somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার প্রথম প্রেম!

১০ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



২০০২ এর দিকের ঘটনা, বরিশালের অমৃত লাল দে কলেজে পড়ি ফার্ষ্ট ইয়ারে। আমার বাসার পাশেই আমার এক ফ্রেন্ড থাকত - মাসুদ, কিন্তু ওর সাথে তেমন কোন কথা হত না প্রথম দিকে। আমার আগে থেকেই সিনিয়র দের সাথে বেশি ভাব হয়, সেভাবে মাসুদের বড় ভাই মামুনের সাথে আমার খুবই ক্লোজ রিলেশন হয়। মামুন ভাই আমার সাথে সবই শেয়ার করত। আমরা এক সাথে অনেক আড্ডা দিতাম।

রাস্তার একদম পাশেই আমাদের বাসা ছিল। সেই রাস্তার ঠিক অপর পাশেই ছিল তানিয়ার নানুবাড়ি। ও বছরের ৩৬০ দিনই নানুবাড়িতেই থাকত। আর পাঁচ দিন ওদের বাসায় যেত অক্সফোর্ড মিশন রোডে। ও আমার সাথেই পড়ত কিন্তু মহিলা কলেজে। কখনো তেমন কোন কথা হয়নি ওর সাথে, কিন্তু এমনি চিনতাম।

কলেজে শুরুতে খুবই আড্ডাবাজি করতাম। আমাদের সাথে একটা মেয়ে পড়ত শুক্লা নামে। আমার ফ্রেন্ডরা পারলে ওর সাথে আমাকে প্রেম করিয়েই ছাড়ে। আমি জানি আকাশ নামে আমারই আরেক ফ্রেন্ড শুক্লাকে পছন্দ করত। আকাশের আরেকটা নাম ছিল, ভুলে গেছি। আকাশ ওর নিজের রাখা নাম। কিন্তু আকাশ যে শুক্লাকে পছন্দ করত তা আমি বাদে আর কেউই জানত না। আমি যে শুক্লাকে পছন্দ করতাম ঠিক তাও না, কিন্তু সারাদিন কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকলে এমনিতেই একটা ভাল লাগা তৈরী হয় নিজের অজান্তেই। আমার বিশ্বাস, ব্যাপারটা ও নিজেও জানত। এ নিয়ে কখনো কথা হয়নি।

এর মধ্যে একদিন মামুন ভাই আমাকে এসে বলে যে সে তানিয়াকে পছন্দ করে। কোন একটা ব্যবস্থা করে দিতে যেহেতু একই ব্যাচ। আমি বললাম, ভাই ওর সাথে তো আমার কোন কথা হয় না, এক সাথে কোথাও প্রাইভেটও পড়ি না। ৩-৪ দিন হাই হ্যালো হয়েছে, এর মধ্যে একদিন আমার কাছ থেকে বাংলার সাজেশন নিয়েছে - এইটুকুই। আমি কিভাবে করব? দুজন মিলে অনেক চিন্তা করলাম। পরে মামুন ভাই বলল, তোর লেখার হাত ভাল আছে (এইটা চাপা পুরাই, পটানোর জন্য। ছোটবেলা থেকে ম্যাগাজিনে লিখতে পছন্দ করতাম দেখে কেউ প্রশংসা করলেই গলে যেতাম :p), তুই আমাকে চিঠি লিখে দে। আমি ওর বাসার ঠিকানায় পোস্ট করে দেই। আমি বললাম, সেটা করতে পারি। এর পর শুরু করলাম মনের মাধুরী মিশিয়ে চিঠি লেখা। সপ্তাহে ৩-৪টা করে চিঠি লিখে দিতাম। চিঠি লেখাকে পুরাই শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রতিদিন নতুন নতুন ভাষা যে তখন কই পেতাম! আর মামুন ভাই সেই চিঠি পোস্ট করে আসত। বলা বাহুল্য, নিচে নাম লিখতাম না।

এভাবে ২-৩ মাস কেটে গেল। এর মধ্যে মাসুদের সাথেও আমার ক্লোজ রিলেশন হল। তবে মামুন ভাই বার বার করে বলে দিয়েছে, যেন তানিয়ার কথা মাসুদকে না বলি। এমন সময় আমার ফ্রেন্ডরা ঠিক করল, শুক্লাকে আমার হয়ে প্রপোজ করবে। আমি বাধা দিয়ে বললাম, ভাই যদি করিস তাহলে আকাশের জন্য কর। পোলাটা অনেক দিন ধরে ওরে পছন্দ করে। সবাই আকাশ (এই আকাশ মাথার উপড়ের আকাশ) থেকে পড়ল। আকাশ (এটা নিচের আকাশ, ফ্রেন্ড) আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ও ভাবেওনি আমি এভাবে দুম করে বলে দিব। আমি তখন বললাম, কাহিনী হল এই। আমার হয়তো শুক্লাকে হালকা ভাল লাগে, কিন্তু সেটা তেমন কিছু না। আর আমার ভাল লাগার পিছনে দায়ী তোরা, আমি না। আর আকাশেরটা অরিজিনাল, প্রিজারভেটিভ ছাড়া একদম। আমার চেয়ে আকাশই বেশি ডিজার্ভ করে। বলে হিরোদের মত একটা উদাস ভাব নিয়ে উপড়ের আকাশের দিকে তাকালাম। পরিস্থিতি থমথমে। আকাশ ওর রুমে চলে গেল, মেসে থাকত সে। আমি তখন সবাইকে আবার খুলে বললাম। সবাই মিলে ঠিক করল, কাল আবার এ নিয়ে মিটিং হবে। মজার কথা যার বিয়ে তার খবর নাই - শুক্লা এসবের কিছুই জানত না :D

