somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-৪ | প্রাচীন হিব্রুভাষীদের গল্প

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইতিহাসের প্রসঙ্গ আসলেই আর্যভাষীদের মতই আরেকটি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী আমাদের দৃষ্টি কাঁড়ে, এরা হল হিব্রুভাষী। হিব্রুভাষী ইহুদিদের ইতিহাসটি এতোই পুরনো যে এর সাথে অনিবার্যভাবে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর ইতিহাসও জড়িয়ে গিয়েছে। ইহুদি জীবনধারাকে সরাসরিভাবে স্পর্শ করেছে প্রাচীন সভ্যতার প্রধান ধারাগুলো। সেজন্য ইহুদি ইতিহাস যেনো আসলে প্রাচীন মিসরীয়, মেসোপটেমীয়, মেসিডোনীয়, রোমান ও মুসলিম খিলাফতের ইতিহাসেরই অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। ইহুদি ইতিহাসের পথ ধরে হাটলে সামনে এসে দাঁড়ায় হারিয়ে যাওয়া কত সভ্যতার ইতিহাস। মনে পড়ে যায় হারিয়ে যাওয়া দিনের কত গল্প, কত কথা, কত কাহিনী।

গল্পের শুরুটা হয় ইহুদিদের আদি পিতা ইব্রাহিমকে দিয়ে। গল্পের গোড়ায় এসে যায় প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার কথা। কারণ ইব্রাহিম বসবাস করতেন এখানেই, উত্তর-পশ্চিম মেসোপটেমিয়ায়। সময়কালটা ছিল ২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি। সে সময় সুমেরীয় সভ্যতার চলছে পড়ন্ত দশা। ইব্রাহিম থাকতেন সুমেরীয় শহর উর শহরে। তাঁর পূর্ব পুরুষদের আদি বাস ছিল আরব মরুভূমিতে। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বের দাবি রাখে তা হল, ইহুদি ইতিহাসের গোড়াটা ফিলিস্তিনে নয় বরং সুমেরীয় সভ্যতায় অর্থাৎ বর্তমান ইরাক অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া যায়।


চিত্র: মরু-সাগরের তীরে ইব্রাহিমের লোকজনদের যাত্রাবিরতী

উর শহরটির অবস্থান ছিল বর্তমান ইরাকে। এখান থেকেই এক সময় ইব্রাহিম তাঁর বংশের লোকজন নিয়ে চলে যান ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ফিলিস্তিন অঞ্চলে। ফিলিস্তিন ভূখন্ডের সাথে ইহুদি ইতিহাসের যোগসূত্র স্থাপিত হয় এখান থেকেই। ইব্রাহিমের নাতি ইয়াকুবের নেতৃত্বে তারা সেখানকার কেনানে বসতি স্থাপন করে। ইয়াকুবের আরেক নাম ইসরাইল। এ নাম থেকেই ইহুদিদের পরিচয় হয় ইসরাইলী বলে। ইয়াকুবের পুত্র ইউসুফকে তাঁর সৎ ভাইরা ফেলে দেয় পানির কূপে। সেখান থেকে একজন মিসরীয় ব্যবসায়ী তাঁকে উদ্ধার করে ফারাওয়ের রাজ কর্মচারীর কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। এই বালক দাসই একদিন হয়ে যান ফারাওয়ের মন্ত্রী। ভাগ্যের কী পরিহাস! একদিন এই ইউসুফই তাঁর হিংসুক ভাইদের প্রাণ বাঁচিয়ে আশ্রয় দিলেন মিসরে।


