somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি কেন আর হাত দেখি না

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ ভোর ৫:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি যখন থার্ড ইয়ারের ছাত্র, তখন থেকে হাতের রেখা দেখে ভাগ্য বলতে শুরু করি। ফোর্থ ইয়ারে ওঠার পর ক্যাম্পাসে, বিশেষত মেয়েদের কাছে আমি এতটাই জনপ্রিয় যে এক ছাত্রনেতা আমাকে ডেকে নিয়ে শাসিয়ে দিয়েছিলেন। এসব ‘বুজরুকি’ বন্ধ না করলে মেডিকেল কলেজ থেকে বিতাড়নের পাকা ব্যবস্থার কথা জানানো হলো আমাকে। তখন চিকিৎসক হওয়ার পরিবর্তে ফুটপাতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে টিয়া পাখি দিয়ে ভাগ্য গণনার ব্যবসা করতে হবে বলে জানিয়ে বাংলা ছবির ভিলেনের ভঙ্গিতে হেসেছিলেন ছাত্রনেতা। আমি খপ্ করে তাঁর ডান হাত ধরে ফেলেছিলাম। সেই হাতের মুঠো খুলে একনজর তাকিয়ে ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে এমনই এক আশার বাণী শুনিয়েছি, মুহূর্তে বরফের চাঙ গলে পানি। ছাত্রনেতা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেই থেকে কলেজ ক্যানটিনে আমার চা-শিঙাড়া ফ্রি।

কিন্তু হস্তরেখাবিদ হিসেবে আমার এমন উজ্জ্বল ক্যারিয়ার এখন হুমকির মুখে। পচা শামুকে পা কাটার মতো। লীলা নামের ফার্স্ট ইয়ারের এক পুঁচকে মেয়ে আমার পাঁচ-ছয়জন ভক্ত-অনুরাগীর সামনে বলে বসল, হাত দেখার ব্যাপারটা নাকি পুরোটাই একটা ভাঁওতাবাজি। শুনে মেজাজটা খিঁচড়ে গিয়েছিল, কিন্তু নিজের জ্যোতিষীসুলভ ইমেজের কথা ভেবে আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করেছি। একটা বানানো হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললাম, ‘আমি তো বিজ্ঞাপন দিইনি। যারা আসে, নিজের ইচ্ছাতেই আসে। আপনাকেও ডেকে আনিনি।’

লীলা এবার আরও আক্রমণাত্মক, ‘আমি হাত দেখাতে আসিনি, আপনার প্রতারণার কথা সবার সামনে বলতে এসেছি।’

প্রতারণা! শব্দটা শুনে যেন পুলিশের সামনে হাতকড়া পরে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের চেহারাটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। কষে একটা চড় দিয়ে ওর গালটা আরও লাল করে দিতে ইচ্ছে করছিল আমার। কিন্তু পারা যায় না দুটি কারণে—এক. আমার ইমেজ রক্ষার দায়, দুই. মেয়েটির ভয়াবহ সুন্দর চেহারা। মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা বোধ করি সুন্দরীদের জন্মগত অধিকার। এ রকম একটি মেয়েকে চড় মারা দূরে থাক, চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকতেও হিম্মত লাগে। স্বীকার করি, সেই মুরোদ আমার অন্তত নেই।

বললাম, ‘প্রতারণা মানে? আমি কি কারও কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়েছি?’

আমার গলায় বোধ হয় একটু উত্তেজনা ছিল। লীলা হাসল। অপূর্ব সেই হাসি। রাগের মাথায়ও সেই হাসিতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।

লীলা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আপনি রেগে যাচ্ছেন, আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, আপনার ভাগ্য গণনা কতটা ঠিক?’