বৃহস্পতিবার রাত আমার কাছে স্বর্গীয় মনে হত, কারণ পরদিন বন্ধ। তেমন এক রাতে আমাদের বাড়িওয়ালার বাসা থেকে ডাক আসল। আমার ফোন এসেছে, তখন আমাদের মোবাইল ছিল না। সব জায়গায় বাড়িওয়ালার ফোন নম্বর দিতাম। আমি নিশ্চিত, কাল শুক্রবার - নিশ্চয়ই কোন প্লান করেছে। হ্যা, প্লান তো ছিলই - সেটা বিধাতার! আমি গিয়ে ফোন ধরলামঃ

- হ্যালো
- আমি তানিয়া
- হ্যা বল, কি অবস্থা?
- কেমন আছ?
- এই দাড়া! কেমন আছি মানে? কিছু হইছে?
- না জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছ?
- ওয়েট, আপনি কোন তানিয়া? (আমাদের সাথে আরো এক তানিয়া পড়ত, আমি ভেবেছিলাম সে ফোন করেছে)
- তোমাদের বাসার সামনের বাসার তানিয়া।
- ওহ তুমি! আমি তো বুঝতেই পারিনি। বল তারপর -
- কাল একটু দেখা করতে পারবে?
- কাল? কখন?
- ১০ টায়।
- হ্যা পারব। কি নোট নিয়ে আসব?
- নোট না, অন্য ব্যাপারে
- কি ব্যাপারে?
- সেটা আসলেই বুঝতে পারবা!
- আচ্ছা!!! কই আসব?
- বেলস পার্ক এস।
- আমি বললাম আচ্ছা। কিন্তু তুমি বের হবার পরে আমি বের হব। আগে গিয়ে বসে থাকতে পারব না।

আচ্ছা বলেই লাইন কেটে দিল সে।

আমার বুকের মধ্য থেকে হুহু করে বাতাস সরে গেল। মনে হল বুক একদম খালি, এর মধ্যে সারা দুনিয়া ঢুকে যাবে এখন। একবার মনে হল ও কি বুঝতে পারছে যে আমি চিঠি লিখে দেই? বুঝলে মামুন ভাই বলেছে। কিন্তু তার সাথে তো কথা হলে আমাকে জানাতই। নাকি পোলাপান দিয়ে মাইর দিবে? একবার মনে হল ফ্রেন্ডদের জানাই যাতে ওরাও রেডি থাকে। আবার ভাবলাম যদি না হয়? ফ্রেন্ডদের সামনে ইজ্জত যাবে। আমি বরং মাসুদকে বললাম, দোস্ত এই এই কাহিনী। তখন দুজন মিলে প্লান করে ঠিক করলাম যে, মাসুদ সবাইকে বলবে একটা ঝামেলা হতে পারে, সবাই যেন রেডি থাকে সকালে। কিছু হলে জানাবে। আর সকালে মাসুদ আমার পিছন পিছন যাবে। অবস্থা খারাপ দেখলে ও সবাইকে খবর দিবে।

প্লানমত, আমি আর মাসুদ বাসার ভিতরে রেডি হয়ে ওদের গেঁটের দিকে তাকিয়ে আছি। ১০টার কিছু আগে সে বের হল। রিকশা নেবার সাথে আমি আর মাসুদ বের হয়ে দুজনে দুটো রিকশা নিলাম। প্রথম মোড় ঘুরে কিছুদূর যেতেই দেখি তানিয়া রিকশা থামিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বলল, নেমে এটাতে উঠ। আমিও নেমে উঠলাম। পিছন ফিরে দেখি মাসুদ রিকশা থেকে নেমে রিকশার ভাড়া দিচ্ছে। মানে কি? ও যাবে না? ঐ শালায়ও কি তাইলে জড়িত? তাইলে কি মাসুদ তানিয়া রে পছন্দ করে? আমি ওর ভাইরে হেল্প করতেছি দেখে সিস্টেম করতেছে? কত যে চিন্তা মাথায়!

রিকশায় উঠে প্রথম খাজুরে পেঁচাল শুরু করলাম দু জনে। এমন কথা বলতে বলতে বেলস পার্কে নামলাম আমরা। ফুচকা খেতে চাইল, খাওয়ালাম। ও বলল যে বরিশালে এই ফার্ষ্ট কোন ফ্যামিলি মেম্বার ছাড়া ও ঘুরতে বেরিয়েছে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর তানিয়া বলল, শোনো, আমি প্রাইভেটের কথা বলে বের হয়েছি। এখন ফিরতে হবে। আসল কথা বলি। তুমি আমাকে চিঠিগুলো কেন লিখতে? আমি আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললাম? কোন চিঠি? আমি কেন তোমাকে লিখব?
- আমার কাছে কিন্তু সব চিঠি আছে এখন। তুমি যে চিঠি পাঠাতে তার তিনটা আমার মার হাতে পড়েছে। তুমি দেখবে বাকিগুলো?
- হ্যা, দেখাও তো। কি চিঠি লিখলাম আমিই জানি না!
- (কি আজব, ও এক গাদা চিঠি বের করল) এই নাও। কয়জনকে চিঠি দাও যে মনে রাখতে পার না?
- (আমি চিঠিগুলো হাতে নিয়ে) আরে এই চিঠি আমার না তো। কোথাও তো আমার নামও নেই। কে বলেছে যে আমি লিখেছি?
- হাতের লেখা তো তোমার
- মাথা খারাপ, আমার লেখা এটা না