চিত্র: ফারাওয়ের রাজপ্রাসাদের সামনে নতজানু ইহুদিরা

কেনান দেশে তখন প্রচণ্ড দূর্ভিক্ষ চলছে। অন্যান্য কেনানীয়দের সাথে ইউসুফের ভাইরাও খাদ্য ভিক্ষা করার জন্য গেল মিসরে ইউসুফের কাছে। ভাইয়ে ভাইয়ে পরিচয় হলো; কিন্তু ইউসুফ প্রতিশোধ নিলেন না, বরং তাদের জন্য খাদ্যশস্যের ব্যবস্থা করলেন, এমনকি তাদেরকে তিনি অনুর্বর কেনান থেকে নিয়ে আসলেন মিসরে। গোশেন নামে মিসরের একটি উর্বর এলাকা দান করলেন তাদেরকে যেখানে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। এ ঘটনার তাৎপর্য দুটো। প্রথমত প্রতিশোধ না নেয়ার বিষয়টি। সে যুগে চাষযোগ্য ভূমির তুলনায় শ্রম ছিল অপর্যাপ্ত। তাই চাষবাসের জন্য শ্রম দানে সমর্থ মানুষকে হত্যা না করে কাজে লাগানো ছিল কল্যাণকর। কারণ চাষ করে যে ফসল অর্জিত হবে তার একটি অংশ কর হিসেবে রাজকোষকে করবে সমৃদ্ধ। দ্বিতীয় তাৎপর্যটি হল, ইসরাইলীদের ফিলিস্তিনের কেনান অঞ্চল ছেড়ে মিসরে পুনর্বাসিত হওয়ার ঘটনা।


চিত্র: জেরুজালেম পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন নগরী

ইরাক অঞ্চল ছেড়ে ফিলিস্তিনে এসে আবার মিসরে চলে যাওয়া থেকে প্রমাণ পায় যে, ফিলিস্তিনের ওপর বর্তমানের ইহুদি যায়নবাদীদের ঐশ্বরিক দাবিটি ভিত্তিহীন। যায়নবাদ দাবি করে যে, যিহোবার সাথে ইহুদিদের একটি চুক্তি আছে। আর সেই চুক্তি অনুযায়ী ফিলিস্তিন ইহুদিদের জন্য যিহোবার প্রতিশ্রুতি ভূমি এবং এর বিরুদ্ধে কোন ইহলৌকিক যুক্তি খাটবে না বা অন্য কোন ধর্মের যুক্তিও খাটবে না। মজার ব্যাপার হলো, মিসরে ইউসুফের বদৌলতে উর্বর জমি পেয়ে ইসরাইলীরা তাদের এই প্রতিশ্রুত ভূমি ছেড়ে সেখানেই চলে যেতে শুরু করল।

১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে দূর্ভিক্ষ পীড়িত ফিলিস্তিন ছেড়ে প্রায় সকল ইহুদিই গিয়ে ভিড় করল মিসরে। সেখানে তারা ক্রমে ফারাওদের দাসে পরিণত হল। ইহুদিরা প্রায় চারশ বছর মিসরে থাকল। কালক্রমে সেখানে অত্যাচারী শাসকের আবির্ভাব ঘটল। ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসরে রামেসেস নামে এক রাজা এল। সেই ফারাও ইহুদিদের হত্যা করার আদেশ দিলো। অবশেষে ১৩০০-১২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ইহুদিদের নতুন নেতা মুসা তাদেরকে মুক্ত করে লোহিত সাগর পেরিয়ে নিয়ে আসেন এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থল সিনাই উপদ্বীপে।


চিত্র: রাজা সোলায়মানের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে দুটি ইহুদি
রাজ্য জুডিয়া ও ইসরাইলসহ অন্যান্য স্থানীয় জাতির অবস্থান

মিসরের ফারাওদের হাত থেকে পালিয়ে এসে ইহুদিরা কিন্তু কেনানে অর্থাৎ তাদের বর্তমানের ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’-তে ফিরে গেলো না। তারা থেকে গেল এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থল সিনাই উপদ্বীপেই, সেখানে তারা থাকল প্রায় ২৫০ বছর। ইহুদি কিংবদন্তী হল মুসা যিহোবার সাথে দেখা করার জন্য সিনাই পাহাড়ে আরোহন করেন। সেখানে ৪০ দিন অবস্থান করে যিহোবার কাছ থেকে ১০টি নির্দেশ নিয়ে ফিরে আসেন। মুসার মৃত্যুর পর ইহুদিরা যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

