প্রিয় আফসার,
আমার পক্ষ থেকে তোমার উপর বড় বেশি অবিচার হয়ে গেল। তোমার দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘যথা,কথকতা’ তিন মাস পূর্বে পাঠ শেষে নাই করে ফেলেছি। খুব প্রিয় এবং অযাচিতভাবে কিছু অপ্রিয় (বিরক্তিকরও বলতে পারো) পঙক্তির নিচে কলমের আচড় টেনে দিয়েছিলাম এই ভেবে যে, উপযুক্ত সময়ে পুণর্বিবেচনার মাধ্যমে নিজের অভিব্যক্তি তুলে ধরবো। গ্রন্থটি তুমিই দিয়েছিলে। ভুলিনি, কালির ভরাটদাগে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ব্যক্ত হয়ে শুভেচ্ছাটুকুও স্থান পেয়েছিল। তখনই তড়িৎ বেগে আমাকে জানান দিয়েছিল-কাব্য-চারণের জীবন দু’দশকেরও উপরে অতিক্রম হয়ে গেছে। এতদিনে তুমি/তোমরা একটি দশক অতিক্রম করে এর প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছ। সেখানে আমি কোনো পদচিহ্ন রেখে আসতে পারিনি।
‘আনাজপাতির ঘ্রাণ’ কবিতাটি সুরমা সাহিত্য সাময়িকী’তে যখন প্রথম প্রকাশ পায় তখন একটি উপলব্ধি জাগ্রত হয়─কবি সৈয়দ আফসার তার হেঁটে আসা পথকে অবজ্ঞা করেননি। যখন কবি হিসেবে তোমাকে আবিষ্কার করি, কবিরূপে পূর্ণ কাব্য শক্তি নিয়ে তোমাকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখি। তখন পূর্ণ মর্যাদায় একজন কবিকেই দেখার চেষ্টা করি। এই কবিতাটি পরে কবি আবু মকসুদ সম্পাদিত ‘তৃতীয় বাংলার নির্বাচিত কবি ও কবিতা’ গ্রন্থেও স্থান পেয়েছিল।
কাব্যজগতের মানুষ নির্ঘুম জীবন-যাপনই করেন বেশি। সুখী মানুষের কবিতায় এই নির্ঘুম-যাতনার ছাপ খুব একটা পাওয়া কিংবা লক্ষ্য করা যায় বলে মনে হয় না। ‘যথা-কথকতা’─অর্থাৎ তুমি বলতে চেয়েছ যেমন-কথকেরকথা অর্থে, যার ভেতর তোমার যাপিত জীবনের কবির জন্য অনুপযুক্ত পরিবেশের যে বেদনা, তা তোমার ভাষার চটুলতা একে ভাবগাম্ভীর্যের পরিবর্তে পেলব হয়ে উঠেছে বেশি। পাঠক্রমের স্মৃতি আমাকে এভাবেই জানিয়ে দিচ্ছে। অথচ দ্বিতীয় গ্রন্থে সন্নিবেশিত কবিতার চেয়ে তোমার সাম্প্রতিক কাব্যচেতন অনেক উজ্জ্বল। অবশ্য এটা নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করতে পারি যে, আমার এ ভাবনা অবশ্যই সাময়িক। সাধারণ পাঠের রেখাপাতকে স্মরণে আনা আর নিবিষ্ট পাঠ শেষে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া এক কথা নয়।
আফসারের কি মনে পড়ে আলাপচারিতায় প্রায়শঃ আমরা বলতাম, উপলব্ধি থিতু হবার পূর্বেই যদি তা প্রকাশ পেয়ে যায়, সে উপলব্ধি সকলের হয়ে ওঠে না? মুহূর্তের প্রকাশে একটা অস্থিরতা থাকে। এ বড় চঞ্চলমুহূর্ত। কোথাও একটু চুপ হয়ে ভাবতে শেখায় না। এই চাঞ্চল্য ‘যথা-কথকতা’ গ্রন্থে যথেষ্ট পরিমাণ লক্ষ্যণীয়। আমরা অনেক সময় উপলব্ধির পরিমিত হওয়ার ক্ষণটিকে অবজ্ঞা করি ফেলি যা একজন কবির জন্য মোটেই শোভন নয়।
