somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরিত্রাণ

২২ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১০:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাথার পাশে ফোনটা বেজেই চলেছে।স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি রাত দু'টা সাঁইত্রিশ।ফোন রিসিভ করতেই ছোটজন বললো,"ভাইজান তুমি তাড়াতাড়ি স্কয়ার হসপিটালে চলে এসো।বাবার অবস্থা ভালো না"।

মাঝরাতে এরকম একটা খবর শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।মিনিট দশেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে।

তিন মাস আগেই মাত্রাতিরিক্ত নিকোটিনের প্রভাবে বাবার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে।ডাক্তার রিমুভার দিয়েছিলেন।বলেছিলেন যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করাতে,সবচেয়ে ভালো হয় বাইরে নিয়ে যেতে পারলে।হসপিটাল থেকে ফিরে বাবা মোটামুটি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন বলে আমরা আর তেমন একটা গুরুত্ব দেইনি।

হসপিটালে ঢুকতেই দেখি মা,ছোটজন আর হানিফ কাকা দাঁড়িয়ে আছেন।মা'র মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।চেহারায় একটা দিশেহারা ভাব এসে গেছে,অনবরত কেঁদেই চলেছেন।

আমি এগিয়ে গেলাম।ছোটজনের চেহারায় আতঙ্ক।হানিফ কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম,"অবস্থা কি কাকা?"

কাকা বললেন,"তুমি একটু আসো আমার সাথে"।

আমি থতমত খেয়ে গেলাম।ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে কি?বাবা মারা গেছেন?যদি মারা না যান তবে আমাকে আলাদা করে দূরে ডেকে কথা বলার কোন মানে হয়না।আমি গেলাম না।এখন মা'র কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে কথা বলার মানে হলো মা'র শোক বাড়িয়ে দেয়া।মা হয়তো ভেবেই বসবেন বাবা মারা গেছেন।

কাকাকে বললাম,"যা বলার এখানেই বলেন কাকা।আমরা সবরকম পরিস্থিতিই সামাল দিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত"।

হানিফ কাকা আমার দিকে শুকনো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।মনে হচ্ছে তিনি গুছিয়ে উঠতে পারছেন না কি বলবেন।

বাবাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।আগামী ছয় ঘন্টা তিনি অচেতন থাকবেন।আমি মাকে নিয়ে বাসার জন্য বের হলাম।ছোটজন থেকে গেল হসপিটালে।

রিক্সায় মা কোন সাড়াশব্দ করলেন না।একবার শুধু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,"শওকত,তোর আব্বা মনে হয় আর বাঁচবেন না"।

আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না।বড় ছেলে হিসেবে আমার উচিত উনাকে সান্ত্বনাসূচক কিছু বলা।বললাম,"মা আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন না।নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।ইনশাআল্লাহ্ উনি ভালো হয়ে যাবেন"।

মা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন।আমার ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে কাঁদি!মায়ের এমন অসহায় মুখ আমি কোনদিন দেখিনি।জনমদুঃখিনী একটা চেহারা।

দুপুরবেলা বাবাকে দেখতে গেলাম।উনার জ্ঞান ফিরেছে।কথাও বলতে পারছেন তবে খুব ধীরে ধীরে।ছোটজনকে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।সারারাত জেগে ছিল ছেলেটা।মুখটা শুকিয়ে গেছে এক রাতেই।

বাবা হাত ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন।তার মুখ হাসি হাসি।চেয়ার টেনে উনার বিছানার পাশে বসলাম।মনে হলো উনি কিছু বলতে চাচ্ছেন।আমি বললাম,"বাবা!কিছু বলবেন?"

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু ভাবলেন।তারপর বললেন,"আমাকে একটা সিগারেট খাওয়াতে পারবি শওকত?"

আমি যেন ঠিক বুঝিনি এমনভাবে বললাম,"হ্যাঁ?"

বললাম,"আমাকে একটা সিগারেট খাওয়াতে পারবি?তোর পকেটে সিগারেট আছে?থাকলে একটা দে,টানি।আর না থাকলে কিনে আন।খুব সিগারেট টানতে ইচ্ছে করছে।"

যে বাবাকে দেখতাম এক গাম্ভীর্যতায় মোড়ানো মুখ,যে বাবা বিনা প্রয়োজনে কারো সাথে বেশি কথা বলতেন না,যে বাবাকে দেখিনি কখনো কারো কাছে মাথা নত করতে,সেই বাবা আজ নিজের সন্তানের কাছে একটা সিগারেট চাইছেন।এমনভাবে চাইছেন যেন তিনি অতি দরিদ্র কেউ,যার একটা সিগারেট কেনারও সামর্থ্য নেই।

আমি ডাক্তারের সাথে কথা বললাম।ডাক্তার বললেন কোনভাবেই রোগীকে সিগারেট দেয়া যাবেনা।আমি বাবার দিকে পরাজিত মানুষের মতো তাকালাম।বাবা অসহায় ভিক্ষুকের মতো চেয়ে আছেন।তাঁর দৃষ্টিতে আমার প্রতি তীব্র ঘৃণা।আমি মাথা নিচু করে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলাম।

রাতে অপারেশনের কথা ছিল।বাবার দেরী সইলো না।বিকেল বেলাতেই তিনি চুপচাপ মরে গেলেন।সেই যে বাবা দুপুর বেলাতে সিগারেট না পাওয়াতে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন তারপর আর একটি কথাও বলেননি কারো সাথে।যে যাই জিজ্ঞেস করেছিল বাবা তার কোন উত্তর না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলেন।

রাত তিনটার মধ্যেই বাবাকে দাফন করা হলো।গোরস্হান থেকে ফেরার পথে সিগারেট ধরাতে যাবো এমন সময় বাবার অসহায় মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।তিনি যেন আমাকে ধিক্কার দিচ্ছেন!মৃত্যুর আগে তাঁর মাত্র একটা সিগারেটের আবদার আমি মেটাতে পারিনি।এখন কোন সাহসে নিজে সিগারেট ধরাচ্ছি?

সিগারেটটা প্যাকেটে ভরলাম।তারপর প্যাকেটটা রাস্তার পাশের ড্রেনে ফেলে দিলাম।আর না,আর কোনদিন না।

বাসার দিকে সোজা হাঁটা ধরলাম।অন্ধকার কমে আসছে।আরেকটু পরেই ভোর হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১০:২৪
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×