জ্বিনের বাদশার উস্কানিতে শুরু করলাম । কতদূর টেনে নিতে পারবো জানি না । তবে আপনারা সাথে থাকলে কিছু দূর তো যাবে অবশ্যই)
ফিনল্যান্ড উপসাগরের পশ্চিম-দিগন্তে অস্তগামী সুর্য পুরো ডুবে যাওবার আগেই রুশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে পূব অংশে বেরিং সাগরে পূব দিগন্তে সু্র্য উঁকি দেয় । মাত্র তিনটে দেশ সম্বন্ধে এ কথা বলা যায়, রাশিয়া, ক্যানাডা আর মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্র । (ফরাসী, ইংরেজ, পর্তুগিজ আর ডাচ সাম্রাজ্য সম্বন্ধেও এ কথা খাটত বটে তবে তা সাগরপারের নানান বিচ্ছিন্ন ভুখন্ডের সমষ্টি, একীভুত কোনো দৈত্যাকার মহাদেশীয় রাষ্ট্র নয় ) । এবং তুরষ্ক বাদে রাশিয়া পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেটা ইউরোপ আর এশিয়া এ দুই মহাদেশে পড়েছে ।
তবে রুশ শাসকরা সবসময়ে নিজেদের ইউরোপিয়ান ভাবতে ও পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন । যদিও সেটা সমস্ত ইওরোপিয়ানদের পছন্দ ছিল না, এবং গোঁড়া রুশ অর্থোডক্সরাও মস্কোকে 'দ্বিতীয় বাইজান্টিয়াম' বা 'তৃতীয় জেরুসালেম' বলে ভাবতে পছন্দ করত । তাদের ধারনা ছিল 'প্রকৃত' খ্রীষ্ট ধর্মের তারাই একমাত্র ও সর্বপ্রথম হকদার । পশ্চিমের খ্রীষ্ট-ধর্ম কলুষিত ও ভ্রষ্ট । প্রথমে রোমের পদস্থলন ঘটেছে তারপরে লুথার সেটাকে বিভ্রান্তির নতুন গহ্বরে নিয়ে ফেলেছেন ।
সে যাই হোক, মহামতি সম্রাট পিটার (বা পিওতর, বুঝবার ও উচ্চারনের সুবিধার জন্য ইংরেজি বানান রীতি অণুসরণ করা হয়েছে যথা সম্ভব) প্রায় গায়ের জোরে রাজধানী সেইন্ট পিটার্সবু্র্গে স্থানান্তরের পরে যতদূর সম্ভব পাশ্চাত্যকরণের চেষ্টা করেছেন । ফিনল্যান্ড উপসাগরের তীরের বন্দর-নগর-রাজধানীটি বলা যায় দুই প্রজন্মের ক্রীতদাস শ্রমে তৈরী । সাগরের ধারের কাদাভরা জলাভুমি গাছের সোজা সোজা গুঁড়ি বুনিয়াদ শক্ত করে মস্ত মস্ত আলিশান সব দালানের ভিত করে তোলা হয়েছে । পিটার ও পলের দূর্গ, শীত প্রাসাদ, গাচিনা প্রাসাদ, আর্মিটেজ, অ্যাডমিরাল্টি ভবন সবই অষ্টাদশ আর ঊনিশ শতকের কীর্তি ।
সেইন্ট পিটার্সবু্র্গকে বলা হতো উত্তরের ভেনিস । অসংখ্য খাল আড়াআড়িভাবে ছেদ করেছে শহরটাকে । সত্যি বলতে কী সেইন্ট পিটার্সবুর্গ অনেকগুলো দ্বীপকে সেতু দিয়ে জোড়া দিয়ে তৈরী । ঊনিশ শতকে অধিকাংশ পর্যটকই মন্তব্য করেছে এ শহরে এলে কেমন যেন ইটালি ইটালি আভাস পাওয়া যায়! অবশ্য তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই কারন ইতালিয়ান কারিগররাই গড়েছে এখানকার বেশিরভাগ দালান কোঠা ।
এই শহরে জড় হয়েছিল রাশিয়ার সবচেয়ে জ্ঞানী-গুণী, প্রতিভাবান আর অপব্যায়ী লোকেরা । তাদের নজর ছিল বার্লিন-প্যারিস কিংবা লন্ডনের বা আরো পশ্চিমের ওয়াশিংটনের দিকে । নিজের দেশের মানুষকে অভিজাত আর বুদ্ধিজীবি উভয় শ্রেণীই করুণা আর অবজ্ঞার চোখে দেখতেন । ধনী লোকেরা ফরাসী রিভিয়েরা বা ইটালির উত্তরে ছুটি কাটাতে যেতেন । আমোদ-ফুর্তি আর জুয়া খেলার জন্য রুশ অভিজাত নন্দনরা বিখ্যাত । বলা যায় মন্টে-কার্লোর জুয়ার দালানগুলোর পত্তন হয়ে রুশ অভিজাতদের পকেট থেকে খসে পড়ে রুবলের তোড়া থেকে ।
কিন্তু ঠিক কোন উৎস থেকে এই বিলাস ব্যাসনের টাকা আসতো? বিশাল বিশাল সব খাস তালুক ছড়ানো ছিল পুরো রাশিয়া জুড়ে । উদয়াস্ত পরিশ্রম করত সেখানকার লাঙ্গল ঠেলা চাষী । চাষি না বলে তাদের জমিদারের ঘানিতে জুড়ে দেয়া বলদ বলল অনেক ঠিক হবে কারন ১৮৬২ সালে আগ পর্যন্ত চাষীদের একটা বড় অংশ ছিল "সার্ফ"--ভুমিদাস (সার্ফ শব্দটা ল্যাটিন servus থেকে এসেছে মানে সার্ভ বা সেবা করে) । এস্টেটের অংশ ধরা হতো তাদের, পিতার মৃত্যুতে পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরাধিকারী হতো এদের ।
