উফফ!আজকেরটা যা হইছে লম্বা একটা টান দিয়ে বলল আশরাফ।এবার নিজে টান দেবার জন্য হাত বাড়ায় মিফতা।আজ প্রায় এক মাস হল সে গাঁজা ধরেছে।প্রতিদিন টানা না হলেও সপ্তাহে দুই তিন বার টানা হয়েই যায়।মিফতাকে অবশ্য কোন টাকা খরচ করতে হয়না।সবাই মিলে চাদা যা দেয় তাতেই হয়ে যায়।আর তাছাড়া আশরাফ নিজেই গাঁজা পৌঁছে দেয় অনেক জায়গায়।তাই অল্প দামে গাঁজা সে পেয়েই থাকে। মিফতাদের দলে আজকে পাঁচ জন।এরা সবাই স্কুল অথবা কলেজ লাইফ থেকে গাঁজা টানে।প্রথম যখন রাজশাহী কলেজে ভর্তি হয়ে এদের সাথে বন্ধুত্ব হয় তখন এরা নিজেরাই অনেক জোর করে মিফতা কে গাঁজা টানতে বলে।মিফতা যে শুধু এদের কারনেই কৌতূহল বসত গাঁজা ধরেছে তা নয়। ' কি আছে জীবনে !'অনেকটা এরকম চিন্তাই আসে এক সময়।এদের মদ্ধে গাঁজা টানার ব্যাপারে সবচেয়ে নতুন হল মিফতাই। তবে মজার বিষয় হল সবার বড় টান গুলো মিফতাই দেয় আর গাঁজা টানার পর সবাই যখন উল্টা পাল্টা কাজ শুরু করে তখনও মিফতার মাথা ঠিক থাকে।নেশার মধ্যেও অবশ্য থাকে যেটাকে, সবাই বলে পিনিক।মিফতা দুই আঙ্গুলের মাঝে গাজার স্টিক ধরে।তারপর চোখ বন্ধ করে টানা শুরু করে।সবাই হা করে তাকিয়ে দেখে।সবাই দুইবার করে টান দিলে যত টুকু নেয়,মিফতা এক টানেই সেটা ভেতরে নেয়।চোখ খুলতেই মিফতা দেখে সুমন হাত বাড়িয়ে আছে । হেসে জিজ্ঞাসা করে'মামা কয়তলা?'।সুমন ও পাল্টা একটা হাসি দিয়ে বলে,'এতটুকুতে আমার কিছুই হয়না।তারপর সুমনকে ইশারা করে থামতে বলে।এখনও আরও একটা টান বাকি আসে মিফতার।আবার চোখ বন্ধ করে মিফতা।দুই ঠোঁট এর মাঝে নিয়ে এইবার একটা লম্বা টান দিতেই চোখের সামনে ভেসে থাকা অতীতগুলো একে একে সরে যেতে শুরু করে ।একটা শান্তি অনুভব হয়।যেন জগতের কিছুতেই কোন দুঃখ নেই।
#নাটোরের মনিপুর গ্রামে বড় হওয়া মিফতার জীবনটা ছিল একটু অন্য রকম।সাধাসিধে,নরম ভদ্র আর লাজুক স্বভাব এর মিফতাকে সবাই পছন্দ করত।স্কুল জীবন এর শুরু করার পর থেকে টানা পাঁচ বছর এক রোল থাকে ক্লাশে।এরপর হঠাৎ করেই কেন যেন একটার পর একটা আঘাত লাগতে শুরু করে মিফতার জীবনে।শরীর স্বাস্থ সব ভেঙ্গে যেতে শুরু করে মিফতার। চোখের নিচে কালি পরে যায়।মিফতার বাবা শহরে চায়ের দোকান চালায়।সাথে কেক,বিস্কুট,রুটি,বিড়ি-সিগারেটও থাকে। তারপর ও যে খুব খারাপ অবস্থা ছিল তা নয়।গ্রামের জমিজামা দিয়ে ভালই চলত কিন্তু মিফতার জন্য কিছুতেই আর বাবস্যা তে মন বসাতে পারেনা মিফতার বাবা।অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখায় মিফতার বাবা।কিন্তু কেওই যথাযথ চিকিৎসা দেয় না। রোগী ধরে রাখা এখন ডাক্তারদের একটা ব্যাবসা হয়ে গেছে।এদিকে ছেলেটার দিকে তাকিয়েতো অস্থির মিফতার বাবা। কখনও মিফতার কপালে হাত দিলে দেখে প্রচণ্ড গরম কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরেই আবার দেখা যেত কপাল বরফ এর মত ঠাণ্ডা।গ্রামের সবাই এমনকি মিফতার নিজের বোনও বলা শুরু করল মিফতাকে নিশ্চয়ই কেও তাবিজ করেছে।না হলে এইরকম হবে কেন? চায়ের দোকানদার হলেও এইসবে কান দেয়না মিফতার বাবা। একের পর এক ডাক্তার দেখাতে থাকে মিফতাকে।অবশেষে একজন ডাক্তার ব্লাড টেস্ট দেয় তিনটা।সেখানেই ধড়া পরে মিফতার শরীরে টাইফয়েড এর ব্যাকটেরিয়া সুপ্ত অবস্থায় আছে প্রায় নয় মাস ধরে।খুব কম মানুষেরই এইরকম হয়।কিন্তু তাই বলে মিফতা কেন!অনেক দামি দামি ওষুধ লিখে দেয় ডাক্তার।একটা সময় সুস্থ হয় মিফতা কিন্তু আগের মত আর পড়ালেখা করতে পারেনা মিফতা।কেন জানি কিছু মনে থাকেনা।ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা মিফতাকে নিয়ে ঠাট্টা উপহাস শুরু করে।সবার ধারনা মিফতা এখন ফাকিবাজ হয়ে গেসে।পড়ালেখা করেনা আর সবাইকে বলে বেড়ায় সে অসুস্থ।কেও কেও তাকে বলে,'মামা ধুনের উপর বেশি প্রেসার দিলে অমন তো হবেই।আবার ক্লাস এ টিচাররা যদি তাকে জিজ্ঞাসা করে যে সে কেন পড়ালেখায় এত পিছিয়ে গেল তখন পিছ থেকে অন্য ছেলেরা বলে,' ওর বিচিতে সমস্যা'। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি শুরু করে পুরো ক্লাস।টিচার শুধু শুনতে পায়না বলে অবাক হয়ে ধমক দেয় সবাইকে।আর মিফতা মুখ বুজে সহ্য করতে থাকে।এরপরও মিফতা অনেক কষ্ট করে এস. এস. সি তে জি.পি. এ ফাইভ পায়।কিন্তু কষ্টের জীবনের শুরু তখন কেবল মাত্র।
#সকাল বেলা মিফতার ঘুম ভাঙ্গে মোবাইল এর রিংটোন এ।কে যে কল দিলো এত সকালে।তার খালাতো ছোট ভাই। রাজশাহীতেই থাকে মিফতার এই খালা ।দেখতে অনেক সুন্দর বলে ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছিল খালার।খালুও বেশ ভালো মানুষ।কখনই মিফতার পরিবার এর দিকে বাকা দৃষ্টিতে তাকাননি তিনি।মিফতার খালা -খালু তাদের বাড়িতেই থেকে পড়ালেখা করতে বলেছিল।কিন্তু কারো দয়ায় মিফতা চলবে না ভেবেই হোস্টেল এ উঠে যায়।
কলটা রিসিভ করতেই ওপার থেকে নিবিড় কথা বলে ওঠে,' ভাইয়া,তোমার জন্য একটা টিউশন পেয়েছি।প্রথমেই মিফতা জিজ্ঞেস করে মাসে বেতন কত দিবে।নিবিড় উত্তর দেয় পাঁচশ।সরাসরি না করে দেয় মিফতা। তারপর চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ।সে ভালো কোন ভার্সিটি তে পড়তে পারেনি বলে ওকে কেও দাম দেয়না।এই যুগের কেও কোনদিন পাঁচশ টাকায় প্রাইভেট পড়ায় নাকি মিফতার জানা নেই।এখনকার সমাজের অভিভাবকদের চিন্তাধারা কেমন যেন হয়েগেসে।মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং এ যারা পড়ে তারা হল ট্যালেন্ট ছেলেপেলে।ঢাকার প্রাইভেট ভার্সিটি গুলোতে যারা পড়ে তারা হল বড়লোকের ছেলেপেলে।আর যারা সরকারি ভার্সিটিতে পড়ে তারা একদম ছাত্র যে খুব ভাল তা নয় কিন্তু অধিকাংশই গ্রামের। কেও যখন জিজ্ঞেস করে কোথায় পড় তখন রাজশাহী কলেজ উত্তর দিলে এমনভাবে তাকায় যেন একটা ঘৃণ্য বস্তু।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এডমিশন টেস্টের সময়কালে সারাদেশে চলছিল হরতাল, অবরোধ আর বিক্ষোভ। মিফতার বাবার পক্ষে সম্ভব হয় না দোকান খোলার। একদিন সাহস করে দোকান খুলতেই আগুন দিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। অসহায় হয়ে পড়ে মিফতার বাবা। আর তাছাড়া গোটা বাংলাদেশ ভ্রমণ করে যে বিভিন্ন ভার্সিটি দিবে সেটাও সম্ভব হয়না। একেতো রেজিস্ট্রেশন ফি অনেক আর হল হরতালের কারনে যাতায়াত খরচ হয়ে পড়েছে দিগুন। মেডিকেল,রাজশাহী ভার্সিটি, রুয়েট আর রাজশাহী কলেজে রেজিস্ট্রেশন করে মিফতা। রাজশাহী ভার্সিটিতে বেশ পেছনে সে পড়ে যায়। ভাইভার জন্য ডাক পড়ে অবশ্য। কিন্তু সেখানে পৌঁছে বুঝতে পারে সে ওয়েটিং লিস্ট থেকে সামনে এসে পড়লেও লাখ খানেক টাকা ছাড়া ভর্তি হতে পারবে না সে। অগত্যা তাই রাজশাহী কলেজই হয় মিফতার লক্ষ্য।
#
এরপর থেকেই মিফতা অন্য রকম হয়ে যায়। নামায পড়া ছেড়ে দেয়। বিড়ি-সিগারেট থেকে গাঁজায় এসে পড়ে। অথচ তার মন মানসিকতা এমন ছিল যে সে কোন দিন পথভ্রষ্ট হতে পারেনা,খারাপ জিনিস কোনদিনও হাত দিবেনা। কিন্তু মিফতা হাত দিয়েছে আর বুঝতে পেরেছে যে কোন মানুষ এমনকি নিজেকেও বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে এমন পরিস্থিতে ফেলতে পারে যাতে যেকোন মানুষ যেকোন কাজ করতে পারে। না হলে তার বোনই বা আত্মহত্যা করল কেন বিয়ের পর।কি এমন হয়েছিল তার স্বামীর সাথে। বোনকে হারানোর পর তার সব ব্যর্থতার পর মিফতা নেশার পথ ধরে আর ভাবে সে কি ছিল আর কি হয়ে গেছে।
