somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-৫ | বিধান দিলেন ইষ্রা

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইষ্রা! এক ইহুদি ধর্মাচার্যের নাম। তবে ইতিহাসে তাঁর গুরুত্ব শুধুই একজন ধর্মযাজক হিসেবে নয়। কারণ তাঁর রচিত ধর্মীয় বিধান আজ আড়াই হাজার বছর পরেও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের মত একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা বাধিয়ে রেখেছে। আচার্য ইষ্রা প্রণীত বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্বে উদ্ধুদ্ধ হয়ে আজকের যায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র বারবার নিষ্ঠুর গণহত্যায় মেতে উঠছে ফিলিস্তিন ভূখন্ডের নিরীহ আদি বাসিন্দাদের ওপর যারা গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসেও কখনও ইহুদিদের প্রতি এ ধরণের কোন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রদর্শন করেনি।

এ যায়নবাদী নিষ্ঠুরতার মূলে রয়েছে আচার্য ইষ্রার বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্বের বিধান যা তিনি প্রবর্তন করেছিলেন ব্যাবিলন থেকে পারস্য সম্রাট আর্তাজারেক্সেসের দয়ায় ইহুদিদের শেষ দলের সাথে জেরুজালেমে ফিরে আসার পর (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ইষ্রা:৭:১)। ফিরে এসেছিলেন তিনি ৪৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাসের দয়ায় ব্যাবিলনের দাসজীবন থেকে ইহুদিদের প্রথম দলটির প্রত্যাবর্তনের ৯৪ বছর পরে সম্রাট আর্তাজারেক্সেসের অনুমতি পেয়ে আচার্য ইষ্রার নেতৃত্বে ব্যাবিলনে বসবাসরত বাদ বাকি ইহুদিরা বেরিয়ে পড়ল জেরুজালেমের পথে। এ দলে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল সতেরশ’। এক সময় তারা পৌছেও গেল জেরুজালেমে।

এই প্রত্যাবর্তন নেবুচাদনেজারের জেরুজালেম ধ্বংস তথা ‘ব্যাবিলনীয় বন্দিদশা’ শুরু হওয়ার ১৪৩ বছর পর। এই সময় ধরে কয়েক পুরুষ গত হয়েছে। তবুও ব্যাবিলনের বন্দি ইহুদিরা ক্যালদীয় বা পারসীয় হতে পারেনি। যে শিশুর জন্ম হয়েছে ব্যাবিলনে সেও তার বার্ধক্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত স্বপ্ন দেখেছে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার। তাই এই প্রত্যাবর্তন ছিল ইহুদিদের জন্য এমন অভাবিত আনন্দের যা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।

সম্রাট আর্তাজারেক্সেস ইষ্রাকে জেরুজালেমের ধর্মীয় আচার্য নিযুক্ত করলেন। সেই সময়ের অন্যান্য সমাজের মতই ইহুদি সমাজও শ্রেণি শোষণ থেকে মুক্ত ছিল না। দাসকেন্দ্রিক অর্থনীতি ছিল তখনকার সমাজের ভিত্তি। মিসর ও ব্যাবিলনের দাসজীবনের যন্ত্রণার সাক্ষী ইহুদিদের নিজেদের ভেতরেও এ ব্যাবস্থা চালু ছিল। ঋণগ্রস্থ ইহুদিরা ক্রমে ধনী ইহুদিদের দাস হয়ে পড়ছিল । কিন্তু এ অধঃপতন দেখে মোটেও ভাবিত হন না আচার্য ইষ্রা। বরং বিপুল উৎসাহের সাথে তিনি ইহুদিদের নিয়ে গেলেন এক প্রচন্ড গোঁড়ামীপূর্ণ জাতিগত সংরক্ষণবাদের পথে; প্রবর্তন করলেন বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্বের। এটাই আধুনিক যায়নবাদের ভিত্তি। অ্যাসিরীয়রা উত্তরের সামারিয়া দখলের পরে সেখানে অ-ইহুদিদের থাকতে দিয়েছিল (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ২ বাদশাহনামা:১৭)। সেখানকার অ-ইহুদিদের সাথে মিশ্রণ ঘটে যায় স্থানীয় ইহুদিদের। ব্যাবিলন থেকে জেরুজালেমে ফিরে আসা ইহুদিদের সাথেও মিশ্রণ ঘটেছিল অ-ইহুদিদের (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ইষ্রা:১০:১৮-৪৪)। তাতে নাকি বিশুদ্ধতা হারিয়েছে ইহুদি রক্ত!

