somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ অ্যালুমিনিয়ামের বাটি

১৯ শে মে, ২০১৫ রাত ৯:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পাশের ছোট্ট বারান্দাটার জন্যই বাসাটা খুব পছন্দ হল তার। অন্য রুমটায় অ্যাটাচড টয়লেট থাকলেও আয়তনে ছোট। ড্রইং রুমটায় থাকে একজন ছাত্র, সে ভাড়াও দেয় কম; অগত্যা এ রুমটাই তার ভাগে পড়ে। সব মিলিয়ে এখানে থাকার জন্য রাজী হয়ে যায় অনিক। দু’একদিন যাওয়ার পর বুঝা যায় বারান্দাটা একেবারেই অসার। একটু বসে সময় কাটানো কিংবা দাঁড়ানো কোনোটাই হবে না; রাস্তার ধূলাবালি সব এসে তিন তলার সকালের পরিষ্কার এ বারান্দাটাকে বিকেলের মধ্যেই ধূসর করে দিয়ে যায়। তবু মজা এটাই যে অফিস যেতে সব মিলিয়ে সময় লাগে বড়জোর বিশ মিনিট, এমনকি চাইলে হেঁটেও আসা-যাওয়া করা যায় খুব সহজেই।

ঝামেলাটা শুরু হয় নতুন চাকরিটায় যোগ দেবার পর। শেখের টেকের এক নং গলি থেকে ধানমন্ডি বত্রিশ পযর্ন্ত পৌঁছাতে সময় লেগে যায় বেশি। রিকশায় আসা-যাওয়া করলে দিনে ভাড়া হিসেবে গুনতে হয় কমপক্ষে একশত টাকার একটা নোট। এ অংকটা তার জন্য অনেক বেশিই; নিজের খরচাপাতি, বাসা খরচ, খাওয়া-দাওয়া সব মিলিয়ে বেতনের সিংহভাগই ব্যয় হয়ে যায়। অবশিষ্টাংশ পাঠাতে হয় তার পরিবারের জন্য – গ্রামে থাকা বাবা-মায়ের কাছে। যতোই আরামে অফিস যাওয়া হোক আর সময় বাঁচুক না কেন রিকশা ভাড়াটা দেয়ার সময় খচখচানি টের পায় বুকের ভেতর – এখনো তার গ্রামের বাড়িতে এর চাইতে অনেক কমে একজন দিনমজুর পাওয়া যায়। অবশ্য সমস্যাটার সমাধান হয়ে যায় অল্প ক’দিনেই – যখন থেকে শাহীন উঠে আসে তাদের বাসায়। একই অফিসে চাকরি, তাই একসাথে আসা-যাওয়া শুরু করে দু’জন। অনিকের পাশের রুমটাই ভাড়া নেয় শাহীন। দু’জনে সকালে একসাথে বাসা থেকে বেরোয়, নাস্তা সেরে নেয় কাছেই কোথাও; তারপর একটা রিকশা নিয়ে উঠে পড়ে অফিসের উদ্দেশে। দু’জন কাছাকাছি ফ্লোরেই কাজ করে, দুপুরে অফিসের ক্যান্টিনে খাবার সারে; আবার একইসাথে ফিরে আসে সন্ধ্যেটায়। এ শিডিউলটা অবশ্য সবসময় মেলে না, বিশেষ করে যেদিন ক্লাশ থাকে অনিকের। একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিষয়ে মাস্টার্স করছে সে - চাকরিতে টিকে থাকার জন্য কিংবা প্রমোশনের জন্য একাডেমিক ডিগ্রীগুলো খুব বেশি জরুরী হয়ে পড়েছে আজকাল। এর বাইরেও কোন কোন দিন ইচ্ছে করেই আগে বেরিয়ে পড়ে সে শাহীনের দেরি হবে বুঝতে পারলে। এসব ক্ষেত্রে শাহীন অখুশিও হয় না খুব একটা; কারণ সে দেরি করে অফিস থেকে ফিরলে হয়তো তার বসের গাড়িতে লিফট নেয় অথবা এমনটি হতে পারে যে বসের সাথে ফেরার জন্য মাঝেমাঝে