‘আমি কিরোর বই পড়ে হাতের রেখার বিশ্লেষণ শিখেছি। কিরো যদি ঠিক হয়, তাহলে আমিও ঠিক।’

আবার সেই মোম গলানো হাসি, বলল, ‘হাতের রেখা দেখে ভাগ্য বলতে কিরো পড়ার দরকার হয় না, একটু কমনসেন্স থাকলেই হয়। আপনার কমনসেন্সটা ভালো, তাই...।’
‘আপনি পারবেন?’
‘নিশ্চয়ই। দেখতে চান?’
‘দেখান।’ সরাসরি যুদ্ধে আহ্বান করলাম আমি।

উপস্থিত মেয়েদের মধ্য থেকে শান্তাকে বেছে নেওয়া হলো। লীলা তার হাতের তালুটা নেড়েচেড়ে দেখে বলল, ‘খুব ছোটবেলায় তোমার একটা কঠিন রোগ হয়েছিল, জীবন-মরণ টানাটানি... ঠিক?’
শান্ত মেয়ের মতো শান্তা বলল, ‘ঠিক।’

লীলা আবার বলল, ‘নবম বা দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় একটা ছেলেকে তোমার খুব ভালো লেগেছিল, কিন্তু ওকে কখনো মুখ ফুটে এ কথা বলতে পারোনি...ঠিক?’

শান্তা মাথা নামিয়ে বলল, ‘না, ক্লাস এইটে পড়ার সময়...।’
লীলা বলল, ‘সময়ের সামান্য হেরফের হতে পারে, কিন্তু কথাটা তো সত্যি, নাকি?’
‘হ্যাঁ।’

অন্য সবার মতো আমাকেও চমকে দিয়ে বিজয়িনীর ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছিল লীলা। হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনার হাত দেখেও ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারব, প্রয়োজন হলে দেখা করবেন।’

জীবনে আমি এত অপমান বোধ করিনি আর কখনো। এসব কথা ক্যাম্পাসে চাউর হলে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। দুটি দিন খুব অস্থিরতার মধ্যে কাটল। প্রায় নির্ঘুম রাত কাটিয়ে তৃতীয় দিন সকালে ফোন করলাম পূরবীকে। পূরবীই লীলাকে নিয়ে এসেছিল আমার কাছে। ওরা হোস্টেলে একই কক্ষে থাকে।

‘দেখা করতে চাস? হাত দেখাবি?’ রহস্যময় হাসি শোনা গেল পূরবীর, ‘বিকেলে লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের নিচে থাকিস, ওকে বলে দেব।’
বিকেলে দেখা হয়ে গেল। ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করতেই হাসিতে জুঁইফুল ছড়িয়ে বলল, ‘ভালো। কিন্তু আপনি দেখছি ভালো নেই!’
‘কী করে বুঝলেন?’
‘সব কথা কি আর হাতে লেখা থাকে?’
‘তাহলে বলুন কেন ভালো নেই’—বলে ডান হাতের করতল মেলে ধরলাম ওর সামনে।
লীলা বলল, ‘হাত দেখাতে হবে না, আমার চোখের দিকে তাকান, চোখ দেখে বলব।’
চোখের দিকে তাকিয়ে কী একটু কেঁপে উঠেছিলাম? লীলা বলল, ‘আরে, আপনি তো প্রেমে পড়েছেন!’
ঢোঁক গিলে বললাম, ‘কার?’
‘যদি কথা দেন আর কোনো দিন কারও হাত দেখবেন না, তাহলে বলতে পারি।’
অস্থির লাগছিল আমার, বললাম, ‘দেখব না, কথা দিলাম, বলুন কার?’
সেই বিখ্যাত হাসি লীলার মুখে, সেই হাসি একটু আরক্ত, বলল, ‘আমার।’

আশ্চর্য, হাত না দেখেও এত কিছু বোঝা যায়! তাহলে আমি কিরোর বই পড়ে হাত দেখি কেন?

সেই থেকে আমি আর কারও হাত দেখি না। ক্লাস শেষে লীলার সঙ্গে ক্যানটিনে যাই, বিকেলে অডিটরিয়ামের সামনে নিরিবিলি জায়গাটাতে দুজনে বসে বাদাম চিবাই। সন্ধ্যায় ও হোস্টেলে ফিরে গেলে পরের দিনটার জন্য অপেক্ষা করি।
১৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×