somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এখনো ক্রীতদাস

১৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৮:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমি যখন দেশের স্বনামধন্য একটা ঔষধ কোম্পানিতে কাজ করতাম তখন থেকেই মনে হতো আমরা যেন এখনো ক্রীতদাস ! সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যে অবধি, কোন দিন অনেক রাত অবধি এমন কি ছুটির দিনেও কাজ করে যাচ্ছি । মাস গেলে সর্বসাকুল্যে ন্যূনতম বেতন ! শুধু ঐ বেতনটাই নির্ধারিত ছিল, কাজ বা কর্ম ঘণ্টা নয় । আমি বিক্রয়, বিতরণ ও আইটি বিভাগে অফিসেই বসতাম বলে মাস গেলে বেতনও পেতাম ঠিকঠাক । কিন্তু আমার ডিপোতে থাকা এম.পি.ও আর ডেলিভেরি ম্যান যারা ছিল তাদের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক । সে সময় একজন এম.পি.ও এর ন্যূনতম বেতন ছিল ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা, আর একজন ডেলিভেরি ম্যান এর ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা মাত্র ! অথচ রোজ তাদের ক্লিন শেভ আর স্যুট-টাই দেখে বাইরের মানুষ জন আকাশ কুসুম ভাবতো । আমার ভীষণ কষ্ট হত যখন দেখতাম মার্কেটে আউটস্ট্যান্ডিং থাকায় মাস শেষে একজন এম.পি.ও বা ডেলিভেরি ম্যান এর বেতন আটকিয়ে দেওয়া হতো । তখন অফিস থেকে বের হয়ে এক কাপ চা যে খাবে এমন পয়সাও অনেকের পকেটে থাকতো না । কি নির্মম ! ভাবুন একবার । যেন শাঁখের করাতের মতো তাদের অবস্থা ! বাকী না দিলে দোকানী ঔষধ নেবে না, বাকী পড়ে থাকলে সে মাস শেষে বেতন পাবে না ! ব্যাটা ক্রীতদাস কোথাকার ! আমার কাছে তখন থেকে নিজেকে বা বিশেষত তাদেরকে আধুনিক ক্রীতদাস মনে হতো ।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাবমতে বর্তমানে বিশ্বে ২ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ নানাভাবে আধুনিক দাসত্বের শিকার । সংস্থাটির মতে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশেই রয়েছে ১ থেকে দেড় কোটি আধুনিক দাস । আমার মতে এই আধুনিক ক্রীতদাসের সংখ্যা আরও কয়েক গুন বেশি । ধনতান্ত্রিক দানব গণতন্ত্রের ছব্দবেশ ধারণ করে ধোঁকায় ফেলেছে মানুষকে । ধনতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণকারী পুঁজিপতি শোষকদের বিষাক্ত ছোবলে খুবলে খেয়েছে মানবিক বোধ । এইসব মুনাফালোভী শয়তানদের নির্মিত অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য প্রতিনিয়ত দেশে দেশে পেশা ও জীবিকা হারিয়ে অসহায় মানুষ সস্তায় শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে ।


আমাদের দেশের টেক্সটাইল বা গার্মেন্টস কারখানায় ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকায় শ্রমিকরা যে কাজ করছে তা সস্তায় শ্রম বিক্রির প্রকৃষ্ট উদাহরণ । দেশের মফস্বল এলাকার শিল্প কারখানা গুলোতে একজন শ্রমিক একই কাজ করে ৩০০০ থেকে ৫০০০ হাজার টাকায় মাসিক মুজুরি নিতে বাধ্য হচ্ছে । এদের কোন অধিকার নেই, নেই শ্রমিক ইউনিয়ন । কেউ এসব নিয়ে কথা বললেই চাকরীচ্যুত হয়ে তাকে হারাতে হবে জীবিকা অর্জনের অবলম্বন । রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে উন্নত বিশ্বও জানে যে এসব শিল্প কারখানায় শ্রম শোষণ হচ্ছে । ঐক্যবদ্ধ ভাবে সমগ্র বিশ্বের মুনাফাখোর মানব-দানব যেন শ্রমের প্রকৃত মূল্য দিতে নারাজ । মুনাফালোভী শিল্পপতি, রাষ্ট্রযন্ত্র আর উন্নত বিশ্ব শোষণ আর বঞ্চনার উদ্দেশ্যে এই সব শ্রমজীবী মানুষদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে জন্ম দিয়েছে আধুনিক দাসত্ববাদের । তাহলে কি মানুষ এভাবে এখনো ক্রীতদাস ?

