somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সকলের সুভাষদা

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভালোবেসেই সাধারণ মানুষকে জিতেছিলেন
সুভাষ চক্রবর্তী
জন্ম : ১৮ই মার্চ, ১৯৪২
মৃত্যু : ৩রা আগস্ট, ২০০৯

পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট আন্দোলন ও গণ-আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড সুভাষ চক্রবর্তীর জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার মশাইলে। ১৯৪২ সালের ১৮ই মার্চ তাঁর জন্ম। পিতার নাম হেমচন্দ্র চক্রবর্তী, মায়ের নাম লাবণ্যপ্রভা চক্রবর্তী। কিশোর বয়সে তিনি থাকতেন দমদম এলাকার একটি কলোনিতে। তাঁর স্কুল এবং কলেজ জীবন এই দমদম নাগেরবাজার এলাকাতেই। আবার এই দমদম নাগেরবাজার এলাকা থেকেই কমরেড সুভাষ চক্রবর্তীর রাজনৈতিক জীবন শুরু। নাগেরবাজারের কে কে হিন্দু আকাদেমিতে পড়াশোনা করেন তিনি, তারপরে দমদম মতিঝিল কলেজ থেকে স্নাতক হন।
স্কুল জীবন থেকেই বামপন্থী রাজনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন সুভাষ চক্রবর্তী। ভালো করে রাজনীতি বোঝার আগেই আবেগে ভেসে বামপন্থী রাজনীতিতে নেমে পড়েন। ১৯৫৭ সালে দমদম বিধানসভা কেন্দ্রে নির্বাচনে স্যোসালিস্ট পার্টির হয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর এক সহকর্মী পবিত্র রায়। সেই সময়ে কমিউনিস্টরাও তাঁকে সমর্থন করেন। কিশোর বয়সেই সুভাষ চক্রবর্তীর চোখে সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক। তাই তাঁর সহকর্মীর পক্ষে সুভাষ চক্রবর্তীও সেই নির্বাচনী প্রচারে নেমেছিলেন হই হই করে। এই সুবাদে সেই কিশোর বয়সেই তিনি সংস্পর্শে চলে আসেন দমদমের তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ অনুরক্তি ডেকে আনে। নাগেরবাজারের সি পি আই অফিসে তখন থেকেই যাতায়াত শুরু হয়ে গেলো সুভাষ চক্রবর্তীর।
১৯৫৮ সালের ৩রা মে সুভাষ চক্রবর্তী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। প্রথম দিকে বিষয়টা তিনি গোপনেই রেখেছিলেন। কিন্তু ততদিনে তিনি মতিঝিল কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছেন। কলেজে ঢুকেই তিনি ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হন। বেতনবৃদ্ধি বিরোধী সত্যাগ্রহ আন্দোলন করতে গিয়ে সেই বয়সেই জেলে যেতে হয় তাঁকে। ছাত্রাবস্থাতেই কারাবরণের ভয়ডর টুটে গেল তাঁর। এরপরেও তাঁকে দুইবার জেলে যেতে হয়েছে। সবমিলিয়ে তাঁকে ১৪ মাস জেলে কাটাতে হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনই যার গতিপথ তাঁকে কি আর জেলের ভীতি দমিয়ে রাখতে পারে! কিন্তু কারাবরণের পর সুভাষ চক্রবর্তীর কমিউনিস্ট রাজনৈতিক জীবন আর গোপন রইলো না। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনেও তিনি ক্রমশ নেতৃত্বের সারিতে উন্নীত হতে লাগলেন।
ছাত্রাবস্থায় কমিউনিস্টদের শৃঙ্খলাপরায়ণ রাজনৈতিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সুভাষ চক্রবর্তীর প্রাথমিক অসুবিধা ছিলো খেলার মাঠের প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ। ফুটবল খেলার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিলো সুভাষ চক্রবর্তীর। তিনি নিজেই বলতেন, খোলা আকাশের নিচে খেলার মাঠ আর বন্ধুদের দৌড়াদৌড়ি আমায় প্রচণ্ড টানতো। সেইসব ছেড়ে কাঁচা মাটির ঘরের পার্টি অফিসের ভিতরের মিটিংয়ে প্রথম দিকে আমার মন বসতো না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য খেলা ছেড়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই প্রাণমন সঁপে দেন তিনি। ছাত্র আন্দোলনের ঘূর্ণিঝড় তাঁর মনপ্রাণকেও গ্রাস করে নিয়েছিলো। ১৯৫৮ সালের ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন, বন্দী মুক্তির দাবিতে আন্দোলন, দ্রব্যমূল্য বিরোধী আন্দোলন, কেরোসিন তেল ও কাগজের দাবিতে আন্দোলন, শিক্ষার প্রসারের দাবিতে আন্দোলন, শিক্ষকদের সমর্থনে আন্দোলন, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আন্দোলন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে এরাজ্যে ছাত্র আন্দোলন ছিলো তীব্রভাবে সোচ্চার। আর কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী ক্রমশ আসতে থাকেন তার পুরোভাগে।
