আবারো ছোটবেলার কথা...
রোজা ছিলো ডিসেম্বরে। ক্লাস ফাইভে পড়ি মনে হয় তখন। বৃত্তি পরীক্ষার জন্য ধুমায়া পড়াশুনা করতে হলো সারা বছর ধরে। ডিসেম্বর মাসে সব পরীক্ষা শেষ। রোজার মাস শুরু। এক মাস পুরো স্কুল ছুটি।
সেই যে মাথায় ঢুকে গেলো রোজার মাসে ছুটি থাকে, আজও ব্যাপারটা বের হয়নি মাথা থেকে। এখন চাকরি করি। পড়াশুনা করে এসেছি। সেবার ছাড়া এরকম ছুটি আর কখনও পাইনি। কিন্তু মাথায় ঢুকে গেছিল রোজার মাস মানেই পুরোটা ছুটি। ছুটি দেয়না বলে তাই কলেজ, ভার্সিটি, কিংবা প্রথম চাকরি সবার প্রতিই একটা অভিমান কাজ করতো। আজও করে।
ক্লাস ফাইভের একটা ছেলে কতটাই বা আর শক্ত-সমর্থ? আমি এমনিও অবশ্য রোজা রাখতাম সব। মা বাবা বলতো, বুঝাতো, বাবা দিনে দুবার খেলে দুই রোজা। তিন বার খেলে তিন রোজা।
শেষ মেশ না পেরে মা এক হুজুরকে দিয়েও আমাকে ফতোয়া দেয়ালো। আমি প্রায় বিশ্বাসের মতো করে নিয়েও কেন যেন আবার রোজা রাখতাম। ভাবতাম থাক, আমার একটা রোজাই ভালো।
সেহরি খেয়ে সেই যে ঘুম। টানা ঘুমায়ে উঠতাম এগারোটার দিকে। চলে যেতাম দাবা খেলতে।
খুব ভালো দাবা খেলতে পারতাম তখন। এক গুরু ছিলো, আমার চেয়ে বছর দশেকের বড় হবে। খুব নাম ডাক চারদিকে। আমাকে উনিই শিখাইছিলো খেলা। উনার সাথেই খেলতাম।
হঠাত করেই টের পেলাম উনি আর পারছেনা আমার সাথে। যেই চালই দেক। কিস্তিমাত।
ব্যাস। ছেড়ে দিলাম খেলা। মনে হতো আরেহ এইতো, গ্র্যান্ড মাস্টারকে (!!!) হারাইছি। আর খেলে কি হবে?
দুপুরে সুরসুর করে ভদ্র ছেলের মতো নামাজে চলে যেতাম। হাতে থাকতো তসবীহ। হুজুরদের অনুকরণে।
পুরাই আলেম ওলামাদের মতো মনে হতো নিজেকে। অনেক ইসলামী বইটই পড়তাম। পাড়াগায়ের হুজুররা ভূলভাল বললে ভূলটা বিনয়ের সাথে ধরিয়ে দিতাম। রেফারেন্স সহ।
কি যে পছন্দ করতো পাড়ায় সবাই আমাকে কিংবা আমাদের! একটা গ্রুপ ছিলো। আমি, শিমুল,হারুন,রাকিব আরো কত। আহঃ মফস্বল।
নামাজে গেলে পাড়ার হাতেম দাদা, আজিজ মাস্টার, আকরাম হুজুর, জোনাব স্যার খুব খুশী হতেন। বাহ, এভাবেই তো হবে। কি অভিব্যক্তি ছিলো উনাদের মুখে। এখনো ভাবলেই শান্তি লাগে কেমন যেন।
মনে আছে এখনো, পাল্লা দিয়ে শবে বরাতের বা কদরের রাতে নফল নামাজ পড়তাম আমরা। কে কত বেশী পারে।
এক রোজার মাসে তাবলীগেও চলে গেলাম। রাতে এক বাসায় আমাদের সেহরীর দাওয়াত দিলো। খাবার চলে আসলো যথারীতি। তবে সেহরীর শেষ সময়ের দশ মিনিট আগে। খেতে গিয়ে দেখি ভাত ঘেমে নষ্ট হয়ে গেছে। খাওয়ার উপযুক্ত না। হুজুর বললেন, খাও। আমরা এর চেয়ে বেশী ভালো কিছু খাওয়ার যোগ্য নই। আল্লাহ তাই এটাই পাঠিয়েছেন আমাদের।
আহা, কি সবুর ছিলো মানুষের।
কি সহজ সরল মানুষগুলো।
বিকেল হলেই পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে দলবেঁধে ব্যাডমিন্টন খেলা। খিদে লাগায় আর খেলতে গিয়ে দৌড়াদৌড়িতে পেটে ব্যাথা শুরু হয়ে যেতো। তাও থামাতাম না।
সবকিছুই এতো বেশী মধুর ছিলো কেন?
তখনও মধুর লাগতো। আজও লাগে।
অদ্ভুত।
হাতেম দাদার কবরটা দেখলাম সেদিন। আজিজ স্যারেরটাও। আকরাম হুজুর আর ইমামতি করান না। জোনাব স্যারও ঠিকমত সময় দেন না। বাবা মসজিদ কমিটির সভাপতি হয়েছেন। নতুন কমিটি, নতুন ইমাম নিয়োগ পেয়েছেন। মসজিদ ঘরটা টিনের চালা ভেঙ্গে দোতলা হয়েছে।
সব এতো নতুন।
আমার স্মৃতিগুলো এতো পুরাতন কিন্তু জ্বলজ্বলে কেন?
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ৯:২৮