বিজাতীয়দের সাথে ইহুদিদের এই মিশ্রণ ক্রুদ্ধ করে তোলে আচার্য ইষ্রাকে। তিনি ছিলেন ইহুদি ধর্মজগতের মধ্যমণি, মুসার ভাই হারুনের সপ্তদশ উত্তরপুরুষ! তাঁর পূর্বপুরুষদের তালিকা রয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্টের পবিত্র বংশাবলী পুস্তকে। অতএব তিনি ইহুদিদের ওপর যাজকতন্ত্রের প্রভাব খাটাবার একচ্ছত্র অধিকারী বনে গেলেন। তার মুখ নিঃসৃত কথাই হয়ে যায় ধর্মীয় বিধান। ইহুদিরা এ বিধান না মেনে যাবে কোথায়? তাই তিনি ইহুদিদেরকে তাদের পরজাতীয় স্ত্রী ও সন্তানদেরকে প্রত্যাখ্যানে বাধ্য করার জন্য ওল্ড টেস্টামেন্টে সংযুক্ত করলেন ইহুদি জাতির বিশুদ্ধতার বিধান।

যে ভয়াবহ বিধানটি তিনি জারি করেছিলেন তা হল- যেসব ইহুদি পুরুষরা পরজাতীয় মেয়েদের স্ত্রী করেছে, সেই সব স্ত্রীদের এবং তাদের গর্ভজাত পুত্র-কন্যাদের ত্যাগ করতে হবে (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ইষ্রা:১০:১১)। এ ঘোষণা কতটা অমানবিক ও হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে- তা আচার্য ইষ্রা ভালভাবেই জানতেন। কিন্তু এতে তিনি বিচলিত হলেন না। আচার্য ইষ্রা তাঁর যাজকীয় ক্ষমতাকে পোক্ত করার জন্য বিশুদ্ধবাদী অনুশাসনে অনঢ় রইলেন; হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশুর ক্রন্দন তাকে স্পর্শ করল না। আচার্য ইষ্রার এই বিশুদ্ধবাদী অনুশাসনের কথা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর অনুসারীরা ওল্ড টেস্টামেন্টে সংরক্ষিত করেছে। ওল্ড টেস্টামেন্টের বংশাবলীর দ্বিতীয় খন্ডে ইষ্রার নিজের কথার শ্লোকগুলোতে এটি বর্ণিত আছে।


চিত্র: ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি ইষ্রার বিধানের সৃষ্টি

জেরুজালেমে ফেরা ইহুদিদের সর্বশেষ দলটির প্রতি আচার্য ইষ্রার বিশুদ্ধবাদী অনুশাসন কতটা জীবন বিরুদ্ধ ও অমানবিক ছিল তা তুলে ধরেছেন প্রয়াত লেখক-সাংবাদিক সত্যেন সেন তাঁর ‘পাপের সন্তান’ গ্রন্থে। এখানে পাপের সন্তান মানে হল ইহুদি পুরুষদের পরজাতীয় স্ত্রীদের গর্ভজাত সন্তানরা। আচার্য ইষ্রার অনুশাসন অনুসারে পরজাতীয় কন্যাদের সাথে যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তাদের ঔরসে ঐসব স্ত্রীদের গর্ভজাত সন্তানরা হল পাপের সন্তান। এদেরকে প্রত্যাখ্যান করার হুকুম জারি করলেন তিনি। সেই সাথে পরজাতীয় স্ত্রীদেরও।

ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আচার্য ইষ্রার এই অমানবিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে জোনাথন, যহসিয়, মশুল্লম, শব্বথয়সহ ব্যাবিল প্রত্যাগতদের অনেকেই তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে (ওল্ড টেস্টামেন্ট:ইষ্রা:১০:১৫)। কিন্তু তাদের এ প্রতিবাদ আচার্য ইষ্রাকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। নির্বিকার চিত্তে তিনি জবাব দিলেন, পরজাতীয় মেয়েদের গর্ভজাত সন্তানরা পাপের সন্তান। এরা যত শীঘ্র লোপ পাবে, যিহোবার রাজ্য তত নিষ্কলঙ্ক হয়ে উঠবে। ধর্মের নামে আচার্য ইষ্রার এই যাজকতন্ত্রের যুপকাষ্ঠে বলি হয়ে গেল হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, যুবা-বৃদ্ধ।

সম্রাট সাইরাস ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইহুদিদের প্রথম যে দলটিকে স্বদেশ ফেরার অনুমতি দিয়েছিলেন তারা ওল্ট টেস্টামেন্ট লিপিবদ্ধ করার কাজে হাত দিয়েছিল। মুসার সময়কাল ধরা হয় ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গিয়েছিলো প্রায় ৭৬২ বছর। এতদিন পরে তাঁর বাণী লিপিবদ্ধ করার কাজের শুরু। কিভাবে সম্ভব মুসা যা বলেছিলেন হুবহু তা লিপিবদ্ধ করা? বংশ পরম্পরায় চলে আসা মুসার বাণীর কতটুকু ছিল আসল আর কতটুকু ছিল অপভ্রংশ আর কতটুকু ছিল বক্তাদের নিজস্ব সংযোজন তা কে বলতে পারে? তার ওপর আবার লিপিকররাও ছিলেন ধর্মবেত্তা। তারাও তাদের সুবিধামত বিভিন্ন বক্তব্য ও বিধি-বিধান মিশ্রিত করেছেন। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আচার্য ইষ্রার ইহুদি রক্তের বিশুদ্ধতার বিধান।

ইহুদিদের প্রথম যে দলটি জেরুজালেমে ফিরে এসে ওল্ড টেস্টামেন্ট লিপিবদ্ধ করার কাজে হাত দিয়েছিল, তাদের ৯৪ বছর পরে ইহুদিদের শেষ দলের সাথে আচার্য ইষ্রা জেরুজালেমে ফিরে আসেন। এরপর তিনি ওল্ড টেস্টামেন্টে ইহুদি রক্তের বিশুদ্ধতার যে বিধান সংযুক্ত করলেন, তা একান্তই তার নিজস্ব। এটা কোনক্রমেই নবি মুসার বাণী হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ নবিরা উঠে আসতেন সাধারণ মানুষদের স্তর থেকে এবং তাদের অনুসারীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ছুটে যেতেন সাধারণ মানুষের কাছেই। এ ধরনের বর্ণবাদী জাতিতত্ত্বে সাধারণের আকৃষ্ট হওয়ার কোন কারণ নেই। বরং নবিদেরকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি এড়িয়ে চলতে। বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্ব নয়, বরং একত্ববাদই ছিল তাদের প্রচারের মূল বিষয়।


চিত্র: প্রাচীন জেরুজালেমের একটি মানচিত্র

ইবরানী ও ইসরাইলী ধর্মমতের ধারায় একটি ব্যাপার সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। তা হল ধর্মের আদলে রাজদ্রোহ। সেমেটিক নবিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা সকলেই প্রচলিত শাসকপূঁজারি ধর্মমতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, যা পরোক্ষভাবে ছিল শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ। শাসকপূঁজারি ধর্মমতের বিরুদ্ধে সেমেটিক নবিদের বিদ্রোহী মতবাদ ছিল একত্ববাদ। শাসকপূঁজারি ধর্মমত অনুসারে রাজা নিজেকে দেবতার আসনে বসিয়েছে আর এর বিপরীতে একজন ইব্রাহিম কিংবা মুসার আবির্ভাব ঘটেছে অত্যাচারী শাসকের দেবত্ব অস্বীকারের ঘোষণা নিয়ে। তাই একত্ববাদ ছিল রাজতন্ত্রী দৈব কর্তৃত্ব ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ভাষা। শাসকপূঁজারি বহুদেবতাবাদ আর একত্ববাদের মধ্যকার সংঘাত হল শাসকশ্রেণি ও শোষিতের মধ্যকার সংঘাত।