ছাত্র আন্দোলন ও দমদম এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির কাজের সুবাদে সুভাষ চক্রবর্তী, বিভূতি দেব, তরুণ সেনগুপ্ত (ভানুদা), দেবী বসু, দীনেশ মজুমদারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সন্ত্রস্ত পরিবেশেও পুলিসের নজর এড়িয়ে তিনি নেতৃত্বের মধ্যে, বিশেষত দমদম জেলে বন্দী নেতৃত্বের সঙ্গে বাইরে থাকা নেতৃত্বের যোগাযোগের কাজ করে দিতেন। কিন্তু পারিবারিক জীবনে আর্থিক সঙ্কট তাঁকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছিলো। আত্মীয় পরিজনরা তাঁকে চাকরি করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। অনেক শুভানুধ্যায়ী তাঁকে চাকরির সুযোগও করে দেন। অন্তত তিনটি সংস্থায় চাকরিও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোনোটিই করেননি তিনি। দীনেশ মজুমদারের পরামর্শে চাকরি করার মানসিকতাই পরিত্যাগ করেন সুভাষ চক্রবর্তী।
প্রবল উদ্যম, আবেগ, বাগ্মিতা, এবং অন্যকে ভালোবাসার ক্ষমতার জন্য সুভাষ চক্রবর্তী ছাত্রসমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৭০ সালে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হলে তিনি এর রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদকের পদে থেকে এরাজ্যে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এস এফ আই-র সর্বভারতীয় প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিমান বসু। ১৯৭৬ সালে বিমান বসু ঐ পদ থেকে অব্যাহতি নিলে এস এফ আই-র দ্বিতীয় সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হন সুভাষ চক্রবর্তী। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি ঐ পদে ছিলেন। দীর্ঘসময় ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ১৯৬৯ সালে ভিয়েতনামে মার্কিন বর্বরতার অন্যতম কারিগর রবার্ট ম্যাকনামারা কলকাতায় আসেন। সেই সময় কলকাতার ছাত্রসমাজ উত্তাল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সুভাষ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ছাত্ররা কলকাতা বিমানবন্দর ঘিরে স্লোগান দিয়েছিলেন- ম্যাকনামারা গো ব্যাক। কলকাতার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ঐতিহ্যের ইতিহাসে সেই ঘটনা মাইলস্টোন হয়ে রয়েছে।
১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজনের সময় দক্ষিণপন্থীদের বিরোধিতা করে সি পি ‌আই (এম)-এ যোগ দেন কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী। এরপরে নকশালপন্থী ধারারও তীব্র বিরোধিতা করে সংগ্রাম করেছেন তিনি। ১৯৭১ সালেই সি পি আই (এম)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য হন তিনি। ২০০৮ সালের মে মাসে পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেও পার্টি সংগঠনে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে বিরাট অবদান রেখেছেন। পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যও ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তীকালে শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সুভাষ চক্রবর্তী। ১৯৭৮ সাল থেকে তিনি সি আই টি ইউ-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সহসভাপতি। সি আই টি ইউ-র সর্বভারতীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি। পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর বিশেষ অবদান ছিলো। ট্রান্সপোর্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ ইউনিটের সভাপতি ছিলেন তিনি।
