ইদানিং প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার অধিকাংশের ওপর চোখ ফেললেই কিছু বিশেষায়িত শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে ‘জিহাদ’ ও ‘জিহাদী বই’ শব্দদুটো সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত ও উচ্চারিত হচ্ছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলো এদেশে তাদের ‘ডি-ইসলামাইজেশন’ এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এইদুটো শব্দকে নেতিবাচক অর্খে ব্যবহার করছে। ইতোমধ্যে তারা এইদুটো শব্দের একটা বাহ্যিক ইমেজ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে। ইমেজটা এরকম- ‘জিহাদ’ মানে রাষ্ট্রের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বোমাবাজি, হত্যা, লুটতরাজ, বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা ইত্যাদি। আর ‘জিহাদী বই’ মানে সেই সমস্ত পুস্তক যা মানুষকে ‘জিহাদ’ তথা দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বোমাবাজি ও হত্যায় উদ্বুদ্ধ করে।
দেশজুড়ে চলছে জামায়াত-শিবির দমন অভিযান ও খানাতল্লাশি। তল্লাশি করে ‘শিবির নিয়ন্ত্রিত’ মেস ও অফিস থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে শতশত ‘জিহাদী বই’। তথাকথিত প্রগতিশীল ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলো ফলাও করে প্রচার করছে এমন রসালো্(?) সংবাদ। এদেশের জনগণকে বোঝানো হচ্ছে যে, দেশের মধ্যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার মূলে হলো জামায়াত-শিবিরের ‘জিহাদ’ এবং তাদের কর্মীদের এরৃপ কর্মকান্ডে উদ্বুদ্ধ করছে ওইসব ’জিহাদী বই’।
কিন্ত্তু একটা বিষয়কে ওইসমস্ত সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে বরাবরই উপেক্ষা করা হচ্ছে কিংবা গোপন করা হচ্ছে। তারাই জনগণের মাঝে ‘জিহাদ’ ও ‘জিহাদী বই’ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরী করার লক্ষ্যে সন্ত্রাসের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘জিহাদ’ এবং সন্ত্রাসী উপকরণের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘জিহাদী বই’কে অত্যন্ত সুকৌশলে জনগণের সামনে তুলে ধরছে। কিন্ত্তু তারা ‘জিহাদ’ এর স্বরূপ এবং কোন বইগুলো ‘জিহাদী বই’, সে সম্পর্কে জনগণকে অন্ধকারে রেখে দিচ্ছে। কেন?
কোন কিছুকে যখন আমরা ক্ষতিকর মনে করবো তখন সেই ক্ষতিকারক জিনিসটি সম্পর্কে জনগণকে পরিপূর্ণভাবে অবহিত করাই হলো আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। ‘এইডস’ একটি ক্ষতিকারক ও ভয়াবহ রোগ। তাই এইডস সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করার জন্য এই রোগের জীবাণু, লক্ষণ, রোগের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে ব্যপক প্রচারণার মাধ্যমে তা জনগণকে অবহিত করা হচ্ছে, যাতে তারা এ থেকে সতর্ক থাকতে পারে।
‘জিহাদ’ এবং ‘জিহাদী বই’ যদি বাস্তবিকই সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সাবির্কভাবে ক্ষতিকর হয়ে থাকে তবে জিহাদের আদ্যোপান্ত জনগণকে অবহিত করা অবশ্য কর্তব্য। ‘জিহাদ’ কী অথবা জিহাদের স্বরুপ কেমন এবং ‘জিহাদী বই’ কোনগুলো, সেই বইগুলোর বৈশিষ্ট্য কেমন, বইগুলোয় কী কী কথা লেখা আছে এবং সেই লেখাগুলোর ‘ক্ষতিকর’ প্রভাবটাই বা কেমন, ইত্যাদি জনগণকে সুস্পষ্টভাবে জানানো উচিত।
কিন্ত্তু আওয়ামী সরকার এবং তাদের তাঁবেদার মিডিয়াগুলো এ বিষয়টি সম্পূর্ণ চেপে যাচ্ছে, কেননা তারা উপরোক্ত শব্দদুটোকেই ভয় পান। একারণে উপরোক্ত শব্দদুটো সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানলাভ তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। তারা যেমন জানেন না ‘জিহাদ’ শব্দের শাব্দিক বা পারিভাষিক অর্থ তেমনি জানেন না ওইসমস্ত কথিত ‘জিহাদী বই’য়ে কী কী লেখা আছে। অথবা জানলেও তারা জনগণকে জানতে দিতে চান না আসল সত্য। কেননা এতে রয়েছে গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশংকা, নিজেদের মুখোশ খসে পড়ে স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার ভয়।
এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের যেমন এইসব মুখোশধারীদের চক্রান্ত সম্পর্কে সতর্ক থাকা প্রয়োজন, তেমনি আমাদের সকলের জানা প্রয়োজন জিহাদের অর্থ, জানা প্রয়োজন জিহাদের তাৎপর্য ও স্বরূপ কেমন, ‘জিহাদী বই’ বলতে আমরা কি বুঝি বা আওয়ামী সরকার ও তাদের তাঁবেদার মিডিয়াগুলো আমাদের কি বোঝাতে চায়?
