রওনা দিল ওরা । সামনের ঘোড়াটা খুব পরিস্কার ট্রেইল রেখে গেছে । কিন্তু সিকি মাইল যেতেই দেখা গেল মাটিতে তিনটে মেসকিটের ভাঙ্গা ডাল দিয়ে আরেকটা পথ নির্দেশক তীর চিহ্ন রাখা ।
চেয়ে রইল নীল ওটার দিকে । ব্যাপারটা এখন ব্যাক্তিগত পর্যায় চলে গেছে । লোকটা স্পষ্টই খেলা করছে ওদের সাথে । ও নিশ্চয়ই জানে ব্যাপারটা কিমেল বা হার্ডিনের মত একগুঁয়ে লোক কীভাবে নেবে । এটা স্পষ্ট একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে সে ওদের দিকে । পুরোপুরি অবজ্ঞা করছে সে ওদের দলটাকে ।
কাটিয়ে আসা বেসিনের বিশাল শুন্যতা আবছা হয়ে আসছে বিকেলের মরা বেগুনি আলোয় । ডানদিকের পর্বতের দেয়াল আরো খাড়া আর লালচে রং নিচ্ছে । আগের পোড়া লাল রং এখন আরো গাঢ় লাল হয়েছে, আর এখানে সেখানে শাদা কোয়ার্টজের রেখা ক্লিফের গা বেয়ে নেমে এসেছে যেন শাদা লম্বা আঙ্গুল ।
ওরা সবাই পরের মেসেজটা দেখল, কিন্তু চোখ ফিরিয়ে রাখল যেন চোখে না দেখতে হয় । ক্লিফের কালচে দেয়ালে লম্বা তীর চিহ্ন টেনে পাশে লেখা, 'ছায়ায় চল, নইলে রোদে তাপে অসুস্থ হয়ে পড়বে ।'
ঘোড়া হাঁকিয়ে চলল ওরা । কয়েক মাইল দুরে গিয়ে যখন ছায়ারা লম্বা হয়ে উঠেছে । বেশ কয়েকটা পথচিহ্ন চোখে পড়ল ওদের । ছয়জন মানুষই এখন শ্রান্ত, ক্লান্ত । ওদের ঘোড়াগুলোও ধীরে চলছে । মরুভুমির বাতাস শীতল হতে শুরু করেছে । ধাওয়াটা অনেকক্ষন ধরেই হচ্ছে ।
পাশাপাশি চলতে থাকা কিমেল আর কেসনি হঠাৎ ঘোড়ার রাশ টেনে ধরল । সামনে একটা পাথুরে দেয়াল আর তীরচিহ্ন এবার নীচের একটা গভীর খাদ নির্দেশ করছে ।
'তোমার কী মনে হয় হার্ডিন? ও কিন্তু একজন একজন করে আমাদের ফেলে দিতে পারে ।' ইতস্তত করে একটা সিগারেট ধরিয়ে পরিস্থিতি জরিপ করল হার্ডিন ।
'এখন পর্যন্ত সেটা করেনি ও ।' নীলের মন্তব্যটা একটা শান্ত পুকুরে ঢিল পড়ার মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল । বাকি পাঁচজন ভেবে দেখল এ মন্তব্যের তাৎপর্য । অপেক্ষা করছে নীল ।
লক ইচ্ছা করলেই এদের দুয়েকজন বা প্রায় সবাইকেই রাইফেল দিয়ে গুলি করে ফেলে দিতে পারত । কেন করেনি সেটা সে ? ও কী আঁধার নামার অপেক্ষায় আছে যখন সটকে পড়তে সুবিধা হবে ওর? নাকি ওদের সবাইকে ফাঁদে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সে ?