গণ-আন্দোলনে সাড়া জাগানো নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সংসদীয় রাজনৈতিক জীবনেও নজির সৃষ্টিকারী সাফল্য দেখিয়েছেন কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী। তাঁর প্রথম জনপ্রতিনিধিত্ব করা শুরু ১৯৬৭ সালে দক্ষিণ দমদম পৌরসভায় পৌরপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি পৌরপ্রতিনিধি ছিলেন। তারপর এলো সাতাত্তর সালের প্রথম বামফ্রন্ট সরকার। তখনই তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হন পূর্ব বেলগাছিয়া কেন্দ্র থেকে। সেই শুরু। তখন থেকে টানা সাতবার ২০০৬ সাল পর্যন্ত ঐ কেন্দ্র থেকেই তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে আসছেন। ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পরেই সুভাষ চক্রবর্তী রাষ্ট্রমন্ত্রী হন, ক্রীড়া যুবকল্যাণ ও দুগ্ধ উন্নয়ন দপ্তরের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৮৭ সালে তিনি পূর্ণমন্ত্রী হন এবং ক্রীড়া, যুবকল্যাণ ও পর্যটন দপ্তরের দায়িত্ব পান, ১৯৯১ সালেও তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি ক্রীড়া ও পরিবহন মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। ২০০১ সালে তিনি এর সঙ্গে এইচ আর বি সি-র দায়িত্বও পান। ২০০৬ সালে ক্রীড়া পরিবহন ও যুবকল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী হন।
রাজ্যের মন্ত্রী হিসাবে তিনি প্রবল দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পরিবহন শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা করার জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। ক্রীড়া মহলে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিলো প্রবল। ক্রীড়াবিদরা নানাভাবে তাঁর কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছেন। সল্টলেকে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন গড়ে তোলায় সুভাষ চক্রবর্তীর পরিশ্রম এবং উদ্যোগ তাঁকে ক্রীড়া মহলের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছিলো। সাংস্কৃতিক মহলেও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিলো প্রবল। বহু শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগতভাবেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। বিভিন্ন ক্লাব সংগঠনকে খেলাধুলায় ও সুস্থ সামাজিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার জন্য উৎসাহ দিতেন তিনি। মেলা, প্রভাতফেরী, পদযাত্রা, পাহাড় থেকে সমুদ্রে যেকোনো রোমাঞ্চকর অভিযানে তাঁর উৎসাহী হাত পাওয়া যেত পাশে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় ত্রাণ সংগ্রহে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীসহ বহুবিশিষ্ট ব্যক্তির অবদান স্মরণে রাখতে তিনি সামাজিক উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ১৯৭৮ সালে সল্টলেক নোটিফায়েড এরিয়া গঠনের সময়ে জ্যোতি বসু ছিলেন তার প্রথম চেয়ারম্যান আর সুভাষ চক্রবর্তী ছিলেন তার প্রথম ওয়ার্কিং চেয়ারম্যান। সল্টলেকের উন্নয়নেও তিনি কাজ করেছেন। দমদমের পাতিপুকুরে এবং সল্টলেকে বসবাসকালে সাধারণ মানুষের কাছে কমরেড সুভাষ চক্রবর্তীর ছিলো অবারিত দ্বার। বহু মানুষ দূর দূর থেকে নানা সমস্যা নিয়ে এসে সাহায্য পেয়েছেন তাঁর কাছ থেকে। এইসব নানা কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সুভাষ চক্রবর্তী ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ভালোবাসার নেতা। রাজনৈতিকভাবে বিরোধীরাও সুভাষ চক্রবর্তীর কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান পেতেন এবং সেই কারণে তাঁকে প্রতি সম্মানও দিতেন।