ইব্রাহিম যে একত্ববাদের ধর্মমত প্রচার করেছেন তা সুস্পষ্টভাবেই রাজদ্রোহের শামিল এবং রাজতন্ত্রের জন্য একটি হুমকি। তাই তাকে তাঁর অনুসারিদের নিয়ে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। পরবর্তীতে একইভাবে ইব্রাহিমের উত্তরসূরী মুসাও তাঁর অনুসারিদের নিয়ে রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে আসেন। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে, একত্ববাদ সু্স্পষ্টভাবে শাসক তথা মানুষের দৈব সত্ত্বা ও মর্যাদাকে অস্বীকার করে এবং একই যুক্তিতে মানুষের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের দৈব ভিত্তিকেও অস্বীকার করে। একত্ববাদের সাথে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব বা রক্তের বিশুদ্ধতার ব্যাপারটি খাপ খায় না। একত্ববাদের মূলনীতি অনুযায়ী মানুষের রক্তে কোন দৈব প্রভেদ নেই।

আচার্য ইষ্রার বিধান যে একান্তই তাঁর নিজস্ব বিধান, একে মুসার অনুশাসনের সাথে কোনভাবেই সংযুক্ত করা যায় না, সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইতিহাসের পথ ধরে হাটলে। আমরা জানি প্রধান প্রধান ইসরাইলী নবিরা কিভাবে পরজাতীয় কন্যাদের বিবাহ করেছেন। যা ইষ্রার বিধানে মাহপাপ। বিখ্যাত নবিদের অন্যজাতীয় নারী বিবাহের ঘটনাসমূহ নিশ্চিতভাবে ইষ্রার বিধানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। ইব্রাহিম বিয়ে করেছিলেন মিসরীয় নারী হাজেরাকে (ওল্ড টেস্টামেন্ট:তাওরাত-১ম খ-:১৬:৩)। হযরত ইসহাক ও ইয়াকুবের স্ত্রীরা ছিলেন ইরামীয় (ওল্ড টেস্টামেন্ট:তাওরাত-১ম খ-:২৪ ও ২৮)। মুসা বিয়ে করেছিলেন ইথিওপীয় মহিলাকে (ওল্ড টেস্টামেন্ট: তাওরাত-৪র্থ খ-:১২:১)। দাউদ বিয়ে করেছিলেন হিট্টীয় (আর্যদের একটি শাখা) নারী বৎশেবাকে। একবার রাজ প্রাসাদের ছাদ থেকে তিনি এক স্ত্রী লোককে স্নান করতে দেখেন। সাথে সাথে এই নারীকে তাঁর পছন্দ হয়ে যায়। কিন্তু মহিলাটি ইহুদি বংশীয় ছিল না। সে ছিল ইলিয়ামের কন্যা, হিট্টীয় উরিয়ের স্ত্রী বৎশেবা।