সে তখন সুন্দর করে ব্যাগ থেকে বাংলার সাজেশনটা বের করল, যেটা আমিই তাকে দিয়েছিলাম। দুম করে স্পীকার হয়ে গেলাম একেবারে! শব্দহীন, ভাষাহীন এবং চিন্তাহীন হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম! এই বয়সে এই মেয়ের এত বুদ্ধি ক্যান? আমি তো একবারও ভাবলাম না।

একটু সামলে নিয়ে আমি তাকে সব খুলে বললাম। ঘটনা খুলে বললাম, ঘটনা! মামুন ভাই কে তানিয়াও চিনে। ও বলল যে, তারও মনে হইছে মামুন ভাই পছন্দ করে। কিন্তু মামুন ভাই যেহেতু আমার সাথেই বেশিক্ষণ থাকে এবং চিঠি আমি লিখেছি, তাই ভাবলে যে আমার জন্যই মামুন ভাই তার দিকে চেয়ে থাকত!

- (তানিয়া) চিঠির কথা গুলো মুখে বলতে পারনা?
- সব কথা তো মুখে বলা যায় না। তাছাড়া, আমি তো তোমাকে বলতেও চাইনি।
- বলার মত কেউ আছে বলে তো জানিনা, যে থাকার একটু চান্স ছিল তাকেও তো ফ্রেন্ডের জন্য কুরবানি দিয়েছ।
- সে খোজ কখন নিলে?
- বরিশাল অনেক ছোটো শহর, চাইলেই খোজ নেয়া যায়।
- তাই বলে তুমি আমার খোজ কেন নিবে?
- চিঠি পড়ে যে ভালবেসে ফেলেছি
- আমি কি মামুন ভাইকে কিছু বলব? নাকি তুমি নিজেই বলবে?
- উনি আসল কোথা থেকে আবার?
- চিঠি আমি লিখলেও লিখতাম তো ওনার জন্য
- ভাষাগুলো তো তোমার
- আমি কিন্তু তার দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতাম
- যে মানুষ মনের চোখ দিয়ে এত সুন্দরভাবে দেখতে পারে, তার সাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়!

আমার কাছে আর উত্তর রইল না। এই প্রথম আমি তানিয়ার দিকে মুখ তুলে তাকালাম ভালভাবে। আগে কখনো মেয়েটিকে তেমন ভাবে দেখিনি। আকাশে অনেক মেঘ করেছে, মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবেই। কিন্তু এই মেয়ের কাজল দেয়া চোখে তো তার আগেই বৃষ্টি আসি আসি করছে। ষোড়শী মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর লাগে ছলছল চোখে। বলতে ইচ্ছে করে, মেয়ে তুমি কেঁদো না, শুধু জলটুকু ধরে রাখো চোখে - আর আমি তাকিয়ে থাকি প্রাণভরে।

তানিয়া চোখে কাজল বাদে আর কোন কিছু দেয় না মুখে। থাকে না কোন অর্নামেন্টস। শুধু হাতে কিছু এলোমেলো চুড়ি। আমার এমনিতেই সিম্পল মেয়ে পছন্দ। যেখানে কোন কৃত্রিমতা নেই, শুধুই স্নিগ্ধতা। মূহুর্তেই মনে হল আমি মনে হয় এই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলাম।

- (তানিয়া) বৃষ্টিতে ভিজবে?
- যদি ঠাণ্ডা লাগে?
- লাগবে না। আর যদিও লাগেও, ভাবলে আমার জন্য লাগল। মনে থাকবে সব সময়।
- কিন্তু তোমার তো সময়ও নেই
- হ্যা, চল রিকশায় করে বৃষ্টিতে ভিজি
- সেই ভাল, চল

বসা থেকে যেই উঠে রিকশার জন্য দাঁড়ালাম, অমনি ও আমার হাতের আঙ্গুলগুলো ওর আঙ্গুলের সাথে জড়িয়ে নিল। আমি সরাতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম, আমার চঞ্চলতা এখানে এসে সীমানা পেয়েছে। যেখান নিজেকে সমর্পন করাই শ্রেয়। আমিও ওর আঙুল ধরলাম। জীবনে প্রথম কাউকে সত্যি ভাল লাগল অনেক। সেই যে হাত ধরলাম, সেটা ছেড়েছিলাম প্রায় আধা ঘণ্টা পড়ই ওর বাপের সামনে পড়ে! আসছি সেই কথায়।