ইহুদিদের কোন রাজা ছিল না। ধর্মযাজকরাই তাদের শাসন করতো। এদের বলা হত জজ। এক পর্যায়ে ইহুদিরা তাদের একজন রাজা ঠিক করল। তাঁর নাম সউল। তিনি ইহুদিদের প্রথম রাজা। কিন্তু তাঁর কোন স্থায়ী আবাস ছিল না। তিনি তাঁবুতে থাকতেন। খুব সাদাসিদে জীবন যাপন করতেন। সউলের পর রাজা হলেন ডেভিড; যাকে আমরা হযরত দাউদ বলে চিনি। ইহুদি কিংবদন্তীতে ডেভিডের অনেক বীরত্বগাথা আছে। গোলিয়াথ নামের এক দৈত্যকে তিনি বধ করেন। রাজা সউলের মেয়ে এতে খুশি হয়ে তাকে বিয়ে করেন। এভাবে তিনি ইহুদিদের রাজায় পরিণত হন।


চিত্র: Wailing Wall বা ‘অশ্রুর প্রাচীর’ হলো দাউদের প্রাচীরের
এক ক্ষুদ্র অংশ। এটিই ইহুদিদের সর্বোচ্চ মর্যাদার ধর্মীয় স্থাপনা

রাজা দাউদ ইহুদিদের জন্য একটি স্থায়ী আবাসভূমির কথা ভাবলেন। ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে তিনি ইহুদিদের নিয়ে অগ্রসর হলেন জেরুজালেমের দিকে। যিবুসাইট্স্দের হাত থেকে দখল করলেন জেরুজালেম। দাউদের জেরুজালেম দখলের সময়ে মেসোপটেমিয়ায় চলছে অন্ধকার যুগ। সুমেরীয় সভ্যতার পরবর্তী সময়কার প্রাচীন ব্যবলনীয় সভ্যতা হারিয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছিল কিছু ছোট ছোট রাজ্যের অস্তিত্ব। এদের কেউ একক আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল না। ফিলিস্তিন অঞ্চল জুড়ে ছিল অনেকগুলো জাতির বসবাস। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

কেনানীয়: তাওরাতে বর্ণিত নবি নোয়ার পুত্র ছিল হাম। হামের পুত্র কেনান। কেনানের বংশধররাই হল কেনানীয়। ইব্রাহিম তাদের দেশে আসার বহু আগেই তারা সে অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তাদের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ফিলিস্তিনে। (তাওরাত: ১০: ১৫-২০)

সিডনীয়: কেনানের বড় ছেলে সিডন। ফিনিশীয় বাণিজ্য কেন্দ্র সিডন শহর ছিল তাঁর বংশধরদের।

যিবুসীয় ও আমোরীয়: এরা কেনানের বংশের শাখা। ইংরেজিতে এদের বলা হয় যিবুসাইট ও আমোরাইট। ব্যাবিলনীয়রা ছিল আমোরীয় জাতির লোক। যিবুসীয়দের কাছ থেকে দাউদ জেরুজালেম দখল করেছিলেন। কেনানীয়দের অন্যান্য শাখা হল- গির্গাশীয়, হিব্বীয়, অর্কীয়, সীনীয়, অর্বদীয়, সমারীয় এবং হমাতীয়রা। সিডন থেকে গাজার দক্ষিণ এলাকা পর্যন্ত ছিল এদের দেশ।

ফিলিস্তিনী: হামের আরেক পুত্র মিসর। মিসরের বংশধর হল লিডীয়, অলমীয়, লহাবীয়, নপ্তুহীয়, পথ্রোষীয়, কসলূহীয় ও ক্রীট দ্বীপের অধিবাসী ক্রীটীয়রা। এদের মধ্যে কসলূহীয়রা ছিল ফিলিস্তিনীদের পূর্বপুরুষ। (তাওরাত: পয়দাদেশ: ১০: ১৩-১৪)

