]আশরাফি[
বৈশ্বিক রপ্তানি বানিজ্যে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্য সারির দেশ। আমদানি বা ক্রয় বানিজ্যে দেশটির অবস্থান বরাবরই উপরের দিকে।বানিজ্যিক পন্য উতপাদন বাজার সৃষ্টি ও রপ্তানি সক্ষমতায় বাংলাদেশ দিনের পর দিন যে খারাপ করছে তা উঠে এসেছে জাতিসংঘের ইকোনমিক এন্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া এন্ড প্যাসিফিকের এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট ২০১৫ বার্ষিক রিপোর্টে।(সুত্র প্রথম আলো ৪ নভেঃ)। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করছে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের পন্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.৪ শতাংশ যা পুর্বের বছর গুলো অর্থাৎ ২০১০,১১,১২ ও ২০১৩ সালের তুলনায় অনেক কম।ঐ সময় বাংলাদেশের রপ্তানির গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১২.১২ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১০,১১,১২ সালের তুলনায় দেশটির আমদানি বানিজ্য ১১ শতাংশ থেকে লাফ দিয়ে উঠে গেছে ১৪ শতাংশে।সুতরাং সমীকরন দেখে সহজেই অনুমেয় যে আমাদের দেশীয় অর্থনীতি উতপাদন মুখিতা হারিয়ে ফেলেছে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। সেবাখাত রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক দূর পিছিয়ে।দিনে দিনে এইহার ঋনাত্নক হারে বাড়ছে। এই প্রতিবেদন আরো বলছে পুর্বের বছর গুলোর তুলনায় ২০১৪ সালে দেশে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট কমে যায় ৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১৫৭ কোটি ইউএস ডলার।২০১৪ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ১৫৩ কোটিতে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসে মুলত টেলিকম ও বস্ত্র খাতে।এসকাপের এই প্রতিবেদন যেদিন প্রকাশ হয় ঠিক একই দিনে যুক্তরাজ্যের বহুজাতিক গবেষনা প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস আগামি ৩৫ বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিবর্তন কেমন হবে তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।প্রতিবেদন অনুযায়ি ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৩তম অর্থনৈতিক শক্তি হবে। প্রতিষ্ঠাণটি তাদের গবেষোণায় মূলত একটি দেশের ক্রয় সক্ষমতাকে সুত্র ধরে মত দিয়েছে যে ২০৫০ সালে বিশ্বের মাত্র তিনটি দেশ ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের উপরে থাকবে।গবেষনায় আশা করা হচ্ছে আগামি ৩৫ বছরে চীনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কমতে থাকবে ফলে পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানি গুলো বাংলাদেশের দিকে ঝুকবে ফলশ্রুতিতে দেশে নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার সাথে সাথে দেশীয় পুজিবাজার সম্প্রসারিত হবে বলে মনে করছে তারা।পুর্বেই বলেছি বাংলাদেশের অর্থনীতি পুরোটাই আমদানি নির্ভর দিনে তা ধনাত্নক হচ্চে। একটি দেশের অর্থনীতি শুধুমাত্র ক্রয় সক্ষমতাকে কেন্দ্র করে বিবেচনা করা বড়ই দুরহ ব্যপার।বাংলাদেশ তার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর। গত ১৪-১৫ অর্থ বছরে দেশে রেমিটেন্স এসেছিল ১ হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। ধারনা করা হচ্ছে চলতি বছরে রেমিটেন্স অনেক কম আসবে। প্রবাসিদের পাঠানো টাকায় দেশের পুজিবাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়িয়েছে ঠিকই বিপরীতে গত বছরে বিদেশি বিনিয়োগের উল্টো যাত্রা দেশীয় অর্থনীতির জন্য ভবিষ্যত বার্তা এনে দেয়।একটি দেশের অর্তনৈতিক প্রবৃদ্ধির সক্ষমতা তৈরিতে যতগুলো প্রনিধানযোগ্য ফ্যাক্টর তার মধ্যে রাজনৈতিক শক্তি একটি অঅর্থনৈতিক ফ্যাক্টর হলেও অর্থনীতির বিকাশে রাজনৈতিক পরিবেশের আনুকুল্যতা অবশ্য বাঞ্চনীয়। বলা বাহুল্য হবেনা যে বর্তমানে বাংলাদেশে অনিরাপদ ঝুকিপুর্ন রাজনৈতিক পরিবেশ দেশের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তায় যে বড় ধরনের হুমকি তৈরি করছে তাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আগামি ৩৫ বছরে কেমন হবে সে বিষয়ে বড় হিসেব কষে অর্থনৈতিক বিশ্লেষন করাটা প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপারসের উচিত ছিল বলে মনে করি। অথচ তারা এ ব্যপারে পুরোটাই নিরবতা দেখিয়েছে। দেশি অথবা বিদেশি বিনিয়োগে গড়ে ওঠা যে গুটি কয়েক পন্য রপ্তানি সারিতে আছে তার মধ্যে প্রাধান তৈরি পোশাক খাত বিরাট দুর্দিনের মুখোমুখি।ইতোপুর্বে এই খাত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত অগ্রাধিকার প্রবেশ মুল্য (জিএসপি) সুবিধা হারিয়েছে।