somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প – কালো ছাগলের ডিম:|:|

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
দৈনিক মগবাজার

১)

জানালা দিয়ে কুয়াশা দেখা যায়। কুয়াশার পর পেয়াজ রসুনের খেত। তার পরই মরিচ খেত। সেখানেই উপছে পড়ছে শীতের কোমল কুয়াশা। উঠোনের কোণে খোয়াড়ের মুরগীগুলো এখনো বের হয়নি। কনকনে শীতের সকালে নাইবা বের হলো। কিন্তু ওয়ামী ভাবছে মুরগীগুলো আজ কয়টা ডিম পেড়েছে? এ শীতের সকালে পেয়াজ মরিচ দিয়ে ডিম ভাজি করে পান্তা দিয়ে খাওয়া ওয়ামীর পুরোনো অভ্যাস। একসময় পাখির ডিম বেশ ভালোবাসতো ওয়ামী। কিন্তু দিন দিন পাখিগুলোর ডিম ছোট হয়ে আসছে। মাকে বলে কিছুদিন আগে পাকিস্তানী মুরগী কিনেছিলো বলেইতো আজ বড় বড় ডিম খেতে পারছে।

অবসর সময়ে জানালা দিয়ে বসে বসে মুরগীগুলোর বিচরণ দেখা ওয়ামীর অন্যতম প্রিয় মূহুর্ত। ছোট পায়ে হেলে দুলে চলা মুরগীগুলোকে দেখলে সোনার বাংলার কথা মনে পড়ে যায়। সোনাকে আগুনে পুড়িয়ে উঠালে যে বর্ণ ধারণ করে, মুরগীগুলোর গায়ের রং সেরকম। এক স্বর্ণালী আভায় মাটির উঠোনটা নূরের মতো জ্বলে উঠে। ওয়ামীর আনন্দের শেষ নাই। জানালার গ্রীল বেয়ে সে নূর ওয়ামীর চোখ মুখ উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিয়ে যায়।

ফোন বেজে উঠে ওয়ামীর। ও প্রান্ত থেকে প্রতিদিনের মতো আজও সে একই প্রশ্ন, “কয়টা পেড়েছে?” ওয়ামীর মনটা দুষ্টুমিতে ভরে উঠলো। “আমি কম্বলের নীচে। কিন্তু মনে হচ্ছে তোমার ঘাঁড় থেকে উম বেয়ে পড়ে আমাকে তাতিয়ে তুলছে। এখনো বিছানা ছাড়িনি। একটু পরই দেখবো কয়টা ডিম পেড়েছে। মা পেয়াজ, রসুন, মরিচ তুলতে গেছেন। চুলায় তেল গরম দিয়েছেন।”

(২)

ওয়ামী এখনো ডিম খায়নি শুনে তার একমাত্র প্রেমিকার মনে এক অচেনা বেদনার সুর অনুরনিত হলো। ক’দিন আগে আসমার জন্মদিন ছিলো। জন্মদিনে ওয়ামি তাকে একজোড়া পাকিস্তানী মুরগী উপহার দিয়েছিলো। এর আগের জন্মদিনে দিয়েছিলো পাকিস্তানী বোরকা। পাকিস্তানী বোরকা দেখতে সুন্দর। কোমরের দিকটা একেবারে শরীরের সাথে ফিটিং থাকে। ফিগারটা স্পষ্ট বুঝা যয়। বোরকা পরলেও একটি মেয়ের শরীর সম্পর্কে ধারণা নেয়া যায় খুব সহজে। পাকিস্তানী মুরগীর মতো পাকিস্তানী বোরকাও ওয়ামীর বেশ পছন্দের।

খোয়াড়ের দরজা খুলে হতাশায় ভেঙে পড়ে ওয়ামী। আজ মুরগীগুলো একটি ডিমও পাড়েনি। ভালো করে চেয়ে দেখলো মুরগীগুলোও নেই! বুকের বাম পাশে ব্যথা অনুভব করছে। অনেক জোরে মা’কে ডাকাডাকি করলেও মুখ দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না। বড়শিতে ধরা মাছের মতো ঠোঁট দু’টো নাড়িয়েই যাচ্ছে, কোন শব্দ হচ্ছে না। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে আসমাকে মেসেজ অপশনে গিয়ে লিখলো, “Dim nai, Murgio nai!” মেসেজটি পাঠিয়ে দিয়েই খোয়াড়ের দরজার মুখে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো ওয়ামী।

(৩)

আসমা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখের পানি ছাড়ছে। ওয়ামীর শোবার ঘরের এ জানালা ধরে দাঁড়িয়ে এমন কতদিন পাকিস্তানী মুরগীগুলোর চলন বলন দেখেছে, আজ শূন্য উঠোন খাঁ খাঁ করছে। উঠোনের যায়গায় উঠোন, খোয়াড়ের যায়গায় খোয়াড়, পেয়াজ রসুন আর মরিচের খেতও শীতের রোদ পড়ে ছেয়ে গেছে… কেবল মুরগীগুলো নেই! আসমা বুঝতে পারছে ওয়ামীর মনের অবস্থা খুব খারাপ। এ ধকল সামলে উঠতে অনেকদিন লাগবে।

