পেছনের গেইটে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে দূরত্ব মাপলো অমি। খোলা পার্কিং স্পেসটাতে এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকগুলো গাড়ির মধ্যে তারটা গেইট থেকে প্রায় ত্রিশ গজ দূরে। বৃষ্টির জোরটা যদিও কমে এসেছে। তবু এখনো যে ধারায় ঝরছে তাতে ঠাণ্ডা লাগা শরীরটা নিয়ে খোলা আকাশের নিচে যেতে ইচ্ছে করলো না। এখন অল্প ভিজা মানেও দু’দিন ধরে বিব্রত রাখা ঠাণ্ডা বোধটাকে চেপে বসতে সাহায্য করা। কি করবে বুঝতে না পেরে ঘাড় কাত করে আকাশের দিকে তাকালো সে।
নিম্নচাপের মেঘ যদিও সারাদিন আকাশ দেখে সময় বোঝার সুযোগ রাখে নি। সকাল থেকে এক রঙা আকাশটা রঙ বদলানোর উপলক্ষ খুঁজে পায় নি। বরং এখন যেন সান্ধ্য সান্নিধ্যে নিকষতর হয়ে উঠেছে। বোঝা যাচ্ছে খানিকক্ষণ পর তাও চোখে পড়বে না। আরো খানিকক্ষণ সময় কাটানোর জন্য প্রয়োজন থাকলে খানিকটা কেনাকাটা করা যায়, প্রয়োজনটা আদৌ আছে কি না জানার জন্য মোবাইলে মানসীর নাম্বারটা বের করলো অমি, তখনই বিস্ময়মাখা সম্বোধনটা কানে আসলো তার, ‘আরে অমি ভাই না, এই ভাই’!
সামনে দাঁড়ানো মানুষটা অমিকে খুশি করলো না। এক পলকে প্রথম চাকরির অনেক স্মৃতি উসকে দেয়া লোকটি সহাস্যে হাত বাড়ালো ‘মিঞা আপনে তো দেখি একেবারে আগের মত রইয়্যা গেছেন। অমিকে আগের মত থাকার কথা বললেও নিজের আঞ্চলিকতা টানা সম্বোধনে যেন সময়টা ধরে রাখার ঘোষণা করলেন তিনিই। তাই! স্পষ্টতঃ সতর্কতা ফুটে উঠল অমির গলায়। আবার পর মুহূর্তে নিজের মনে হাসলো সে।
হাসছেন যে! জবাব দিতে যাচ্ছিল অমি, এমন সময় তার মোবাইল বেজে উঠল। ব্যাপারটাতে সামান্য কাকতাল আবিষ্কার করে ফোনটা রিসিভ করলো সে। কি ব্যাপার ফোন করে কথা বলছো না কেন ওপাশ থেকে মানসীর গলা ভেসে এলো। অ, তাহলে কাকতালীয় নয়, ফোন চলে গিয়েছিল। ‘কিভাবে কথা বলি, তোমাকে কল করার সাথে সাথে এমন একজন মানুষের দেখা পেলাম, যার উপস্থিতিতে মানুষত মানুষ, গ্রহ নক্ষত্র, চন্দ্র সূর্যও স্থির হয়ে যেতে পারে!’ ওরে বাবা কে এমন মহৎ ব্যক্তিত্ব মানসী ও সমান তারল্যে বিস্ময় জানাল।
কাকে বললেন, বৌ নাকি?
