অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায় :
ফি বছর নিয়ম করে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনকে আমরা গুরুত্ব দিই। বৈশাখ পড়লেই তপ্ত পরিবেশেই বিশ্ব কবিকে স্মরণ করাটা আমাদের প্রায় রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিশ্ব যে প্রতিনিয়ত গরম হয়ে উঠছে। আগামী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে আমাদের সেই ভূমিকা কোথায়।
আমরা আয়োজন করি, কাজ করি না। এটা পরিবেশ, প্রকৃতি নিয়ে আলোচনাতেও সহজে বলা যায়। রাজ্য সরকার ছেড়ে দিন, ভারত সরকারের তরফেও তাই বসুন্ধরা দিবস পালনে আমাদের আগ্রহ নেই। পরিবেশের বিরূপতার জন্য খোদ শান্তিনিকেতনে একসময় ২৫শে বৈশাখের বদলে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালিত হতো ১লা বৈশাখ। প্রখর রোদ আর জলকষ্টে বিধ্বস্থ শান্তিনিকেতনের আবাসিকদের কথা ভেবেই রবীন্দ্রনাথ জীবৎকালেই এই প্রচলন। কিন্তু সব কিছুই বদলে গেছে আমাদের সদিচ্ছার কারণে। ফিকে হয়ে গেছে আন্তর্জাতিকভাবে পালিত বিশ্ব বসুন্ধরা দিবসটির মূল্যও।
পৃথিবীর ওপর রাত-দিন বছরের পর বছর কাটিয়েও কখনো আমাদের মনে হয় না কিভাবে আমাদের রক্ষা করে চলেছে প্রকৃতি। এখনও গরিব, বড়লোক সকলের কাছে সমান পরিমাণেই বিশুদ্ধ অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছে এই প্রকৃতি। কিন্তু তার জন্য কিছু অন্তত করা বা যেসব ভুল করে চলেছি আমরা তা শুধরানোর কোন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা আমাদের মনে পড়ে না। যদিও ২০০৯সালে রাষ্ট্রসংঘ ২২শে এপ্রিলকে ‘ইন্টারন্যাশানাল মাদার আর্থ ডে’ বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু ঐ করেই খালাস। কে কিভাবে ঐ আন্তর্জাতিকস্তরে যোগ দিতে পারে তা নিয়ে রাষ্ট্রসংঘ তেমন বাধ্যবাধকতাও তৈরি করে নি। তাই রাষ্ট্রসংঘের তরফে গুটি কয়েক দেশের মধ্যে পরিবেশ নিয়ে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য ‘আর্থ ডে নেটওয়ার্ক’ চালু থাকলেও তা সাধারণ মানুষের কিছু কাজে আসে না। আর সাধারণের কাছে পরিবেশ, প্রকৃতি নিয়ে কোন কিছু বলতে যাওয়া মানেই ঐ একই প্রচার। গাছ কেটো না, গাছ লাগাও। জল নষ্ট কোরো না, সংগ্রহ করো। আর নতুন যেটি সংযোজিত হয়েছে বৃষ্টির জল ধরে রাখো। কিন্তু কেন এগুলো আমরা করতে যাবো ? মাটির নীচের জল যে সকলের তা আমরা মানতে পারি না। যার কাছে শক্তিশালী পাম্প আছে সে মাটির নীচে জলভান্ডারে পূর্ণমাত্রায় ভোগ করছে। আর যা নেই সে তাকিয়ে আছে প্রকৃতি অন্য সংস্থানের দিকে।
তাই ২২শে এপ্রিলের বসুন্ধরা দিবস পালন করতে গিয়েও পরিষ্কার দুটি বিভাগ হয়ে গেছে। যারা আয়োজন করতে পারে। আর যারা পারে না। যদিও রাষ্ট্রসংঘের দাবি বসুন্ধরা দিবসটি বিশ্বের ১৭৫টি দেশ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে থাকে। হ্যাঁ, ঐ দেশের তালিকায় ভারতও আছে। আর ভারত বা পশ্চিমবঙ্গে তা পালানের উদ্যোগতো আপনারা সকলেই দেখেছেন। দিন পালনতো দূর কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র বা মিডিয়াতেও তেমন করে স্থান পায় নি ‘বিশ্ব বসুন্ধরা দিবস’। পৃথিবী ৭০০কোটির বেশি মানুষের ভার বহন করেও আমাদের প্রাণধাত্রী বসুন্ধরাকে এতটা উপেক্ষিত হতে হবে তা কেউই বা জানতো।
