ভাটি অঞ্চলের গা ঘেষা উজান এলাকা করিমগঞ্জ। সাতবারের রঙিন বার মঙ্গলবার। সাপ্তাহিক হাটের দিন। সূর্যের বয়স একটু একটু করে বাড়ে। বাড়তে থাকে মানুষের পায়ের জোড়া। আশপাশের মানুষ, দূর দূরান্তের মানুষ। বাজার লাগোয়া নরসুন্দা নদী ঘাট। উজানের বুকে পা ফেলায় ভাটির মানুষ। দিনের মাঝবয়েসী বেলায় হাটের উতলা যৌবন। মোরগমহালের ধার ঘেষে ফাকা জায়গায় দাড়িয়ে যায় জালাল ক্যানভাসার। পিছনে একটা ব্যানার টানায়। ব্যানারজুড়ে কৃমির ছবি। সূতা কৃমি, ফিতা কৃমি, গোড়া কৃমি। পেট ভর্তি কৃমি ছোট বাচ্চারছবি পায়খানা সাড়তে পায়ুপথে কৃমি বেড়িয়ে আসার ছবি। জালালের হাতে একটা লাঠি। কৃমির অপকারিতা জানান দিয়ে একটু পর পর ব্যানারে বাড়ি দেয়। হাটের লোকজনকে তার দিকে ফেরানোর চেষ্টা করে। কিছু লোক দাড়িয়ে যায়। কিছু বাচ্চা ছেলে পেলে। জালাল মুখস্থ বুলি আওড়ায়। কৃমিতে যাদের পেটটা ঢোল হয়ে আছে, পাছায় খাউজায়া লাল কইরা ফেলাইতেছেন তাদের লাইগ্গা মহাষৌধ রাইতে
সেবন, সকালে বেখসুর খালাস। লোকজন হা করে কথা শোনে। কেউ কেউ কিনে নেয়। কেউ কেউ পেটে হাত দেয়। সুস্থ মানুষও কৃমির অস্তিত্ব অনুভব করে। কেউ দ্বিধায় পড়ে। আমারও কি চুলকায়। থাক,আরেকদিন দেখি। পরের সপ্তাহ নেয়া যাবে।
হাটের কোমড় সমান পৌছাইতেই কানে বাজে সার্কাসের মিউজিক। স্বদেশী ক্যানভাসার। তার কাছে হ্যামিলনের বাঁশি নেই। মিউজিকই
ভরসা। লাল কাপড়ের সামিয়ানা টানায়, চারদিকে লাল কাপড় দিয়ে অনেক নিচু করে বেড়া দেয়া। বেড়া ডিঙিয়ে প্রবেশিধাকার সংরক্ষিত।
হাটের সবচে বড় মজমা। মাঝে মাঝে মেয়ে কন্ঠশিল্পী আনা হয়। লোকসমাগম বেশি হয়। এক হাত লম্বা কাচের বোতলের ফাইল। কেমিক্যালমুক্ত বিভিন্ন গাছগাছড়ার পাতা,বাকলের রস। সম্পূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন। এক ফাইলেই নাড়ি ভূড়ি নিয়ন্ত্রণে। প্রাণ ম্যাঙ্গোজুস সিস্টেেম বিক্রি হয়। ওষুধ খাওয়া শেষে বোতল ফেরত দিতে হয়। কেউ কেউ হাতে নিয়ে দেখে। গাছগাছালি বিশ্বাস করা যায়।
শরীরটাও এখন দুর্বল দুর্বল লাগে। একজন কিনলে আরও দুজন টাকা বের করে।বিক্রি বাড়তে থাকে।
হাটের দিন স্কুল মাঠটা দখলে থাকে কামাল ক্যানভাসারেরর। কখনও ঠেলা ভাইয়ের। দুজনই খুব উচ্চ শ্রেণির ক্যানভাসার। সাথে তাদের শিষ্য থাকে। আসর জমানোর কাজ শিষ্যদের। এক দুজন লোক সামনে রেখে একটা বাক্স নিয়া লোক জমা না পর্যন্ত "এই বাইড়া,বাইড়া" বলা নিয়ম। মানুষজন আগ্রহ। নিয়ে দাড়ায়। বাক্সের দিকে তাকায়। কিছু বের না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। মাঝে মাঝে চিকার মত শব্দ করা। মাইকের ডিস্টার্ব থাকলে মেয়ে মানুষের কান্নার মত শোনা যায়। লোকজন জমতে থাকে। দুয়েকটা ম্যাজিক দেখায়। কাগজ দিয়া টাকা বানানো,মাটি দিয়া বিস্কিট। এক পর্যায়ে বলতে থাকে কিচ্চা কাহিনী। শেষ হয় ওষুধে।
শ্রিরিপুরের ট্যাবলেট। খুব গুণী ওষুধ। আবার তেজীও। এক সময় পুকুর/নদীতে বুক সমান নেমে ডাবেরর পানি দিয়া এই ওষুধ খাওয়ার নিয়ম ছিল। আগের দিন বাঘে খাইছে। দেশ এখন ডিজিটাল। এখন বাসি পানি দিয়া খাইলেই চলে।
তাদের কাছে সব সময় একটা গোপন ছবি থাকে। এই ছবি প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য। ছোটদের বের করে দেয়া হয়। ফটোশপে এডিট করা রোগাক্রান্ত পুরুষাঙ্গ, কোন মেয়ের ন্যাংটা ছবি সাপের সাথে মেলামেশা করছে এই টাইপ। ছবি দেখানো শেষ করে অল্প বয়সি কোন ছেলেকে ডেকে নিবে। তার হাতে একটা পলিথিন ধরায় দিবে প্রশ্রাব করে আনার জন্য। ছেলেটা ভয়ে ভয়ে পলিথিন ভর্তি প্রশ্রাব নিয়া আসে। ছেলেটার জটিল রোগ। প্রশ্রাবের সাথে পাথর বের হয়ে আসছে।তাদের ট্যাবলেট হাতে ধরায় দেয়। ছেলেটাও মনে মনে ভাবে কোন পথ দিয়া পাথর আসছে, টের পাই নাই তো। ৫০% নিশ্চিত ডিসকাউন্টে ওষুধ ছাড়ে কামার ক্যানভাসার। এক হাত দুহাত করে হাটের সহজ সরল মানুষের পকেটে ঢুকে যায় ক্যানভাসারের ওষুধ।
হলে সিনেমা দেখানোর মত দিনে তিন চারটা একই নিয়মে মজমা করে কামাল ক্যানভাসার। সন্ধ্যা নামে। শেষ হয় হাটের জীবন্ত বিনোদন। ঘরে ফেরার তাড়া। দিন দিন অবিশ্বাসী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে কাজ করতে থাকে ক্যানভাসারেরর ওষুধ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৩:৪৫