তোমার অনেক সিরিজের মধ্যে ‘বোবাসিরিজ’টাই একবার স্মরণে আনো। এর ভূমিকা-পর্বে তিন/চারটি চরণে তুমি যে উপলব্ধিকে গেঁথে তুলেছ, দীর্ঘ কবিতাটির টানা গদ্যেও কি তা প্রকাশ করতে পেরেছ? তোমার স্মৃতিগাঁথা শিশুকালটি তিন/চারটি চরণেই অমরতার দাবী রাখে। এই যে নিজেকে একটি ব্যপ্তির ভেতর ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে টেনে নেয়া-কবির জন্য এটি অমাঙ্গলীক পর্ব । শঙ্কারও বিষয় বটে।
উপরোক্ত কথার রেশ ধরে আমার সাম্প্রতিক উপলব্ধির কথা একটু বয়ান করতে আগ্রহী।
সাম্প্রতিকালে কবিরা অধিকমাত্রায় আত্মকেন্দ্রীক হয়ে উঠলেও আশির দশকের শেষের দিকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ফলে আমরা যথেষ্ট উন্মুক্ত কবিতা পেয়েছিলাম। পরবর্তী দশকের কবিরা স্ব-অবস্থানে নিজেদের গুটিয়ে নেন। এ পর্যবেক্ষণ সামগ্রিক অর্থেই বিবেচ্য। কবিকে এভাবে গুটিয়ে থাকা কিংবা রুগ্ন মানসে বিচরণ করা কোনো অর্থেই গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষের প্রতি কবির দায়বদ্ধতা থেকে সরে দাঁড়াবার বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল ক্ষমার অযোগ্য। এই বৃত্তের ভেতর বড়দাগে নব্বই দশকের বা শূন্য দশকের অনেক কবিই আবর্ত হয়েছেন/হচ্ছেন বেশি। ভাষায় তারা ঋদ্ধ হলেও চিন্তায় তারা যথেষ্ট অপরিপক্ক-দৈন্য, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপোষকামী বা সুবিধাবাদীও বলা যায়। উপমায়-চিত্রকল্পে অনেকক্ষেত্রে ইতিহাস লগ্ন হলেও জীবনানন্দ ধারায় বা অগ্রজের কাছে সারাক্ষণ পেলব-মানসের ভেতর থাকতে খুবই পছন্দ করেন। পূর্বসুরীর প্রভাবমুক্ত হবার তাগিদ কিংবা অগ্রজের কাছে সাহসী হয়ে উঠতে সহসা দেখা যায় না তাদের। সাহস বলতে কোনো অর্থেই উল্লঙ্ঘন তো নয়ই, ঔদ্ধত্যও নয়। বরং প্রিয় ও শুদ্ধচারী লেখকের সৃষ্টি থেকে কিছু আবিষ্কার করতে না পারা অথবা তাদের লেখার ভেতর পাঠকের অতৃপ্ত অংশটুকু চিহ্নিত করতে না পারার ব্যর্থতাকেই বোঝাতে চেয়েছি। মুক্ত-জগৎ আমাদের সেই দীক্ষাই দেয়।
এসব উল্লেখের অর্থ এই নয় যে, তোমার কবিতা অনেক গৌণ। তারচে বলা উচিৎ একটি সুক্ষ্ম-অনুভূতিজ্ঞাত স্রোতধারা থেকে তোমার কাব্য সৃষ্টিকে প্রকাশ করতে অভ্যস্ত। তোমার মুঠোয় যখন আনাজের ঘ্রাণ ধরে রাখো কিংবা ঢলঢলে লাউয়ের শরীর অথবা পুঁইশাকের লতিয়ে থাকা দৃশ্যে স্পৃষ্ট হয়েছিলে, তখন কি প্রিয়তমা স্বদেশকে আবিষ্কার করতে পারোনি? আমি বলবো পেরেছ, অন্তত তোমার কবিতা সেই বার্তাই প্রতিনিয়ত বহন করছে।