রাজ্যের মন্ত্রী বা প্রশাসক হিসাবে প্রয়োজনীয় কঠোরতা দেখাতে সুভাষ চক্রবর্তী কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না। বহু কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ তিনি মসৃণভাবে রূপায়ণ করেছেন বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষ থেকে। বালক ব্রহ্মচারীর মরদেহ আটকে রেখে সোদপুরে যখন আইন ভেঙে পরিবেশ ও সংস্কৃতির দূষণ ঘটানো হচ্ছিলো তখন তিনিই সরকারের পক্ষ থেকে পুলিসী অভিযানে তদারকি করেছিলেন। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে আদালতের নির্দেশে পরিবহন ক্ষেত্রে পুরানো গাড়ি বাতিলের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত রূপায়িত করতেও তিনি কোনো শিথিলতা দেখাননি। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি অফিসে এসে কাজ করতেন, এমনকি কয়েকদিন আগে যন্ত্রণাদায়ক কেমোথেরাপি নিয়ে এসেই নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন ধর্মঘট ঠেকিয়ে রাজ্যের পরিবহন ক্ষেত্রকে সচল রাখার জন্য। শুধু প্রশাসক হিসাবেই নয়, গণ-আন্দোলনের দক্ষ সংগঠক হিসাবেও তিনি পশ্চিমবঙ্গে অবদান রেখে গেছেন। আটের দশকের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় বঞ্চনা ও বেকারীর বিরুদ্ধে যুবসমাজকে পথে নামাতে তিনি হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালের জন্য উদ্দীপনাময় স্লোগান তুলেছিলেন। ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়ে নয়া বাংলা গড়বো - তাঁর এই স্লোগান নিয়ে সল্টলেক থেকে হলদিয়া পর্যন্ত পদযাত্রা হয়েছিলো। বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আন্দোলনেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। একদল মিডিয়ার কুৎসার বিরুদ্ধে তাঁকে বরাবর সংগ্রাম করতে হয়েছে। আবার ২০০৬ সালে নির্বাচনী সংগ্রামের সময় তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিক পক্ষপাতিত্বপূর্ণ আচরণের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে তাঁকে সোচ্চার হতে হয়েছিলো। জীবনে চুপ করে বসে থাকার সময় তিনি খুব একটা পাননি।
তাঁর পরিবারও পার্টিরই পরিবার। স্ত্রী রমলা চক্রবর্তী পার্টির উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটির সদস্য, তাঁর দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী। একমাত্র সন্তান পুত্র অনুভব।
প্রশাসক ও কমিউনিস্ট রাজনৈতিক সংগঠক, উভয়ক্ষেত্রেই কমরেড সুভাষ চক্রবর্তীর অবদান কোনোদিন ভুলতে পারবে না পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।

ভালোবেসেই সাধারণ মানুষকে জিতেছিলেন
সুভাষ চক্রবর্তী
জন্ম : ১৮ই মার্চ, ১৯৪২
মৃত্যু : ৩রা আগস্ট, ২০০৯

পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট আন্দোলন ও গণ-আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড সুভাষ চক্রবর্তীর জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার মশাইলে। ১৯৪২ সালের ১৮ই মার্চ তাঁর জন্ম। পিতার নাম হেমচন্দ্র চক্রবর্তী, মায়ের নাম লাবণ্যপ্রভা চক্রবর্তী। কিশোর বয়সে তিনি থাকতেন দমদম এলাকার একটি কলোনিতে। তাঁর স্কুল এবং কলেজ জীবন এই দমদম নাগেরবাজার এলাকাতেই। আবার এই দমদম নাগেরবাজার এলাকা থেকেই কমরেড সুভাষ চক্রবর্তীর রাজনৈতিক জীবন শুরু। নাগেরবাজারের কে কে হিন্দু আকাদেমিতে পড়াশোনা করেন তিনি, তারপরে দমদম মতিঝিল কলেজ থেকে স্নাতক হন।
স্কুল জীবন থেকেই বামপন্থী রাজনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন সুভাষ চক্রবর্তী। ভালো করে রাজনীতি বোঝার আগেই আবেগে ভেসে বামপন্থী রাজনীতিতে নেমে পড়েন। ১৯৫৭ সালে দমদম বিধানসভা কেন্দ্রে নির্বাচনে স্যোসালিস্ট পার্টির হয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর এক সহকর্মী পবিত্র রায়। সেই সময়ে কমিউনিস্টরাও তাঁকে সমর্থন করেন। কিশোর বয়সেই সুভাষ চক্রবর্তীর চোখে সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক। তাই তাঁর সহকর্মীর পক্ষে সুভাষ চক্রবর্তীও সেই নির্বাচনী প্রচারে নেমেছিলেন হই হই করে। এই সুবাদে সেই কিশোর বয়সেই তিনি সংস্পর্শে চলে আসেন দমদমের তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ অনুরক্তি ডেকে আনে। নাগেরবাজারের সি পি আই অফিসে তখন থেকেই যাতায়াত শুরু হয়ে গেলো সুভাষ চক্রবর্তীর।