আমরা রিকশা নিলাম। একটু পরই অনেক জোড়ে বৃষ্টি নামল। আমরা দুজন হাত ধরে ভিজে ভিজে যাচ্ছি। প্রেম হবার ঠিক পরমূহুর্তেই মানুষ কথা খুঁজে পায় না। আমরাও পাই নি। আর দরকারই বা কি ছিল কথা বলার! কিছু কিছু মূহুর্ত শুধু উপভোগ করার। শব্দ সেখানে বাহুল্য। বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা বাসার কাছাকাছি। গলির অন্য মাথা থেকে একটা বাইক আসছে। হঠাত তানিয়া বলে উঠল - আব্বু! আমি বললাম কই? ও বলল, ঐ তো সামনে বাইকে! আমি চলন্ত রিকশা থেকে দিলাম লাফ, সেই হাত ছাড়লাম। ও শুধু একবার পিছন ফিরে তাকাল। আমার পাশ দিয়ে একটু পর বাইকটা চলে গেল, ভাগ্যিস দেখেনি। আমি এরপর সামনে গিয়ে বললাম, তুমি চলে যাও, বাসার কাছেই তো।

- তুমি হেঁটে যাবে?
- আমি একটু কলেজের দিকে যাব। (মিথ্য কথা ছিল, আমি আসলে মাসুদকে খুঁজব - শালায় বেইমানী করল ক্যান)
- উত্তরটা তো জানা হল না!
- উত্তরটা যদি "না" হত তবে এতক্ষণ হাতটা ধরে থাকতাম না

শুনে এত সুন্দর একটা হাসি দিল - পরেও আর কখনো আমি ওকে এত সুন্দর করে হাসতে দেখিনি। কিছু কিছু মূহুর্ত জীবনে একবারই আসে। তেমন কোন সময়কে স্মরণীয় করে রাখতে এমন একটা হাসিই যথেষ্ট।

ও চলে গেল বাসার দিকে, আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের আড্ডার দিকে রওয়ানা দিলাম। বৃষ্টির মধ্যে সিগারেট খাওয়ায় অন্য রকম মজা, যারা খায় শুধু তারাই জানে। গিয়েই দেখি মাসুদ পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। আমি গিয়েই সাথে সাথে মাইর শুরু করলাম - বেঈমান! ও বলল, দোস্ত, তোকে যখন ওর রিকশায় নিল - তখনই বুঝলাম অন্য কেস। পাড়ার মধ্যে এক রিকশায় বসতে দুইটা জিনিস লাগে - সাহস আর ভালবাসা!

প্রায় দেড়টা বছর আমরা যে কত পাগলামো করেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পাগলামো হল ওর সাথে রাতে দেখা করা। ওদের বাসা ছিল এক তলা, উপড়ে ছাদ। রাত এগারোটার পরে যখন সবাই ঘুমাত, আমি একটা আমড়া গাছ বেঁয়ে উঠতাম ওদের ছাদে। ওর রুমের উপড়ে গিয়ে, ছাদ থেকে ওর জানালায় ঢিল ছুড়তাম, আর ও তখন চলে আসত ছাদে। আমরা পিছনের দিকে গিয়ে দুজন পা ঝুলিয়ে বসতাম। একদিন তো তুমুল বৃষ্টি। বুঝতেছিলাম না যে যাব কিনা। ও যদি অপেক্ষা করে থাকে। ফোন তো নেই যে বলব। আমি গেলাম, ও তো অবাক। এত বৃষ্টির মধ্যে কেন আসছ! বললাম, তোমাকে অপেক্ষা করাতে পারব না। বৃষ্টিতে ভিজলাম রাতে বসে বসে, দু পা ঝুলিয়ে আর আমার হাতের মধ্যে তার হাতটা রেখে। কত যে গল্প, তার কোন শেষ নেই! হঠাত শুনি ছাদের সিঁড়ি ঘর থেকে তানিয়ার নানুর গলা - তানিয়া, তুই কি ছাদে? আমি মাথা ঘুরালাম। চেয়ে দেখি ওর নানু এক হাতে ছাতা আর অন্য হাতে টর্চ নিয়ে আসছে। এদিকেই টর্চটা মারল। আমি আবারো ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে একেবারে লাফ দিলাম একতলা থেকে নিচে কাঁদা মাটির উপর। সেই ছিল শেষবারের মত ওর হাত ধরা!

এর পরই হঠাত করে তানিয়া যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। অনেক চেষ্টা করেও কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। শুধু মাঝে একবার মাসুদকে বলেছিল, ওকে বল আমাকে যেন ভুলে যায়।

সেদিন থেকে আমার এইচ এস সি পরীক্ষার বাকি মাত্র ১২ দিন। আমি আসলেই জানিনা কি হয়েছিল, কেনই বা দূরে সরে গেল। আমি ধারণা করি যে, ওর নানুই হয়তো ঝামেলাটা করেছে। পরে ওর বাবা-মা ও হয়তো অনেক চাপ দিয়েছে। আমি জানি ও আমার নাম বলেনি, কারণ এর পরেও ওর নানু বা ওর বাসার অন্য লোক আমার সাথে আগের মতই খুবই স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে।

তানিয়া, অনেক চাপ সহ্য করে তুমি আমার নাম বলনি, কিন্তু প্রথম দিনের চেয়ে আর একটু বেশি সাহস করতে পারলে এই গল্পের শেষটা হয়তো অন্য রকম হত!২০০০ এর দিকের ঘটনা, বরিশালের অমৃত লাল দে কলেজে পড়ি ফার্ষ্ট ইয়ারে। আমার বাসার পাশেই আমার এক ফ্রেন্ড থাকত - মাসুদ, কিন্তু ওর সাথে তেমন কোন কথা হত না প্রথম দিকে। আমার আগে থেকেই সিনিয়র দের সাথে বেশি ভাব হয়, সেভাবে মাসুদের বড় ভাই মামুনের সাথে আমার খুবই ক্লোজ রিলেশন হয়। মামুন ভাই আমার সাথে সবই শেয়ার করত। আমরা এক সাথে অনেক আড্ডা দিতাম।

রাস্তার একদম পাশেই আমাদের বাসা ছিল। সেই রাস্তার ঠিক অপর পাশেই ছিল তানিয়ার নানুবাড়ি। ও বছরের ৩৬০ দিনই নানুবাড়িতেই থাকত। আর পাঁচ দিন ওদের বাসায় যেত অক্সফোর্ড মিশন রোডে। ও আমার সাথেই পড়ত কিন্তু মহিলা কলেজে। কখনো তেমন কোন কথা হয়নি ওর সাথে, কিন্তু এমনি চিনতাম।

কলেজে শুরুতে খুবই আড্ডাবাজি করতাম। আমাদের সাথে একটা মেয়ে পড়ত শুক্লা নামে। আমার ফ্রেন্ডরা পারলে ওর সাথে আমাকে প্রেম করিয়েই ছাড়ে। আমি জানি আকাশ নামে আমারই আরেক ফ্রেন্ড শুক্লাকে পছন্দ করত। আকাশের আরেকটা নাম ছিল, ভুলে গেছি। আকাশ ওর নিজের রাখা নাম। কিন্তু আকাশ যে শুক্লাকে পছন্দ করত তা আমি বাদে আর কেউই জানত না। আমি যে শুক্লাকে পছন্দ করতাম ঠিক তাও না, কিন্তু সারাদিন কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকলে এমনিতেই একটা ভাল লাগা তৈরী হয় নিজের অজান্তেই। আমার বিশ্বাস, ব্যাপারটা ও নিজেও জানত। এ নিয়ে কখনো কথা হয়নি।

এর মধ্যে একদিন মামুন ভাই আমাকে এসে বলে যে সে তানিয়াকে পছন্দ করে। কোন একটা ব্যবস্থা করে দিতে যেহেতু একই ব্যাচ। আমি বললাম, ভাই ওর সাথে তো আমার কোন কথা হয় না, এক সাথে কোথাও প্রাইভেটও পড়ি না। ৩-৪ দিন হাই হ্যালো হয়েছে, এর মধ্যে একদিন আমার কাছ থেকে বাংলার সাজেশন নিয়েছে - এইটুকুই। আমি কিভাবে করব? দুজন মিলে অনেক চিন্তা করলাম। পরে মামুন ভাই বলল, তোর লেখার হাত ভাল আছে (এইটা চাপা পুরাই, পটানোর জন্য। ছোটবেলা থেকে ম্যাগাজিনে লিখতে পছন্দ করতাম দেখে কেউ প্রশংসা করলেই গলে যেতাম :p), তুই আমাকে চিঠি লিখে দে। আমি ওর বাসার ঠিকানায় পোস্ট করে দেই। আমি বললাম, সেটা করতে পারি। এর পর শুরু করলাম মনের মাধুরী মিশিয়ে চিঠি লেখা। সপ্তাহে ৩-৪টা করে চিঠি লিখে দিতাম। চিঠি লেখাকে পুরাই শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রতিদিন নতুন নতুন ভাষা যে তখন কই পেতাম! আর মামুন ভাই সেই চিঠি পোস্ট করে আসত। বলা বাহুল্য, নিচে নাম লিখতাম না।

এভাবে ২-৩ মাস কেটে গেল। এর মধ্যে মাসুদের সাথেও আমার ক্লোজ রিলেশন হল। তবে মামুন ভাই বার বার করে বলে দিয়েছে, যেন তানিয়ার কথা মাসুদকে না বলি। এমন সময় আমার ফ্রেন্ডরা ঠিক করল, শুক্লাকে আমার হয়ে প্রপোজ করবে। আমি বাধা দিয়ে বললাম, ভাই যদি করিস তাহলে আকাশের জন্য কর। পোলাটা অনেক দিন ধরে ওরে পছন্দ করে। সবাই আকাশ (এই আকাশ মাথার উপড়ের আকাশ) থেকে পড়ল। আকাশ (এটা নিচের আকাশ, ফ্রেন্ড) আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ও ভাবেওনি আমি এভাবে দুম করে বলে দিব। আমি তখন বললাম, কাহিনী হল এই। আমার হয়তো শুক্লাকে হালকা ভাল লাগে, কিন্তু সেটা তেমন কিছু না। আর আমার ভাল লাগার পিছনে দায়ী তোরা, আমি না। আর আকাশেরটা অরিজিনাল, প্রিজারভেটিভ ছাড়া একদম। আমার চেয়ে আকাশই বেশি ডিজার্ভ করে। বলে হিরোদের মত একটা উদাস ভাব নিয়ে উপড়ের আকাশের দিকে তাকালাম। পরিস্থিতি থমথমে। আকাশ ওর রুমে চলে গেল, মেসে থাকত সে। আমি তখন সবাইকে আবার খুলে বললাম। সবাই মিলে ঠিক করল, কাল আবার এ নিয়ে মিটিং হবে। মজার কথা যার বিয়ে তার খবর নাই - শুক্লা এসবের কিছুই জানত না :D