বিভিন্ন ইবরানী জাতি: নোয়ার বড় ছেলে সাম। সামের বংশেই জন্ম ইব্রাহিমের। ইব্রাহিমের বংশধরদের বলা হয় ইবরানী। ইবরানীদের মধ্যে আছে ইব্রাহিম পুত্র ইসমাঈলের বংশধর আরবরা। অপর পুত্র ইসহাকের পুত্ররা হল ইয়াকুব (ইসরাঈল) ও ইস। ইস এর বংশধররা হল ইদোমীয় (পয়দাদেশ: ২৫:৩০)। ইসরাইলের বংশধরই হল ইহুদিরা। ইসরাইলের ১২ সন্তানের ঔরশজাত ১২টি শাখায় তারা বিভক্ত ছিল। দাউদ তাদের সবার নেতা। ইসরাইলের ছেলে এহুদার বংশধর ছিলেন দাউদ। আরব ইদোমীয়রা ফিলিস্তিনের বাইরে বাস করতো।

মোয়াবীয় ও আমোনীয়: ইব্রাহিমের ভাই হারন। হারনের ছেলে লুত। লুতের দুই পুত্র মেয়াব ও বিন-আম্মি। এদের বংশধররা হল মোয়াবীয় ও আমোনীয় (পয়দাদেশ: ১৯: ৩৭-৩৮)। এরা ফিলিস্তিন এলাকায় সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ইহুদিদের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্ধীতে পরিণত হয়। তাই তাওরাত তথা ওল্ড টেস্টামেন্ট রচনার সময় ইহুদিরা এদের বংশপরিচয়ের গোড়ায় কলংক আরোপ করেছে। তাওরাতের ঊনবিংশ অধ্যায়ের ৩১ থেকে ৩৬ তম আয়াত পর্যন্ত মোয়াবীয় ও আমোনীয়দের ওপর এ কলংক আরোপ করেছে ইহুদিরা।

হিট্টীয়: আর্যদের যে শাখা তুরস্কে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদেরকে বলা হয় হিট্টীয়। ইংরেজিতে হিট্টাইট্। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের পরে এরা আর্যদের অন্য গোষ্ঠীর কাছে পরাজিত হয়ে ফিলিস্তিন ও সিরিয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

কেনানীয় গোত্রের শাখা যিবুসাইটসদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে রাজা দাউদ প্রথমবারের মত ইহুদি রাজ্যের একটি ভিত্তি গড়লেন। এটা তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র একারণেই যে তখন আশেপাশে কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল না। দাউদ তাবুর জীবন ছেড়ে উঠে এলেন অট্টালিকায়। জেরুজালেমকে করলেন প্রাচীর বেষ্টিত। এই প্রাচীরের একটি ক্ষুদ্র অংশ আজও টিকে আছে যা wailling wall (অশ্রুর প্রাচীর) নামে পরিচিত। এর নিচে দাঁড়িয়ে ইহুদিরা এখনও অশ্রু বিসর্জন দেয়। এটি ইহুদিদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় পবিত্রতার প্রতীক।

জেরুজালেমে ইহুদিদের অধিকার এটাই প্রথম। এর আগে প্রায় ৮০০ বছর তারা জেরুজালেমের অধিকার ছাড়াই ইহুদি পরিচয়ে কাটিয়েছে। আবার জেরুজালেমে তাদের কর্তৃত্বও খুব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। এক সময় তারা জেরুজালেমের কর্তৃত্ব হারায়। এর পরে পেরিয়ে গেছে হাজার হাজার বছর। তারা আর জেরুজালেমের কর্তৃত্ব ফিরে পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। কারণ সভ্য দুনিয়ার সকল জায়গা চলে যায় বিভিন্ন সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্রের অধীনে। আর এসব সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেছে বৃহৎ অর্থনৈতিক জীবনকে কেন্দ্র করে।

