বিকাল ৫ টা
সারাদিন চমৎকার একটা ঘুম দিলাম।অপারেশনের আগে আমি এমন টাইপ ঘুম দেই,শরীর মন সতেজ হয়ে ওঠে,ব্রেন টা ভালো কাজ করতে থাকে।আজকের দিনটা কেমন ছিল বলতে পারবো না।সূর্যটা কি ঠিকমতো আলো দিয়েছিল?কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে।হাই দিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম।জানালা দিয়ে বাতাস আসছে।রেডি হতে হবে।
বিকাল ৬ টা
কিছুক্ষন পড়ন্ত সুর্যটা দেখলাম।অনেককেই জীবনেরই শেষ সুর্যটা দেখা থেকে বঞ্চিত করেছি। সুর্যটা কি লাল,ঠিক তাঁদের ছটফটানি কমে আসলে চুইয়ে চুইয়ে যে গাড়ো লাল রক্ত পড়তে থাকে,ঠিক সেরকম।গায়ে হালকা একটা সুয়েটার,পায়ে চপ্পল।সুয়েটারটা থেকে কেমন যেন বাবার গন্ধ ।
সন্ধ্যা ৭ টা
ভালোই কুয়াশা পড়েছে।আমার জন্য ভালোই,যত কম চোখ দেখবে ততই মঙ্গল।রহিম মিয়ার দোকান থেকে ১ কাপ চা খেলাম।আহ তৃপ্তি।জীবনে কিছু কিছু জিনিস আমি মিস করবো।এই চায়ের মজাটা কিসের সাথে তুলনা করা যায়?মৃত্যু নিশ্চিত জেনে যখন আমার শিকারেরা কাকুতি মিনতি শুরু করে,তাদের চোখে আমি মৃত্যুভয় দেখি,সেই সময়টা,সেই তৃষ্ণাটুকু আমি উপভোগ করেছি গরম চায়ের একটি চুমুকের মত।
রাত ৯ টা
বুঝে গেছেন নিশ্চই আমি কে।বাংলায় খুনী,ইংরেজীতে কিলার,যাই হোক।আজ আমার বিশেষ একটা অপারেশন আছে।আমার ভাষায় এটা রোগমুক্তি বলা যেতে পারে।বৃত্তান্ত একটু পরেই বুঝতে পারবেন।একটা ভালো খাওয়ার হোটেল খুঁজছি।ধোয়া ওঠা গরম ভাত,ভুনা গরুর গোশত,সাথে এক টুকরো পেয়াজ,লঙ্কা।সারাজীবন তো এর জন্য যুধ্ব করে গেলাম।
রাত ১০ টা
চানখারপুলের একটা ভাতের দোকান।আমার সামনে একপ্লেট ভাত।গরুর গোশত।আমি বসে বসে ধোয়া ওঠা দেখছি।দেখতে ভালোই লাগছে।কেমন জানো কান্না চলে আসছে।আশ্চর্য তো,ঠান্ডা মাথার খুনী যার কিনা মৃত্যুভয়ে ভীত কোন মানুষের কান্না দেখে সামান্য একটু মায়া লাগেনি,চোখের একটা পাপঁড়ি কাঁপেনি সে কিনা আজ গরম ধোয়া ওঠা এক প্লেট ভাত দেখে কাঁদছে।উঠে পড়লা।ভাতগুলো অপেক্ষা করুক।মলিন হয়ে যাক,পোকায় খাক,আমি তো সারাজীবনই অপেক্ষা করলাম।আমাকে তো পোকায় খেল,ভাত,হাহ।
রাত ১২ টা
কুয়াশা আর শীত।রাস্তা প্রায় জনশুন্য।কুকুরের মত কুন্ডলী পাকানো কিছু মানুষ দেখছি।চাঁদ নেই,চাঁদ কি জিনিস আবার?আমি অন্ধকারের বাসিন্দা,চাঁদ সুর্য আমার জন্য নিষিধ্ব।ধ্যাত্তের।
রাত ২ টা
চিপা কানাগলিটার ঠিক শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছি।এখানে আমি হাত লাল করতে আসতাম।আজ আবার করব,হাত,বুক,কলিজা।শেষবার।কি ভাবছেন,এরপর ভালো হয়ে যাব?তা তো যাবোই।এটাই শেষ।
রাত ২,৩০ মিনিট
ওঁরা আসে।ঠিক রাত ৩ টায়।আমাকে ভয় দেখায়,আমাকে নিয়ে যেতে চায়।আমি ভীষন ভয় পাই।তড়াক করে ঘুম থেকে উঠে পড়ি।বালিশের পাশে পানির গ্লাসের বদলে ঠান্ডা পিস্তলটা পাই।আমার মতই তৃষ্ণার্ত।ওঁরা আসে।স্বপ্নে,জাগরনে,এখানে সেখানে।ওফ আমি না পাগল হয়ে যাচ্ছি।ওঁরা আমাকে নিয়ে যাবে।শুধু বুকের বা পাশটায় হাত দেয়।কালচে হয়ে আছে,গুলি করার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা আমার।ওঁরা বুক চেপে ধরে।আমি ব্যাথায় অজ্ঞান হয়ে যাই।আর পারা সম্ভব হচ্ছে না।ওরা দল বেধে আসে।নতুন নতুন মুখ,আমিই যাদের ওঁদের দলে ভীড়িয়েছি।ইচ্ছে হয় ওঁদের সব কয়টাকে গুলি করে উড়িয়ে দেই,আমি গুলি চালাই।গুলি ফাকা দেয়ালে বিধ্ব হয়।মৃত মানুষদের যে গুলী ভেদ করতে পারে না।এটাই আমার রোগ।ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে আছি।ওঁরা আসবে।আমাকে রোগমুক্তি দিবে।আমিও তারপর ওঁদের একজন হয়ে যাব।
রাত ৩ টা
পিস্তলের নলটা বুকের বা পাশে ঠেকালাম।কি ঠান্ডা,আমি শিউরে উঠি।আঙ্গুল শক্ত হয়ে চেপে বসেছে ট্রিগারে।ওঁরা আসছে,ঐতো,আমাকে ডাকছে,আয় আয়,আমি আশু রোগমুক্তির আনন্দে বিভোর।
রাতের নির্জনতা খান খান করে দিল যে শব্দ,কেউ তা শুনলো না।কুয়াশা কেটে যাচ্ছে,চাঁদটা উকি দিয়ে শুধু আমার অন্তর্ধানের সাক্ষী করে রাখলো নিজেকে।