
এই অন্তর্বর্তী সরকার রহস্যময় বিষয়গুলো নিয়ে যে কীভাবে কাজ করছে, তা ভাবলে মাঝে মাঝে অবাক লাগে।
কয়েক শত বছর আগে অন্ধ্রপ্রদেশের এক গুহা থেকে উদ্ধার হয়েছিল একটি ছোট্ট পাথরের টুকরো। কিন্তু সেই পাথর থেকে এমন আলো নির্গত হচ্ছিল, যেন কোনো অলৌকিক দৃশ্য চোখের সামনে। এর নাম রাখা হয় ‘দরিয়া-ই-নূর’, অর্থ আলোর সমুদ্র।
দরিয়া-ই-নূর এক রহস্যময় হীরা, যা বাংলাদেশে থাকলেও কোনো বাংলাদেশি এখনো তা দেখেনি। ধারণা করা হয়, বিশ্বের মহামূল্যবান হীরা ‘কোহিনুর’ যেখান থেকে পাওয়া গিয়েছিল, সেখান থেকেই উদ্ধার হয়েছিল এই হীরা। এর মূল্য তাই অপরিসীম। ‘বাংলাদেশ অন রেকর্ড’ নামে একটি ডিজিটাল আর্কাইভ সংস্থার তথ্যমতে, দরিয়া-ই-নূর তার দীপ্তি ও স্বচ্ছতায় অতুলনীয়। এটি মিনাকরা সোনার ওপর বসানো একটি প্রথম শ্রেণির টেবিল কাট হীরা, যার চারপাশে ১০টি মুক্তা জড়ানো। এই তথ্যের প্রমাণ মেলে ১৮৫১ সালের ৩১ মে ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ’-এ প্রকাশিত একটি ছবিতে।
প্রথমে এই হীরা ছিল মারাঠা রাজাদের হাতে। পরে হায়দ্রাবাদের নবাবরা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় এটি কিনে নেন। কিন্তু তারাও বেশিদিন রাখতে পারেননি। হীরাটি চলে যায় পারস্য সম্রাটের কাছে। আশ্চর্যজনকভাবে, পারস্য সম্রাটের কাছ থেকেও হীরাটি হাতছাড়া হয় এবং পাঞ্জাবের রাজা রনজিৎ সিং তা দখল করেন।
১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা পাঞ্জাব দখল করলে রনজিৎ সিংয়ের কোষাগার থেকে কোহিনুর ও দরিয়া-ই-নূর লুট করে নেয়। ব্রিটিশরাই প্রথম এই হীরার ঐতিহাসিক গতিপথ নথিভুক্ত করেন। ১৮৫০ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার সম্মানে হীরাটি কোহিনুরের সঙ্গে লন্ডনে পাঠানো হয়। কিন্তু ব্রিটিশ রাজপরিবার কোহিনুরের প্রতি আগ্রহী হলেও দরিয়া-ই-নূরের ব্যাপারে তাদের উৎসাহ ছিল কম। ফলে ১৮৫২ সালে কলকাতার হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানি হীরাটি নিলামে তোলে। সেই নিলামে উপস্থিত ছিলেন ঢাকার নবাব খাজা আলিমুল্লাহ, যিনি হীরাটি কিনে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন থেকে এটি ঢাকার নবাব পরিবারের কাছে ছিল।
রহস্যের শুরু ১৯০৮ সালে। তখন নবাব পরিবার আর্থিক সংকটে পড়ে আসাম সরকার থেকে ১৪ লাখ টাকা ঋণ নেয়। বন্ধক হিসেবে ১০৯টি মূল্যবান রত্ন, যার মধ্যে ছিল দরিয়া-ই-নূর, আসাম সরকারের কাছে রাখতে হয়। সেই ঋণ আজও শোধ হয়নি, তাই হীরাটি আর ফিরে আসেনি।
বন্ধক থাকায় হীরাটি সরকারি ব্যাংকের ভল্টে চলে যায়। প্রথমে ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার কাছে থাকলেও, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এটি স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর হীরাটি সোনালী ব্যাংকের ভল্টে আসে।
কিন্তু রহস্য এখানেই। ১৯০৮ সালে বন্ধক দেয়ার পর থেকে গত ১১৭ বছরে দরিয়া-ই-নূর আর কেউ দেখেনি। সোনালী ব্যাংকের ভল্টে এটি আদৌ আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার পর সরকারি বিভাগগুলোর স্থানান্তরের হিসেবে, দরিয়া-ই-নূরের দায়িত্ব এখন ভূমি মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হীরাটির অস্তিত্ব যাচাইয়ের কোনো উদ্যোগ সফল হয়নি।
ধারণা করা হচ্ছিল, দরিয়া-ই-নূর অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। কিন্তু ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সোনালী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, প্রায় ১০ বছর আগে মতিঝিল শাখায় ‘দরিয়া-ই-নূর’ লেখা একটি প্যাকেট গোপনে স্থানান্তর করা হয়েছিল। ভূমি মন্ত্রণালয়ের রেকর্ডও এই তথ্যের সঙ্গে মিলে। তাদের তথ্যমতে, নবাব পরিবারের সম্পত্তি সদরঘাট শাখায় থাকলেও, ২০১১ সালে নিরাপত্তার কারণে তা মতিঝিল শাখায় সরানো হয়।
তাহলে কি দরিয়া-ই-নূর এখনো ঢাকায় আছে?
অন্তর্বর্তী সরকার এই রহস্য উন্মোচনের উদ্যোগ নিয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় হীরাটির অস্তিত্ব খুঁজতে তৎপর। তবে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ এই হীরা দেখেনি, এমনকি ১১৭ বছর ধরে এটি বাক্স থেকে খোলা হয়নি।
এখানে একটি মজার টুইস্ট। ২০১৮ সালে প্রথম আলোতে দরিয়া-ই-নূরের ইতিহাস নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন এক ব্যক্তি। তিনি হীরার রহস্যময় গল্প তুলে ধরে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর সেই ব্যক্তিই অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন।
কালের কন্ঠে প্রকাশিত সংবাদ
লিংক
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১২:২১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