পৃথিবীর তাপমান বাড়ছে। মরু অঞ্চলের বরফ গলছে, সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে চলেছে। বিশ্বের সবকটি পরিবেশ গবেষণা সংস্থার এক কথা। কোন দেশে কতটা জলস্তর বাড়ছে, তার জন্য কত মানুষ ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া থেকে চুলচেড়া নানারকমের সমীক্ষার শেষ নেই। কিন্তু বিশ্ব তাপমান (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) ঠেকাতে কীসব উদ্যোগ নিতে হবে, না নিলেও কী আইনী ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে নেওয়া হবে তা নিয়ে নেই কোন স্বচ্ছ নির্দেশিকা। বিশ্ব তাপমান কমাতে ‘কার্বন দূষণ’ কমাতে হবে। বিশ্বের উন্নতশীল দেশের কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদনের মাত্রা বেঁধে দেওয়ার পরেও কে কার কথা মানছে। পরিবেশকে কলুষিত করতে আমেরিকাসহ কিছু উন্নতদেশের বিরুদ্ধে কে কথা বলবে ?
পরিবেশ নিয়ে শুধুই লোক দেখানো সম্মেলনের আয়োজন চলে আসছে। আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে যারা সবচেয়ে বেশি বিশ্ব পরিবেশের ক্ষতি করছে তারাই পরিবেশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন, সচেতনার কথা বলছে। চূড়ান্ত দ্বিচারিতার মধ্যে পড়ে গেছে পৃথিবীর তৃতীয় বিশ্বের দেশ। তাদের ওপর দিনকে দিন চাপ বাড়িয়ে চলছে আগ্রাসী পশ্চিম দুনিয়া। তারাই বিভিন্ন সময় পরিবেশের পরিবর্তন নিয়ে নানা ধরণের ভয়ার্ত সমীক্ষা প্রচার করে চলেছে তাদের পোষ্য সব পরিবেশ গবেষণা সংস্থাদের দিয়ে। যেমন, সুন্দরবন নিচিহ্ন হয়ে যাবে।
জলতল গ্রাস করে নেবে গোটা সুন্দরবন। এমনকি মার্কিনী তোষামোদী সংস্থা ওয়াল্ড ওয়াইড ফান্ড (ডব্লু ডব্লু এফ) এবছরের বার্ষিক রিপোর্টে বলেছে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সুন্দরবনের ১০২টি দ্বীপের মধ্যে ২টি নিচিহ্ন হয়ে গেছে। আরো ৪টি অদূর ভবিষ্যতে মানচিত্রের বাইরে চলে যাবে। পরিবেশজনিত উদ্বাস্তু (এনভায়রনমেন্টাল রিফিউজি) হতে চলেছেন ২হাজার মানুষ। কিন্তু সব কিছু বলার পরেও রাজ্য প্রশাসনকে লিখিতভাবে কিছু পরামর্শ বা জানানোর দায় নেই ঐ প্রতিষ্ঠানের। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের সর্বত্র এই ধরণের ভয়ার্ত চিত্র তুলে ধরতে বেশি দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সেসব সংগঠনদের। কিন্তু সে দেশের আমাজন জঙ্গলই যে যেতে বসেছে তার প্রচার নেই। এটি পরিবেশ নিয়ে উন্নতদেশের একটি আগ্রাসন।