বৌ ছাড়া আর কাকে বলবো। আমাদের তো আর কপাল দুটো নয়, অমি এবার খোঁচাটা দিতে ভুল করলো না। পরকীয়া না কি কে জানে, কতক্ষণ পর পর বিভিন্ন জাতীয় কথা বলতে হাসনাত সাহেবের বার বার উঠে যাওয়ার অভ্যাসটা স্মরণ করলো সে। তাছাড়া এখন তো অফিসিয়াল কোন সম্পর্ক নাই যে, তার যে কোন মন্তব্য ইচ্ছাকৃত বিকৃত বা বিশ্লেষণ করে বসদের কাছে গিয়ে উগরে আসবে।
অনেকদিন পর দেখা, চলেন কোথাও বসি, বেশ আন্তরিক গলায় বললেন হাসনাত সাহেব। অবাক হলো অমি। এই লোকটা এতটা আন্তরিকভাবে কথা বলছে। অথচ যখন সহকর্মী ছিল, পারলে, গুলি করে মারতো। আবার পরমুহূর্তে মাথা নাড়লো অমি, না তার অন্তর্গত স্বভাবটা প্রতিফলিত হতো না বাহ্যিক আচরণে। যে কারণে কেউ কেউ তাকে আড়ালে খেকশিয়াল বলে ডাকতো।
আপনার খবর কি বলেন হাসনাত ভাই, তিন তলার কফিশপটাতে বেশ আরাম করে বসলো অমি, আপনি কি এখনো পুরনো কোম্পানিতেই আছেন। স্বভাবজাত কুঁতকুঁতে চোখে আশপাশে তাকাচ্ছিলেন হাসনাত সাহেব। কি অন্ধকাররে বাবা, তার স্বগতোক্তি শোনা গেল। অমির প্রশ্নটা কানে যেতেই ঘুরে আসলো দৃষ্টি, ‘কি করে থাকি। আপনি যাওয়ার পর যে আসলো সে তো এক কথায় . . . ইয়ে, যুতসই কোন শব্দের খোঁজে হাতড়াতে লাগলেন হাসনাত সাহেব। সেটা কি এলিয়েন নাকি নিরীহ মুখে প্রশ্ন করলো অমি।
এলিয়েন না হলেও ঐ জাতীয়, একেবারে সাংঘাতিক! মুখ বিকৃত করলেন হাসনাত সাহেব।
কি রকম, অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করলো অমি, আপনার সাথেও পাল্লা দিতো নাকি? সাথে শব্দের পরের ও টাতে অস্বাভাবিক জোর দিল সে। যেন এড়ানোর কোন সুযোগ না থাকে।
আমাদের সেকশানে আমি ছাড়া আর তো কেউ ছিল না, লাগ তো আমারই পেছনে। যেটা এড়িয়ে যাওয়া দরকার, পুরনো অভ্যাসমত সেটা ঠিকই বুঝতে পারলেন না হাসনাত সাহেব।
অ। তা কিভাবে লাগতো, আপনি আসার পরও এখনো আসেননি জাতীয় কথা বলতো নাকি। নিরীহ গলায় জানতে চাইল অমি।
না, না, তা কিভাবে বলবে! কার্ড পাঞ্চ করার পর সে সুযোগ তো থাকে না, হাত নাড়লেন হাসনাত সাহেব, থাকলে সেটাও নিশ্চয়ই বলতো।
তা অবশ্য ঠিক, কার্ড পাঞ্চ করার পর সে সুযোগ থাকে না, আওড়ালো অমি। মনে পড়লো সদ্য জয়েন করার পর এই হাসনাত সাহেবকে ফোন করেছিল তাদের লাইন ম্যানেজার। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বলেই শুধু নয়, নিশ্চয়ই মোবাইলটার স্পিকারও বাড়ানো ছিল, পরিষ্কার কানে এসেছিল লাইন ম্যানেজারের কথা, তিনি জানতে চাইছিলেন অমি অফিসে পৌঁছেছে কি না। অফিসে ঢোকার সময় পেরিয়ে মিনিটের কাটা ততক্ষণে পুরো এক চক্কর ঘুরে এসেছে। প্রায় সাড়া দিয়ে ফেলেছিল অমি, অথচ তাকে বিস্মিত করে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন হাসনাত সাহেব। হেঁটে যেতে যেতে দেয়া তার জবাবটি বিমূঢ় করেছিল অমিকে, ‘না উনি তো এখনো আসেন নি, উনি সব সময়ই দেরি করে আসেন’। তখনো তাকে কার্ড দেয়া হয় নি, দেয়া হয় নি অফিসিয়াল মোবাইলও। থতমত খেয়ে যাওয়া অমির সারাটা দিন কেটেছিল একটা ঘোরের মধ্যে। বুঝতে পারছিল না তার করণীয় সম্পর্কে, কিংবা এই জলজ্যান্ত মিথ্যার কারণটাও অবোধ্য ছিল সেদিন। তাকে ঘিরে ফেলা মন খারাপের আবহটা চাকরি ছাড়ার শেষদিন পর্যন্ত ছিল। আর সেই অনুভূতির প্রধান অথবা একমাত্র অনুষঙ্গ এখন তার সামনে বসে ক্ষোভ ঝাড়ছে একই অনুভূতির কথা বলে।
