somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রংপুরের তিন সাহসী উকিল

২৪ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ক্ষুদিরাম বসুর কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু ক্ষুদিরামের সাথে রংপুরে যোগ সূত্র রয়েছে যা সত্যিই গর্ব করার মতো। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠা ইংরেজ বিরোধী প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলন।




১৯০৭ সালের শেষের দিকে সারা দেশে শুরু হয় ব্রিটিশ শাসক আর সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের সংঘর্ষ, ধরপাকড় আর নির্যাতন। স্বাধীনতাকামী বিপ্লববাদী দলগুলোকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠে। একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে নিয়ে যেয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে তাঁদের উপর চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন। কলকাতার তদানীন্তন চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড ছিল বর্বর, বিবেকহীন, অত্যাচারী এক নর পিশাচ। বাংলার সবচেয়ে কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট এই কিংসফোর্ড। তাই বিপ্লবী দলের সুবোধ মল্লিক, হেমচন্দ্র, চারু দত্ত, বারীন ঘোষ ও অরবিন্দ সিদ্ধান্ত নিলেন কিংসফোর্ডকে হত্যা করার। এই অপারেশনের দায়িত্ব পড়লো দুই তরুণের উপরে। যাদের একজন মাত্র ১৯ বছরের এক তরতাজা তরুণ মেদিনীপুরের ক্ষুদিরাম বসু এবং অপর জন প্রফুল্ল চাকী যিনি ক্ষুদিরামের থেকে সামান্য বড়। এই প্রফুল্ল চাকীর স্মৃতিধন্য আমাদের প্রাণপ্রিয় রংপুর।

১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল রাত আটটায় কিংসফোর্ডকে হত্যার সুযোগ পান তাঁরা । সেই রাতের অন্ধকারের মধ্যে অ্যামবুশ করে ছিলেন তাঁরা । অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর কিংসফোর্ডের গাড়ি ইউরোপিয়ান ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাঁরা ওই গাড়িকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারেন হাত বোমাটি। প্রচণ্ড শব্দে বোমাটি ফাটে গাড়ির উপর। ভারতের বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে বিদেশী শক্তির উপর এটাই ছিল প্রথম বোমা হামলা। হামলার নায়ক ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল কাজ শেষ করে ছুটতে থাকে। কিন্তু তখনও তারা জানে না ভুলবশত বোমা গিয়ে যে গাড়িতে পড়েছে সেই ফিটন গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। ছিলেন কেনেডি নাম্নী একজন ইউরোপীয় মহিলা ও তার কন্যা সন্তান যারা বোমার আঘাতে মৃত্যুবরণ করে ঘটনাস্থলেই।


ঘটনার পরে ক্ষুদিরাম রেল লাইনের পাশ ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে পাড়ি দেন প্রায় ২৪ মাইল পথ। সারা রাত এভাবে ছুটে চলার পর ভোরে পৌঁছে যান ওয়েইনি রেল ষ্টেশনের কাছে। কিশোর ক্ষুদিরাম ভেবেছিল বিপদ কেটে গেছে। সারা রাতের ধকল সামলানোর জন্য কিছু খেতে ঢুকে পড়েন একটা রেস্তোরায়। সেখানেই কয়েকজন পুলিশের খপ্পরে পড়ে যান ক্ষুদিরাম। পিস্তল দিয়ে নিজেকে গুলি করার আগেই ধরা পড়ে যান ক্ষুদিরাম।



এদিকে ক্লান্ত শ্রান্ত প্রফুল্ল চাকী ট্রেনে উঠলেন কলকাতা যাবার জন্য। সে রাতেই (০১ মে ১৯০৮ ইং) তিনিও ধরা পরে গেলেন কুখ্যাত নন্দলাল দারোগার কাছে। মামলায় নির্ঘাত ফাঁসী হবে তাই আত্মসমর্পণের আগেই নিজের গলায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। হয়ে যান ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলার প্রথম প্রকাশ্য শহীদ।
মজফফরপুর সেশন আদালতে ক্ষুদিরামের বিচার কাজ শুরু হলো ০৮ জুন ১৯০৮ইং। কিন্তু সারা পশ্চিম বাংলা থেকে কোন আইনজীবী মামলায় আসামী পক্ষের হয়ে কোন আইনজীবী আদালতে দাঁড়াতে সাহস পাননি। তখন পূর্ব বঙ্গ থেকে রংপুর বারের উকিল বাবু সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, বাবু কুলকমল সেন ও বাবু নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী ক্ষুদিরামের পক্ষে মামলায় সহযোগীতায় এগিয়ে আসেন। বিচার শুরুর কয়েকদিন আগেই তাঁরা মজফফরপুর চলে যান। ইতোমধ্যে বিচারক করন্ডারফের অনুরোধে কালিদাস বসু নামে স্থানীয় এক আইনজীবী এগিয়ে আসেন আসামী পক্ষের হয়ে। ৮-১৩ জুন চললো দায়রা বিচার। বিচারের শুরুতেই ক্ষুদিরাম স্বীকারোক্তি প্রদান করেন। কিন্তু দায়রা জজ এই স্বীকারোক্তিকে এড়িয়ে আদালতের প্রচলিত নিয়মেই বিচার করা হবে মর্মে ঘোষণা দিলেন। রংপুর থেকে যাওয়া তিন আইনজীবী বাবু সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, বাবু কুলকমল সেন ও বাবু নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী দুই দিন সরকারী সাক্ষীদের জেরা করেন। কিন্তু ক্ষুদিরাম তখন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে নিজেকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। রংপুর থেকে যাওয়া আইনজীবীদের তিনি সহযোগিতা করেননি।

