আরাফাত আল মাসুদ
বাস্তব জগত শুধুই কি বস্তুগত? কল্পনা, স্বপ্ন, প্রত্যাশা সে বস্তুজগতে কতখানি জায়গা জুড়ে থাকে? আর স্বপ্নভঙ্গের প্রচ্ছায়া ঘন গুমোট করে রাখে কতখানি? এ বিষয়গুলো অনেক বেশি আবর্তিত হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ঘিরে। নিম্নবিত্ত আর উচ্চবিত্তদের মত সে জীবন পুরোপুরি বস্তুগত নয়। পুরোপুরি বস্তুগত হওয়া সম্ভবও নয়। কল্পনার স্নিগ্ধ মলয় তার তপ্ত বাস্তবতাকে কিছুটা আরামপ্রদ করে রাখে । অনেকক্ষেত্রে তাকে আকাশ কুসুম কল্পনা বলা যায়, একটু ঘুরিয়ে স্বপ্ন দেখার দুঃসাহসও কি বলা যায় না? তবে দুঃসাহস হলে সে স্বপ্ন পূরনে জেদ কোথায়? শেষোক্ত প্রশ্নটি যাদের তারা হয়ত সমাজ বাস্তবতার তীব্র প্রতিবন্ধকতাকে চাপা দিতে চান দুচারটা সফল উদাহরণের তলায়। কিন্তু যে প্রতিবন্ধকতায় প্রতিনিয়ত পিষ্ট হতে থাকে মধ্যবিত্তের জীবন সে যাপিত জীবনে কল্পনার বুদবুদ, স্বপ্নের সম্মোহন, অলীকতা কিংবা অলৌকিকতা এসবের গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় কোথায়?
মঈনুল আহসান সাবের সাহিত্যের পাঠকদের জন্য নতুন কোন নাম নয়। সত্তরের দশক থেকে গত পাচ দশকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে তার সাহিত্য সাধনা আমাদের সাহিত্য জগতকে সমৃদ্ধ করেছে নানাভাবে। বিশেষ করে তার ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ অর্জন । তবে সে বিষয় বিস্তারে না গিয়ে আমরা সরাসরি তার সদ্য প্রকাশিত নতুন উপন্যাস “ আখলাকের ফিরে আসা ”য় প্রবেশ করব।
উপন্যাসের মূল চরিত্র আখলাক। এ আমাদের চেনাজানা চরিত্রগুলোরই একটি। মধ্যবিত্ত শ্রেনির প্রতিনিধি। মধ্যবিত্ত শ্রেনি অসংখ্যবার আমাদের সাহিত্যে নানাভাবে এসেছে। মার্ক্সবাদী সাহিত্যিকরা অবশ্য এই শ্রেণিকে সন্দেহের চোখে দেখেন। কার্ল মার্ক্স মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বেঈমান বলেছেন কিনা! কার্ল মার্ক্সের সমাজ বদলের গুরুত্বপূর্ণ দর্শনটি আমাদের দেশের বামপন্থিরা যেভাবে বিকৃতির চোরাবালিতে প্রায় বিলীয়মান করেছে তার থেকে সাহিত্যও পুরোপুরি মুক্ত থাকেনি। তবে সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের লেখকরা বুঝতে চেয়েছেন এই শ্রেণিকে। জহির রায়হান, রাবেয়া খাতুন, মাহমুদুল হক, হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্যে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে পাই এ শ্রেণির উপস্থিতি। মঈনুল আহসান সাবেরও চেয়েছেন মধ্যবিত্ত সমাজ নিয়ে গড়ে উঠা গৎবাধা ধারণার বাইরে থেকে তাদের বিচার করতে। মধ্যবিত্তের স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গ, জড়তা আর জটিলতা, সঙ্গতি আর সীমাবদ্ধতা, আত্মবিকাশের আকুতি আর আত্মরক্ষার মুখোশ এসবকে বিবেচনায় না এনে আমরা এই শ্রেণিকে বিচার করতে পারিনা। যুগের পরিবর্তন, রাজনৈতিক আবহের গতিমুখ এসবও গুরুত্বের দাবী রাখে। এসব দিক একজন সমাজ নিরিক্ষক সাহিত্যিকের দৃষ্টি এড়ায় না। এড়িয়ে গেলে সেই সাহিত্যিক কালের নজর থেকেও এড়িয়ে যান। গ্রহণযোগ্যতা এত সহজ ব্যাপার নয়। যাই হোক, আমরা ফিরে আসি “আখলাকের ফিরে আসা”য়।