ইচ্ছে করেই দেরি করে বেরোয়। বাসায় পা দিয়েই খুব তৃপ্তি নিয়ে বলে, ‘আজ রোজী আপার গাড়িতে ফিরলাম’। ‘উঁহু, রোজী আপার গাড়ি নয়, অফিসের গাড়ি’, অনিক সুযোগ দেয় না তাকে। মাঝে মাঝে ব্যঙ্গ করে বলে উঠে, ‘আরে ভাই, আপনারাই তো আসবেন, বসদের সাথে ভাব, ভাল খাতির; আমরা কি আর চান্স পাব’! খোঁচাটা নীরবে সহ্য করে শাহীন। ঠাট্টা করে বললেও ব্যাপারটা অনেকটাই সত্যি। শাহীনের সাথে তার ম্যানেজার, এমনকি অনিকের ম্যানেজারের সাথেও খুব ভাল সম্পর্ক। শাহীনের এ ব্যাপারটা নিয়ে মাঝেমাঝে অনিকের ঈর্ষাবোধ হয়; কিন্তু অধিকাংশ সময়ই ব্যাপারটা নিয়ে সে অস্বস্তি বোধ করে, কেমন যেন বর্ণচোরা স্বভাবের, যে যা যেভাবে বলে ঠিক তার সাথে সেভাবে আচরণ করা। অনিক ব্যাপারটা অপছন্দ যেমন করে, তেমনি কথা বলতেও ছাড়ে না কখনো। সুবিধার মধ্যে একটাই যে ভেতরের অনেক গোপন খবরাখবর পাওয়া যায়, আর তা নিয়ে রসিয়ে গল্প করা হয় দু’জনের। তার সুবাদে অনিকেরও সুযোগ হয় কখনো কখনো একসাথে আসা-যাওয়ার, বসদের সাথে একটু ঘনিষ্ট হবার, অফিসের বাইরে অন্য বিষয়ে আলাপ আলোচনার। যদিও এটাতে সে অভ্যস্ত হতে পারে না খুব একটা – গ্রামীণ নিরেট স্বচ্ছতা এখনো তার আষ্টেপৃষ্টে, কাউকে খুশি করার জন্য মিথ্যাচার, জ্বী হুজুর স্বভাবটা এখনো পেয়ে বসেনি তাকে – যদিও সে দেখে এসবের কী কদর তার চারপাশে। খেটে খাওয়া মানুষদের ঘামের ঘ্রাণে বেড়ে ওঠা তার – নিষ্ঠুর শৈশব তাকে শিখিয়েছে যে যতক্ষণ ঘাম ঝরিয়ে দু’মুঠো জোগাড় করা যায়, ততক্ষণ কাউকে অকারণ কুর্নিশ করার দরকার নেই; অভাব মানুষকে নষ্ট করে না, যতটুকু করে তার লোভ। এসবের কারণে কদাচিৎ তার আসা-যাওয়া হত বসদের গাড়িতে। একদিন তাড়াহুড়ো করে পড়িমড়ি করে অফিসের সবাই গাড়িতে উঠে রওনা দিল শহরে গন্ডগোলের খবর শুনে। অফিসের পশ্চিম দিক থেকে ভেসে আসতে থাকে ঘনঘন গোলাগুলির শব্দ; উৎকন্ঠিত সবাই, একেকজন একেকরকম তথ্য দেয়। রাস্তায় আর্মির্ গাড়ি নেমে গেছে, সবার মধ্যেই টানটান উত্তেজনা। বাসায় ফিরে টিভি অন করতেই চোখ ছানাবড়া দু’জনেরই। সব চ্যানেলেই বিডিআর বিদ্রোহের দৃশ্য। সে গল্প অন্য কোথাও হবে। আজ সেই গাড়িটিতে শেষবারের মত যাত্রাটির কথা বলা যাক।

শাহীন আগের রাত্রেই বলে রেখেছিল কাল রোজী আপার সাথে অফিস যাবে। ‘আপনি যাবেন নাকি?’ জানতে চেয়েছিল সে।
‘যেতে তো আপত্তি নেই, কিন্তু সমস্যা তো হচ্ছে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হবে। কই একটু কথা বলতে বলতে, আড্ডা দিতে দিতে যাব, তা না......’
‘আরে চলেন, আপনার বসও থাকবে, ওনার সাথে আড্ডা দিয়েন’।
‘আমার বসের অতো সময় আছে নাকি আপনার বসের মতো অকারণ বকবক করার’?