বৃহস্পতিবার রাত আমার কাছে স্বর্গীয় মনে হত, কারণ পরদিন বন্ধ। তেমন এক রাতে আমাদের বাড়িওয়ালার বাসা থেকে ডাক আসল। আমার ফোন এসেছে, তখন আমাদের মোবাইল ছিল না। সব জায়গায় বাড়িওয়ালার ফোন নম্বর দিতাম। আমি নিশ্চিত, কাল শুক্রবার - নিশ্চয়ই কোন প্লান করেছে। হ্যা, প্লান তো ছিলই - সেটা বিধাতার! আমি গিয়ে ফোন ধরলামঃ

- হ্যালো
- আমি তানিয়া
- হ্যা বল, কি অবস্থা?
- কেমন আছ?
- এই দাড়া! কেমন আছি মানে? কিছু হইছে?
- না জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছ?
- ওয়েট, আপনি কোন তানিয়া? (আমাদের সাথে আরো এক তানিয়া পড়ত, আমি ভেবেছিলাম সে ফোন করেছে)
- তোমাদের বাসার সামনের বাসার তানিয়া।
- ওহ তুমি! আমি তো বুঝতেই পারিনি। বল তারপর -
- কাল একটু দেখা করতে পারবে?
- কাল? কখন?
- ১০ টায়।
- হ্যা পারব। কি নোট নিয়ে আসব?
- নোট না, অন্য ব্যাপারে
- কি ব্যাপারে?
- সেটা আসলেই বুঝতে পারবা!
- আচ্ছা!!! কই আসব?
- বেলস পার্ক এস।
- আমি বললাম আচ্ছা। কিন্তু তুমি বের হবার পরে আমি বের হব। আগে গিয়ে বসে থাকতে পারব না।

আচ্ছা বলেই লাইন কেটে দিল সে।

আমার বুকের মধ্য থেকে হুহু করে বাতাস সরে গেল। মনে হল বুক একদম খালি, এর মধ্যে সারা দুনিয়া ঢুকে যাবে এখন। একবার মনে হল ও কি বুঝতে পারছে যে আমি চিঠি লিখে দেই? বুঝলে মামুন ভাই বলেছে। কিন্তু তার সাথে তো কথা হলে আমাকে জানাতই। নাকি পোলাপান দিয়ে মাইর দিবে? একবার মনে হল ফ্রেন্ডদের জানাই যাতে ওরাও রেডি থাকে। আবার ভাবলাম যদি না হয়? ফ্রেন্ডদের সামনে ইজ্জত যাবে। আমি বরং মাসুদকে বললাম, দোস্ত এই এই কাহিনী। তখন দুজন মিলে প্লান করে ঠিক করলাম যে, মাসুদ সবাইকে বলবে একটা ঝামেলা হতে পারে, সবাই যেন রেডি থাকে সকালে। কিছু হলে জানাবে। আর সকালে মাসুদ আমার পিছন পিছন যাবে। অবস্থা খারাপ দেখলে ও সবাইকে খবর দিবে।

প্লানমত, আমি আর মাসুদ বাসার ভিতরে রেডি হয়ে ওদের গেঁটের দিকে তাকিয়ে আছি। ১০টার কিছু আগে সে বের হল। রিকশা নেবার সাথে আমি আর মাসুদ বের হয়ে দুজনে দুটো রিকশা নিলাম। প্রথম মোড় ঘুরে কিছুদূর যেতেই দেখি তানিয়া রিকশা থামিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বলল, নেমে এটাতে উঠ। আমিও নেমে উঠলাম। পিছন ফিরে দেখি মাসুদ রিকশা থেকে নেমে রিকশার ভাড়া দিচ্ছে। মানে কি? ও যাবে না? ঐ শালায়ও কি তাইলে জড়িত? তাইলে কি মাসুদ তানিয়া রে পছন্দ করে? আমি ওর ভাইরে হেল্প করতেছি দেখে সিস্টেম করতেছে? কত যে চিন্তা মাথায়!

রিকশায় উঠে প্রথম খাজুরে পেঁচাল শুরু করলাম দু জনে। এমন কথা বলতে বলতে বেলস পার্কে নামলাম আমরা। ফুচকা খেতে চাইল, খাওয়ালাম। ও বলল যে বরিশালে এই ফার্ষ্ট কোন ফ্যামিলি মেম্বার ছাড়া ও ঘুরতে বেরিয়েছে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর তানিয়া বলল, শোনো, আমি প্রাইভেটের কথা বলে বের হয়েছি। এখন ফিরতে হবে। আসল কথা বলি। তুমি আমাকে চিঠিগুলো কেন লিখতে? আমি আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললাম? কোন চিঠি? আমি কেন তোমাকে লিখব?
- আমার কাছে কিন্তু সব চিঠি আছে এখন। তুমি যে চিঠি পাঠাতে তার তিনটা আমার মার হাতে পড়েছে। তুমি দেখবে বাকিগুলো?
- হ্যা, দেখাও তো। কি চিঠি লিখলাম আমিই জানি না!
- (কি আজব, ও এক গাদা চিঠি বের করল) এই নাও। কয়জনকে চিঠি দাও যে মনে রাখতে পার না?
- (আমি চিঠিগুলো হাতে নিয়ে) আরে এই চিঠি আমার না তো। কোথাও তো আমার নামও নেই। কে বলেছে যে আমি লিখেছি?
- হাতের লেখা তো তোমার
- মাথা খারাপ, আমার লেখা এটা না