যেন এরা মানুষ নয়, গরু-ছাগল বা ভেড়া । ঠিক অস্থাবর সম্পত্তির মতোই কেনা বেচা হতো সার্ফরা । একটা ভাল ঘোড়ার জন্য কোনো অশ্ববিলাসী ভুস্বামী পঞ্চাশ বা একশো জন ভুমিদাসের মালিকানা হস্তান্তর করেছেন এমন ঘটনা খুব বিরল নয় । ইভান তুর্গেনেভ (বিখ্যাত আলোকপ্রাপ্ত জমিদার নন্দন) বলেছেন একবার বাগানের একটা গোলাপ ছিঁড়ে ফেলায় তুর্গেনেভের মা, বাড়ির সব সার্ফকে (সংখ্যায় ত্রিশ চল্লিশজন হবে ) চাবুক পেটা করেছিলেন, এই রকম কিছু ঘটনাই নাকি তুর্গেনেভকে রুশ সামন্ত জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল । তলস্তয়দেরও সার্ফ ছিল মেলা--মহান লেভ (তলস্তয়) যৌবনে অন্তত একজন ভুমিদাস রমনীকে পোয়াতি করেছিলেন বলে সুষ্পষ্ট আলামত আছে ।
কিছূ কিছু দূরাচার আছে তা এতোই, অমোচনীয় ভাবেই কেলেংকারীজনক যে সবচেয়ে অত্যাচারী শাসকও নিজের স্বার্থেই সে সব মোচন করার উদ্যোগ নেন । আমাদের দেশে যেমন শ্বেতাঙ্গ নীলচাষীদের উৎপাতে খোদ ইংরেজ সরকার বাহাদুরই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন, স্পষ্ট বুঝেছিলেন এদেরকে শক্তহাতে না ধরলে বিশাল প্রজাবিদ্রোহের ঘটনা ঘটবে । তো সেরকমই রাশিয়াতেও মধ্য সার্ফ তন্ত্রের যে অবসান ঘটানো দরকার তা মধ্য ঊনিশ শতকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ।
তবে ১৮৬২ সালে বিড়ালে গলায় ঘণ্টা বাঁধার কৃতিত্ব জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের । অবশ্য ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বেধড়ক মার খেয়েছিল রাশিয়া সেটাও একটা কারন । 'মুক্তিদাতা জার' নামটি তাই দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের নামের আগে লেখা হয় । সার্ফ তন্ত্র ইউরোপের প্রায় সব জায়গাতেই ছিল কিন্তু ঊনিশ শতকে ছিল খুব অল্প কিছু জায়গায় । ব্যাপারটা অনেক অভিজাত রুশের কাছেও ছিল সন্মানের প্রশ্ন
আরো অনেক কিছু করেছিলেন এই সম্রাট । সেন্সরশিপ শিথিল করা, স্থানীয় পর্যায় নির্বাচন আরো অনেক কিছু । তা এসব করেও সব মহলে মন পাননি তিনি । ভুমি সংস্কারের পুরো সুফল জোটেনি বেশীরভাগ চাষীর কপালে । তাদের সন্তানরা শহরে গিয়ে নৈরাজ্য আর সন্ত্রাসবাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত হতে থাকল । (আর আরো অনেক কিছুর মতো নিহিলিজম ও পশ্চিম থেকে আমদানী করেছীল রুশরা) । শেষ মেষ ১৮৮১ সালে জারের গাড়ি বহরে বোমা মেরে গুরুতর জখম করে দিল কতিপয় নিহিলিস্ট । বোমার আঘাতে আলেকজান্ডারের পেটের নীচের অংশ ছিন্ন ভিন্ন অংশ হয়ে গিয়েছিল । গাড়ি প্রাসাদে ফেরার কিছু পরেই মারা যান তিনি ।
গদিতে বসলেন জার তৃতীয় আলেকজান্দার । বাবার উদারনীতির ফল তিনি নিজের চোখে দেখেছেন । 'মুক্তিদাতা জারের' ভাগ্যে জুটেছে আততায়ীর বোমা । এই বাঞ্চোত দেশবাসীকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না ! সব শালাকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেয়া হবে । উপরে ঈশ্বর আর নীচে তাঁর প্রতিনিধি জার । একনায়ক তো অনেকই ছিল, কিন্তু নিজেকে অফিশিয়ালি "আফতোক্রাত" (অটোক্র্যাট) ঘোষনা দিয়েছে কয়জন ?
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০০৭ সকাল ১০:১৫