somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনাকাঙ্ক্ষিত গন্তব্য

০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ ভোর ৪:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

# বইয়ের দিকে তাকিয়ে আর মুখে কলম নিয়ে একমনে চিন্তা করছে ফয়সাল। গতকালই তার বাড়ির স্যার এই ধরনের অংক বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজকে হোমওয়ার্ক করতে বসে কিছুই যেন মাথায় আসছে না।
'এই ফয়সাল!' হঠাৎ মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পায় ফয়সাল। 'কতক্ষন ধরে ডাকছি তোকে। আর তুই কোন সাড়া-শব্দ দিচ্ছিস না। কানে হেডফোন লাগান নাকি দেখি।' ফয়সাল মাথা ঘুরিয়ে মাকে দেখায় যে তার কানে কিছু আছে নাকি। তারপর হেসে বলে, 'মাথায় অংক ঢুকছে না। এতই বেশি চিন্তা করছিলাম যে তোমার কথা শুনতেই পাইনি।' 'অংক নিয়ে পরে চিন্তা করিস। দাদীর ঘরে যা। দেখ, কি জন্য ডাকছে এত।'
মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় ফয়সাল। তার দাদী তাকে ডাকছে আর তার মা সানন্দে সেটা মেনে নিয়েছে! এটা কিভাবে সম্ভব হল? যাই হোক, মা যখন অনুমুতি দিয়েছে তাহলে মত পরিবর্তন করার আগেই দাদীর ঘরের দিকে বই-খাতা রেখে দৌড় দেয় ফয়সাল। ঘরের দরজার কাছে এসে উকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'দাদী, আসব?' ভেতর থেকে কাতর কণ্ঠে দাদী উত্তর দেন, 'আয় ভাই। ভেতরে এসে আমার পাশে একটু বস।'
ফয়সাল ভেতরে গিয়ে দাদীর মাথার কাছে বসে। 'ডাকছিলে কেন,দাদী?' দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদী বলেন, 'কতদিন ধরে তোকে দেখিনি। খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল তোকে দেখতে। তোর মাকে অনেক বলার পর অবশেষে তোকে ডাকল।'
দাদীর কথা শুনে চোখে পানি চলে আসে ফয়সালের। একই বাড়িতে থাকে তারা। অথচ দাদীর সাথে তার দেখা হল কম করে হলেও তিন-চার সপ্তাহ পরে। দাদী আরও বলতে থাকেন, 'তোদের সব ভাইবোনদের এক এক করে দেখে নিচ্ছি। তোরা ভালমত পড়াশুনা করিস। মারামারি করিস না নিজেদের মধ্যে। বাবা-মার কথা শুনবি। আর আমার জন্য মন খারাপ করবি না। আমি মনে হয় আর বাঁচব না।' 'এসব কথা বলতে নেই দাদী।' দাদীর মাথায় হাত রাখে ফয়সাল। কিন্তু দাদী তার হাত সরিয়ে দেন। 'আমার শরীরে হাত দিস নারে,ভাই। তুই যা, পড়তে যা। আর তোর মাকে একটু পাঠিয়ে দে।'
ফয়সাল মন খারাপ করে চলে যায় দাদীর ঘর থেকে।যাবার সময় রান্না ঘরে মাকে দাদীর ঘরে যেতে বলে যায়। এই বাড়িতে দাদি ছাড়াও তার চাচা-চাচি আর তাদের ছেলে-মেয়েরা থাকে। ফয়সালের বড় হচ্ছে তার চাচাতো বোন অর্পিতা। তারপর তার নিজের ছোট বোন অহনা। আর সবার ছোট হচ্ছে অর্পিতার ছোট ভাই ফাহাদ। সবাই একই স্কুলে কিন্তু ভিন্ন ক্লাসে পড়ে। অর্পিতার জন্মের পরপরই তাদের দাদা মারা যায়। দাদা-দাদীর দুইজনের ভালবাসাই ওরা পায় শুধুমাত্র দাদীর কাছে থেকে। মাত্র এক বছর আগেও সব ভাই-বোন মিলে দাদীর ঘরে রাতে ঘুমাত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একদম অন্য রকম।