উপন্যাসের প্রথম বাক্যেই আমরা আখলাকের মৃত্যুর খবর পাই। পরের বাক্য থেকেই আমরা টের পাই, লেখক আমাদের টেনে নিয়ে যাচেছন পরাবাস্তবতার দিকে। পরাবাস্তবতা বা যাদুবাস্তবতার চর্চা আমাদের সাহিত্যে খুব বেশি পুরোনো নয়। নব্বইয়ের দশক থেকে এর প্রচলন দেখতে পাই। সাবেরের এর আগের গল্প উপন্যাসগুলো রিয়েলিস্টিক বা বাস্তববাদি। পরাবাস্তববাদ নিয়ে তার লেখা তেমন একটা আমরা পাই না। তবে এ উপন্যাসে মধ্যবিত্তীয় যাপিত জীবন পরাবাস্তবতার মোড়কে উপস্থাপন করেছেন লেখক। পুরো উপন্যাসটি মৃত আখলাকের স্মৃতিচারণের মধ্যদিয়ে বর্ণিত হয়েছে। আখলাকের সাংসারিক চিত্র আমরা দেখতে পাই। আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের চিত্র থেকে ভিন্নতা নেই বাইরের দিক থেকে। আখলাক ও জেসমিনের ছোট সংসার। তবে একটু ভিতরে ঢুকলে তা আমাদের লিউ তলস্তয়ের “আনা কারেনিনা”র সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দেয় - “সব সুখী পরিবারের চিত্র একইরকম, কিন্তু অসুখী পরিবারগুলো একে অপর থেকে আলাদা।”
আখলাকের দুই সন্তান আছে। অবশ্য কল্পনাজাত। নাম দিয়েছে তানিম ও টুম্পা। জেসমিনের সাথে এ নিয়ে তাদের কথাবার্তাও হত মাঝেমাঝে। সন্তানহীনতার কষ্ট দুজনই চাপা দিয়ে রাখত এমনিভাবে। আখলাক এর জন্য দায়ি হলেও জেসমিনকে এ নিয়ে কোন অভিযোগ করতে দেখা যায় নি। তবে মাঝেমাঝে দীর্ঘশ্বাস বেরুতো জেসমিনের বুক থেকে। মাতৃত্বের আকুতি। তারা দত্তক নিতে চায়নি। নিজেদেরই সন্তান চেয়েছিল। অনেক বৃথা চেষ্টার পরও তারা অপেক্ষায় ছিল। অনেক স্বপ্নের মৃত্যুর পরও তারা ফিরে আসত আশার আবেষ্টনীতে। আশায় বসতি। মধ্যবিত্তের জীবনটাই কি অনেকটা পরাবাস্তব নয়? ধনী বা দরিদ্রদের মত তা নিখাদ বাস্তব তো নয়। জেসমিনের কোন আহ্লাদ মেটাতে পারেনি আখলাক। বহুদিন বলেও একটিবারের জন্য কক্সবাজার গিয়ে সমুদ্র দেখার সাধ পুরণ হয়নি জেসমিনের। তবু তারা পরিকল্পনা করত। নানা জায়গায় বেড়াতে যাবার। গ্রামে এক স্বপ্নকুটির গড়ে তোলবার। যেখানে জেসমিনকে নিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাবে। জেসমিন মাঝেমাঝে বলত,“এই পরিকল্পনা করতে করতেই জীবন যাবে তোমার।” তবু জেসমিনও পরিকল্পনা করত। মধ্যবিত্তের আশায় বসতি।
আপাত সুখী এই দাম্পত্য জীবনে বিষফোড়া হয়ে থাকে জেসমিনের বাল্যবন্ধু শান্ত। এ নিয়ে আখলাক জেসমিনের কথা কাটাকাটিও হয়েছে। জেসমিন বারবার বোঝাতে চেয়েছে বন্ধুতার বাইরে আর কোন সম্পর্ক নেই তাদের। “নির্দোষ মেলামেশা,সে জানে জেসমিন এমন বলবে। কারণ এমনই বলেছে সবসময়। সই, সেও বলছেনা তাদের মেলামেশার পেছনে অন্য কোন অর্থ আছে, কিন্তু চোখে লাগে না? এলাকার লোকজন দেখে না? দেখলে, কখনো কিছু ভাবে না? আর, এত কিসেরই-বা গল্প, এত কিসের! জেসমিন আর শান্ত থাকত একই এলাকায়, কৈশোরে, তাই বলে তাদের গল্প ফুরোবে না!” আখলাকের মনে হত।