চিত্র: অনেক ইহুদি মনে করেন তাদের ধর্ম জুডাইজমে আধুনিক যায়নবাদের কোনো স্থান নেই

এই পরজাতীয় বৎশেবাকে দাউদ তার আপন স্ত্রী বানালেন (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ২ শামুয়েল:১১:২৭)। তাঁর গর্ভেই জন্ম নেন সলোমন। সলোমনও বিয়ে করেছিলেন ফারাওয়ের কন্যাকে। এছাড়াও মোয়াবীয়, আমোনীয়, ইদোমীয়, সিডনীয় ও হিট্টীয় রমণীরাও তাঁর পত্নী ছিল (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ১ বাদশাহনামা :১১:১)। এই সলোমন নির্মিত ধর্মগৃহই ইহুদি ধর্মের মূল ধর্মীয় স্থাপনা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইসরাইলী নবি পিতৃসূত্রে ইসরাইলী হলেও মাতৃসূত্রে ছিলেন অন্যবংশীয়। শুধু নবি কেন অনেক সাধারণ ইসরাইলীরাও অন্যজাতীয়দের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে। দাউদের জেরুজালেম দখলের পর এর পতন ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে। এর মধ্যে পেরিয়ে যায় চার শতাধিক বছর। এই সুদীর্ঘ সময়কালে ইহুদি রক্তের সাথে সংমিশ্রণ ঘটে স্থানীয় কেনানীয় ও ফিলিস্তিনিদের রক্তের।

ইষ্রা সমগ্র মানব জাতিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যেখানে একটি হল তাঁর ইহুদি জাতি যাদের শরীরে বিশুদ্ধ রক্ত প্রবাহিত। আর অন্যটি হল বাকি দুনিয়ার সকল মানুষ যাদের শরীরে নিকৃষ্ট রক্ত প্রবাহিত। কিন্তু ইহুদি ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তাদের জাতিগত বিশুদ্ধতার একেবারে গোড়ায় গলদ রয়েছে এবং পরজাতীয়দের সাথে ইহুদি রক্তের সংমিশ্রণের ঘটনায় ইহুদি ইতিহাস সমৃদ্ধ। বর্তমান যায়নবাদ মনে করে ইহুদিরা স্রষ্টার চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি ও বাকি পৃথিবীর সবাই তাদের থেকে নিকৃষ্ট। তাই ইহুদিদের সাথে অন্যজাতীয় ও অন্যধর্মীদের বিবাহ নিষিদ্ধ। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি হল স্রষ্টার দৃষ্টিতে একমাত্র খাঁটি এই ইহুদি ধর্মে অন্য কেউ প্রবেশও করতে পারবেনা। ইহুদি হবে একমাত্র ইহুদি বংশজাত লোকজন; অন্য কেউ নয়। বাদ বাকী যারা ইহুদি ঘরে জন্ম নেয়নি তাদের ভাগ্যে কল্যাণ নেই। আবার তাদের ইহুদি হওয়ার সুযোগও নেই। এই বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই যায়নবাদের মূল ভিত্তি। এর সাথে মিল রয়েছে ভারতীয় ব্রা‏হ্মণ্যবাদের। অর্থাৎ শুধু জন্ম পরিচয়ই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করছে। কিন্তু জন্ম কারও ইচ্ছার বিষয় নয় এবং এতে কারও হাত নেই।

পৃথিবীতে কি এমন কোন জাতির অস্তিত্ব সম্ভব যাদের রক্তে অন্য কোন জাতির রক্তের সংমিশ্রণ নেই? এর উত্তর এক কথায় হবে ‘না’। পরম বিশুদ্ধ জাতি বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। পরমভাবে ‘জাতি’ বলেও কোন কিছু নেই। সমগ্র মানবজাতির উৎস হিসেবে তিনটি মহাজাতিকে বিবেচনা করা হয়- ককেশীয়, নিগ্রো ও মঙ্গোলীয়। এ তিনটি মহাজাতির গোড়াও আবার সুদুর অতীতে গিয়ে এক হয়ে যায়। আসলে জাতীয়তার বড়াইটা খুবই দূর্বল ভিত্তির উপর টিকে থাকে। আরেকটা প্রশ্ন হল, জাতিগত বিশুদ্ধতা ধরে রাখা কিংবা জাতীয় সত্ত্বাকে দীর্ঘকাল বাঁচিয়ে রাখার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি? আজ মানব সভ্যতা এমন এক পর্যায়ে চলে এসেছে যেখানে জাতিগত সংকীর্ণতা জীবনের পথে একটি বাঁধা হিসেবে দেখা দিয়েছে।