#
অনেক দিন হল খালার সাথে দেখা হয়নি মিফতার। হঠাৎ ফোন করে তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসতে বলে খালামনি। হঠাৎ এভাবে ডাক দেয়ায় মিফতা বুঝতে পারে নিশ্চয় দরকারি কোন কাজ পড়েছে। তাই তাড়াতাড়ি মিফতা চলে যায় খালামনির বাড়ি। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় নিবিড়। বসার ঘরেই খালামনি বসেছিলেন। নিবিড়কে ঘরে যেতে বলে মিফতাকে বসতে বলেন তিনি। চুপ করে মিফতার দিকে তাকায় থাকেন কিছুক্ষন। 'কি হয়েছে খালামনি?' প্রশ্ন করে মিফতা। 'তোর মা আসছে ' শান্ত স্বরে বলেন খালামনি। 'মা! হঠাৎ কেন?' একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে খালামনি বলেন 'আমি আসতে বলেছি। তুই আজ তোর মার মাথায় হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করবি আর কোনদিন নেশা করবি না।' আকাশ থেকে পড়ে মিফতা। তার নেশার কথা খালামনি কিভাবে জানল বুঝতে পারে না মিফতা। কেবল অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। 'ভাবছিস আমি কিভাবে জানলাম? এই শহরে তুই কখন কোথায় থাকিস,কি করিস সব আমার কানে আসে' চোখ নামায় ফেলে মিফতা। ভাবতে থাকে তার মা এইটা কিভাবে সহ্য করল যে সে নেশা করে। হয়ত বুকফাটা আর্তনাদ দিয়েছিল কিংবা মুষড়ে পড়েছিল। কিন্তু ঠিকই নিজেকে সামলে নিয়েছে। ছুটে আসছে ছেলেকে সঠিক পথে ফেরানোর জন্য। 'তোর বাবা-মা কি তাদের যা সামর্থ্য আছে তা দিয়ে তোর অভাব পূরণ করার চেষ্টা করেনি? এমন কি হয়েছে যে তুই নেশা শুরু ক্রেছিস।'দু চোখ দিয়ে অঝোরে পানির বন্যা পড়তে শুরু করে। 'খালামনি, আমি কোনদিন কি আমার বাবা-মার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেছি? আমার জীবনটা কেমন হয়ে গেছে তুমি জানো না?'' 'বাবা, জীবনটা এমনই। এগুলো মেনে নিতে হয়।' 'আর কত মানবো আমি!' মিফতার পাশে বসে খালামনি।মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, 'যা হওয়ার হয়ে গেছে বাবা। ভেবে দেখত তোর বাবা যদি জানে তাহলে কি হবে। লোকটাতো মরেই যাবে।' চুপ করে বসে থাকে মিফতা। মার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
ঘণ্টা খানেক পার হয়ে গেলেও মা না আসলে দুশ্চিনায় পড়ে যায় মিফতা আর খালামনি। হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, 'আম্মু জানো, রাজশাহী-নাটোর রুটের একটা বাস পোড়ায় দিয়েছে। মাথাটা কেমন জানি চক্কর দিয়ে ওঠে মিফতার। ছলছল চোখে খালামনি তাকায় মিফতার দিকে। মিফতা কিছু না বলে চট করে উঠে পড়ে। তারপর বাড়ি থেকে বের হয়ে পাগলের মত দৌড়াতে থাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে।
#
'মিফতা, এদিকে আয় তো।' জোরে ডাক দেয় সুমন। মিফতা জানে সুমন কি বলবে। সুমনেরকাছে এসে বলে, 'আমি আর নাই।' 'অনেক দিন হল তুই আমাদের সাথে আর খাস না। তোর তো আর টাকা দেয়া লাগবে না।' ঠিক তখনই মাগরিবের আযান শোনা যায় মসজিদ থেকে। সুমনের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেয় মিফতা। তারপর মসজিদের দিকে হাটতে শুরু করে। মাগরিবের আযানের পর পরই তো নামায শুরু হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৫ বিকাল ৫:১৭