‘জিহাদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘জোর প্রচেষ্টা’ অর্থাৎ ‘কোন মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবার্ত্মক প্রচেষ্টা’ আর এর পারিভাষিক অর্থ হলো- মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব বিদুরিত করে সবর্তোভাবে আল্লাহর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত মিশন। জিহাদের এই চূড়ান্ত মিশনকে সামনে রেখেই মূলত: নবী-রাসুলগণকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন এবং মুসলিম জাতিকে এই মিশনের কর্মী হিসেবে মনোনীত করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ দ্ব্যর্খহীনভাবে ঘোষণা করছেন,
“আজ আমি তোমাদের জীবন পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পুর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন-বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম। [সুরা আল মায়েদা-৩]
একথা নির্দ্বিধায় সত্য যে, ঈমানের মৌখিক স্বীকৃতির মাধ্যমে কেউ নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করলেও, প্রকৃত অর্থে সে ততক্ষণ পযর্ন্ত মুসলিম হতে পারেনা যতক্ষণ না সে দ্বীন ইসলাম তথা আল্লাহর মনোনীত জীবন বিধানের মধ্যে প্রবেশ করবে। একথা ব্যক্তিগত জীবনে যতটুকু সত্য, সামষ্ঠিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার চেয়েও বেশি সত্য, চরম সত্য।পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পরিস্কারভাবে বলছেন,
“যারা আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী বিচার- ফায়সালা করেনা তারাই কাফের।”[সুরা আল মায়েদা: আয়াত-৪৪]
বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা আজো সম্ভব হয়নি। ব্যক্তিজীবনে ইসলামের কিছু কিছু নিয়ম-কানুন পালিত হলেও কিংবা সামগ্রিক জীবনে কিছু ইসলামী আচার –অনুষ্ঠান সংঘটিত হলেও আমাদের অধিকাংশের মধ্যে প্রকৃত ইসলাম নেই। এদেশে যুগে যুগে ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতায় কিংবা রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় পীর-মুরিদি প্রথা এবং মাজার-খানকা ভিত্তিক ব্যবসা বিস্তার লাভ করেছে, রাষ্ট্র এদের উত্তরোত্তর পৃষ্ঠপোষকতাও দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে। কারণ এদের দ্বারা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার রাজতান্ত্রিক মসনদ নড়োবড়ো হওয়ার কোন ভয় নেই। কেননা, ঐসব পীর-মুরিদি প্রখা এবং মাজার-খানকা ভিত্তিক ব্যবসায় আল্লাহ প্রদত্ত মিশনের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না। আল্লাহ বলেছেন,
“লোকদের শুধু এ হুকুমই দেয়া হয়েছে যে, তারা সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একমাত্র আল্লাহর দ্বীনকে কায়েম করে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই ইবাদত করবে।” [সুরা আল বাইয়্যেনাহ: আয়াত-৫]
কিন্ত্তু মুসলমান নামধারী মুশরিক ও কাফেরগণ এটা মোটেই মেনে নিতে পারেনা। তারা আল্লাহর দ্বীনকে মেনে নিতে পারেনা, তাই তারা এ দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রত কর্মীদের অস্তিত্ব ও কর্মকান্ড কিছুতেই সহ্য করতে পারেনা। কুরআন মজীদে মহান স্রষ্টা মুসলিমদের কর্তব্য সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি মুশরিক ও কাফিরদের এ চরিত্র সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করেছেন,
“তিনি তার রাসুল(সা
কুরআন নাযিলের ইতিহাস, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং এর বিভিন্ন সুরার আয়াত থেকে একথা সুস্পষ্ট হয় যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার যমীনে মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্বকে খতম করে কেবল আল্লাহর প্রভুত্ব কায়েমের জন্যই সত্যদ্বীনসহ রাসুলে করীম(সা
“তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, যতদিন না ফেতনা(গায়রুল্লাহর প্রভুত্ব) নির্মুল হয়ে যায় এবং দ্বীন সমগ্রভাবে আল্লাহ তায়ালারই স্থাপিত হয়।” [সুরা আনফাল: আয়াত-৩৯]
জিহাদে উদ্বুদ্ধ করতে স্বয়ং আল্লাহ কুরআনের অন্যত্র বলছেন,
“যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। সুতরাং শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাও। শয়তানের সকল চক্রান্তই দূবর্ল।” [সুরা আন নিসা: আয়াত-৭৬]
এভাবে একবার-দু’বার নয়, বারবার আল্লাহ তার নাযিলকৃত মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ‘জিহাদ’ তথা আল্লাহ প্রদত্ত জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনের অন্যত্র তিনি বলেন,
“আল্লাহ ছাড়া আর কারো আদেশদান ও আইনজারী করার অধিকার নেই। তাঁরই নির্দেশ এই যে, স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব করোনা। এটাই হচ্ছে মজবুত জীবন-বিধান, কিন্ত্তু অধিকাংশ লোক তা জানেনা। [সুরা ইউসুফ: আয়াত-৪০]
বর্তমানে ‘জিহাদী বই’ রাখার অপরাধে অনেককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে ‘জিহাদী বই’। ‘জিহাদী বই’কে এখানে নিষিদ্ধ অস্ত্রের সমতূল্য বলে বোঝানো হচ্ছে। যারা এটা বোঝাতে চাইছেন দূর্ভাগ্য তাদের এবং তাদের বংশধরদের। আল্লাহ তাদের হেদায়াত দান করুন।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে আল কুরআনের মতো সবচেয়ে বড় ‘জিহাদী বই’টি সংরক্ষিত আছে। আওয়ামী সরকারের কর্ণধার এবং তাদের তাঁবেদারদের প্রত্যেকের ঘরেই বোধকরি দুয়েকটি করে এমনতরো ‘জিহাদী বই’ তাকের ওপর সাজানো আছে। আওয়ামী সরকার ও তাদের তাঁবেদার মিডিয়া কর্ণধারদের কি একথা জানা নেই?
তাহলে কেন ‘জিহাদ’ এবং ‘জিহাদী বই’য়ের নামে এমন নেতিবাচক প্রচারণা? ‘জিহাদ’-এর মতো এমন একটি মহান শব্দের ওপর কেন এত কালিমা লেপন? লাল যোদ্ধারা ‘বিপ্লব চিরজীবি হোক’ বলে শ্লোগান তুললেতো তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের এতো চেঁচামেঁচি শোনা যায়না। বরং তারা বাহবা দেয়ার জন্য তৈরী থাকেন। বিপ্লবী চে’গুয়েভারা, ফিডেল ক্যাস্ট্রো, লেলিনের বিপ্লবী চেতনার বইগুলো তো গুণীমহলে(?) খুব সমাদর পায়। তাহলে ‘জিহাদী বই’য়ের অপরাধটা কোথায়?
প্রকৃতপক্ষে নেকড়ের ছলের কোন অভাব হয়না। যেকোন ছলেই সে প্রতিপক্ষের ওপর নগ্ন আগ্রাসনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই ‘জিহাদ’ এবং ‘জিহাদী বই’ শব্দগুলোর ওপর নেতিবাচক অর্থ আরোপের মাধ্যমে তা জনগণের সামনে উপস্থাপন করে ইসলামী আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতি বৈধ করে নিতে চায় আওয়ামী সরকার। আওয়ামী তাঁবেদার মিডিয়াগুলো এই নীতিরই বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে।
তাই ঈমানদারদের আজ সচেতন হওয়ার সময় এসে গেছে। সময় হয়েছে এই হীন চক্রান্তের যোগ্য জবাব দেওয়ার। মনে রাখতে হবে যে, খোদাদ্রোহীরা কখনোই সফল হবেনা, তাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ পাক কুরআন মজীদে বলেন,
“দেশের ভেতর খোদাদ্রোহীদের তvপরতা দেখে তোমরা যেন প্রতারিত না হও, এসবতো স্বল্পকালীন জীবনের অস্থায়ী সম্পদ মাত্র। পরিণামে তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম এবং সেটা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান। [সুরা আলে ইমরান: আয়াত:-১৯৬-১৯৭]
শত দমন নিপীড়নের মাঝেও মুমিনদেরকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে দাড়াতে হবে। ইসলামী আন্দোলনের পথ মসৃণ নয়। রাসুলে করীম(সা
“নিরুvসাহিত হয়োনা- এবং দু:খ করোনা। তোমরাই জয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হও।” [সুরা আলে ইমরান: আয়াত-১৩৯]

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