বলছিলাম ‘বোবাসিরিজে’র কথা। কবিতায়ও মাঝেমধ্যে সারকথা লিখতে ইচ্ছে জাগে। অথচ কে না জানে, একটি কবিতাই তো মুহূর্তের সারাংশ। আবার উল্টোপথে বলতে হয়, একটি মুহূর্তের বিস্তরণই একটি কবিতা। ‘বোবাসিরিজ’-এ যে সারকথাটি কয়েক লাইনের মধ্যে উল্লেখ করেছো দীর্ঘ বিস্তরণের চেয়ে তা উপজীব্য হয়ে উঠেছে বেশি। পাঠ হোক কবিতাটির সারকথা─
ক্ষণকাল বেঁচে থাকা শিশুবেলাকার টানে
বিশ্রী প্রয়োজনে আহা! নিঃসঙ্গ আয়োজনে
আমাকে টেনে তোলো সখি প্রলয়ের দিনে
এই রোদনবাহী সারকথার পরে নিবিষ্ট পাঠকের জন্য কবির মনে কী এমন বার্তা থাকতে পারে? এটুকু পাঠ শেষে বিস্তারিত পড়তে মন আর সায় দেয় না, কেবল তিনটি চরণের উপরই চোখ বিদ্ধ হয়ে থাকতে চায়।
তুমি উচ্চারণ করেছ─‘মাটি ফেঁেড় সমাধান করো; মানব বৃক্ষের সম্পর্ক কোন মর্মে’। আমি তো এই মর্মকথাই আবিষ্কার করতে চাই। বৃষ্টিস্নাত পৃথিবীতে দর্শনের অন্তরগত মানুষটি কখনও যন্ত্রচালিত হতে পারে না। প্রাকৃতজাত মানুষের চিন্তার কলকব্জা কখনো কখনো লাগাম ছেড়ে সিদ্ধান্তমূলক উপত্যাকায় ঘুরতে থাকলে সহজিয়া কবি ঐ জায়গাটা চিনিয়ে দিতে সচেষ্ট হন।
নিজেকে জানার মধ্যদিয়ে কী গভীর রহস্যটাই না সারাক্ষণ তাড়িত করে─এই বোধ নিয়েই কবি নিজের ভেতর পান্থবাসী হয়ে যান। তুমি এই হাঁটা পথেরই কবি, যে-কবি সহসা থামবে বলে কবিতা লিখতে আসেনি। সে আরও বহুদূর যেতে চায়─কালোমাটির পরিখা খনন করে।
আফসারের কবিতা ভাবশূন্য নয়, তুমি সেটা করোনি, সেটাই শক্তি। ভাবকে আকড়ে ধরেছ ব্যথায়-বেদনায়, অনেকটা নির্লিপ্ত চোখেও। অবশ্য ভাবের একটা প্রলোভনও আছে─তারুণ্যের মুগ্ধতা প্রলোভন থেকে মুক্তি দিতে চায় না। এই পুরো আবহকে আমরা গীতলতা ধরে নিলে, তোমার কোনো কোনো কবিতা অপেক্ষাকৃত কম-গীতলতায় আক্রান্ত। কখনও কখনও মাত্রাতিরিক্ত আবেগ কবিকে নিয়ে এই গীতলসুরটি খেলতে শুরু করে, পছন্দও করে। কবি নিজে যখন এর ঘাড় মটকে দিতে প্রয়াশী হন তখন গীতলতাই গীত-প্রবণে মুক্তি পায়। তুমিও মুক্তি পাবে। অবশ্য কোনো ধরনের প্রকট শব্দ তোমাকে আক্রান্ত করেনি। এটাই নিয়ামক। যা দেখেছ তুলে নিয়েছ নির্দ্বিধায়─কবিতার খাজে ফেলে দেখার-দৃশ্যপটকে জীবন দিয়ে।
তাহলে পাঠ হোক কবি সৈয়দ আফসার-এর উল্লেখযোগ্য কিছু চরণ :
১.
কান্নার সুর আছে, জল শুকালে চোখেরও হাহাকার কমে
উৎসের খুঁজে বাঁধা পড়বে কে? কে নেবে আঙুলের ঋণ
(মিলেমিশে কবিতার ৩য় স্তবক এর অংশবিশেষ)
২.
অজানা ব্যাধির পাশে রূপ ধরে আছে
স্পর্শ কেঁপে ওঠার আগে
অবাক চোখে তাকাই তার প্রাজ্ঞতা নিয়ে
দৃষ্টি ঝুলে পড়ার আগে
আপেল বন সামনে দাঁড়ালে পাশ ফিরে তাকাই
ইচ্ছেকে খুন করে করে নিজেই খুন হতে চাই
(দেহের সবক-এর স্তন অংশ)
৩.