সকাল থেকে কিছুই খায়নি ওয়ামী। আসমা বাজারে গিয়ে ফিরে আসলো। বাজারে কোন ডিম নেই। সব ডিম কে যেন কিনে নিয়ে গেছে। ডিমের শূন্য খাঁচার দিকে তাকিয়ে ঢুঁকরে কেঁদে উঠেছিলো আসমা। মুখ চেপে ধরে হবু স্বামীর বাড়ি ফিরে এসে পুরো ঘর খুঁজে একটি টিকটিকর ডিমও খুঁজে পায়নি সে। পুত্রশোকে ওয়ামীর মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। এখন তার মাথায় পানি ঢালছে প্রতিবেশীরা। জ্ঞান ফিরে পেয়েই আসমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ডিম পেয়েছিসরে মা?” আসমা কোন জবাব দিতে পারেনি। তার কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেলো। মা আর বৌয়ের কান্না দেখে প্রতিবেশীরাও চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি।

এমন বিপদের সময় ওয়ামীর বাবাও কাছে নেই। ৪০ বছর আগের কিছু ভুল নিয়ে মামলা খেয়ে এখন জেলে আছেন। ডিমের প্রতি আসমার হবু শশুরেরও আগ্রহের শেষ নেই। সবধরনের ডিমের প্রতি তার আগ্রহ ছিলো দেখার মতো। সবকিছু আয়নার মতো ভাসছে আসমার চোখের সামনে। চোখের জল কমে আসলেও নাক ফুলিয়ে এখনো কান্না করছে ওয়ামীর হবু বৌ।

কোনমতে পেয়াজ, রসুন আর মরিচ ভাজি দিয়ে শাশুড়ী, স্বামীকে নিয়ে দু’টো খেয়ে এখন বসে বসে ওয়ামীর গায়ে তেল মালিশ করছে আসমা। বিয়ের আগেই স্বামীসেবা করার সুযোগ পেয়ে আসমার খুশীর শেষ নেই। কান্না করতে করতে ফুলিয়ে ফেলা চোখ দুটোর ভেতরে কত যে উচ্ছ্বাস চেপে আছে, ওয়ামী কি তা টের পাচ্ছে? এ প্রশ্নটি বারবার আসমার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাত হতে চললো। বিয়ের আগে শশুর বাড়িতে রাত কাটালে কলংক রটতে পারে। আসমা এখন বাড়ি ফিরে যাবে।

(৪)

একটি পুরোনো রেল স্টেশন। মরচে পড়া টিনের ফলকে লেখা “লাহোর জংশন”। সবকিছু কেমন যেন পরিত্যক্ত। শীতের কনকনে বাতাসে মাঝে মধ্যে দু’একটি শুকনো পাতা ওয়ামীর সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। পাশে পড়ে আছে কয়েকটি ছেঁড়া বোরকা। একটি বোরকা অবিকল আসমার বোরকার মতো। ডানে বাঁয়ে সরে কাউকে দেখতে পায় না ওয়ামী। দক্ষিণ দিকে চেয়ে দেখে একটি কালো বর্ণের ছাগল এদিকে আসছে। কাছে এসে ওয়ামীকে ইশারা করলো পেছনে পেছনে হাঁটতে।

ওয়ামী ছাগলের পেছনে পেছনে হাঁটছে। ওয়ামীর পেছনে শুকনো পাতাগুলো উড়ছে। কানে বাজছে হারিয়ে যাওয়া মুরগীগুলো গুনগুন ডাক। রেল লাইনের দু’ধারের কাশবন আগুনে পুড়ে গেছে। দূরের গম খেত থেকে উড়ে আসছে ছাই। কিছুদূর পরপর ল্যাম্পপোস্টে ঝুলে আছে মানুষের কংকাল। প্রায় ২০ মিনিট ধরে হাঁটছে। পেছনে তাকিয়ে আর কিছু দেখতে পায় না, মনে হচ্ছে অনেকদূর চলে এসেছে। জংশনের নামগন্ধও নেই।

(শেষ)

বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে ওয়ামী। বিস্তৃর্ণ মাঠজুড়ে তেলতেলে কালো বর্ণের ছাগলরা কেউ গান গাইছে, কেউ নাচছে। যতদূর চোখ যায়, ততদূর ছাগল আর ছাগল। ছাগলের ভিঁড় ঠেলে একটি সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে ওয়ামী। এ কী দেখলো ওয়ামী!! ইয়া বড় বড় ডিম!! একটি নয়, দু’টি নয়… লক্ষ কুটি ডিম!! ক্ষুধার্ত ওয়ামীর চোখে মুখে খুশির জলসা লেগে গেলো। পকেট থেকে পেয়াজ, মরিচ কুচি বের করে বাম পাশে রাখা চুলায় আগুন ধরিয়ে আরেক পকেট থেকে তেল বের করে কড়াইয়ে ঢেলে দিলো।

একটি বড় সাইজের ডিম দু’হাতে জড়িয়ে সরাতেই দেখে ডিমের আড়ালে ওয়ামীর বাবা কামারুজ্জামান বসে আছে! ওয়ামীর হাত থেকে ডিম পড়ে গেলো। কামারুজ্জামান নিজের ছেলের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। দু’চোখের জল ফেলে বলতে থাকলেন, “বাবারে, এ ডিমগুলো তুই খেতে পারবি না। এগুলো আমাদের জন্য রেখেছেরে বাপ! আমরা এখন মুখ দিয়ে ডিম খাই না, পেছন দিয়ে খাই!!” এ কথা বলেই দৌড়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বুক ফাটা আর্তনাদে মূর্ছা খেলেন কামারুজ্জামান।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:৪৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×