বিশাল আয়তনের ভূখন্ডের অর্থনীতি একটি অভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার আওতায় কেন্দ্রীভূত হয়ে এক একটি সাম্রাজ্যের আকার ধারণ করে যা তার আর্থ-রাজনৈতিক পরিধিকে আরও ব্যাপকতার দিকে নিয়ে যেতে চায়। এসব সাম্রাজ্যের জাতীয়তার ভিত্তি ইহুদিদের মত নয়। ইহুদিরা একটি সংকীর্ণ ধর্মীয় গণ্ডীবদ্ধ জাতীয়তায় আবদ্ধ। এটার ভিত্তিতে স্বাভাবিক রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য গড়ে উঠতে পারে না। সাম্রাজ্যগুলোর জাতীয়তার ভিত্তি ছিল সুবিশাল এলাকা বা ভূখন্ডের অধিবাসীদের জাতীয়তা, যেমন- পারসীয়, রোমান বা মুসলিম সাম্রাজ্য কোন ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ছিল না; বরং বিশাল অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয়ই এসব সাম্রাজ্যের জাতীয়তার ভিত্তি নির্ধারণ করেছে।


চিত্র: জেরুজালেমের দামেস্ক গেট

ইহুদিরা সভ্যতার দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে অস্তিত্বশীল হয়ে উঠতে পারে নি একারণেই যে, একটি সংকীর্ণ ধর্মীয় গোষ্ঠীতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র রচনা করা চলে না। এজন্য প্রায় তিন হাজার বছর ধরে ইহুদিরা শুধু তাদের ধর্মীয় সংকীর্ণতাকেই আঁকড়ে থেকেছে। কখনও রাষ্ট্রীয় ভিত্তি অর্জন করতে পারেনি। তিন হাজার বছর পরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় যে ইহুদি রাষ্ট্রটি জন্ম নিয়েছে তা রাষ্ট্র গঠনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। ইহুদিরা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মিশে গিয়েছিল। যেভাবে অনেক জাতির লোকেরাই বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে মিশে গিয়েছে। সেই ইহুদিদেরকে বিভিন্ন দেশ থেকে টেনে এনে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। মূলত জার্মানির ইহুদি নাগরিকরাই ইসরাইলের জনসংখ্যার বড় অংশ। পৃথিবীর বহু জাতির মানুষেরই আলাদা রাষ্ট্রীয় ভিত্তি নেই এবং তার কোন প্রয়োজনও নেই। কারণ জাতি মানেই যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভিত্তিশীল হতে হবে এমন কোন কথা নেই।

তাই স্বাভাবিকভাবেই ইহুদিরাও সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে স্বাধীন রাষ্ট্রবিহীন অবস্থায়ই কাটিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর অধীনতাকেই তাদের মেনে নিতে হয়েছে। যে ফিলিস্তিনে তারা বসতি গড়ে সেটাও এমন একটি জায়গা যে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে এর চলে যাওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এটি তিনটি মহাদেশের সংযোগস্থল এবং মহাদেশগুলোর মধ্যে সামুদ্রিক যোগাযোগের কেন্দ্র। বিভিন্ন প্রাচীন সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী উপকুলীয় এই অঞ্চলে ইহুদিদের স্বাধীন রাজ্যের একমাত্র দৃষ্টান্ত হল দাউদের জেরুজালেম দখলের পরবর্তী সময়টুকু। জেরুজালেম দখলের পর দাউদ রাজ্য সীমানার বিস্তার ঘটালেন। ফিলিস্তিনের প্রায় সবটাই চলে আসে তার অধীনে। এ সময়ে অনেক ছোট ছোট জাতি ও অঞ্চল স্বাধীন ছিল। দাউদ ফিলিস্তিন দখল করে ইহুদি রাজ্য স্থাপন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সভ্যতার বিকাশের স্বাভাবিক ধারাতেই বড় বড় সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে এবং ইহুদি রাজ্য হারিয়ে যায় সেগুলোর মধ্যে। এমনকি অন্য সব ছোট রাজ্যগুলোও।