এই যে শান্ত, পুরো উপন্যাসে যার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি একেবারেই নেই, পরোক্ষ উপস্থিতিও খুবই সামান্য অথচ উপন্যাসে তার প্রভাব মোটেও সামান্য নয়। নির্দোষ বন্ধুতার বাইরে অন্য কোন সম্পর্কে শান্তর সাথে জেসমিন জড়িয়ে পড়েছে কিনা ঔপন্যাসিক তা খোলাসা করেননি। কিন্তু যখনতখন শান্তর চলে আসা আর আখলাকের মতে প্রায়ই জেসমিনের ‘গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর’ চালিয়ে যাওয়া পরকীয়ার ইঙ্গিত দেয় পাঠকের মনে। কিন্তু আখলাকের প্রতি জেসমিনের ভালবাসা আছে। আখলাকের স্মৃতিচারণায় যা বারবার উঠে এসেছে। তা তো কৃত্রিম বলে মনে হয়না। আধুনিক জটিল মানসিকতা, উদ্বেগহীন অনিশ্চিত যাত্রার কৌশলী চিত্র লেখক একেছেন। শান্তর প্রসংগ ধরেই আখলাক জেসমিনের শেষ ঝগড়া, আখলাকের তিব্র অভিমান,বাড়ি না ফিরে বেড়িবাধের দিকে চলে যাওয়া সন্ধ্যার পর, অতঃপর ছিনতাইকারীদের কবলে পড়া। মোবাইল, ঘড়ি, মানিব্যাগ নেয়ার পর পিতৃদত্ত জীবনটা তারা নিয়ে নিয়েছে কোন কারণ ছাড়াই। ছিনতাইকারীদের একজনের ইচছা হয়েছিল বলে। বেওয়ারিশ হয়ে পড়েছিল সেখানেই। বারবার সে উঠে আসতে চেয়েছে । ফিরতে চেয়েছে জেসমিনের কাছে। কিছুটা অভিমান থাকলেও অনুশোচনাই তার প্রবল হয়ে উঠে। শান্তর কথা আমরা ভুলে যাই। আখলাকের জীবনের কোন এক অধ্যায়ে থাকা পলির কথা আমরা জানতে পেলেও তা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে না। আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে শুধুই আখলাক আর জেসমিন। কিংবা শুধুই আখলাক। তার মৃত্যু। কিংবা সামগ্রিক মৃত্যুচেতনা।
মৃত্যু। মৃত আখলাকের স্মৃতির ডানায় ভর করে আমরা ভ্রমণ করে আসি তার শৈশবে কৈশোরে, যেখানেও অনেক অদ্ভুত মৃত্যু তাকে আলোড়িত করে। আমাদেরও। কোনটা তার দেখা, কোনটা অন্যের কাছ থেকে শোনা। মৃত্যু নিয়ে তার অদ্ভুত সব ভাবনা যা যুক্তিতে মেলানো যায়না। মেলানো যায় না জীবনের না পাওয়াগুলো নিয়ে তৈরি করা কল্পনার ফানুস। কিন্তু তবু মধ্যবিত্তের নিরন্তর ‘যদি এমন হত’ চাওয়া কোন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে না পৌছুলেও তার সম্মোহন শক্তির কমতি হয়না এতটুকু। ‘যদি এমন হত’ তার বাবাও এমন চিন্তায় আচ্ছন্ন হতেন এবং টের পাই এরকম আচ্ছন্নতায় আমাদের প্রত্যেককে প্রায়ই পেয়ে বসে। শুধু মৃ্ত্যু নয়, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন জীবনের অতৃপ্তিগুলোকে যদি’র বুদবুদে ফেনায়িত না করে পারে না। “এমন কি হতে পারত না, তার মানিব্যাগ ভরতি টাকা। সে যতই খরচ করত,মানিব্যাগের টাকা শেষ হত না, বহু বহু খরচ করার পরও মানিব্যাগ মোটাই থেকে যেত।” কাজেই জীবনের বাকেবাকে কোথাও না কোথাও আখলাকের অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি এক হয়ে যায় আমাদের সাথে।