তবে এটা না মেনে উপায় নেই। গোটা নদীমাত্রিক দেশে ভারতে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে যা অবস্থা হয়েছে তা অবর্ণনীয়। একের পর এক নদী বাঁধ শুধু জলাধারার ক্ষতি করে নি অনেক রাজ্যকে করে তুলেছে বন্যাপ্রবণ। বাঁধ আর জলাধার তৈরির দাপটে প্রায় ৪কোটি লোক বাসস্থান খুইয়েছে। নদীকে না বুঝে, ভূ-প্রকৃতিকে পরখ না করে শিল্পের নামে জলা-জঙ্গলকে চেছেমুছে ফেলার কুফল ধীরে ধীরে ফলতে শুরু করেছে। অতিরিক্ত চিন্তা প্রসূত পরিকল্পনা দেশের সব নদীকে জুড়ে দেওয়ার প্রকল্পও দারুন ধাক্কা খাচ্ছে। যখন ঐ পরিকল্পনা করা হয়েছে তখন বোঝা যায়নি এক দশকের মধ্যে পৃথিবীর বুক থেকে কমপক্ষে ১০টি নদী চিরতরে মুছে যাবে। তার প্রভাব পড়বে দেশের নদী প্রকল্পে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন ভারতের সেই জীবনরেখা (লাইফ লাইন) নিচিহ্ন হয়ে যেতে পারে। উৎপত্তিস্থলের কাছে গঙ্গার এখন যে হাল তা নিয়ে কেউ ভেবেছেন ? এলাহাবাদের অনেক জায়গায় গঙ্গা নদীকে পায়ে হেঁটে পেরোনো দেখেও আমাদের মন্ত্রীদের মাথায় ভাবনা আসে না। দুরপাল্লার ট্রেনে করে ঘুরতে গিয়েও আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে না যখন দেখী বিশাল বিশাল রেল ব্রিজের নীচে জলের রেখাটি যখন দেখতে পাওয়া যায় না। নদী, উপনদী সব শুকিয়ে এখন জনপথ তৈরি হয়ে গেছে। যখন বিজ্ঞানীরা বলেন ১টি গাছ কমপক্ষে ৫জন পূর্ণবয়স্কের দৈনিক অক্সিজেন চাহিদা মেটাতে পারে কিংবা মাত্র ৩০টি গাছ একটি এলাকার সারা বছরের কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে শুষে নিতে পারে, তখনও টনক নড়ে না স্থানীয় প্রশাসনে। এরপরেও মামুলি কারণে নৃশংসভাবে কাটা হয় বড় বড় গাছ।
জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রকে উপেক্ষা করে বড় বড় পুকুরের পাড় বাধিয়ে দেওয়াটা মধ্যে কতটা বাস্তব চেতনা আছে তা নিয়ে প্রশ্নতো উঠতে পারে। আর সেই কাজকে সমর্থন দিয়ে চলেছে প্রশাসনিক অর্থ মঞ্জুরি। জন সাধারণ যা খুশীই চাইতে পারেন, কিন্তু তা কতটা স্থিতীশীল উন্নয়নের পরিপন্থী তা পরখ করতে হবে না সরকারকে ? তাই শুধু বাক্য দিয়েই উন্নয়ন হবে। তা কতটা পরিবেশ সহায়ক ভাবতে হবে না। এই পৃথিবীর স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে কী করে আমাদের স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে ? সামান্য এ বার্তাটি জনসাধারণের কাছে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, নাকি বোঝাতে কোথাও খামতি থেকে যাচ্ছে তাই একটু পর্যালোচনা করার দরকার বোধহয় দরকার। নাহলে বসুন্ধরা দিবস উদযাপনটা অনেকটা জন্মদিন পালনের মতো হয়েই থাকবে।
আলোচিত ব্লগ
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন
মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)
ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)
০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন
টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন
আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।
ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।