ড. মুহাম্মদ ফজলুল হক
পলাশী চক্রান্তের যৌক্তিকতা খুঁজে বের করার জন্য ইংরেজ ও কিছু সংখ্যক অন্যান্য ঐতিহাসিক ইতিহাস রচনার নামে কত কিছুই না লেখেছেন। তারা এক্ষেত্রে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টায় বহু কাল্পনিক কাহিনী তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন। তারা নানাভাবে নবাব সিরাজের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বকে খাটো করে পলাশীর ইতিহাসকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেন। ইতিহাস রচনার নামে তারা যেসব কাণ্ড করেছেন তা ভাবতেও কষ্ট হয়। কিন্তু তারা তো জানেন, ইতিহাস ইতিহাসের গতিতে চলে। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে না। সাময়িকভাবে তারা কিছুই উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু ব্যাপক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এসব উত্তেজনা কোন কাজে আসে না।
আসলে নবাব সিরাজ ও পলাশীর ইতিহাসের প্রকৃত চিত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যাপক বাধা লক্ষ্য করা গেছে। প্রধান বাধা-প্রায় দু'শ' বছরের বৃটিশ শাসন এবং দ্বিতীয় বাধা ইংরেজ ও কিছু সংখ্যক হিন্দু ঐতিহাসিকের ইতিহাসের নামে অসত্য কাহিনী প্রকাশ। অবসরে তিনি তিনি ছিলেন একজন মহান দেশপ্রেমিক, সাহসী যোদ্ধা, বিজ্ঞ রাজনীতিক ও ব্যক্তি চরিত্রে সহজ-সরল ও বলিষ্ঠ নবাব। তিনি ছিলেন এ মাটিরই সন্তান। এই মাটির সাথে তিনি কোনদিন বেঈমানী করেননি। তিনি এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। ইচ্ছা করলে তরুণ নবাব বৃটিশ বণিকদের বাণিজ্য সুবিধা কিছুটা বৃদ্ধি এবং তাদের ঔদ্ধতা সহ্য করে বহু যুগ শান্তিতে নবাবী করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য তার অকৃত্রিম ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ তিনি সব শত্রুকে চিহ্নিত করে দেশের স্বাধীনতাকে মজবুত করতে চেয়েছিলেন। দেশের প্রতি এবং দেশের মানুষের প্রতি তার এই শ্রদ্ধাবোধ আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।"
আলীবর্দী খান বাংলার নবাব হন ১৭৪০ সালে। তখন তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর এবং সিরাজউদ্দৌলা ৪/৫ বছরের শিশু। ৬৬ বছরের বৃদ্ধের জন্য হেরেমের প্রয়োজন ছিল না। আলীবর্দী খানের হেরেম ছিল তার পরিবার পরিজন নিয়ে গঠিত অন্দর মহল। সেখানে বাঈজী বা বারবনিতা হেরেমবালা ছিল না (সীয়ারুল মুতাখখেরীন ১ম অধ্যায় পৃঃ ৫৮.৫৯)। রবার্ট ওর্ম লিখেছেন যে, "আলীবর্দী খুব মিতচারী ছিলেন। তার আরাম আয়েশ ও হেরেম বলতে কিছু ছিল না। তিনি এক স্ত্রী নিয়েই সুখী ছিলেন। সুতরাং সিরাজউদ্দৌলা তার শৈশব-কৈশোরে লাম্পট্যের ট্রেনিং নেবার মতো, রাজা-মহারাজাদের গড়ে দেয়া আর্যসুন্দরী বাঙালিদের নিয়ে গঠিত হেরেমের সংস্পর্শ পাননি। তবে তত্কালীন রাজা-মহারাজারা তাদের বোন আলেয়াদেরকে দিয়ে তরুণ সিরাজকে সে পথে প্রলুব্ধ করার চেষ্টায় যে ব্যস্ত ছিলেন এ কথা কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবীই তাদের নাটকে নিজেদের অজ্ঞাতেই ফাঁস করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নবাব সিরাজ লাম্পট্য করার সময় কখন পেলো? দেশব্যাপী ষড়যন্ত্রের আবর্তের মধ্যে প্রায় কিশোর সিরাজউদ্দৌলাকে মাত্র ১৪ মাস ১৪ দিনের মধ্যে পুর্নিয়া থেকে কলকাতা হয়ে পলাশী পর্যন্ত ১১০০ মাইল পথ চলতে হয়েছে, পাঁচ-পাঁচটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে, তাকে তো আলেকজান্ডারের চেয়েও দ্রুতগতিতে পথ চলতে হয়েছে। দিন কাটাতে হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে কিংবা অশ্বপৃষ্ঠে, রাত কাটাতে হয়েছে ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে। নানাজীর উদ্যোগে সেই অল্প বয়সে বিবাহিত সিরাজের তখন আপন স্ত্রী লুত্ফা ও শিশু কন্যার প্রতি ফিরে তাকাবারও সময় ছিল না।
আসলে নবাব সিরাজের চরিত্রের উপর লুত্ফা বেগমের বিরাট প্রভাব পড়েছিল। উন্নত চরিত্র ও গুণাবলীর অধিকারিণী লুত্ফা সারা জীবন সিরাজউদ্দৌলার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন এবং নবাব থাকাকালীন তার উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছেন।
লুত্ফুন্নেছা খোশবাগে সিরাজের কবরের কাছে একখানি কুঁড়েঘর তৈরি করে বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দেন। কতবড় বিদূষী ও মহীয়সী নারী হলে জীবনের সব লোভ ও আয়েশ পরিত্যাগ করে তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময়টি প্রাণাধিক প্রিয় স্বামী সিরাজের ধ্যানে কাটিয়ে দেন। তিনি মাসিক যে মাসোহারা পেতেন তা দিয়ে প্রতিদিন কাঙ্গালী ভোজের ব্যবস্থা করতেন। তিনি সুদীর্ঘ আটাশ বছর ধরে এভাবে স্বামী সেবা করে ১৭৯০ সালের নভেম্বর মাসে ইন্তেকাল করেন এবং সিরাজের পদতলে তিনি সমাধিস্থ হন। বেগম লুফুন্নেছার একনিষ্ঠ প্রেম-ভালবাসা ও ত্যাগ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালে সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আর এ ইতিহাস কি সিরাজের চরিত্রের পবিত্য গুণাবলীর স্বাক্ষর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে না?
আজ সিরাজ উদ-দৌলার জন্মবার্ষিকী। আমরা তার ও তার পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।