১৯৫৮ সালের ৩রা মে সুভাষ চক্রবর্তী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। প্রথম দিকে বিষয়টা তিনি গোপনেই রেখেছিলেন। কিন্তু ততদিনে তিনি মতিঝিল কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছেন। কলেজে ঢুকেই তিনি ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হন। বেতনবৃদ্ধি বিরোধী সত্যাগ্রহ আন্দোলন করতে গিয়ে সেই বয়সেই জেলে যেতে হয় তাঁকে। ছাত্রাবস্থাতেই কারাবরণের ভয়ডর টুটে গেল তাঁর। এরপরেও তাঁকে দুইবার জেলে যেতে হয়েছে। সবমিলিয়ে তাঁকে ১৪ মাস জেলে কাটাতে হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনই যার গতিপথ তাঁকে কি আর জেলের ভীতি দমিয়ে রাখতে পারে! কিন্তু কারাবরণের পর সুভাষ চক্রবর্তীর কমিউনিস্ট রাজনৈতিক জীবন আর গোপন রইলো না। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনেও তিনি ক্রমশ নেতৃত্বের সারিতে উন্নীত হতে লাগলেন।
ছাত্রাবস্থায় কমিউনিস্টদের শৃঙ্খলাপরায়ণ রাজনৈতিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সুভাষ চক্রবর্তীর প্রাথমিক অসুবিধা ছিলো খেলার মাঠের প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ। ফুটবল খেলার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিলো সুভাষ চক্রবর্তীর। তিনি নিজেই বলতেন, খোলা আকাশের নিচে খেলার মাঠ আর বন্ধুদের দৌড়াদৌড়ি আমায় প্রচণ্ড টানতো। সেইসব ছেড়ে কাঁচা মাটির ঘরের পার্টি অফিসের ভিতরের মিটিংয়ে প্রথম দিকে আমার মন বসতো না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য খেলা ছেড়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই প্রাণমন সঁপে দেন তিনি। ছাত্র আন্দোলনের ঘূর্ণিঝড় তাঁর মনপ্রাণকেও গ্রাস করে নিয়েছিলো। ১৯৫৮ সালের ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন, বন্দী মুক্তির দাবিতে আন্দোলন, দ্রব্যমূল্য বিরোধী আন্দোলন, কেরোসিন তেল ও কাগজের দাবিতে আন্দোলন, শিক্ষার প্রসারের দাবিতে আন্দোলন, শিক্ষকদের সমর্থনে আন্দোলন, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আন্দোলন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে এরাজ্যে ছাত্র আন্দোলন ছিলো তীব্রভাবে সোচ্চার। আর কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী ক্রমশ আসতে থাকেন তার পুরোভাগে।
ছাত্র আন্দোলন ও দমদম এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির কাজের সুবাদে সুভাষ চক্রবর্তী, বিভূতি দেব, তরুণ সেনগুপ্ত (ভানুদা), দেবী বসু, দীনেশ মজুমদারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সন্ত্রস্ত পরিবেশেও পুলিসের নজর এড়িয়ে তিনি নেতৃত্বের মধ্যে, বিশেষত দমদম জেলে বন্দী নেতৃত্বের সঙ্গে বাইরে থাকা নেতৃত্বের যোগাযোগের কাজ করে দিতেন। কিন্তু পারিবারিক জীবনে আর্থিক সঙ্কট তাঁকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছিলো। আত্মীয় পরিজনরা তাঁকে চাকরি করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। অনেক শুভানুধ্যায়ী তাঁকে চাকরির সুযোগও করে দেন। অন্তত তিনটি সংস্থায় চাকরিও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোনোটিই করেননি তিনি। দীনেশ মজুমদারের পরামর্শে চাকরি করার মানসিকতাই পরিত্যাগ করেন সুভাষ চক্রবর্তী।
প্রবল উদ্যম, আবেগ, বাগ্মিতা, এবং অন্যকে ভালোবাসার ক্ষমতার জন্য সুভাষ চক্রবর্তী ছাত্রসমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৭০ সালে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হলে তিনি এর রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদকের পদে থেকে এরাজ্যে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এস এফ আই-র সর্বভারতীয় প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিমান বসু। ১৯৭৬ সালে বিমান বসু ঐ পদ থেকে অব্যাহতি নিলে এস এফ আই-র দ্বিতীয় সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হন সুভাষ চক্রবর্তী। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি ঐ পদে ছিলেন। দীর্ঘসময় ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ১৯৬৯ সালে ভিয়েতনামে মার্কিন বর্বরতার অন্যতম কারিগর রবার্ট ম্যাকনামারা কলকাতায় আসেন। সেই সময় কলকাতার ছাত্রসমাজ উত্তাল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সুভাষ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ছাত্ররা কলকাতা বিমানবন্দর ঘিরে স্লোগান দিয়েছিলেন- ম্যাকনামারা গো ব্যাক। কলকাতার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ঐতিহ্যের ইতিহাসে সেই ঘটনা মাইলস্টোন হয়ে রয়েছে।