বেঁধে রেখো তামা-কাসা; পঞ্চ-ধাতু কবজ
কূন্যান্তরে বেঁচে আছে জন্মঋণ
প্রথাগত নিয়ম বলে দেয় কোমরে কালো তাগা
প্রথম বেঁধে ছিল মা
কিন্তু সম্পর্কস্থাপন বশ করে মিশ্র জীবনের কারুকাজ
কার অনুভবে ইচ্ছে সাথে মিশে যাচ্ছে দেহের লাজ
যশ-খ্যাতি যা পাবার গোপনে পেয়ে যাবো আজ
তুমি তাবিজে রেখেছো লাজ-শরম অজানাসূত্রসন্ধান
কবজে রেখেছো ইচ্ছে শাসনসহ মোহ উপাদান
(দেহের সবক-এর কোমর অংশ)
৪.
মুঠো খুলে দেখি তোমার মৌন সমর্পণে
খুলে যাচ্ছে বাতাসের কথা; বুক ও হৃদয়
রেখার অক্ষমতায় পুরো দশ আঙুল খুলছি
অঙ্গুরীর ভালোবাসায়
(দেহের সবক-এর আঙুল অংশ)
৫.
রাগ করে থেকো না বেশিদিন
রাগ করলে তোমার মুখটি ভারি
হয়ে যায়, মনে হয় সব লোকালয়হীন ...
(পরিবর্তন সিরিজ এর ১৮ নম্বর স্তবক)
৬.
আমাকে না পোড়ালে ভালো এরকম আশায় লুকিয়ে রাখি
গোছা গোছা গন্ধ পুরনো গামছায়, ঠা-া জমবে দেহে
এযুগে এসে ভাঁটফুলে ফুটে আছো এ-আশা পুরোটাই ভুলে গেছি
খোঁজাখুঁজি; পাতার আড়ালে ছায়া মনমরা হয়ে থাকতে পারে না
এরকম রূপকথা হাঁসফাঁস ছাড়াই ভেবেছি; লোহা-পিতল-স্টিল
শেষমেষ কার শাসন মেনে ফেলেছি দীর্ঘশ্বাসে
চারদেয়ালের আলোতে মিশে
দীর্ঘতর ভাবনা বলছি ইশারা করো না, গ্রহণ প্রশ্নে আমিও পরাজিত
পাথরে পাথর ঠুকে বাজাচ্ছি─পুরনো স্মৃতি পোড়ালেও পুরোটা অক্ষত
(গ্রহণ প্রশ্নে আমিও পরাজিত)
৭.
আমারও সংকোচ ছিল কুমারী পর্দায়
এই নিঃসঙ্গ বাঁশপাতাবনে, বনেলা হাওয়ায়
কারা ছাই রেখে প্রাণ দিয়ে যায়, একা বসে ভাবে
তরুণ কুমার ... তুমি রেফারেন্স খোঁজো না; প্লিজ!
লজ্জাশীলা
এ্যাকোরিয়াম ভরে রাখবো তোমার জন্য দমকা হাওয়া
(পরিবর্তন সিরিজ-এর ৫ম স্তবক)
৮.
প্রতিভোরে ঘুম ভাঙে না
কেউ সাবধানও করে না
দু’পায়ের ফাঁকে অন্ধকার জমে
ক্রমে-ক্রমে রাতের আগে দিন আসে
স্বপ্ন দোষে
৯.
লাউ-কুমড়ার সাথে মনের বুঝা-পড়া ভালো
আলু-পটলের সাথে মিশে পড়ো তুমি
যেন মানকচুর স্পর্শে আঁকা ডাঁটাওয়ালা শাক
আহা! .. কর্ডফিস ভাজা মচমচে চিপস্্ কে-চাপ
পেট ভরে খাই কাঁথায় মুড়িয়ে মাথা নাক ডেকে ঘুমাই
স্বপ্নভাঙারাতে শুশ্রুষা চাখি, পোড়াদেহ অবলীলায় সাজাই
বলছি, হলুদ-সবুজ লেবুর কাছে দেশি-বিদেশি অভিমান
মুঠো খুলে দেখি আমার হাতে শুধু আনাজপাতির ঘ্রাণ
(আনাপাতির ঘ্রাণ)
কবিতার সূত্র : সুরমা সাহিত্য সাময়িকী। কবিতাপত্র। তৃতীয় বাংলার নির্বাচিত কবি ও কবিতা। নিসর্গ। লোকন। পত্রিকা সাহিত্য সাময়িকী। স্যামহোয়ার ব্লগ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১০ সকাল ৮:৩০