আর বইলেন না আমার বসটাও একটা ছোটলোক, শান্তিতে নাইরে ভাই, আফসোসের ভঙ্গিতে বললেন হাসনাত সাহেব। এরপর যেন অমির দিকে নজর দিলেন। আরে তখন থেকে তো আমার কথাই বলে যাচ্ছি, আপনার কথা কিছু বলেন। আমি আছি আমার মত নিজেই নিজেরে চালাই। আর কোন চাকরি বাকরি করছি না, হাসলো অমি, তা আপনার কলিগরা কেমন।
আর কইয়েন না, সবগুলোই হারামির বাচ্চা আবার বিরক্তি ফুটে উঠলো হাসনাত সাহেবের মুখে চোখে। পরমুহূর্তে মুখটা সহজ না করেই আমন্ত্রণ জানালেন, একদিন আসুন না আমার অফিসে।
হাসনাত সাহেবের ভিজিটিং কার্ডটা হাতে নিয়ে তখনই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললো অমি। পেশাগত কারণে হাসনাত সাহেবের বসের সাথে তার পরিচিতি ঘটেছিল এবং এখনো এই অফিসের সাথে তার একটা যোগাযোগ আছে। সে যোগাযোগ ঝালাই করতে তার নিজের যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু হাসনাত সাহেবের হালচালটা দেখার আগ্রহ জম্মালো হঠাৎ।
মানসী কিন্তু একমত হলো না, কে কিভাবে থাকছে সেটা নিয়ে তোমার কি দরকার। সেদিন বাসায় ফিরে অমি যখন মানসীকে ব্যাপারটা জানালো বিপরীত মত শুনলো সে। হাসনাত সাহেব তার সহকর্মী ছিলেন বিয়ের আগে, তবু অফিস পলিটিক্সের একটা প্যাকেজ হিসেবে হাসনাত সাহেব তার কাছে সবসময়ই উল্লেখযোগ্য। যেকোন নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে বরাবরই তার কাছে মনে পড়তো এই বিশেষ নামটি। সে হিসেবে জীবনের কোন কিছুই গোপন না করা মানসীর কাছে এই চরিত্রের বিভিন্ন উদাহরণও বহুশ্রুত। দুয়েকবার অবশ্য অন্য কথা বলেছে মানসী, বলতো প্রথম চাকরির সহকর্মী হিসেবে মনমতো না হওয়াতেই সবকিছু নেতিবাচক মনে হওয়ার কথা। হয়তো, কিন্তু অফিসও যে পলিটিক্সের একটা ক্ষেত্র হতে পারে এবং সহকর্মী মাত্রই যে অযোগ্য, বসের কাছে সেটা তুলে ধরা যে চাকরির একটা উল্লেখযোগ্য অঙ্গ সেটা ক’জনই বা ভাবতে পারে। এই অভিজ্ঞতা তাকে ঋদ্ধ করেছে, চাকরিরত বা চাকরিদাতা উভয় ক্ষেত্রেই। তবু আজ, একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে শেষটা না হোক অন্তত: দ্বিতীয় ধাপটা দেখার সুযোগ আসলো।
তবে এসব ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের আগ্রহ তুঙ্গে থাকলেও স্বল্পতম বিরতিতে কৌতুহলটা থিতিয়ে যায়। কে কখন কি করেছে বলে এখনো সে একইভাবে চলতে থাকবে এমনটা ভাবার কারণ নেই, দু’দিনের মাথায় মানসীর মতটা তার মাঝেও সংক্রমিত হলো। কোথায় কোন ব্যক্তি পদে পদে প্যাঁচ কষতো বলে এখনো অন্যদের বিপদে ফেলার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নাকি বদলে গিয়ে আর দশটা মানুষের মত জীবনাচরণ বেছে নিয়েছে সেটা অমির জন্য গুরুত্বপূর্ণ থাকলো না। সে ব্যস্ত থাকলো নিজের কাজে। অতএব হাসনাত সাহেবের অফিসে তার অবস্থান বা অবস্থা দেখতে যাওয়াটা পরে কোনদিন করা যাবে জাতীয় কাজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো। কৌতুহল থাকলো তাতে তবে গুরুত্বপূর্ণ এর তালিকায় নয়।
