষ্ঠানের সংবর্ধনাপত্রটি অবশ্য আমিই রচনা করেছিলাম। এতে তখন আমাকে তথ্য দিয়ে, গ্রন্থ দিয়ে বিশেষ সহযোগিতা করেছিলেন গল্পকারও গবেষক মামুন সিদ্দিকী।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০২১ রাত ৮:৫৯