সকাল ১২ টা ৪৫ মিনিট প্রলয় দ্যা’র রুমের সামনে শিশির ও মুবিদ ।
ব্যাচলর ফ্ল্যাটের ঘড়িতে এই সময় ই সকাল হয় ।
আধাটা ঘণ্টা অপেক্ষার পর দরজা খোলে প্রলয় দ্যা । খুলতেই ঝাঁপিয়ে পরে দুইজন দাদা আবিরের বাকি গল্পটা বলো ।
কোন আবির? আমি কোন আবিরকে চিনি না । বেশ নিরাশ হয়েই দুইজন গত রাতের গল্পটা শুনায় প্রলয় দ্যা’কে ।
বেশ বিরক্ত নিয়েই বলে প্রলয় দ্যা – আসলে আবির আমাদের জীবনের একটা কালো অধ্যায়ের নাম।
সব সময় আবিরকে ভুলে থাকার ট্রাই করি আমরা কিন্তু কাল কি বলছি জানি না।
প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে প্রলয় দ্যা আবারও বলা শুরু করলো ।
সবাই ট্যূরে গিয়ে ট্যূরের অবিজ্ঞতা ভাগ করে নেয় সবার সাথে, কিন্তু আমার গল্পটা একটা অপূর্ণ ট্যূরের।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেকগুলো ট্যুর দিয়েছি, কখনও ক্লাবের বন্ধু তো কখনও ডিপার্টমেন্টের পাপীদের সাথে।
কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষের সেমিস্টার ব্রেকের অপূর্ণ সিলেট ট্যুরটা আজও মনে দাগ কাটে বারংবার ।
ফাইনালের দুই সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হয় ট্যুরের প্লানিং ।
টিউসনের অ্যান্টিকেও বলে দিয়েছিলাম সাত দিন আসা হবে না ।
নিউ মার্কেট থেকে দুইটা নতুন শর্টস ও কিনে ফেলেছিলাম বেশ কালারফুল দেখে, জাফলং এ গোসল করব বলে ।
সাত রঙ্গের চা খাবো বলে প্রাক্তনের দেয়া বক্সে মুড়ানো মগটাও বের করে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছিলাম।
দুপুর দুইটা বাজে তখন। রাতের গাড়িতে রওনা দেব আমারা কিন্তু টিকিট কাঁটা হয় নি তখনও।
কেন না তাজিন আর জুবু তখনও টাকা দেয় নি । ঝড়ের বেগে আনিকার আগমন ।
কিছু বুঝে উঠার আগেই ঠাডিয়ে এক থাপ্পড় আমাকে।
দুই চার মিনিটের জন্য গ্রাউন্ডের মধ্যমণি আমি। থাপ্পরের কারণ টাকা তোলার গুরু দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে।
পরিশেষে রাজিব লোন দিলো দুইজনকেই কিন্তু ট্যুর বাদ দেয়া যাবে না।
তিনটায় ক্লাস শেষ হওয়ার কথা থাকলেও-
আমি দুইটার সময় চুপিসারে ক্লাস থেকে বের হতে নেই-
কিন্তু পিছন থেকে আমজাদ স্যারের সেই মহান লাইন কানে ভেসে আসে “এই বেকুব কই যায়”?
