somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হারু , ভাগ্যবিড়ম্বিত এক বেজন্মা !

২৩ শে জুন, ২০১০ দুপুর ২:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত আনুমানিক তিনটা। ধড়ফড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠে হারু মিয়া। ইদানীং সে একটা দু:স্বপ্ন দেখছে। দু:স্বপ্ন দেখে প্রতিরাতেই তার ঘুম ভাঙে, বাকীটা সময় সে নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়। পানির খোঁজে চারিদেকে হাতড়ায়, এক ঢোক পানি খেয়েই রেখে দেয় বাকিটা। পানিও এখন তার কাছে বিস্বাদ লাগে।

হারু মিয়া থাকে মহাখালী রেলগেট বস্তিতে। ছোট্ট একটা খুপড়ির ভিতর। এটার ভাড়া বাবদ তাকে প্রতিমাসে ১০০ টাকা গুণতে হয়। তার পেশা ভিক্ষাবৃত্তি। এক পা হারিয়েছে অনেক আগেই। আর এক পা এখন থেকেও নেই। তাই সারাদিন ওই মহাখালী রেলক্রসিংয়ের পাশে বসেই সে তার ভিক্ষা করে যায়। এইতো কয়েকদিন আগেও সে ক্রাচে ভর দিয়ে জ্যামে আটকে থাকা গাড়িগুলোর পাশে গিয়ে ভিক্ষা চেতে পারত। আয়ও একদম খারাপ হত না। কিন্তু এখন ? বসে বসে আর কটাকাই বা ভিক্ষা পাওয়া যায়? তার চারিদিকের পরিধি দিনে দিনে ক্ষুদ্র হয়ে আসছে। মৃত্যুর ভয় হারুর কোনোদিনও ছিল না। কিন্তু তার একটাই চিন্তা, সে মারা গেলে তার লাশটি কুকুরে খাবে নাতো ? পরক্ষণেই সে আবার হাসে। হলেও হতে পারে। অসম্ভব কি?

বিকেলের পর সে তার খুপড়ি ঘরে চলে আসে। শরীর আর সায় দেয় না। এখন সে তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করে সময় পার করে দেয়। কখনও হাসে, কখনও কাঁদে। আবার কখনও বা কি এক অন্ধ আক্রোশে চোখে অন্ধকার দেখে। তখন তার ইচ্ছা করে উদভ্রান্তের মত কোন দিকে চলে যেতে। চলে যাওয়ার কথা মনে পড়লেই প্রথমে মনে হয় তার পায়ের কথা। যেটা সে হারিয়ে ছিল ১৯৭১ সালে। না সে মুক্তিযোদ্ধা না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেই তার পা হারিয়েছে, তাও পাক সেনাদের গুলিতে। সে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা কোনদিনই দাবি করেনি। মুক্তিযুদ্ধ করেও সে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেনি। আজন্মই ভাগ্য এই হারুর সাথে বেইমানি করে এসেছে।

আর নয়, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসে, সৈনিক জীবনের প্রথম অপারেশনেই সে তার পা হারাবে কেন? ট্রেনিংয়ের জন্য বাড়ি ছাড়ার এক সপ্তাহ পরই কেন শুনতে হবে যে তার অসুস্থ বাবা মারা গেছে ? কেন শুনতে হবে তার মা আর ৮ বছর বয়সের ছোট বোনটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে? তাও একই সাথে? ছোট ওই মেয়ের সামনে মাকে আর মায়ের সামনে মেয়েকে ?

মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ২০। টগবগে এক বোকাটে ধরনের তরুণ ছিল হারু। হারুর স্পষ্ট খেয়াল আছে, সে যখন বাড়ি ছাড়ে তার মা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিল। আর চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রু বর্ষিত হচ্ছিল। আর বাবা সেতো আগে থেকেই বিছানায় পড়েছিলেন। ছোট বোনটা কিছুতেই ভাইয়ের জামার খুট ছাড়ছিল না। সেই সব দিনের কথা হারু ভুলবে কি করে ? সেই মমতাময়ী মা, সেই আদরের ছোট বোনটা....... তাদেরকে নিয়েই হারুর দু:স্বপ্ন। সে তার স্বপ্নে দেখে কিছু অদ্ভুত কিন্তু ভৌতিক সরিসৃপ জাতীয় পদার্থ কিলবিল করে তার মা আর ছোট বোনের গা বেয়ে উঠে যাচ্ছে। আর জায়গায় জায়গায় ঠোকর দিচ্ছে। সে অনেক চেষ্টা করছে সেগুলোকে তাড়াতে। পা দিয়ে লাথি মারছে, কিন্তু পারছে না। সে তার পায়ে কোনো সাড়া পায় না....এটুকু দেখেই সে ধড়ফড় করে উঠে যায়। আর পায়ের দিকে হাত চলে যায়। কিন্তু, সেখানে তো পা নেই। বা পায়ের সেই জায়গাটুকুতো খালি। হায় বিধি ! স্বপ্নের মাঝেও ভাগ্যের প্রতারণা !