হঠাৎ করেই দাদীর শরীর এ খোস-পাঁচড়া,গোটা উঠা শুরু করে। অনেক ওষুধ খেয়েও এই রোগ সারেনা। এরপর থেকে একজন ডাক্তার প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে এসে দাদীর শরীর গোটা গুলো ফাটিয়ে বিষাক্ত পুঁজ বের করে ওষুধ দিয়ে যাই। রোগটা ছোঁয়াচে বলে বাড়ির সবাইকে ডাক্তার সতর্ক থাকতে বলে। আর এরপরই ফয়সালসহ তার সব ভাইবোনের দাদীর ঘরে প্রবেশ নিষেধ হয়ে পড়ে।
# ভোরবেলাতেই কান্নার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যাই ফয়সালের। বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। দৌড়ে দাদীর ঘরে যেতেই আবার বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে অথে। বাবা আর চাচু দাদীর বিছানায় বসে কাঁদছে। মা আর চাচিও চোখ মুচছে। বুঝতে বাকি রইলনা আর ফয়সালের। দাদী আর নেই। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে শুরু করে ফয়সালের। একে একে তার সব ভাইবোন এসে হাজির হয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সবাই কান্নাকাটি শুরু করে।
খবর পেয়ে ধীরে ধীরে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আসা শুরু করে। কম বেশি সবাই কান্নাকাটি করতে থাকে। দাদী সবসময় বলেছিলেন যে তিনি মারা গেলে যেন বেশি দেরি না করা হয়। দাদাকে কবর দেয়া হয়েছিল গ্রামের বাড়িতে। আর দাদার পাশেই যেন তাকে কবর দেয়া হয়। কান্নাকাটি করতে করতেই সবায় ধীরে ধীরে সব বন্দোবস্ত করা শুরু করে দেয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হল গ্রামের বাড়িতেই লাশ গোসল করানো হবে।
কিন্তু বিপত্তি তখনই ঘটলো যখন লাশের কাপড় আর খাটিয়া এসে পৌঁছাল। চারজন মিলে চেষ্টা করেও কেও লাশ এক চুল নড়াতে পারলনা। মানুষ মারা গেলে শরীর ভারি হয়ে যায় কিন্তু এতটা কেও দেখেনি। ফয়সালের বাবার একজন মামাতো ভাই বাপারটা দেখে খুব বিরক্ত হয়ে পড়ে। 'আরে একজন বয়স্ক মানুষের লাশ তোমরা তুলতে পারনা। সরে দাড়াও তোমরা।' সবাই সরে দাঁড়ালে ফয়সালের সেই চাচা একাই দাদীর লাশ তুলে ফেলেন। কিন্তু ভারসাম্য রাখতে না পেরে লাশসহই তিনি পড়ে যান। মুহূর্তের মধ্যে ফয়সালের বাবা হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।
'তোমরা এ কি করলে। আমার মরা মায়ের লাশ এতটা অবহেলা কিভাবে করতে পারলে।' ফয়সালও আরও ভেঙ্গে পড়ে বাবার অবস্থা দেখে। তার মা আর চাচি ফয়সালের বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। চাচু তখন মাথায় হাত দিয়ে পাথরের মত বসে থাকে শুধু।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে মোটামুটি আট-দশ জন মিলে দাদীর লাশ খাটিয়ায় তুলতে সক্ষম হয়। অনেক কষ্ট করে খাটিয়া মাইক্রোবাসে রেখে দেয়ার পর সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাচে। তাড়াতাড়ি রওনা দিলে গ্রামেই যোহরের নামাজের পর জানাজা দেওয়া সম্ভব তখনও ছিল। তাই যে যেই কাপড় পরেছিল সে সেই কাপড় পরে তাদের ভাড়া করা বাসে উঠে পড়ে।
গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে মোটামুটি এক ঘণ্টা লেগে যায়। ততক্ষণে গ্রামের সবাই দাদীর মৃত্যুর খবর জেনে যায়। বাড়ির আঙিনায় খাটিয়া রেখে দিলে গ্রামের সবাই একে একে দাদীর চেহারা শেষবারের মত দেখে নেয়। কিন্তু মসজিদে খাটিয়া নিতে গেলে আবারও বিপত্তি দেখা যায়।
দাদীর লাশ আগের থেকে অনেক ভারী হয়ে পড়েছে। এবার আট জন মিলেও খাটিয়া তুলে আবার রেখে দেয় পড়ে যাওয়ার ভয়ে। কিভাবে লাশ নেয়া যায় সবাই চিন্তা করতে থাকে। কিন্তু সময় যত পেরোতে থাকে তত বেশি ভারি হতে থাকে দাদীর লাশ।