'জাহান্নামে যাক সব !' বিস্ফোরিত হল হার্ডিন । পাঁই করে ঘোরাল সে ঘোড়াটাকে, পিস্তল হাতে নামতে শুরু করল খাদ বেয়ে । একজন একজন করে ওকে অনুসরণ করল ওরা সবাই । শীতল আর্দ্র হাওয়া আর অন্ধকার চারপাশে ঘন হয়ে উঠছে । ট্রেইলটা আবার ওপরের দিকে ফিয়ে একটা ছোট বেসিনে উঠে এল । সামনে পানি পড়ার মৃদু কলতান, ঘন হয়ে জন্মানো গাছের অন্ধকার ।
হুঁশিয়ার হয়ে সামনে এগোচ্ছে , এমন সময় হঠাৎ সামনে আগুন জ্বলতে দেখল ওরা । দ্রুত হাতে ঘোড়া থামিয়ে, জিন থেকে পিছলে নামল হার্ডিন । অন্যরা অনুসরণ করল ওকে । ছড়ান অর্ধবৃত্তাকারে সাবধানে ওরা এগোল আগুনের দিকে । সবার আগে পৌঁছুল কেসনি । ওর গালাগালের ফোয়ারা, চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ফেলল কাঁচের মত ।
আগুনটা জ্বালান হয়েছে, ছোট্ট একটা পানির স্রোতে পাশে । আগুনের ধারে চমৎকারভাবে কাঠকুটো ডাঁই করে রাখা হয়েছে । পাথরের ওপর বিছান একটা কাগজের ওপর যত্ন করে রাখা কফির ছোট্ট স্তুপ, পাশে আরেকটা স্তুপ, সেটা চিনির । মিনিট খানেক কোন কথা বলতে পারলনা কেউ । বিদ্রুপটা সুস্পষ্ট, মর্মে বিঁধছে ওদের । শুধু ট্রেইলেই বোকা বানায়নি ওদের লোকটা । দিনের শেষে যত্ন করে ক্যাম্প বানিয়ে দিয়েছে ওদের ।
'মাথায় বাজ পড়বে আমার, যদি আমি এসব ব্যবহার করি !' ফেটে পড়ল শর্ট । 'আমি মরুভুমিতে গিয়ে ঘুমাবো !'
'তো যাই হোক,' হার্ডিনের দার্শনিক মন্তব্য । 'পেয়েই যখন গেছি, তখন জিনিসগুলোর সদ্ব্যাবহার করাই ভাল । রাতের বেলা অন্ধকারে ওর পিছে লাগতে পারবনা আমরা ।'
পোঁটলা হাতড়ে একটা কফিপট বের করে ঝর্ণা থেকে পানি তুলল কিমেল । অন্যরা খাবার বের করতে শুরু করল, শুধু কেসনি, আগুনের দিকে চেয়ে বসে রইল মুখ গোমড়া করে । পাশে রাখা জ্বালানির স্তুপ থেকে একটা কাঠি তুলে নিয়ে এমন ভাব করল যেন সাপ দেখছে সে । উঠে চলে গেল বনের মধ্যে এবং মিনিটখানেকের মধ্যেই ফিরে এল সে ।
চারপাশে জরিপ করে দেখছিল সাটার, হঠাৎ মুখ খুলল সে । 'আমি জানি এ জায়গাটা কোথায় ! শুধু ওই খাদটার কথা জানতামনা আমি । এটা মরমন ওয়েল !'