ওয়াস রুম বলে তাড়াহুড়ো করে পাঠাও নিয়ে যাত্রাবাড়ি গিয়ে টিকিট কেটে আবারও তরিঘড়ি করে ক্যাম্পাসে ।
ইসিপিয়ের কন্সার্ট চলছিলো তখন প্রচণ্ড শব্দ পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে, বিরক্তির কারণ সেটা ছিল না, ছিল কেউ ফোন ধরছিল না।
অনেকক্ষণ পর ফোন ধরে আনিকা।
ঝাড়ি দিবই এমন সময় আবিষ্কার করলাম কাঁদছে আনিকা। জীবনে প্রথমবার তার কান্নার শব্দ শুনে কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
কাঁদতে কাঁদতে আনিকা বলে উঠলো কই তুই জলদি পঙ্গু হাসপাতাল আয়।
আবির দুইতলা থেকে পরে গেছে অনেক রক্ত বের হয়ে গেছে বুঝতেছি না কি হবে। জলদি আয়।
আমজাদ স্যারের ক্লাসে একসাথেই ছিলাম আমরা । ঘন্টাখানেক আগেও বান্দ্রামি করছিলো আবির ।
মূলত পুরো ট্যুরের প্ল্যান আনিকা আর আবিরই করছিলো । আমার এবং আনিকার কমন বন্ধু ছিল আবির ।
সাত পাঁচ না ভেবে রউনা দিলাম হাসপাতালের দিকে ।
শুনেছিলাম কেউ থাকে না আবিরের ঢাকাতে গেলে একটু হেল্প হবে যাই, কিন্তু একটু তাও আনিকার বন্ধু বলে ।
হাসপাতালের সামনে গিয়ে আনিকাকে ফোন দিলে চার তলা অপারেশন থিয়েটারের সামনের ওয়ার্ডে যেতে বলে ।
গিয়েই অবাক আমি । পুরো ওয়ার্ডে দশটার মতো রোগী ছিল।
সবার সাথেই একজন থেকে দুইজন ভিজিটর কিন্তু-
একটা বিছানার পাশে প্রায় ত্রিশ জনের মতো মানুষ ঘিরে ধরে ছিল এবং সেই মানুষটা আবির ।
এই ব্যাপারটা যতটা না অবাক করে ছিল-
তার চেয়ে বেশি অবাক করে ছিল অনবরত রক্ত ঝরছিল তার পা থেকে-
কিন্তু বেশ হাসছিল ছেলেটা যেন কিচ্ছু হয় নি, এবং হাঁসাচ্ছিল বাকি সবাইকে।
মোটামোটি সেই দিন থেকেই খুব ভালো লাগা কাজ করে আবিরের প্রতি।
দুই সপ্তাহ পঙ্গু তারপর একটা বেসরকারি হাসপাতালে দেড় মাস-
প্রায় প্রতিটা দিন গিয়ে ছিলাম ছেলেটাকে দেখতে কেন তা জানি না ।
তারপর গ্রামে নিয়ে যায় তার পরিবারের লোকজন ।
কিন্তু কথা খুব কম বলতে পারতাম তার সাথে ।
কেন না দেড় মাসের একটা দিন দেখি নি সে একা আছে-
সব সময় দেখতাম আট দশ জনের দল তাকে ঘিরে থাকতো তাকে।
কখনও তার বিছানার সামনে বসতো বিতর্কের আসর-
তো কখনও তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে হাসপাতালের ছাঁদে নিয়ে বসতো গানের আসর, গিটার তবলাও থাকতো আসরে।
দেড়টা মাসে একটা জিনিষ খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি যে ছেলেটা বেশ দ্রুত আপন করে নিতে পারত সবাই কে ।
বলা শেষ করে একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে বুঝতে পারলো প্যাকেট মোটামোটি খালি ।
শেষ সিগারেট টা মুখে নিয়ে বেশ রাগ নিয়ে বলল প্রলয় দ্যা।
তবে অনেক পরে হলেও বুঝি আবিরের সাথে বন্ধুত্বটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ।
কেউ কামাল মামার দোকান থেকে আমার নাম বলে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয় যা,
প্রলয় দ্যা’ র রাগের সাথে আবিরের গল্পের কোন মিল না পাওয়াতে-
আবিরের গল্পের প্রতি একটা মাদকতা সৃষ্টি করে দিলো দুই জনের মনেই ।
উফ প্রলয় দ্যা কিচ্ছু বুঝি নি, মাথার উপর দিয়ে গেল পুরো ব্যাপারটা,
কে আনিকা ? রাজিব কে ? কিসের ডিবেট ? কিসের গান ? একটু খুলে বলবে পুরো ব্যাপারটা প্লিজ প্রলয় দ্যা ?
উফ খুব বিরক্ত করিস তোরা, দে আগে সিগারেটের প্যাকেটটা দে আমাকে ।
জ্বলন্ত সিগারেট মুখে নিয়ে গোসলে চলে গেলো প্রলয় দ্যা আর একটা কথা না বলেই ।
গত সপ্তাহ থেকে কোন একটা বিষয় নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলেন প্রলয় দ্যা ।
কে বা কারা যেন প্রতিদিন ফোন দিত আর ফোন পেলেই মন খারাপ থাকতো প্রলয় দ্যা’র ।
গোসলখানায় ফোন নিয়ে যেত প্রলয় দ্যা সব সময়।
মনে হল কে কার সাথে যেন গোসলখানার ভিতরেই কথা বলছিল প্রলয় দ্যা ।
সেদিনের মতো চলে গেলো দুইজন কেন না সামনে পরীক্ষা ছিল তাদের তাও সেমিস্টার ফাইনাল ।
অন্যান্য পর্ব সমূহ
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ১০:৩১