১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজনের সময় দক্ষিণপন্থীদের বিরোধিতা করে সি পি ‌আই (এম)-এ যোগ দেন কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী। এরপরে নকশালপন্থী ধারারও তীব্র বিরোধিতা করে সংগ্রাম করেছেন তিনি। ১৯৭১ সালেই সি পি আই (এম)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য হন তিনি। ২০০৮ সালের মে মাসে পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেও পার্টি সংগঠনে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে বিরাট অবদান রেখেছেন। পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যও ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তীকালে শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সুভাষ চক্রবর্তী। ১৯৭৮ সাল থেকে তিনি সি আই টি ইউ-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সহসভাপতি। সি আই টি ইউ-র সর্বভারতীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি। পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর বিশেষ অবদান ছিলো। ট্রান্সপোর্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ ইউনিটের সভাপতি ছিলেন তিনি।
গণ-আন্দোলনে সাড়া জাগানো নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সংসদীয় রাজনৈতিক জীবনেও নজির সৃষ্টিকারী সাফল্য দেখিয়েছেন কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী। তাঁর প্রথম জনপ্রতিনিধিত্ব করা শুরু ১৯৬৭ সালে দক্ষিণ দমদম পৌরসভায় পৌরপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি পৌরপ্রতিনিধি ছিলেন। তারপর এলো সাতাত্তর সালের প্রথম বামফ্রন্ট সরকার। তখনই তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হন পূর্ব বেলগাছিয়া কেন্দ্র থেকে। সেই শুরু। তখন থেকে টানা সাতবার ২০০৬ সাল পর্যন্ত ঐ কেন্দ্র থেকেই তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে আসছেন। ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পরেই সুভাষ চক্রবর্তী রাষ্ট্রমন্ত্রী হন, ক্রীড়া যুবকল্যাণ ও দুগ্ধ উন্নয়ন দপ্তরের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৮৭ সালে তিনি পূর্ণমন্ত্রী হন এবং ক্রীড়া, যুবকল্যাণ ও পর্যটন দপ্তরের দায়িত্ব পান, ১৯৯১ সালেও তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি ক্রীড়া ও পরিবহন মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। ২০০১ সালে তিনি এর সঙ্গে এইচ আর বি সি-র দায়িত্বও পান। ২০০৬ সালে ক্রীড়া পরিবহন ও যুবকল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী হন।
রাজ্যের মন্ত্রী হিসাবে তিনি প্রবল দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পরিবহন শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা করার জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। ক্রীড়া মহলে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিলো প্রবল। ক্রীড়াবিদরা নানাভাবে তাঁর কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছেন। সল্টলেকে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন গড়ে তোলায় সুভাষ চক্রবর্তীর পরিশ্রম এবং উদ্যোগ তাঁকে ক্রীড়া মহলের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছিলো। সাংস্কৃতিক মহলেও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিলো প্রবল। বহু শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগতভাবেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। বিভিন্ন ক্লাব সংগঠনকে