বাবুল আবদুল গফুর
এখন আমাদের চোখে যে কোন প্রকার বিস্ময় খুবই কম মজবুত! যে কোন প্রকার বিস্ময়কর কোন কিছুর সমাধানের জন্য আমাদের মানসিক ও লৌকিকভাবে প্রস্তুতি থাকে। আমরা জানি যা কিছু এখন আমাদের ঘোর লাগাচ্ছে, মনে আন্দোলন তুলতেছে, সমুদ্র ঊর্মি মালার মতো বুকের ভেতর আছড়ে পড়ছে- তার একটা সমাধান নিশ্চয় আছে। হয়তো তা খুঁজে পেতে দেরি হচ্ছে কিন্তু তার গত্যন্তর আমরা পাবো- এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ধারণা রাখি, বিশ্বাস রাখি। কিন্তু আমাদের চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের এক জগৎ। যেখানে আমরা খুঁজি সান্ত্বনা, আমাদের সমস্ত অভিযোগের সূক্ষ্ম বিচারের জন্য আমরা অদৃষ্টের প্রতি মাসুক হই, তাঁর কাছে ধর্না দিই। কখনও পাই, কখনও পাওয়ার আশায় ব্যাকুল থেকে মৃত্যুর সান্নিধ্যে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় মর্ত্য লোকের আলো থেকে। তবু আমাদের অপেক্ষার পরিসমাপ্তি হয় না- শেষ বিচারে সেই বিচার পাওয়ার অদম্য ইচ্ছা আমাদের থেকেই যায়। কত রহস্য!
এই মৃত্যুকে ঘিরে আমাদের লৌকিকত্ব, অলৌকিক বিশ্বাস, যৌক্তিক তর্ক বা অযৌক্তিক বাক-বিতণ্ডার ইয়েত্তা নেই। মনে অনেক প্রশ্নের রহস্যের সমাধানে পৌঁছাতে প্রাণপণ সচেষ্ট হই, পারিনা। কখনও ভাবি, মরার পর কি সত্যি সত্যি আবার কোন জগতেরে মুখোমুখি দাঁড়াবো আমরা? নাকি আমাদের দেহ মাটির অণুজীবের ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করে মিশিয়ে দিবে মাটি, বাতাস ও পানিতে? নিজের ভেতরে কত কিছুই তো তোলপাড় করে, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অবিশ্রান্ত গর্জন করে, আছড়ে পড়ে- কিন্তু কূল-কিনারায় পৌঁছাতে পারি না। এক অদৃশ্যের প্রতি গভীর আস্থা রেখে মেনে নেই- সব সত্যি! কখনও ভাবি, এই অসীম ব্রহ্মাণ্ড, অবারিত সবুজ, নিঃসীম আকাশ, থোকা থোকা গ্রহ-নক্ষত্র, নীহারিকাপুঞ্জ, তারকারাজি, বিশাল পাহাড়, সুউচ্চ পর্বত-শৃঙ্গ, চন্দ্র-সূরজ- কি নিখুঁত মায়াবলে, শক্তি দ্বারা সুনিপুণভাবে পরিচালিত হয়! এর পেছনে কি সত্যি কোন কারিগর রয়েছে? নাকি মহাকর্ষের অমোঘ নিয়মে তা টিকে আছে যুগ-যুগান্তর? না কোন এক অদৃশ্য কারিগর রয়েছে এই ব্যাপ্ত পরিচালনার সুউচ্চ স্থানে? থাকলে তিনি কেমন? মানুষের মতোই? মনে হয় না। কিন্তু অধিকাংশ ধর্ম ও ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে তাঁকে মানুষের মতোই ভাবা হয়েছে। বলা হয়েছে তিনি শুনতে পান, আরশে আজীমে তার আসন সুবিন্যস্ত, তিনি দেখতে পান, নিজ হস্তে শাস্তি দিবেন, তাঁর রয়েছে মূর্তি-প্রতিমূর্তি, রয়েছে ভাগ্যবন্টনের সৈন্য-সামান্ত, ফেরস্তা-অবতার! তবু মেনে নিই- তিনি আছেন। মানুষের ক্ষুদ্র জ্ঞানের কাছে তাঁর বিশালত্ব অনুভব করা, মানুষের অনুভূতিতে তাঁকে প্রকাশ করা সবটুকু সম্ভব নয়- তবে তিনি আছেন। তাই পূজা-অর্চনা, ইবাদত-বন্দেগী, প্রার্থনায় মশগুল হয়ে তাঁর নজর কাড়ার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাই- তবু তিনি ধরা দেন না। তাঁর সর্বব্যাপি ব্যাপ্তি ও বিস্তার আমাকে মনে প্রশান্তি জোগায়, যাক- নাই বা পেলাম তাঁকে কিন্তু নিজেকে তো তাঁর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় উৎসর্গ করতে পেরেছি- নিশ্চয় তিনি তা বিদিত! তাঁর অগোচর নয়। তারপর আশা-প্রত্যাশা, অপেক্ষা-প্রতীক্ষা ও পাওয়া-না পাওয়ার সমস্ত ভোগান্তি, ক্রান্তি শেষ করে একদিন সত্যি সত্যি পাড়ি জমায় কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে! সামান্য হায়াতের যে সময়টুকুতে অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়েছিলাম, ভালোবেসেছিলাম, তাদের আবদার আহ্লাদ মিটাতে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে নিজেই নিঃস্ব হয়েছিলাম, রিক্ত হস্তে তাদেরও ফেলে একদিন এক অন্ধকার আবর্তে যাত্রা করি। তাদের হাহাকার, শোক ও ক্রন্দনে আকাশ বাতাস আন্দোলিত হয়, জমিনে বর্ষার মতোই অশ্রু বৃষ্টি ঝরে- শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে প্রিয় মা ও প্রেমিকা।