‘সাড়ে সাতটায় বেরোব, নাস্তা শেষ করে সোয়া আটটায় অপেক্ষা করব সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে’, বলে রুমে চলে যায় শাহীন।

হোটেলে ঢুকে পরোটা আর ভাজির অর্ডার দেয় শাহীন পরদিন সকালে। ‘এই মামা, সাথে কলিজা ভূনা লাগাও, খাই একটু মজা করে, আজ তো গাড়ি ভাড়া বাঁচবে, নাকি?’ বলে অনিক। নাস্তা শেষ করে রাস্তায় এসে কমিউনিটি সেন্টারের সামনেটায় দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে তারা। এই ফাঁকে শাহীন সিগারেট ফুঁকে আর ধোঁয়া ছড়াতে থাকে আয়েশে। তার নিবির্কার ভঙ্গিতেই বোঝা যায় এ ধরনের অপেক্ষায় তার অভ্যস্ততা। সকালের রোদের ছটায় ওদিকে একটু একটু বিরক্তি বাড়তে তাকে অনিকের। ‘ফোন দিয়ে দেখেন কী অবস্থা’। জানা যায় বাসা থেকে বেরুচ্ছেন তিনি, আরো মিনিট দশেক সময় লাগবে। ‘বসদের জন্য অপেক্ষাতেও এক ধরনের তৃপ্তি আছে, তাই না?’ বলে খোঁচাতে শুরু করে সে। ‘আরে, একটু কষ্ট করেন, এসি’র বাতাসে পুষিয়ে দেব’বলে মুচকি হাসে শাহীন।

খয়েরি রঙের গাড়িটায় চালকের পাশের সিটটাতে জায়গা হয় অনিকের; আর শাহীন যথারীতি পেছনে বসদের পাশে। গাড়িটা শিয়া মসজিদের মোড় থেকে বামে ঘুরে তাজমহল রোড পার হয়ে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের পাশ দিয়ে এগুতে থাকে থানা রোডের দিকে। অনিক বসে বসে আশপাশের মানুষ দেখে, রিকশা-বাস-ট্যাক্সি-প্রাইভেট গাড়ির গতির লড়াই বোঝার চেষ্টা করে। চিরে চ্যাপ্টা হওয়া তার মতো হেঁটে যাওয়া মানুষের এ ধরনের গাড়ির যাত্রীদের প্রতি ঘেন্নাটাকে বিপরীত আয়নায় অনুভবের চেষ্টা করে; যে সৌভাগ্য তার খুব হয় না বললেই চলে! মাঝে মাঝে পেছনের কথাবার্তায় মনোযোগ দেয় সে আর লুকিং গ্লাসে শাহীনের মুখখানা দেখে বোঝার চেষ্টা করে কী হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ গাড়িতে চড়ার অস্বস্তি থাকলেও খুব দ্রুতই গাড়ির আরাম, শীতল বাতাস তার আকাঙ্খার পালে ঘূর্ণি লাগায়, ‘ইস্, আমি যদি এরকম একটা বড় চাকরি করতাম, এরকম যদি একটা গাড়ি থাকত আমার’! নিজেকে প্রবোধ দেয় পলকেই, ‘বেশি লোভ করা ভাল না রে, এক প্রজন্মে আর কত চাস’। সে খুব নীরবে আনমনে ভাবতে থাকে তার শৈশব আর যৌবনের ফেলে আসা সে ক্লান্তিকর, ঘর্মাক্ত দিনগুলোর কথা।

‘দেখেন অনিক, মেয়েটা কী সুন্দর করে ভাত খাচ্ছে। আমার মেয়েটা যদি এভাবে কোনোদিন দু’মুঠো ভাত খেতো’, হঠাৎই পেছন থেকে তার নাম শুনে ঘোর কাটে। গাড়ি এসে থানা রোডের মুখে সিগন্যাল পোস্টে দাঁড়িয়ে আছে একেবারে ফুটপাত ঘেঁষে। রোজী আপার আফসোস অনুসরণ করে তার চোখ আটকে যায় ফুটপাতের ভেতরের পাশটায় দেয়াল ঘেঁষে নোংরা ময়লার পাশে দু’পায়ের ফাঁকে অ্যালুমিনিয়ামের বাটি হতে খেতে থাকা বিবর্ণ রঙের ছেঁড়া জামাপরা উশকু-খুশকু চুলের তিন-চার বছর বয়সের মেয়েটির দিকে। দু’পা লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে তার মাঝখানে রাখা বাটিটি থেকে দু’হাতের কচি আঙুলে পানিতে ডুবে থাকা হয়তো কোথাও থেকে কুড়িয়ে আনা বাসি সাদা পান্তা ভাতগুলো খুঁজে খুঁজে দু’টি একটি করে তুলে তুলে মুখে পুরে দিচ্ছে আর পরম তৃপ্তিতে গিলছে। ‘দেখেন কী সুন্দর করে খাচ্ছে, আর আমাদের মেয়েগুলোকে খাওয়াতে চাইলে মারতে আসে’, শুনে কানটা গরম হয়ে উঠে অনিকের, তুলনাটা খুব বিশ্রী ঠেকে তার কাছে, ছেলেবেলার ক্ষুধার যন্ত্রণা যেন তাকে চাবকাতে শুরু করে – এদের এসব বুঝবার ক্ষমতাটাও বিধাতা দেয়নি! ‘আপা, আপনি কি আপনার মেয়েকে কখনো এ মেয়েটার জায়গায় চিন্তা করতে পারেন? এ জায়গায় থাকলে আপনার মেয়েও এভাবেই গোগ্রাসে খাবারটা গিলত, এরা তো ক্ষুধায় খায়, আপা। আর আমাদের মেয়েরা ক্ষুধা কী সেটাই হয়তো বুঝে না’। মেয়েটার আশপাশে কাউকেই দেখা যায় না। একজন হকার বসে আছে একটা ফ্লাস্ক আর তার হাতলের দু’পাশে ঝুলে থাকা দু’প্যাকেট বিস্কিট নিয়ে ক্রেতার আশায়। বাম দিক থেকে শুরু হয়েছে ফুটপাত দখল করে গজিয়ে উঠা নাসার্রী। ফুটপাতের পাশ ঘেঁষে রাস্তায় অফিসগামী আর চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে ভোরে হাঁটতে বেরোনো বাসাফেরত লোকজনের বিপরীতমুখী ভিড়। দ্রুত হাঁটাচলা আর গাড়ির উড়ন্ত ধূলা ছড়িয়ে পড়ছে মেয়েটির ভাতের বাটিটির ওপর। গাড়ি স্টার্ট নিতেই ঘাড় ঘুরিয়ে অনিক দেখতে পায় মেয়েটা বাটিটি তার মুখে পুরে দিয়েছে উপুড় করে আর অবশিষ্ট ভাত না পেয়ে। ভাতের পানি গলগল করে নামছে তার কন্ঠনালি বেয়ে; গলার হাড় ক’টা তিরতির করে কাঁপছে, একটা একটা করে সব ক’টি গোনা যায়। অজান্তে তার চোখ চলে যায় লুকিং গ্লাসের দিকে, রোজী আপার গলায় মেদ নেমেছে; থলথল করে তা কাঁপছে গাড়ির ঝাঁকুনিতে।

এসি গাড়ির ভেতরেও একটু একটু করে কেমন যেন ঘামতে শুরু করে অনিক, পেছন থেকে আর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে। গাড়িটা ডানে বাঁক নিয়ে মিরপুর রোডে উঠেই একটু একটু করে আগায়, থমকে যেতে থাকে আবার একটু পরেই; সামনে গাড়ির সারি অনেক দূর পযর্ন্ত - আড়ং ছাড়িয়ে। গাড়ির ড্রাইভার শফিক তার দিকে ফিরে গোঁফের আড়ালে একটু একটু করে মুচকি হাসতে থাকে খুব তৃপ্তির ভঙ্গিতে, যদিও তার সতর্ক দৃষ্টি রাস্তার দিকে। একটু একটু করে ধীর গতিতে গাড়ি সামনের দিকে আগাতে থাকে; চারিদিকে অনর্গল হর্ন বাজছে। মানসিক অস্বস্তি আর বিশ্রী কানফাটানো গাড়ির হর্নের শব্দের মাঝে একটু একটু করে কানে বাজে তার বস আর শাহীনের অফিসিয়াল আলাপ আলোচনা। দু’জনের আলাপের মাঝখানে রোজী আপার নিঃশব্দতা তার বুকে ভারি