somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুশ দেশের সত্যিকথা ১

১১ ই জুন, ২০০৭ রাত ১০:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(রুশ সাম্রাজ্য অর্থাৎ অভিজাত তন্ত্র বিদায় নিয়েছে প্রায় নব্বই সাল আগে । তার ধ্বংসাবশেষের উপর গড়ে ওঠা সোভিয়েত রাজ, সেও ভেঙ্গে গেল সতেরো সন হয়। কিন্তু এখনো সেইসব অভিঘাত-সংকট আর টানা পোড়েন প্রাসঙ্গিক, সে সবের বিপর্যয়-দুর্যোগ আর বিপ্লবের প্রতিধ্বনি এখনো পৃথিবীতে বেজে চলেছে ।

জ্বিনের বাদশার উস্কানিতে শুরু করলাম । কতদূর টেনে নিতে পারবো জানি না । তবে আপনারা সাথে থাকলে কিছু দূর তো যাবে অবশ্যই)

ফিনল্যান্ড উপসাগরের পশ্চিম-দিগন্তে অস্তগামী সুর্য পুরো ডুবে যাওবার আগেই রুশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে পূব অংশে বেরিং সাগরে পূব দিগন্তে সু্র্য উঁকি দেয় । মাত্র তিনটে দেশ সম্বন্ধে এ কথা বলা যায়, রাশিয়া, ক্যানাডা আর মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্র । (ফরাসী, ইংরেজ, পর্তুগিজ আর ডাচ সাম্রাজ্য সম্বন্ধেও এ কথা খাটত বটে তবে তা সাগরপারের নানান বিচ্ছিন্ন ভুখন্ডের সমষ্টি, একীভুত কোনো দৈত্যাকার মহাদেশীয় রাষ্ট্র নয় ) । এবং তুরষ্ক বাদে রাশিয়া পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেটা ইউরোপ আর এশিয়া এ দুই মহাদেশে পড়েছে ।

তবে রুশ শাসকরা সবসময়ে নিজেদের ইউরোপিয়ান ভাবতে ও পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন । যদিও সেটা সমস্ত ইওরোপিয়ানদের পছন্দ ছিল না, এবং গোঁড়া রুশ অর্থোডক্সরাও মস্কোকে 'দ্বিতীয় বাইজান্টিয়াম' বা 'তৃতীয় জেরুসালেম' বলে ভাবতে পছন্দ করত । তাদের ধারনা ছিল 'প্রকৃত' খ্রীষ্ট ধর্মের তারাই একমাত্র ও সর্বপ্রথম হকদার । পশ্চিমের খ্রীষ্ট-ধর্ম কলুষিত ও ভ্রষ্ট । প্রথমে রোমের পদস্থলন ঘটেছে তারপরে লুথার সেটাকে বিভ্রান্তির নতুন গহ্বরে নিয়ে ফেলেছেন ।


সে যাই হোক, মহামতি সম্রাট পিটার (বা পিওতর, বুঝবার ও উচ্চারনের সুবিধার জন্য ইংরেজি বানান রীতি অণুসরণ করা হয়েছে যথা সম্ভব) প্রায় গায়ের জোরে রাজধানী সেইন্ট পিটার্সবু্র্গে স্থানান্তরের পরে যতদূর সম্ভব পাশ্চাত্যকরণের চেষ্টা করেছেন । ফিনল্যান্ড উপসাগরের তীরের বন্দর-নগর-রাজধানীটি বলা যায় দুই প্রজন্মের ক্রীতদাস শ্রমে তৈরী । সাগরের ধারের কাদাভরা জলাভুমি গাছের সোজা সোজা গুঁড়ি বুনিয়াদ শক্ত করে মস্ত মস্ত আলিশান সব দালানের ভিত করে তোলা হয়েছে । পিটার ও পলের দূর্গ, শীত প্রাসাদ, গাচিনা প্রাসাদ, আর্মিটেজ, অ্যাডমিরাল্টি ভবন সবই অষ্টাদশ আর ঊনিশ শতকের কীর্তি ।

সেইন্ট পিটার্সবু্র্গকে বলা হতো উত্তরের ভেনিস । অসংখ্য খাল আড়াআড়িভাবে ছেদ করেছে শহরটাকে । সত্যি বলতে কী সেইন্ট পিটার্সবুর্গ অনেকগুলো দ্বীপকে সেতু দিয়ে জোড়া দিয়ে তৈরী । ঊনিশ শতকে অধিকাংশ পর্যটকই মন্তব্য করেছে এ শহরে এলে কেমন যেন ইটালি ইটালি আভাস পাওয়া যায়! অবশ্য তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই কারন ইতালিয়ান কারিগররাই গড়েছে এখানকার বেশিরভাগ দালান কোঠা ।

এই শহরে জড় হয়েছিল রাশিয়ার সবচেয়ে জ্ঞানী-গুণী, প্রতিভাবান আর অপব্যায়ী লোকেরা । তাদের নজর ছিল বার্লিন-প্যারিস কিংবা লন্ডনের বা আরো পশ্চিমের ওয়াশিংটনের দিকে । নিজের দেশের মানুষকে অভিজাত আর বুদ্ধিজীবি উভয় শ্রেণীই করুণা আর অবজ্ঞার চোখে দেখতেন । ধনী লোকেরা ফরাসী রিভিয়েরা বা ইটালির উত্তরে ছুটি কাটাতে যেতেন । আমোদ-ফুর্তি আর জুয়া খেলার জন্য রুশ অভিজাত নন্দনরা বিখ্যাত । বলা যায় মন্টে-কার্লোর জুয়ার দালানগুলোর পত্তন হয়ে রুশ অভিজাতদের পকেট থেকে খসে পড়ে রুবলের তোড়া থেকে ।