সে তখন সুন্দর করে ব্যাগ থেকে বাংলার সাজেশনটা বের করল, যেটা আমিই তাকে দিয়েছিলাম। দুম করে স্পীকার হয়ে গেলাম একেবারে! শব্দহীন, ভাষাহীন এবং চিন্তাহীন হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম! এই বয়সে এই মেয়ের এত বুদ্ধি ক্যান? আমি তো একবারও ভাবলাম না।

একটু সামলে নিয়ে আমি তাকে সব খুলে বললাম। ঘটনা খুলে বললাম, ঘটনা! মামুন ভাই কে তানিয়াও চিনে। ও বলল যে, তারও মনে হইছে মামুন ভাই পছন্দ করে। কিন্তু মামুন ভাই যেহেতু আমার সাথেই বেশিক্ষণ থাকে এবং চিঠি আমি লিখেছি, তাই ভাবলে যে আমার জন্যই মামুন ভাই তার দিকে চেয়ে থাকত!

- (তানিয়া) চিঠির কথা গুলো মুখে বলতে পারনা?
- সব কথা তো মুখে বলা যায় না। তাছাড়া, আমি তো তোমাকে বলতেও চাইনি।
- বলার মত কেউ আছে বলে তো জানিনা, যে থাকার একটু চান্স ছিল তাকেও তো ফ্রেন্ডের জন্য কুরবানি দিয়েছ।
- সে খোজ কখন নিলে?
- বরিশাল অনেক ছোটো শহর, চাইলেই খোজ নেয়া যায়।
- তাই বলে তুমি আমার খোজ কেন নিবে?
- চিঠি পড়ে যে ভালবেসে ফেলেছি
- আমি কি মামুন ভাইকে কিছু বলব? নাকি তুমি নিজেই বলবে?
- উনি আসল কোথা থেকে আবার?
- চিঠি আমি লিখলেও লিখতাম তো ওনার জন্য
- ভাষাগুলো তো তোমার
- আমি কিন্তু তার দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতাম
- যে মানুষ মনের চোখ দিয়ে এত সুন্দরভাবে দেখতে পারে, তার সাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়!

আমার কাছে আর উত্তর রইল না। এই প্রথম আমি তানিয়ার দিকে মুখ তুলে তাকালাম ভালভাবে। আগে কখনো মেয়েটিকে তেমন ভাবে দেখিনি। আকাশে অনেক মেঘ করেছে, মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবেই। কিন্তু এই মেয়ের কাজল দেয়া চোখে তো তার আগেই বৃষ্টি আসি আসি করছে। ষোড়শী মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর লাগে ছলছল চোখে। বলতে ইচ্ছে করে, মেয়ে তুমি কেঁদো না, শুধু জলটুকু ধরে রাখো চোখে - আর আমি তাকিয়ে থাকি প্রাণভরে।

তানিয়া চোখে কাজল বাদে আর কোন কিছু দেয় না মুখে। থাকে না কোন অর্নামেন্টস। শুধু হাতে কিছু এলোমেলো চুড়ি। আমার এমনিতেই সিম্পল মেয়ে পছন্দ। যেখানে কোন কৃত্রিমতা নেই, শুধুই স্নিগ্ধতা। মূহুর্তেই মনে হল আমি মনে হয় এই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলাম।

- (তানিয়া) বৃষ্টিতে ভিজবে?
- যদি ঠাণ্ডা লাগে?
- লাগবে না। আর যদিও লাগেও, ভাবলে আমার জন্য লাগল। মনে থাকবে সব সময়।
- কিন্তু তোমার তো সময়ও নেই
- হ্যা, চল রিকশায় করে বৃষ্টিতে ভিজি
- সেই ভাল, চল

বসা থেকে যেই উঠে রিকশার জন্য দাঁড়ালাম, অমনি ও আমার হাতের আঙ্গুলগুলো ওর আঙ্গুলের সাথে জড়িয়ে নিল। আমি সরাতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম, আমার চঞ্চলতা এখানে এসে সীমানা পেয়েছে। যেখান নিজেকে সমর্পন করাই শ্রেয়। আমিও ওর আঙুল ধরলাম। জীবনে প্রথম কাউকে সত্যি ভাল লাগল অনেক। সেই যে হাত ধরলাম, সেটা ছেড়েছিলাম প্রায় আধা ঘণ্টা পড়ই ওর বাপের সামনে পড়ে! আসছি সেই কথায়।