সময়ও ক্রমশ বয়ে চলে-
খুব দ্রুত আকাশে মেঘ জমে বৃষ্টি হয়, আবার রোদ উঠে, হেমন্ত আসে, ফুলে ফুলে ভরে যায় বসন্ত! তারাও একদিন ভুলে যায়। আমার স্মৃতি রোমন্থনে তাদের মূল্যবান সময় আর অপচয় হয় না। মেলা-পর্বনে, আচার-অনুষ্ঠানে, প্রথা ও নিয়মে আর আমার ডাক পড়ে না।
আর অজান্তেই ধীরে ধীরে আমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই পৃথিবীর বুক থেকে।
একশো বছর পর কেউ এসে জিজ্ঞেস করলে, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে- যেন সে ভুল কিছু শুনেছে অথবা এমন কোন প্রশ্নের সম্মুখীন সে হয়েছে- যার প্রতীক্ষায় সে কখনও ছিলো না। তার কাছে মনেই হবে না আমি নামের কেউ গৃহস্থে একদিন অধিকার খাটাতাম, জিবন-যুদ্ধে উত্তীর্ণের জন্য এই মাঠ-ক্ষেত-নদী, পথকে পথকে হেঁটেছি; সে জানতেও পারবে না- একদিন স্বপ্নপূরণের কঠিন সংগ্রামে আমি মৃত্যু কঠিন শপথে আদিষ্ট ছিলাম। তবু তার দিন কাটবে, আমার মতোও সেও ছুটবে জিবনের পথে, জলে-স্থলে সেও বিচরণ করবে অবাধে- তারপর আমার পরিস্থিতির মতোই সেও মেনে নেবে অজানা গন্তব্যের পথ। সূরা আর্ রাদের সেই সতর্ক কারী ভয় আর থাকবে না। যেখানে সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, ‘তিনি বজ্রপাত করেন এবং তাকে যার উপর চান, ঠিক সে যখন আল্লাহ সম্পর্কে বিতণ্ডায় লিপ্ত তখনই নিক্ষেপ করেন। আসলে তাঁর কৌশল বড়ই জবরদস্ত!’ একদিন এই আয়াত শুনে ঝরঝর করে কেঁদেছিলাম, বৃষ্টিতে মেঘের গর্জনে আতঙ্কিত থাকতাম- ভাবতাম, এই বুঝি তাঁর অভিশাপ আমার উপর এসে নিক্ষিপ্ত হবে। সেই ভয়- আর থাকবে না। সত্যি সত্যি একদিন সব শেষ হয়ে যাবে! আসলেই কি তাই? কেনো এতো ভয় আমি পেয়েছিলাম, কি কারণে, কাকে ভয় করে-তিনি কে? তাঁকে তো আমি দেখিনি- তাঁর সম্পর্কে কেবল শুনেছি আর নির্দ্বিধায় তাঁকে মেনে নিয়েছি- যে মেনে নেওয়ার পেছনে আমাকে ইন্ধন যুগিয়েছে আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরাত্মীয় ও পরিবেশ। যদি এমন হতো, আমি হিন্দুর ঘরে জন্মাতাম- তাহলে কি আমি জানতাম কৃষ্ণ ছাড়া আর কেউ আছেন? জানতাম ভগবদগীতা ছাড়া আর কোন সহীহ আসমানী কিতাব রয়েছে? খ্রিষ্টান হলে কখনও কি মেনে নিতাম ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব, হিন্দুদের বিশালত্ব, বুদ্ধের দয়া-দাক্ষিণ্য? নিশ্চয় নিতাম না। নেওয়ার মতো হয়তো কোন প্রস্তুতিও নিতাম না। আমার সমাজ, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন কখনও আমাকে সে কথা বলেনি, বলেনি- তুমি যা কিছু চাও, চাইতে পারো! তুমি তোমার জিজ্ঞাসা ও কৌতূহলকে যে কোন ভাবেই চরিতার্থ করতে পারো! কিন্তু আমার মনের অতৃপ্তি তারা কখনও প্রত্যক্ষ করেনি, করলেও বুঝতে চায়নি, বুঝলেও সায় দেয়নি অথবা সায় দেওয়া অসম্ভব। কারণ সমাজ আমাদের সে শিক্ষা দেয়নি, আমাদের বিভক্তকরণের জন্য উস্কে দেয়নি, আমাদের বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সে প্রস্তুত নয়। তাই মেনে নিয়েছি-
তারপরও আমার হাত, প্রিয় চোখ- দৃশ্যের পর দৃশ্য আমাকে উপহার দিয়েছে। কাক ডাকা ভোরে কুয়াচ্ছন্ন কোন প্রশান্ত সকাল আমাকে সতেজ করেছে, মেঘের দল-উপদলের আকাশে আধিপত্য আমাকে শিহরিত করেছে, প্রিয়ার গোলাপী বিস্তৃত ঠোঁট আমাকে সুখের পরশ বুলিয়েছে। বেঁচে থাকার এক অদম্য ইচ্ছা ও প্রেরণা দিয়েছে আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়।
কিন্তু একদিন আমার উৎকৃষ্ট সমস্ত পছন্দনীয় সবকিছু ছেড়ে কিংবা উচ্ছিষ্ট-তাচ্ছিল্যের সমস্ত অভিযোগ ও অনুযোগ রেখে কোন এক অজানার পথে যেতেই হবে। জানি না তা কতদূর, কেমন! তবু প্রস্তুত থাকি- যদি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আজও হয়?
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:৩৬