চিত্র: ১৯৪৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মানচিত্র

দুনিয়ার সব জাতি যদি একাকার হয়ে যায় তাহলে তাতে কি কোন সমস্যা আছে? এতে কোন সমস্যা তো নেই-ই বরং তা পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। সভ্যতা আসলে সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। তবে তা মোটেও এক জাতির উপর আরেক জাতির আধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে নয় বরং প্রত্যেকের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের চূড়ান্ত বিকাশের মধ্য দিয়েই সম্ভব। অতীতে যতগুলো প্রাচীন জাতির অস্তিত্ব ছিল তার অধিকাংশই আজ বিলুপ্ত। আজ আর সেই প্রাচীন জাতিভিত্তিক সাম্রাজ্যগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই। যেসব জাতি গড়ে তুলেছিল সিন্ধু সভ্যতা, মিসরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা, ইজিয়ান সভ্যতা - তারা কি আজ আর টিকে আছে? তারা হারিয়ে গেছে কালের আবর্তে। আসলে তারা হারিয়ে যায়নি। বরং তারা আজও টিকে রয়েছে এসব অঞ্চলের ভূমিসন্তানদের মধ্যে - আজকের নানান জাতিগুলোর মধ্যে। এভাবে পৃথিবী থেকে জাতিসত্ত্বার বিলুপ্তিতেই জন্ম নেয় নতুন জাতিসত্ত্বা। প্রাচীন জাতিগুলোর উত্তরাধিকারই হল আজকের জাতিগুলো। এরাও একদিন হারিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এতে কোন সমস্যা নেই। বরং এটাই হওয়া উচিত।

তাহলে ইহুদি জাতিটার পৃথিবীতে এতদিন ধরে টিকে থাকার আদৌ কি কোন প্রয়োজন ছিল যেখানে প্রাচীন আমলের তাদের সমসাময়িক জাতিগুলোর একটাও আর স্বরূপে নেই? এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর কখনও পাওয়া যাবে না। প্রাচীন সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয়, ক্যালদীয়, মিডীয়, হিট্টীয় ইত্যাদি জাতির ইতিহাস থেকে বিলুপ্তি মানব জাতির জন্য কোন ক্ষতির কারণ হয়নি। তাহলে কেন ইহুদি জাতিটির এই টিকে থাকা? এর কারণ হল অন্য জাতিগুলো নতুন জাতিতে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু ইষ্রার বিধান ইহুদিদের জাতিসত্ত্বাকে বিলুপ্ত হতে দেয়নি। কিন্তু তা পৃথিবীর জন্য কোন মঙ্গলজনক বিষয় হয়ে ওঠেনি। ইতিহাস সেটাই প্রমাণ করেছে।

ইষ্রা এটি কেন করেছিলেন? তার কারণ তিনি চেয়েছিলেন ইহুদিদের ওপর যাজকতন্ত্রের নিরংকুশ আধিপত্য ও দাপট। এই যাজকতন্ত্র কোন অংশেই রাজতন্ত্র থেকে কম যায় না। ইতিহাসের বিশাল অংশ জুড়ে আমরা খ্রিস্টধর্মীয় যাজকতন্ত্রের দাপট দেখতে পাই। এর আদি সংস্করণটি হল এই ইহুদি যাজকতন্ত্র। যাজকতন্ত্র ধর্মকে নিয়ে গেছে প্রাণহীন আচারসর্বস্বতার দিকে। সৃষ্টিকর্তার নামে করেছে নোংরা ধর্মব্যবসা। মধ্যযুগে সৃষ্টিকর্তার নামে যাজকতন্ত্র খেটে খাওয়া মানুষের ঘাড়ে চাপিয়েছে করের বোঝা। যাজকতন্ত্র নিজেদের অনুশাসন দৃঢ় করার জন্য স্রষ্টার নামে অসংখ্যবার মনগড়া বিধান চাপিয়েছে জনসাধারণের ওপরে। এভাবে যাজকতন্ত্র বারবার বিসর্জন দিয়েছে একত্ববাদের মূল চেতনা; হয়ে উঠেছে আর্থ-সামাজিক শোষণ প্রক্রিয়ার সহায়ক শক্তি।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৫৮
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×