আমরা রিকশা নিলাম। একটু পরই অনেক জোড়ে বৃষ্টি নামল। আমরা দুজন হাত ধরে ভিজে ভিজে যাচ্ছি। প্রেম হবার ঠিক পরমূহুর্তেই মানুষ কথা খুঁজে পায় না। আমরাও পাই নি। আর দরকারই বা কি ছিল কথা বলার! কিছু কিছু মূহুর্ত শুধু উপভোগ করার। শব্দ সেখানে বাহুল্য। বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা বাসার কাছাকাছি। গলির অন্য মাথা থেকে একটা বাইক আসছে। হঠাত তানিয়া বলে উঠল - আব্বু! আমি বললাম কই? ও বলল, ঐ তো সামনে বাইকে! আমি চলন্ত রিকশা থেকে দিলাম লাফ, সেই হাত ছাড়লাম। ও শুধু একবার পিছন ফিরে তাকাল। আমার পাশ দিয়ে একটু পর বাইকটা চলে গেল, ভাগ্যিস দেখেনি। আমি এরপর সামনে গিয়ে বললাম, তুমি চলে যাও, বাসার কাছেই তো।

- তুমি হেঁটে যাবে?
- আমি একটু কলেজের দিকে যাব। (মিথ্য কথা ছিল, আমি আসলে মাসুদকে খুঁজব - শালায় বেইমানী করল ক্যান)
- উত্তরটা তো জানা হল না!
- উত্তরটা যদি "না" হত তবে এতক্ষণ হাতটা ধরে থাকতাম না

শুনে এত সুন্দর একটা হাসি দিল - পরেও আর কখনো আমি ওকে এত সুন্দর করে হাসতে দেখিনি। কিছু কিছু মূহুর্ত জীবনে একবারই আসে। তেমন কোন সময়কে স্মরণীয় করে রাখতে এমন একটা হাসিই যথেষ্ট।

ও চলে গেল বাসার দিকে, আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের আড্ডার দিকে রওয়ানা দিলাম। বৃষ্টির মধ্যে সিগারেট খাওয়ায় অন্য রকম মজা, যারা খায় শুধু তারাই জানে। গিয়েই দেখি মাসুদ পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। আমি গিয়েই সাথে সাথে মাইর শুরু করলাম - বেঈমান! ও বলল, দোস্ত, তোকে যখন ওর রিকশায় নিল - তখনই বুঝলাম অন্য কেস। পাড়ার মধ্যে এক রিকশায় বসতে দুইটা জিনিস লাগে - সাহস আর ভালবাসা!

প্রায় দেড়টা বছর আমরা যে কত পাগলামো করেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পাগলামো হল ওর সাথে রাতে দেখা করা। ওদের বাসা ছিল এক তলা, উপড়ে ছাদ। রাত এগারোটার পরে যখন সবাই ঘুমাত, আমি একটা আমড়া গাছ বেঁয়ে উঠতাম ওদের ছাদে। ওর রুমের উপড়ে গিয়ে, ছাদ থেকে ওর জানালায় ঢিল ছুড়তাম, আর ও তখন চলে আসত ছাদে। আমরা পিছনের দিকে গিয়ে দুজন পা ঝুলিয়ে বসতাম। একদিন তো তুমুল বৃষ্টি। বুঝতেছিলাম না যে যাব কিনা। ও যদি অপেক্ষা করে থাকে। ফোন তো নেই যে বলব। আমি গেলাম, ও তো অবাক। এত বৃষ্টির মধ্যে কেন আসছ! বললাম, তোমাকে অপেক্ষা করাতে পারব না। বৃষ্টিতে ভিজলাম রাতে বসে বসে, দু পা ঝুলিয়ে আর আমার হাতের মধ্যে তার হাতটা রেখে। কত যে গল্প, তার কোন শেষ নেই! হঠাত শুনি ছাদের সিঁড়ি ঘর থেকে তানিয়ার নানুর গলা - তানিয়া, তুই কি ছাদে? আমি মাথা ঘুরালাম। চেয়ে দেখি ওর নানু এক হাতে ছাতা আর অন্য হাতে টর্চ নিয়ে আসছে। এদিকেই টর্চটা মারল। আমি আবারো ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে একেবারে লাফ দিলাম একতলা থেকে নিচে কাঁদা মাটির উপর। সেই ছিল শেষবারের মত ওর হাত ধরা!

এর পরই হঠাত করে তানিয়া যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। অনেক চেষ্টা করেও কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। শুধু মাঝে একবার মাসুদকে বলেছিল, ওকে বল আমাকে যেন ভুলে যায়।

সেদিন থেকে আমার এইচ এস সি পরীক্ষার বাকি মাত্র ১২ দিন। আমি আসলেই জানিনা কি হয়েছিল, কেনই বা দূরে সরে গেল। আমি ধারণা করি যে, ওর নানুই হয়তো ঝামেলাটা করেছে। পরে ওর বাবা-মা ও হয়তো অনেক চাপ দিয়েছে। আমি জানি ও আমার নাম বলেনি, কারণ এর পরেও ওর নানু বা ওর বাসার অন্য লোক আমার সাথে আগের মতই খুবই স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে।

তানিয়া, অনেক চাপ সহ্য করে তুমি আমার নাম বলনি, কিন্তু প্রথম দিনের চেয়ে আর একটু বেশি সাহস করতে পারলে এই গল্পের শেষটা হয়তো অন্য রকম হত!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১:৪১
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×