সমসাময়িক কালে আমার সোনার দেশের প্রবৃদ্ধি ও মাথা পিছু আয় বেড়েছে । গণমাধ্যমে ফলাও করা এসব খবর জনমনে স্বস্তি দিয়েছে ঠিকই তবে নিজের ঝোলায় যখন হাত দিয়েছে তখন বোধসম্পন্নরা বুঝেছে যে তারা উন্নয়নের ফাঁদে পড়েছে । বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬ অনুযায়ী দেশে প্রতিনিয়ত দরিদ্র মানুষের আয় কমছে । জরিপ বলছে, ৫ বছরের ব্যবধানে সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ । পরিসংখ্যানে এই সব ক্রীতদাসদের দরিদ্র বলে সম্বোধন করা হয় ।


কাগজে কলমে শ্রম নীতি, শিল্প নীতি ইত্যাদি থাকলেও দেশীয় কল-কারখানা গুলোতে এসব মানা হয় না । হলেও সীমিত ভাবে মানা হয় বাধ্য হয়ে । এসব আইন ও নীতি যথাযথ ভাবে মানা হলে শ্রমিকদের অধিকার অনেকাংশেই প্রতিষ্ঠিত হতো । কিন্তু শ্রমিককে ক্রীতদাসে পরিণত করবার লক্ষ্যে শিল্প মালিক ও রাষ্ট্র যেখানে ঐক্যবদ্ধ ভাবে বদ্ধ পরিকর সেখানে অধিকারের কথা ভাবা বাতুলতার নামান্তর । বাংলাদেশে পকেট ও প্যাকেট সংস্কৃতি কিভাবে যে মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করছে সে ফিরিস্তি আরেক দিন দেব ।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কিছু ড্রাইভারদের সাথে আমার বেশ ভাব ছিল, এখনো আছে । তাদের দুর্দশার কথা শুনলে মনের মধ্যে এখনো ক্রীতদাস শব্দদ্বয় অজান্তেই উচ্চারিত হয় । সকাল সন্ধ্যা ডিউটি করে বস যদি বলে রাতেও থাকতে হবে বা সারা রাত ধরে কোথাও যেতে হবে, কেমন লাগে তখন ? অনেকের কাছেই শুনেছি এই অতিরিক্ত কাজের জন্য তাদের অতিরিক্ত কোন পাওনা নেই । তথাকথিত বস ও মালিকগণ এভাবেই তদের জিম্মি করে ক্রীতদাসে পরিণত করেছে ।

দাসপ্রথা একটি অনুমোদিত সামাজিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা । বাংলা পিডিয়া মতে শুধু আইন পুস্তক ও প্রশাসনিক গ্রন্থেই নয়, এ প্রথা সব ধর্মেই স্বীকৃতি ছিল । প্রাচীনকালে সমাজের শক্তিশালী শ্রেণি তাদের উৎপাদন ও প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর শ্রেণির লোককে দাসে রূপান্তর করত । ২১ শতকে এসে ভোল পাল্টানো সমাজের শক্তিশালী শ্রেণি নব্য উদারতাবাদের খোলসে আদিম কায়দায় শোষণ অব্যহত রেখে আধুনিক দাসত্ববাদের জন্ম দিয়ে আমাদের পরিণত করেছে পুনরায় ক্রীতদাসে । আদি থেকে বর্তমান এই প্রক্রিয়া চলমান । ভবিষ্যতেও এহেন প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে কোন পূর্বাভাস নেই । তাই অতীতের ক্রীতদাসদের মতো ভবিষ্যতের ক্রীতদাসরাও বর্তমানের আমাদের মতোই স্বভয়ে উচ্চারণ করবে, এখনো ক্রীতদাস !

এই সব দেখে শুনে ভাবতে ভাবতে খুব খারপ লাগে । ক্রীতদাস হতে কারই বা ভালো লাগে বলুন ! যখন খারাপ লাগে তখন ক্ষেপে গিয়ে উচ্চারণ করি প্রিয় কবিতা গুলোর কিছু বাক্য । এই মুহূর্তে মনে পড়ছে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত তুর্কি কবি ও নাট্যকার নাজিম হিকমতের 'জেলখানার চিঠি' কবিতার নিম্নোক্ত কয়টি লাইনঃ-

'কৃষ্ণপক্ষ রাত্রে কোথাও আনন্দ সংবাদের মত
ঘড়ির টিক্ টিক্ আওয়াজ,
বাতাসে গুন্ গুন্ করছে মহাকাল,
আমার ক্যানারীর লাল খাঁচায়
গানের একটি কলি,
লাঙ্গল-চষা ভূঁইতে মাটির বুক ফুঁড়ে
উদগত অঙ্কুরের দুরন্ত কলরব
আর এক মহিমান্বিত জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত
ন্যায্য অধিকার ! '

রুদ্র আতিক, সিরাজগঞ্জ
৪ বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ
ছবিঃ ইন্টারনেট ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৮:৩৯
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×