৯৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দাউদের মৃত্যুর পরে ইহুদিদের রাজা হন তাঁর পুত্র সলোমন । এই সলোমন ছিলেন একাধারে ইহুদিদের রাজা ও ধর্মীয়ভাবে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। এই সলোমনই জেরুজালেমে নির্মাণ করেন ইহুদিদের অতি পবিত্র ধর্মগৃহ। সলোমনের সময়কালটাই ইহুদি ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। এ সময়েই তারা সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌছে গিয়েছিল। নিজেদের রাজ্য, নিজেদের রাজধানী এবং নিজেদের ধর্মীয় উপাসনালয় নিয়ে তারা সুখী জীবন কাটিয়েছে। সলোমনের মৃত্যুর পর ইহুদি জাতি দুই রাজ্যে ভাগ হয়ে গেল। একটি ইসরাইল রাজ্য অপরটি জুডিয়া রাজ্য। ইসরাইলের রাজধানী হয় সামারিয়া আর জুডিয়ার রাজধানী হয় জেরুজালেম।

মেসোপটেমিয়ায় সে সময়ে অন্ধকার যুগ কাটিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে উত্তরের অ্যাসিরিয়া। ক্রমে অ্যাসিরীয়রা সমগ্র মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের অধিপতি হয়ে ওঠে। আশপাশের দেশগুলোও তাদের আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। ইহুদিরাও বাদ গেল না। অ্যাসিরীয়রা এক সময় জুডিয়ার উত্তরের ইসরাইল রাজ্য কেড়ে নিল । ৭২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যাসিরীয়রা ইসরাইলের রাজধানী সামারিয়া দখল করে ইহুদিদের দশটি গোত্রকে বন্দী করে নিয়ে যায় এবং মানব জাতির ইতিহাস থেকে ইসরাইল নামক এই রাষ্ট্রটি হারিয়ে যায় চিরতরে; থেকে যায় জুডিয়া।

জুডিয়া থেকেই ইহুদিদের ধর্মের নাম হয় ‘জুডাইজম’ বা ‘জুডাবাদ’। দাউদ ও সলোমনের সময় থেকে শুরু করে জুডিয়া রাজ্য যতোদিন স্বাধীন ছিল সেটাই ছিল ইহুদি জাতির চার হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে সোনালী সময়। এই সময়েই তারা উপভোগ করতে পেরেছিল নিজেদের রাজ্যে স্বাধীন জীবন। কিন্তু এক সময়ে তাদের এই স্বাধীনতা মধ্যপ্রাচ্যে নতুনভাবে জেগে ওঠা শক্তিশালী ক্যালদীয় সাম্রাজ্যের কাছে শেকলবন্দী হয়ে যায়। এর শুরুটা করেন ক্যালদীয় সাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট নেবুচাদনেজার। তাঁর রাজত্বকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০৪ থেকে ৫৬১ অব্দ পর্যন্ত। অ্যাসিরীয়দের পতনের পরে তিনি সমগ্র মেসোপটেমিয়া অঞ্চলকে তাঁর পদানত করেন। ইতিহাসে তাঁর সকল বিজয় অভিযান অন্য আরও দশজন সাম্রাজ্যের অধিপতির মতই বৈচিত্রহীন। কিন্তু একটি নিষ্ঠুর অভিযান তাকে ইতিহাসে তাৎপর্যমন্ডিত করে তুলেছে। এটা হল ইহুদিদের জুডিয়া রাজ্য ও জেরুজালেম ধ্বংসের অভিযান।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সাল! ইহুদি ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায় সূচিত হল এ বছর। জুডিয়ার হিব্রু রাজ্যে নেমে এল ধ্বংস আর প্রলয়ের বিভীষিকা। সম্রাট নেবুচাদনেজারের সৈন্যরা ধ্বংস করে দিল ইহুদি রাজ্য। ধ্বংস হল জেরুজালেম। দাউদের প্রাচীর আর সলোমনের ধর্মগৃহ গুড়িয়ে দেয়া হল। প্রায় ৪০/৪৫ হাজার ইহুদি নর-নারীকে শেকলবন্দি করে নিয়ে যাওয়া হল ব্যাবিলনে। সেখানে তারা ভূমিদাসে পরিণত হল। এটাই ইহুদিদের শেকলপরা ইতিহাস। ইতিহাসে এই বন্দিদশার নাম ‘ব্যাবিলনীয় বন্দিদশা’।