সোজা হয়ে উঠে বসল হার্ডিন । 'খাঁটি কথা বলেছ তুমি ! এদিকটায় ছ'সাত বছর আসিনি আমি ।'
আসনপিঁড়ি হয়ে বসল সাটার । 'দেখো !' কাঠি দিয়ে বালির ওপর নকশা আঁকছে সে । 'এইখানে মরমন ওয়েল, যেখানে আমরা আছি । এইদিকে উত্তর-পুর্ব দিকে আছে আছে একটা পুরনো করাতকল । করাতকলটার ওপরেই আছে একটা পানির ট্যাংক । আমি গরুর একটা রান বাজি ধরতে পারি, খুনী লোকটা ওই করাতকলের মধ্যে আজ রাতের মত ঘাঁটি গেড়েছে ।'
কেসনি, লকের পথচলতি 'অপমান' গুলো সবচেয়ে বেশি বিঁধেছে যার মনে, উবু হয়ে বসে ভেজা বালিতে আঁকা নকশাটা দেখতে শুরু করল । মাথা নাড়তে শুরু করেছে চিন্তিতভাবে ।
'খাঁটি কথা বলেছে ও ! আমিও চিনেছি করাতকলটা । একবার ঝড়ে ওর ভেতর আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি । টানা দুদিন ছিলাম আমি ওখানে । পিচ্ছিল লোকটা যদি ওখানে থাকে, তবে ওকে পাকড়াও করতে পারব আমরা ।'
খেতে খেতে শলা-পরামর্শ করল ওরা । এই অন্ধকার রাতে এরকম দুর্গম পার্বত্য পথে পথ চলা প্রায় অসম্ভব । এমন কী যদি চলতে পারেও, ওর ঘোড়াটা তা পারবেনা । বিশ্রাম দরকার বাকস্কিন ঘোড়াটার । এত সময় নষ্ট করেছে লক চলার পথে ওদের সাথে রসিকতা করতে, যে ও নিশ্চয়ই খুব বেশি সামনে যেতে পারেনি । অতএব ধরে নেয়া যেতে পারে, গোটা ব্যাপারটা ও আগে থেকেই প্ল্যান করে করেছে রেখেছিল সে । তাহলে সামনের করাতকলে আশ্রয় নেয়াটাই ওর পক্ষে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ব্যাপার ।
'আমরা ওকে চমকে দেব.' জানাল হার্ডিন । করাতকলটা ভারী গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি, প্রচুর কার্তুজ আছে এমন একজন রাইফেলধারী মানুষ সপ্তাহখানেক ঠেকিয়ে রাখতে পারবে আমাদের ।'
'ওর কাছে কী যথেষ্ট কার্তুজ আছে ?'
'নিশ্চয়ই আছে,' জানাল নীল । 'আমি বনটনে ছিলাম ও যখন সওদা কিনছে । খাবারদাবার আর প্রচুর .৪৪ বোরের কার্তুজ কিনেছে ও । ওর কোল্ট কিংবা উইনচেস্টার, দুরকম অস্ত্রেই ব্যবহার করা যাবে এরকম গুলি ।'
যদিও মুখ ফুটে বলেনি ওরা কেউ, মনে মনে ওরা সবাই লোকটার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছে, সন্দেহ মিশ্রিত শ্রদ্ধা । এরকম একটা লোক কী কার পিঠে গুলি করতে পারে ? ওদের কাছে পরিস্কার আলামত আছে, অন্তত ওদের তাই ধারনা ।
কিন্তু শ্রদ্ধা বাইরেও একটা কিছু আছে । শুধু বিচারের কাঠগড়াতেই লোকটাকে দাঁড় করাতে হবে তাই নয়, ওদের প্রত্যেকের ব্যাক্তিগত মানইজ্জত নিয়ে টান দিয়েছে লোকটা । শুধু খুব পরিস্কার ট্রেইলই রেখে যায়নি লোকটা পেছনে, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে পথচিহ্নও রেখে গেছে সে । যেন ট্র্যাকিংএর ব্যাপারে ওরা সব কচিখোকা । ওদের মধ্যে এমন লোক আছে, যে পাইনবনের বনের মধ্যে একটা কাঠ-উকুনকে ট্র্যাক করতে পারে ।
'সে যাই হোক,' অনিচ্ছার সাথে বলল কিমেল । 'লোকটা আমাদের জন্য ভাল কফি রেখে গেছে !'