সেসময় তাঁর সাথে রংপুর থেকে যাওয়া উকিলদের মধ্যে একটি সংলাপ

উকিল : তুমি কি কাউকে দেখতে চাও?
ক্ষুদিরাম : হ্যাঁ, আমি একবার মেদিনীপুর দেখতে চাই, আমার দিদি আর তাঁর ছেলেপুলেদের।
উকিল : তোমার মনে কি কোন কষ্ট আছে ?
ক্ষুদিরাম : না, একেবারেই নয়।
উকিল : আত্মীয় স্বজনকে কোন কথা জানাতে চাও কি? অথবা কেউ তোমার সাহায্য করুণ এমন ইচ্ছা হয় কি?
ক্ষুদিরাম : না, আমার কোন ইচ্ছাই তাঁদের জানাবার নেই। তাঁরা যদি ইচ্ছা করেন আসতে পারেন।
উকিল : জেলে তোমার সাথে কি রকম ব্যবহার করা হয়?
ক্ষুদিরাম : মোটামুটি ভালোই।উকিল : তোমার কি ভয় করছে?
ক্ষুদিরাম : (স্মিতহাস্যে) ভয় করবে কেন?
উকিল : তুমি কি জানো আমরা রংপুর থেকে তোমারকে সাহায্য করতে এসেছি? কিন্তু তুমি তো আমাদের আসার আগেই দোষ স্বীকার করেছো।
ক্ষুদিরাম : (স্মিতহাস্যে) কেন করবো না?

এই সংলাপ প্রমাণ করে ক্ষুদিরাম নিজের প্রাণ রক্ষায় খুবই নিঃস্পৃহ ছিলেন।

মামলার উকিলরা সওয়াল জবাবকালে যুক্তি দেখিয়েছিলেন এই ঘটনার সময় ক্ষুদিরামের গায়ে একটা ভারী কুর্তা, কোর্ট, দুইটি পিস্তল এবং বেশ কিছু কার্তুজ ছিল তাই ঐ পরিমাণ ওজন নিয়ে তাঁর পক্ষে এতো ক্ষিপ্রতার সাথে বোমা ছুঁড়ে মারা সম্ভব নাও হতে পারে। তাছাড়া দীনেশ (প্রফুল্ল চাকীর ডাক নাম) ক্ষুদিরামের থেকে বলিষ্ঠ গড়নের এবং বোমা বানানো জানতো সে। তাই বোমাটি প্রফুল্ল চাকীর পক্ষেই ছোঁড়ার সম্ভাবনা বেশী। প্রফুল্লের আত্মহত্যাও এই দিকেই ইঙ্গিত করে। কেননা সে জানতো সে দোষী। আর দোষী বলেই ধরা পড়লে সাথে সাথে আত্মহত্যা করে সে। সুতরাং পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করলে ক্ষুদিরামের পক্ষে সন্দেহের অবকাশ (Benifit of doubt) থেকেই যায়। কিন্তু সব কিছু বৃথা যায়। বৃথা যায় রংপুর থেকে মামলায় লড়তে যাওয়া আইনজীবীদের তৎপরতা। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ভোর ৪টায় মজফফরপুর জেলের ভিতরে ক্ষুদিরামের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। মাত্র ১৯ বছর বয়সী এই কিশোর হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন জীবনের জয়গান। রচিত হয় ইতিহাস।

সারা পশ্চিম বাংলা থেকে কোন আইনজীবী মামলায় আসামী পক্ষের হয়ে কোন আইনজীবী আদালতে দাঁড়াতে সাহস পাননি। অথচ, অত্যন্ত প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও মজফফরপুরে গিয়ে এই কিশোরের পক্ষে আইনি লড়াই করেছিলেন রংপুর বারের তিন সাহসী আইনজীবী বাবু সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, বাবু কুলকমল সেন ও বাবু নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী। এই ঐতিহাসিক ঘটনা নিঃসন্দেহে রংপুরের গর্বের বিষয়। এছাড়া ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলার প্রথম প্রকাশ্য শহীদ অগ্নিযুগের বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীরও স্মৃতিধন্য রংপুর। এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের বেশ কিছু সময় এবং তাঁর রাজনৈতিক হাতেখড়িও হয় রংপুর জিলা স্কুলে পড়ার সময়। 

ক্ষুদিরাম বসুর মামলা পরিচালনায় রংপুরের তিন সাহসী উকিল এর নাম অনেকের কাছে অজানা ছিলো এতোদিন । দেশ ভক্ত ক্ষুদিরাম বসুর জীবন উৎসর্গের ইতিহাস জানার পাশাপাশি সেই তিন সাহসী আইনজীবী বাবু সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, বাবু কুলকমল সেন ও বাবু নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী কেও মানুষ জানতে পারবে ।

তথ্য সূত্র : রাজনীতি আমার জীবন : কাজী মোহাম্মদ এহিয়া , রিয়াদ আনোয়ার শুভ
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১:৩৬
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×