তার চেয়ে বড় অশনিসংকেত হচ্চে যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১১ টি দেশের সাথে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ নামে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বানিজ্যক জোট গড়ে তুলেছে। ভিয়েতনাম কম্বোডিয়ার মত দেশ গুলো এই জোটের সদস্য হওয়ায় এসব দেশে সস্তা শ্রমে গড়ে ওঠা পোশাক শিল্প ফ্রি ট্রেডের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজার দখল করে ফেলবে। ফলে বাংলাদেশ তার পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে।প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপারসের ধারনাই যদি সঠিক হয় তাহলে আগামি ৩৫ বচরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে (জিডিপি বিপরিতে ২৩.২ শতাংশ)।বড় বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের দিকে নজর দিবে, শিল্প গড়বে, শ্রম্বাজার তৈরি করবে ইত্যাদি অনেক ইতিবাচক ব্যপার।কিন্তু তাদের ধারনার বিপরীতে যেটি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে তা হল যদি বিদেশি বিনিয়োগে ২৩ তম পুজিবাজার গড়ে ওঠে তবে পুজির একচেটিয়া দখল দারিত্ব চলে যাবে বিদেশিদের হাতে।দেশীয় পুজির মালিকরা পুজির মালিকানা হারিয়ে ফেলবে। দেশীয় অর্থনীতির উতপাদনহীনতার জন্য বড় দুর্যোগ তৈরি করছে দেশীয় পুজির মালিকদের দেশে বিনিয়োগের অনিচ্ছা।এটা সত্যি যে বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ অনেকটা বেড়েছে কিন্তু সে তুলনায় বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়ছেনা। দেশীয় মজবুত অর্থনীতির জন্য শুধুমাত্র সরকারী বিনিয়োগ কোন কালেই যথেস্ট নয়।প্রচন্ড আতংক সৃষ্টিকারী একদলীয় শাসন সরকার দলীয় ক্যাডার ও আমলাদের প্রভুত দুর্নিতির মুখে দেশীয় শিল্পের মালিকরা দেশে বিনিয়োগ করে পুজির নিরাপত্তা নিয়ে আশংকার মুখে দেশে বিনিয়োগ করার সাহস না পেয়ে টাকা বিদেশে পাচার করছে। ফলে দেশীয় পুজির অভাবে শিল্পের বিকাশ ঘটছেনা। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে দেশীয় পুজির শুন্যতায় বিদেশী পুজির দৌরাত্ন কিছুটা হলেও বাড়বে প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপারসের এই ধারনা অনেকটাই যুক্তি সঙ্গত।বর্তমানে দেশীয় পুজির অনিরাপত্তা, বিনিয়োগের ঝুকি, অভ্যন্তরীন রপ্তানিমুখী পন্যের গুনগত নিম্নগামীতা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সর্বোপরী অর্থনৈতিক প্রতিকুলতা হেতু বাংলাদেশী পন্য যেভাবে বিদেশি বাজার ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে এই অবস্থা ধারাবাহিক থাকলে আগামি ৩৫ বছর পর দেশে শুধু বিদেশি বিনিয়োগের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের প্রভাবশালী অর্থনীতির তালিকায় ফেলাটা অতিবাস্তব কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধুমাত্র জিডিপির পরিবর্তন হেতু বিদেশি কোম্পানী গুলো যে এখানে বিনিয়োগ বাড়াবে সে নিশ্চয়তা দেয়াও বড় মুশকিল। আর যদি তারা ইনভেস্টমেন্ট বাড়ায় তার পরও আমাদের দেশীয় অর্থনীতির সুদিন বা আমদানি নির্ভরতা কমে আসার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করিনা।কারন বিদেশি বিনিয়োগে নতুন শিল্প খাত তৈরি হলে প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন দেশিয় পুজি মৃত হয়ে পড়বে। বিদেশিরা টেলীকম ও বস্ত্র খাতের মত খাত গুলোতে বিনিয়োগ করে উতপাদন বাড়াবে বিদেশে রপ্তানি বাড়বে কিন্তু পুজির সম্পুর্ন মালিকানা থাকবে বিদেশিদের হাতে। এক্ষেত্রে দেশীয় মালিক ও সরকার পুজির একটি অংশ কোম্পানি গুলোর কাছ থেক কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে লাভ করবে। উতপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি সুবিধা কাচামাল ইত্যাদি তারা আমাদাণী করবে তাদেরি সহযোগী দেশ অথবা প্রতিষ্ঠান থেকে দেশীয় শ্রমিকদের দ্বারা উতপাদন করে শ্রমিককে মজুরি,সরকারকে শুল্ক, দেশীয় সহযোগীদের কন্ট্রাক্টের অংশ ইত্যাদি দিয়ে ঐ পন্য তারা বিদেশে রপ্তানি করবে ফলে লাভের পুরো অংশ চলে যাবে তাদের হাতে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের সরকার মালিক শ্রমিক ইমপ্লয়ি সবাই বেতনভুক্ত হয়ে পড়বে।আবার তারা ঐ উতপাদিত পন্যই আমাদের যে বেতন দিচ্ছে ঐ টাকার বিনিময়ে আমাদের কাছে দ্বিগুন দামে বিক্রি করবে ফলে আমাদের টাকা আবার চলে যাবে তাদের হাতে। এভাবে একটি চেইনশিপের মাধ্যমে পুজির একক কতৃত্ব চলে যাবে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানী গুলোর হাতে। আবার পুজির মালিকানা যেহেতু তাদের হাতে থাকবে সেহেতু তারা পরোক্ষভাবে আমাদের রাজনিতিকেও শাসন করা শুরু করবে। আর আমাদের পুরনো পথেই বিদেশি রেমিট্যান্স বা সামান্য অর্জিত রপ্তানী বানিজ্যের অর্থে আমদানিমুখী অর্থনীতি চালাতে হবে। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর ও জিম্বাবুয়ে এর ভাল উদাহরন হতে পারে। এসব দেশে মুলত সংখ্যা লঘু চাইনিজরাই সকল ইন্ডাষ্ট্রির মালিক আর সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশীয়রা তাদের শিল্পে শ্রম দিয়ে মাত্রই বেতনভুক্ত হয়ে পড়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৮