হারু মুক্তিযুদ্ধের পর তার গ্রামে ফিরে গিয়েছিল একটি মাত্র আশা নিয়ে। তার মা আর বোনকে যারা ধর্ষণ করেছিল এবং তারপর নির্মমভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল, তাদের বিচারের প্রত্যাশায়। কিন্তু গ্রামে এসে দেখে কি আমূল পরিবর্তন। রাজাকার রা সব ভোল পাল্টে মুক্তিযোদ্ধা বনে গিয়েছে। গ্রাম ছাড়ার সময় যাকে দেখে গিয়েছিল শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে, সে কিনা এখন পুরোদস্তুর মুক্তিযোদ্ধা। এমনকি তার বাড়িতে অনেক সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা আসে দেশ নিয়ে আলাপ করার জন্য। তারপরও সে চেষ্টা করেছিল সেই রাজাকারদের বিরুদ্ধে কিছু করতে। কিন্তু এই পাপের (!) প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতে হল তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভিটা আর জমিটুকু ছেড়ে দিয়ে। এমনকি গ্রাম থেকে পর্যন্ত তাকে বের করে দেয়া হল চুরির অপবাদ দিয়ে। এমনই এক ভাগ্যবিড়ম্বিত বোকাটে ধরনের মানুষ হারু। পঙ্গু এবং অসহায়। পাড়ি জমায় ঢাকার উদ্দেশ্যে।

ঢাকায় এসে হারু এখানে ওখানে-অনেক কাজ খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু কে দেবে তাকে কাজ ? একেতো যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশ, তার উপর সে হল পঙ্গু। নাহ, ভাগ্য এখানেও তার সাথে বেইমানি করল। নানা জায়গায় হোঁচট খেয়ে শেষে হারু সিদ্ধান্ত নিল সে ভিক্ষা করবে। সেই শুরু। এভাবেই কেটে যেতে থাকে হারুর জীবন। কিন্তু সেই দু:স্বপ্নটা ? যেটা দেখে হারুর প্রতিরাতে ঘুম ভেঙে যায় ? কেন দেখে সেই স্বপ্ন ? মাথার পাশ দিয়ে বিকট বিশ্রী শব্দ করে রাত-দুপুরে যখন ট্রেন চলে যায়, তখনও তো হারুর ঘুম ভাঙে না ? তবে এখন কেন?

এইতো কদিন আগের কথা। প্রতিদিনের মত সেদিনও হারু রেলগেটে যায়। দু'হাত ক্রাচে ভর দিয়ে শুরু করে তার জীবিকা নির্বাহ। এ গাড়ি থেকে ও গাড়ি। ও গাড়ি থেকে অন্য আর এক গাড়ি। এমনই এক গাড়ির পাশে দাড়িয়ে হারু ভিক্ষা চাইছিল গ্লাসে হাতি দিয়ে। সাথে সাথেই দামী সেই গাড়ির গ্লাস নীচে নেমে গেল। গাড়ি থেকে মুখ বের করে দিয়ে সেই ভদ্রলোক বলল, " U bustard, গাড়িতে হাত দিয়েছিস কেন ? যতসব নোংরা লোকে দেশটা ভরে গেল !"আরও কি সব ইংরেজি গালি ! হারু অতসব বুঝে না। তবে একটি শব্দ সে খুব ভাল শুনতে পায়, কেননা সেটির অর্থ সে জানে। মনে পড়ে তার, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের টিম লিডার পাকিদেরকে বাস্টার্ড বলে সম্বোধন করত। পরে সে তার এক সহযোদ্ধার কাছ থেকে এর অর্থ জেনে নেয়। সেই থেকে হারু পাকিদেরকে বাস্টার্ড বলে সম্বোধন করে। আর আজ ? হায় বিধি! তুমি এই গরীবকে নিয়ে আর কত খেলা খেলবে ? হারু চোখে অন্ধকার দেখে, গাড়ির জোরালো হর্ণও তার ঘোর ভাঙাতে পারে না। যার পরিণামে অন্য একটি গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে ডান পা'টাও হারায়। সেই রাত থেকেই হারু তার দু:স্বপ্নটি দেখা শুরু করে। হায়রে দেশ, হায়রে দেশের নেতা..... হারু মুক্তিযোদ্ধা আজ বেজন্মা। এই দেশ, কেন জন্ম দিয়েছিস এই বেজন্মাকে ? যার জন্য ওই বুর্জোয়াগুলো দামী গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছে, সে হয়ে গেছে বেজন্মা, আর রাজাকার হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা ?

মহাখালী রেলগেট বস্তিতে অন্যদিনের মত আজও সকাল হয়। সকাল গড়িয়ে দুপুর। তারপর রাত । সেই ঝুপড়ির ভেতর আর কোন অসুস্থ লোকের কাতরানি শুনা যায় না। দু:স্বপ্ন দেখে কেউ ধড়ফড় করে উঠেও না। বাম পায়ের শূন্যস্থানে হাত দিয়ে কেউ আর দীর্ঘস্বাশ ফেলবে না। হ্যাঁ, বেজন্মাটা মারা গেছে। মরে গিয়ে একটা নোংরা মানুষ কমেছে। তবে এখনও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না, তার লাশের ব্যাপারে। বেজন্মাতো ! এই স্বাধীন দেশের মাটি কি এই বেজন্মাকে গ্রহণ করবে ? নাকি শিয়াল-কুকুর টানাটানি করে খুবলে খাবে ?

আচ্ছা এরকম আর কটা বেজন্মার কাতর ধ্বনি স্তব্ধ হলে ওই রাজাকারগুলার বিচার হবে? আর কতগুলো বসন্ত পার হলে হারু বেজন্মার আত্মা শান্তি পাবে ? আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে , বাংলাদেশের মানুষকে সেই গণহত্যা আর ধর্ষণের বিচার পেতে???
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১০ রাত ৮:৩৬
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×