কিন্তু ঠিক কোন উৎস থেকে এই বিলাস ব্যাসনের টাকা আসতো? বিশাল বিশাল সব খাস তালুক ছড়ানো ছিল পুরো রাশিয়া জুড়ে । উদয়াস্ত পরিশ্রম করত সেখানকার লাঙ্গল ঠেলা চাষী । চাষি না বলে তাদের জমিদারের ঘানিতে জুড়ে দেয়া বলদ বলল অনেক ঠিক হবে কারন ১৮৬২ সালে আগ পর্যন্ত চাষীদের একটা বড় অংশ ছিল "সার্ফ"--ভুমিদাস (সার্ফ শব্দটা ল্যাটিন servus থেকে এসেছে মানে সার্ভ বা সেবা করে) । এস্টেটের অংশ ধরা হতো তাদের, পিতার মৃত্যুতে পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরাধিকারী হতো এদের ।

যেন এরা মানুষ নয়, গরু-ছাগল বা ভেড়া । ঠিক অস্থাবর সম্পত্তির মতোই কেনা বেচা হতো সার্ফরা । একটা ভাল ঘোড়ার জন্য কোনো অশ্ববিলাসী ভুস্বামী পঞ্চাশ বা একশো জন ভুমিদাসের মালিকানা হস্তান্তর করেছেন এমন ঘটনা খুব বিরল নয় । ইভান তুর্গেনেভ (বিখ্যাত আলোকপ্রাপ্ত জমিদার নন্দন) বলেছেন একবার বাগানের একটা গোলাপ ছিঁড়ে ফেলায় তুর্গেনেভের মা, বাড়ির সব সার্ফকে (সংখ্যায় ত্রিশ চল্লিশজন হবে ) চাবুক পেটা করেছিলেন, এই রকম কিছু ঘটনাই নাকি তুর্গেনেভকে রুশ সামন্ত জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল । তলস্তয়দেরও সার্ফ ছিল মেলা--মহান লেভ (তলস্তয়) যৌবনে অন্তত একজন ভুমিদাস রমনীকে পোয়াতি করেছিলেন বলে সুষ্পষ্ট আলামত আছে ।

কিছূ কিছু দূরাচার আছে তা এতোই, অমোচনীয় ভাবেই কেলেংকারীজনক যে সবচেয়ে অত্যাচারী শাসকও নিজের স্বার্থেই সে সব মোচন করার উদ্যোগ নেন । আমাদের দেশে যেমন শ্বেতাঙ্গ নীলচাষীদের উৎপাতে খোদ ইংরেজ সরকার বাহাদুরই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন, স্পষ্ট বুঝেছিলেন এদেরকে শক্তহাতে না ধরলে বিশাল প্রজাবিদ্রোহের ঘটনা ঘটবে । তো সেরকমই রাশিয়াতেও মধ্য সার্ফ তন্ত্রের যে অবসান ঘটানো দরকার তা মধ্য ঊনিশ শতকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ।

তবে ১৮৬২ সালে বিড়ালে গলায় ঘণ্টা বাঁধার কৃতিত্ব জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের । অবশ্য ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বেধড়ক মার খেয়েছিল রাশিয়া সেটাও একটা কারন । 'মুক্তিদাতা জার' নামটি তাই দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের নামের আগে লেখা হয় । সার্ফ তন্ত্র ইউরোপের প্রায় সব জায়গাতেই ছিল কিন্তু ঊনিশ শতকে ছিল খুব অল্প কিছু জায়গায় । ব্যাপারটা অনেক অভিজাত রুশের কাছেও ছিল সন্মানের প্রশ্ন

আরো অনেক কিছু করেছিলেন এই সম্রাট । সেন্সরশিপ শিথিল করা, স্থানীয় পর্যায় নির্বাচন আরো অনেক কিছু । তা এসব করেও সব মহলে মন পাননি তিনি । ভুমি সংস্কারের পুরো সুফল জোটেনি বেশীরভাগ চাষীর কপালে । তাদের সন্তানরা শহরে গিয়ে নৈরাজ্য আর সন্ত্রাসবাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত হতে থাকল । (আর আরো অনেক কিছুর মতো নিহিলিজম ও পশ্চিম থেকে আমদানী করেছীল রুশরা) । শেষ মেষ ১৮৮১ সালে জারের গাড়ি বহরে বোমা মেরে গুরুতর জখম করে দিল কতিপয় নিহিলিস্ট । বোমার আঘাতে আলেকজান্ডারের পেটের নীচের অংশ ছিন্ন ভিন্ন অংশ হয়ে গিয়েছিল । গাড়ি প্রাসাদে ফেরার কিছু পরেই মারা যান তিনি ।

গদিতে বসলেন জার তৃতীয় আলেকজান্দার । বাবার উদারনীতির ফল তিনি নিজের চোখে দেখেছেন । 'মুক্তিদাতা জারের' ভাগ্যে জুটেছে আততায়ীর বোমা । এই বাঞ্চোত দেশবাসীকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না ! সব শালাকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেয়া হবে । উপরে ঈশ্বর আর নীচে তাঁর প্রতিনিধি জার । একনায়ক তো অনেকই ছিল, কিন্তু নিজেকে অফিশিয়ালি "আফতোক্রাত" (অটোক্র্যাট) ঘোষনা দিয়েছে কয়জন ?
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০০৭ সকাল ১০:১৫
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×