একটা পর্যায়ে খাটিয়া নাড়ানোই একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে। মসজিদের হুজুরকে ডেকে আনা হলে তিনি দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দেন। কিন্তু কিছুই হয় না। সবাই এইবার ভয় পেয়ে যায়। গ্রামের লোকজন বলাবলি করতে থাকে এই লাশ এখন না সরালে দাদীর আত্মার ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে পারে।
এবার গ্রামের যত শক্তিশালী যুবক ছিল সবাই তারা একত্র হয়। তারপর তার থেকে একটু কম শক্তিশালীরা একত্র হয়। খাটিয়ার চার পাশের চারটা বাঁশ তিন জন করে মোট বার জন তুলে ধরে কাঁধে নেয়। এরপর দুইপাশে আরও ছয়জন যুক্ত হয়ে অনেক কষ্ট করে সবাই সরাসরি রওনা হয় গোরস্তানের দিকে।
জানাজার নামাজের পর অনেক কষ্ট করে লাশ কবরে নামাতে হয়। একটা পর্যায়ে একজনের হাত ফসকে গেলে লাশের মাথা আছড়ে পড়ে। সবাই নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। এমন কেন হছে সবাই ভাবতে থাকে। কিন্তু অবশেষে দাফন সম্পন্ন সম্ভব হলে সবাই মোনাজাত করে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যায় গ্রামের বাড়িতে।
# ফয়সাল আর তার পরিবারের সবাই ও আত্মীয়স্বজন চুপচাপ বসে থাকে অনেকক্ষণ। কেউ কারও সাথে কথা বলে না। একটা সময় শহরে ফিরার জন্য প্রস্তুতি নেয় সবাই। ভাড়া করা মাইক্রোবাস আর বাসটাতো সারাদিন তাদের সাথে থাকবে না।
বাসের সিটে গা এলিয়ে দিতেই চোখ বন্ধ হয়ে যায় ফয়সালের। সারাদিন অনেক দৌড়াদৌড়ির মধ্য দিয়ে গিয়েছে সবাই। একটা সময় ফয়সাল ঘুমিয়ে পড়ে। আর তখনই সে দেখে তার দাদী তাকে বলছে, 'আমি যেতে চাইলাম না। এরপরও তোরা আমাকে কবরে পাঠায় দিলি?' দাদী কান্নায় ভেঙে পড়লে ফয়সাল ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে। তার নিজেরও চোখ থেকে তখন অঝোরে পানি ঝরছে। পাশে অর্পিতার দিকে তাকাতেই দেখে সেও কাঁদছে। ফয়সাল অস্ফুট স্বরে বলে শুধু, 'দাদী।' বাকিটা তখন অর্পিতা বলে, 'যেতে চায়নি। আমরা জোর করে...।'
এরপর ওরা দুইজন দেখে বাসের সবাই একে একে জেগে উঠছে আর কাঁদছে। বুঝতে বাকি রইলনা ওদের যে সবাই একই স্বপ্ন দেখছে। চাচু এসে বাস ড্রাইভারকে জলদি বাস ঘোরাতে বলে আর বার বার তাড়া দিতে থাকে।
# বাস থামতেই ফয়সালের বাবা আর চাচু দৌড়ে গিয়ে কবরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। উন্মাদের মত তারা হাত দিয়েই কবর খুঁড়তে শুরু করে দেয়। ফয়সালের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে ধীরে ধীরে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ ভোর ৪:১৬
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতার সুফল কতটুকু পাচ্ছে সাধারণ মানুষ

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৮

(১) আমলা /সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীর সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব হতাশাজনক। মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের রক্ত দেওয়া দেশের এমন কিছু কখনো আশা কি করছে? বঙ্গবন্ধু এমন কিছু কি আশা... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×