মাস দুয়েক পর তার এক সহকর্মী আবার হাসনাত সাহেবের কথা মনে করাল। ‘স্যার এ বিষয়টা আপনার একটু দেখা দরকার’ বলে যে ফাইলটা হাজির করলো, সেটা ঐ অফিস সম্পর্কিত, এবং ছোট্ট যে জটিলতার কারণে তার দেখা দরকার বলে তার সহকর্মী মনে করলো সেই জটিলতা সারাতে যে কোন একজন কাগজপত্র নিয়ে ঐ অফিসে গেলেই হলো। সুযোগটা নিল অমি, আগে একবার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও বাতিল করেছিল, এবার কৌতূহল আর প্রয়োজন দুটো মিলে যাওয়ায় পরদিন সকালে সেখানে গিয়ে হাজির হলো সে।
রিসেপশনে বসা ছেলেটা অনিশ্চিত চোখে তাকাচ্ছে দেখে অমি নাম বাদ দিয়ে হাসনাত সাহেবের সেকশানে যাওয়ার নির্দেশনা নিল। সেখানে বসে থাকা প্রথম জনও রিসেপশনিস্টের দৃষ্টিতে তাকাল। হাসনাত সাহেব এসেছেন কি? সে প্রশ্নের পাশ দিয়ে না গিয়ে পাল্টা জানতে চাইল, ‘আপনি কোত্থেকে আসছেন?’
নিজের পরিচয় আর আগমনের হেতু জানাল অমি। ওহ্ প্লিজ বসুন, অভিব্যক্তি বদলে আন্তরিক হাসলো লোকটি। বসলো অমি, ‘আসলে হাসনাত সাহেব আর অমি এক সময় এক সাথে চাকরি করতাম,’ দ্বিতীয় পরিচিতি জানালো অমি।
‘আপনি উনার সহকর্মী ছিলেন, আর সেই পরিচিতিতেই উনার সাথে দেখা করতে এসেছেন? বিস্ময় ঝরলো লোকটির গলায়। আবার পর মুহূর্তে সামলে নিতে গিয়েও নিতে চাইল না, ‘অমি দেড় বছর উনার পাশে বসে কাজ করিতো, আমার অভিজ্ঞতার সাথে আপনার এই সৌজন্যতা মিলছে না!’
‘কেন আমি কি পুরনো কলিগের সাথে দেখা করতে আসতে পারি না!’ ব্যাপারটিতে উদারতা আসছে বুঝতে পেরে বলাটা উপভোগ করলো অমি।
এবার পুরোপুরি খোলসে ঢুকে গেল লোকটি, ‘তাতো বটেই।’ মূলত: তার প্রথম মন্তব্যেই হাসনাত সাহেবের এখানকার মূল্যায়ন বোঝা গিয়েছিল। যে কারণে নিজের কাসুন্দি নিজের কাছেই রাখতে চাইল সে। কিন্তু এখনকার অবস্থা জানতে গিয়ে হোঁচট খেল, ‘আসলে কোন নোটিশ না দিয়ে কিংবা কাউকে কিছু না জানিয়ে উনি গত তিন সপ্তাহ ধরে একেবারে লাপাত্তা। অবশ্য শোনা গেছে.... সেটা অবশ্য কনফার্ম না,’ লোকটা কিছু বলতে গিয়ে সামলে নিল। অমি নিশ্চিত, শোনা গেছে বলে যেটা বলতে চাচ্ছিল লোকটা সেটা নিশ্চিত জেনেই বলছিল।
উঠে পড়লো অমি। মিলে যাওয়া অনুমিত সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে, শুনতে ইচ্ছা হলো না কথাটা। তার কাছে অনেক নেতিবাচকতার সূচক যে লোকটা তার আজকের অবস্থান বা মূল্যায়ন হঠাৎ করেই অপ্রাসঙ্গিক মনে হলো। তার পলায়নপর মনোবৃত্তি কিংবা পেশা বদলের বৃত্তান্ত সবকিছু নিমিষেই গৌণ হয়ে গেল। অথবা হতে পারে, মূল্যায়নের কৌতূহল নিবৃত্তির পূর্বাপর তাকে সামগ্রিকভাবে উদাসীন করে তুললো। যেভাবে জীবনে এগুতে গেলে ফেলে যাওয়া প্রতিটা পদক্ষেপের ভিন্নতা জীবনে বৈচিত্র্য আনে।
Click This Link