হয়ে চেপে বসতে থাকে ধীরে ধীরে। প্রাইভেট চাকরি, বসদের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করেই তো চলে। মনে মনে আফসোস করতে থাকে সে কেন এ চাকরিতে এলো। কী সুন্দর ক্যারিয়ারটা শুরু হয়েছিল ব্যাংকের চাকরি দিয়ে, মার্কেটিংয়ের কাজ। কিন্তু মাস না যেতেই বুঝা যায় এ তার কর্ম নয়। গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসা হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে, তাকে দিয়ে কিভাবে সম্ভব আন্তর্জাতিক ব্যাংকে লোকজনের অ্যাকাউন্ট খোলা আর লোন দেয়ার টার্গেট পূরণ করা, যার ঘনিষ্ট আত্নীয়-স্বজনের মধ্যে পড়ে না এমনকি কোন মধ্যবিত্ত পরিবারও। তাই এ চাকরি ছেড়ে যোগ দিল বায়িং হাউজে; যেখানে মূলতঃ কাজ করতে হতো গার্মেন্টস-এর সাথে। সে দিনগুলোর কথা মনে পড়লে তার এখনো গা শিউরে উঠে তার, চোখের সামনে ভেসে উঠে প্রতি সকালে গার্মেন্টসে ছোটা লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষের মুখ ‘এরা বোধহয় মানুষ নয়, মানুষগুলো অন্যরকম’। তিন মাস চাকরি করে ছেড়ে আসা। এরপর জন্ডিসে বিছানায় পড়ে থাকার সময় দেখতে আসে তার মামাতো ভাই, ‘তুই আয়, আমাদের সাথে কাজ করে দেখ, ভালো লাগলে থাকবি, ভালো না লাগলে চলে আসবি’বলে সে, স্থানীয় একটি এনজিও সংস্থার বড় কর্মী। সেই যে দেখতে আসা, আর ফেরা হল না।

‘আজ এখানে এতো সাংবাদিকের ভীড় কেন’? পেছন থেকে আওয়াজ আসে। অনিক ঘাড় ঘুরিয়ে বামে তাকায়। সংসদ ভবনের প্রবেশ পথে অসংখ্য সাংবাদিক, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের গাড়ি আর ক্যামেরা। ‘কিছু একটা আছে হয়তো’, ‘আরে, কিছু আর লাগে নাকি, এতো মিডিয়া আমাদের দেশে এখন, সাংবাদিকরা গেলেই একটা জনসভা হয়ে যায়, আর কাউকে লাগে নাকি’? অনেকক্ষণ পর রোজী আপার গলার আওয়াজে এতোক্ষণে একটু স্বস্তি পায় অনিক। গাড়িটা ধীরে ধীরে সামনে এগোতে থাকে, জ্যাম সেই অনেক দূর পযর্ন্ত বিস্তৃত। আসাদ গেট পার হয়ে একটু সামনে এগিয়ে ওভারব্রীজের নিচে একটা প্রাইভেট কারের পেছনে থমকে যেতেই পাশ থেকে গাড়ির সামনে বেরিয়ে আসে পোড় খাওয়া থুরথুরে একটা হাত। শতচ্ছিন্ন পাঞ্জাবি আর কাছা গোছানো লুঙ্গি পরা এক বুড়ো ভিখারি ডান হাত গাড়ির কাঁচে বুলাতে থাকে – পুরো হাতজুড়ে কাঁচা-পাকা লম্বা লম্বা কেশ; বাম হাতে তার একটি লাঠি আর একটি অ্যালুমিনিয়ামের বাটি ধরা, বাটিতে কিছু খুচরো এক টাকা আর পাঁচ টাকার ধাতব মুদ্রা। অনিক সহজাত ভঙ্গিতে মাথাটা ডান দিকে একটু ঝুঁকিয়ে ঠোঁট নাড়ে, যার অর্থ ‘মাফ করেন’। বৃদ্ধ ভিখারি হতাশ হয়ে সরে যায় পেছনে। একইভাবে পেছনের কাঁচে হাত বুলোয়, পেছনে বসে থাকা লোকদের দৃষ্টি আকষর্ণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ ফিরে তাকায় না। শাহীন আর তার বস নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত। বৃদ্ধ ভিখারি তজর্নী তুলে ধীরে ধীরে গাড়ির কাঁচে টোকা দিতে থাকে। কারো কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বুড়ো ডান হাতটি নামিয়ে নেয়, বাম হাতটি বাড়িয়ে অ্যালুমিনিয়ামের বাটিটি দিয়ে গাড়ির কাঁচে টকটক শব্দ তুলতে শুরু করে একটু পরেই। বসদেরকে শব্দের বিরক্তি থেকে বাঁচানোর জন্য শাহীন হাত নাড়ে ভিখারিটির উদ্দেশ্যে ‘মাফ করেন, চাচা’। ‘এই ভিখারিদের যন্ত্রণায় আর পারা গেলো না’এতোক্ষণে ল্যাপটপের উপর থেকে মাথা তুলে রোজী আপা। ‘কী সাহস, আগে একসময় দেখতাম দূর থেকে ভিক্ষা চাইত, কাছে আসত না, এখন গাড়িতে টোকা দেয়, বাটি দিয়ে পযর্ন্ত ধাক্কা দেয়া শুরু করেছে আজকাল, অবস্থা কী দেখেছেন শাহীন?’ উষ্মা ঝরে তার কন্ঠে। ‘আপনি কী বলেন অনিক, আপনি তো এদের ক্ষুধা-ঠুধা বুঝেন’? টের পায় অনিক, ছাইচাপা রাগ বেরিয়ে আসছে রোজী আপার কন্ঠে। ‘হুম, কী মনে হয় আপনার’? অনিক মনে মনে নিজেকে সাবধান করতে থাকে, কিচ্ছু বলা যাবে না, কিচ্ছু না। গলা টিপে রাখার চেষ্টা করে সে, ঠোঁট চেপে ধরে, যে কোনভাবেই হোক। মুখ খুললেই বিপদ, পস্তাতে হবে। নিজেকে অনেক কষ্টে ধরে রাখে মুহূর্তকাল। ‘এভাবেই তো নিজেকে ম্যাচিউরড করে গড়ে তুলছিস ধীরে ধীরে’ ভেতর থেকে কেউ যেন ধিক্কার দিয়ে উঠে তাকে, ‘এভাবেই তো পাল্টায় মানুষ’। পলকেই ফুটপাতের পান্তা ভাত খেতে থাকা মেয়েটার মতো তার গলার রগগুলোতে কাঁপন ছোটে, আর সামলাতে পারে না নিজেকে ‘আমি তো মনে করি, এটাই প্রকৃত উন্নয়নের সূচক আপা, আমরা যে উন্নয়নের কথা বলি, মানুষ একত্রিত হবে, তার অধিকারের কথা জানবে, দৃপ্তস্বরে বলবে এবং যোগ্য পাওনা আদায় করে নেবে। এভাবেই তো শুরু, একদিন গাড়ির কাছে এসেছে, আরেক দিন টোকা দিয়েছে, আজ অ্যালুমিনিয়ামের বাটি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে, এক দিন গাড়ির কাঁচ ভাঙবে। সেই দিনই আমাদের খুশি হবার কথা, যেদিন সব ভেঙেচুরে আমাদের কাছ থেকে তাদের প্রাপ্যটা আদায় করে নেবে’। অনিক আাড়চোখে লুকিং গ্লাসের দিকে তাকায়, রোজী আপার মুখটা দেখার চেষ্টা করে; কিন্তু তার বদলে সে দেখতে পায় শাহীনকে – সেই সুবিধাবাদী তেলবাজ মানুষটি, যার বিকার নেই কোন কিছুতে, সবকিছুতেই যে একমত তার বসদের সাথে; বিশেষ করে চোখে পড়ে তার টাক মাথাটা, মাথার একটু নিচে কপালজুড়ে কয়েকটা ঘন সমান্তরাল রেখা ফুটে উঠেছে; তার একটু নিচে যুগল ভ্রু’র কোনায় আড়াআড়ি দু’টো গভীর ক্ষত যেন অনিককে বলছে, ‘আপনার চাকরিটা বোধহয় আর বাঁচানো গেলো না’।

আশীষ বড়ুয়া
১০.০৪.২০১৫
দিনাজপুর
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×