খেলাধুলায় ও সুস্থ সামাজিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার জন্য উৎসাহ দিতেন তিনি। মেলা, প্রভাতফেরী, পদযাত্রা, পাহাড় থেকে সমুদ্রে যেকোনো রোমাঞ্চকর অভিযানে তাঁর উৎসাহী হাত পাওয়া যেত পাশে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় ত্রাণ সংগ্রহে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীসহ বহুবিশিষ্ট ব্যক্তির অবদান স্মরণে রাখতে তিনি সামাজিক উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ১৯৭৮ সালে সল্টলেক নোটিফায়েড এরিয়া গঠনের সময়ে জ্যোতি বসু ছিলেন তার প্রথম চেয়ারম্যান আর সুভাষ চক্রবর্তী ছিলেন তার প্রথম ওয়ার্কিং চেয়ারম্যান। সল্টলেকের উন্নয়নেও তিনি কাজ করেছেন। দমদমের পাতিপুকুরে এবং সল্টলেকে বসবাসকালে সাধারণ মানুষের কাছে কমরেড সুভাষ চক্রবর্তীর ছিলো অবারিত দ্বার। বহু মানুষ দূর দূর থেকে নানা সমস্যা নিয়ে এসে সাহায্য পেয়েছেন তাঁর কাছ থেকে। এইসব নানা কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সুভাষ চক্রবর্তী ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ভালোবাসার নেতা। রাজনৈতিকভাবে বিরোধীরাও সুভাষ চক্রবর্তীর কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান পেতেন এবং সেই কারণে তাঁকে প্রতি সম্মানও দিতেন।
রাজ্যের মন্ত্রী বা প্রশাসক হিসাবে প্রয়োজনীয় কঠোরতা দেখাতে সুভাষ চক্রবর্তী কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না। বহু কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ তিনি মসৃণভাবে রূপায়ণ করেছেন বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষ থেকে। বালক ব্রহ্মচারীর মরদেহ আটকে রেখে সোদপুরে যখন আইন ভেঙে পরিবেশ ও সংস্কৃতির দূষণ ঘটানো হচ্ছিলো তখন তিনিই সরকারের পক্ষ থেকে পুলিসী অভিযানে তদারকি করেছিলেন। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে আদালতের নির্দেশে পরিবহন ক্ষেত্রে পুরানো গাড়ি বাতিলের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত রূপায়িত করতেও তিনি কোনো শিথিলতা দেখাননি। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি অফিসে এসে কাজ করতেন, এমনকি কয়েকদিন আগে যন্ত্রণাদায়ক কেমোথেরাপি নিয়ে এসেই নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন ধর্মঘট ঠেকিয়ে রাজ্যের পরিবহন ক্ষেত্রকে সচল রাখার জন্য। শুধু প্রশাসক হিসাবেই নয়, গণ-আন্দোলনের দক্ষ সংগঠক হিসাবেও তিনি পশ্চিমবঙ্গে অবদান রেখে গেছেন। আটের দশকের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় বঞ্চনা ও বেকারীর বিরুদ্ধে যুবসমাজকে পথে নামাতে তিনি হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালের জন্য উদ্দীপনাময় স্লোগান তুলেছিলেন। ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়ে নয়া বাংলা গড়বো - তাঁর এই স্লোগান নিয়ে সল্টলেক থেকে হলদিয়া পর্যন্ত পদযাত্রা হয়েছিলো। বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আন্দোলনেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। একদল মিডিয়ার কুৎসার বিরুদ্ধে তাঁকে বরাবর সংগ্রাম করতে হয়েছে। আবার ২০০৬ সালে নির্বাচনী সংগ্রামের সময় তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিক পক্ষপাতিত্বপূর্ণ আচরণের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে তাঁকে সোচ্চার হতে হয়েছিলো। জীবনে চুপ করে বসে থাকার সময় তিনি খুব একটা পাননি।
তাঁর পরিবারও পার্টিরই পরিবার। স্ত্রী রমলা চক্রবর্তী পার্টির উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটির সদস্য, তাঁর দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী। একমাত্র সন্তান পুত্র অনুভব।
প্রশাসক ও কমিউনিস্ট রাজনৈতিক সংগঠক, উভয়ক্ষেত্রেই কমরেড সুভাষ চক্রবর্তীর অবদান কোনোদিন ভুলতে পারবে না পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১২ রাত ৮:১০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×