কফিতে চুমুক দিয়ে একমত হল অন্যরা । পৃথিবীতে কফির মত এমন খুব কম জিনিসই আছে , যা হিমেল রাতে ক্যাম্পফায়ারের ধারে, সারাদিন খাটাখাটুনির পর মানুষের দেহমনকে চাঙ্গা করে তুলত পারে । কফি পান করে দেহমনে সতেজ অনুভব করছে ওরা । আর তার সাথেসাথেই সন্দেহের বীজ ডালপালা মেলছে ওদের মনে ।
'আমাদের দুয়েকজনকে অনায়াসে মেরে ফেলতে পারতো ও,' মন্তব্য করল সাটার । 'এ লোক ট্রেইল বোঝে ।'
'আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে,' কেসনির মতামত । 'লোকটা এদিককার পাহাড়পর্বত, এত ভাল করে চেনে, ও যদি আমাদের চোখে ধুলো দিতে চাইত অনেক আগেই তা করতে পারত ।'
কেউ উত্তর দিলনা এ কথার । হার্ডিন পেছনে হেলান দিয়ে বসে, প্যান্টের চামড়ায় সেঁটে থাকা পায়ের কাপড় ঢিলে করল । শর্ট আরেকটা কাঠি ফেলল আগুনে ।
'করাতকলটা খুব বেশি দুরে নয়,' বলল শর্ট । 'গিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখব নাকি ?'
'পরে,' বলল হার্ডিন । 'অনেক ধকল গেছে আজ সারাদিনে ।'
'দুটো গুলিই কী জনির পিঠে লেগেছিল ?'
প্রশ্নটা প্রেতের মত ওদের মধ্যে ঘুরতে লাগল । অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে উঠল শর্ট, চোখ গরম করে চারদিকে দেখল কেসনি । 'অবশ্যই, তাই না হার্ডিন ?'
'নিশ্চয়ই,' বিরতি নিল সে । 'না, ভুল বললাম । একটা গুলি বাঁ বাহুর নীচে লেগেছিল । পাঁজরের দুটো হাড়ে বিঁধেছিল গুলিটা । অন্যটা সোজা মেরুদন্ড ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে ।'
'জাহান্নামে যাক সব !' ঘোষনা করল কেসনি । ' কোন রাস্তার স্কোয়াটার এসে আমাদের এলাকায় এসে আমাদের একজন ছেলেকে গুলি করে মারতে পারেনা । দুটো গুলিই পিঠে লেগেছে, আমি দেখেছি জখমগুলো । একটা পিঠে, মেরুদন্ডের কাছে, জনি নিশ্চয়ই ঘুরতে যাচ্ছিল পিস্তল ড্র করার জন্য, এমন সময় বুকে বিঁধেছে দ্বিতীয় গুলিটা ।'
ওদের কেউ ঘটনাটা ঘটতে দেখেনি, নীল ভাবল । ওরা তবে অবিচার করতে চলেছে সম্পুর্ন অপরিচিত একজন মানুষের ওপর ? ভাবতে গিয়ে নিজেকে বেঈমান মনে হল, কিন্তু লোকটা সম্বন্ধে শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হচ্ছে তার মনে ।
আগুনের শিখা কাঁপছে, ছায়ারা এক ধীর লহরীতে নাচছে পেছনের গাছের অন্ধকার পটভুমিতে । পাশে রাখা একটা কাঠ থেকে বাক ছিলে আগুনে ফেলল সে । আগুন ধরে স্ফুলিঙ্গ ছেটাল কয়েকবার তারপর জ্বলে উঠল । হার্ডিন ঝুঁকে পড়ে কফিপটটা আগুনের আরেকটু কাছে ঠেলে দিল । কেসনি ওর উইনচেস্টারে গুলি ভরা আছে কীনা পরীক্ষা করে দেখল ।
'করাতকলটা কতদুরে হার্ডিন?'
'মাইল ছয়েক হবে ।'
'তাহলে রওয়ানা হওয়া যাক ।' উঠে দাঁড়িয়ে বালি ঝাড়ল শর্ট । 'বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে তাড়াতাড়ি । আমার ছেলেদের বলেছি নতুন বেড়া তুলতে । তোমাকে হয় ওদের কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে, নইলে ওরা পাহাড়ময় ছোটাছুটি করে নরক গুলজার করে তুলবে ।'

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