উপন্যাসের শেষটুকুতে লেখক মুন্সিয়ানার এক অসাধারণ পরিচয় দিয়েছেন। আখলাকের হঠাৎ মনে হল, সে মারা যায়নি। সবই তার মনের ভুল, অবচেতন মনের প্রতিক্রিয়া। তাই সে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দিল। নতুন করে জীবন শুরু করবে আখলাক। আমরা পাঠকরাও দ্বিধান্বিত হয়ে যাই। বাড়ির খুব কাছাকাছি এসে দেখে সে তার বাসার সামনে জটলা। হঠাৎ খুব সুন্দর দুইটি ছেলেমেয়ে এসে তার হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। পরিচয় দেয়, তারা আখলাকের দুই সন্তান- তানিম আর টুম্পা। তারা আর বাসায় ঢুকতে পারছেনা। হঠাৎ করেই তারা নাকি দেখে যে তারা বাসার বাইরে। তারা নিয়ে যায় তাদের দাদাদাদি মানে আখলাকের বাবা মার কাছে। তারা খেলায় মগ্ন। তার সন্তানরা খেলতে বললে তার বাবা মা বলে, ও তো নতুন। পরে খেলবে।“ আখলাক, তুই পরে। ঠিক আছে?” বুঝে নিই, আখলাকের এ ফিরে আসা তার স্বপ্নের কাছে। বাস্তবতায় নয়। বাসার সামনে ঐ যে জটলা, ওখানেই হয়ত মৃত আখলাকের দেহ ঘিরে আছে তার স্বজনরা এবং জেসমিন। এখানে তাই জেসমিন নেই। আছে তার বাবা মা; যারা এখন আর মাটির পৃথিবীতে নেই। আছে তানিম আর টুম্পা; যারা কখনই মাটির পৃথিবীতে ছিল না। ছিল শুধু তার কল্পনায়। আখলাকের ফিরে আসা তাই মধ্যবিত্তের পরাবাস্তবিক বোধে ফিরে আসায়; অসংখ্য স্বাপ্নিক মৃত্যুর মধ্যদিয়েও যেখানে তারা বারবার ফিরে আসে।
পুরো উপন্যাসে মাত্র দুইটি পরিচ্ছেদ। প্রথম পরিচ্ছেদটি বেশ ছোট। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদটিই বাকি উপন্যাস। মঈনুল আহসান সাবেরের অন্য গল্প উপন্যাসের মত এ উপন্যাসের ভাষায়ও রয়েছে একধরণের সাবলীলতা; শব্দ থেকে শব্দে যে একটা স্পন্দন, যা গড়িয়ে চলে, টেনে নিয়ে চলে পাঠককে। ক্লান্ত করে না। সাবেরের লেখায় এমনিতেও এলায়িত ভাব নেই। লেখা অহেতুক টেনে লম্বা করেন না। তবু যে প্রশ্নটি উল্লেখ না করলেই নয়, এই যে মধ্যবিত্তের জীবন যা বাস্তবতার অনেক অপ্রাপ্তির গহ্বর স্বপ্নের বালুকনা দিয়ে পূর্ণ করে রাখে, যা চোরাবালিতে রূপ নিয়ে অতলে তলিয়েও নেয় অনেক সময়; সেই মধ্যবিত্তীয় জীবন কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় যাপিত হয় তা লেখক এড়িয়ে গেলেন কেন? উপন্যাস তো ছোটগল্প নয়। তাই উপন্যাসের কাছে পাঠকের এ দাবি যৌক্তিক।
এটা তো সাহিত্যের পাঠক মাত্রেই জানে, কাহিনীর মধ্যে গল্পের মান প্রতিফলিত হয়না, হয় গল্প বলার ঢংয়ে, উপস্থাপনে। আর সেটাই পাঠককে থামতে দেয়না এবং পাঠশেষে নতুন এক অভিজ্ঞতায় পাঠককে আবিষ্ট করে রাখে। মঈনুল আহসান সাবেরের এ নতুন উপন্যাস “আখলাকের ফিরে আসা” পাঠশেষে এমনি এক আচ্ছন্নতায় আমাদের ঘিরে থাকে কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতায় আর পরাবাস্তব অনুভবে।
গ্রন্থঃ আখলাকের ফিরে আসা
লেখকঃ মঈনুল আহসান সাবের
প্রকাশকঃ দিব্য প্রকাশ
প্রচছদঃ ধ্রুব এষ
মূল্যঃ ১৫০ টাকা