জুডিয়ার ইহুদিরা নানাভাবে নেবুচাদনেজারের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যাচ্ছিল। মিসরীয়দের প্ররোচনায় এক পর্যায়ে তারা কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নেবুচাদনেজার জেরুজালেম ধ্বংসের জন্য সৈন্য পাঠান। ইহুদিদের অবাধ্যতাকে চিরতরে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার ইহুদিকে বন্দী করে নিয়ে আসা হয় ব্যাবিলনে। ইহুদিদের এই করুণ ইতিহাস নিয়ে ‘অভিশপ্ত নগরী’ নামে এক অসাধারণ উপন্যাস রচনা করেছেন প্রয়াত লেখক-সাংবাদিক সত্যেন সেন। ব্যাবিলনে তাদের বন্দীজীবন এবং সেখান থেকে তাদের জেরুজালেমে প্রত্যাবর্তনের ঘটনা নিয়ে তিনি আরেকটি অসাধারণ উপন্যাস রচনা করেন ‘পাপের সন্তান’ নামে।

৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস দখল করে নিলেন ক্যালদিয়ার রাজধানী ব্যাবিলন। এতদিন পরে ব্যাবিলনের বন্দি ইহুদিরা কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেল। সম্রাট সাইরাস কিছুসংখ্যক ইহুদিকে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। ৪৮ বছর পর ক্যালদীয় নিপীড়নে জীবনীশক্তিহীন ইহুদিরা জেরুজালেমে ফিরে এসে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞের সূচনা করল। সেটা হল মুসার বাণী লিপিবদ্ধ করার কাজ। আর এর মধ্য দিয়েই ইহুদি ইতিহাসে সূচিত হল এক নতুন অধ্যায়। পারস্য সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে ফেপে ওঠা ইহুদি যাজকতন্ত্র তখন স্বাধীনভাবে শাসন করতে শুরু করে ইহুদিদেরকে। ঢালাওভাবে যাজকদের নিজস্ব বিধি-বিধান যুক্ত করে রচিত হতে থাকে ওল্ড টেস্টামেন্ট। একসময় ইহুদিদের ওপর নিরংকুশ আধিপত্য বিস্তারের জন্য যাজকতন্ত্র ওল্ড টেস্টামেন্টে যুক্ত করে জাতিতত্ত্বের বিশুদ্ধবাদী অনুশাসন। আধিপত্য ও ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য পূর্বাপর ইবরানী ও ইসরাইলী নবিদের শিক্ষা বাদ দিয়ে ইহুদি সমাজে চালু করা হয় বিশুদ্ধবাদী অনুশাসন।

পারস্য সম্রাট সাইরাসের সময় থেকে শুরু করে পারস্য সম্রাট আর্তাজারেক্সেসের সময় পর্যন্ত ব্যাবিলনের বন্দীদশা থেকে জেরুজালেম ও এহুদায় ফিরে এসেছিল ৪২৩৬০ জন ইহুদি (ওল্ড টেস্টামেন্ট, নবিদের কিতাব, ইষ্রা ২:৬৪)। এ সময়েই ইহুদিদের ধর্ম বিশ্বাসে ভর করে গোঁড়ামী ও রক্ষণশীলতা। মিসর ও মেসোপটেমীয় সাম্রাজ্যগুলোর হাতে ইহুদিরা বারবার পর্যুদস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও পারসীয়রা তাদেরকে দেয় মুক্তি ও পৃষ্ঠপোষকতা। পারস্য সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতাই ইসরাইলী ধর্মীয় ধারায় জন্ম নেয় শক্তিশালী যাজকতন্ত্র, যা ভিত্তি স্থাপন করেছিল আজকের যায়নবাদের।

এবার আমরা যাব সে ইতিহাসের কথায়।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:০৬
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×