২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে যখন বাংলাদেশ ত্যাগ করলাম, তখন আমি মাসিক ২০ হাজার টাকা বেতনের একটা চাকরি করতাম আর সাথে ২ টা টিউশনী করাইতাম। মাস শেষে সর্বমোট ৩২ হাজার টাকা আয় করতাম। এরপর ১৮ মাস পর, ইউরোপ থেকে বৃত্তি নিয়ে একটা মাস্টার্স ডিগ্রী করে আসলাম।
এখন ২০১১ সালের 'মে' মাস, দেশে ফেরার প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল। এরই মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান চাকুরীর বাজার সম্পর্কে একটা ধারণা হল, এইটা সবার সাথে ভাগ করার জন্যই আমার আজকের এই প্রচেষ্টা।
সবার প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে, আমি একজন "নগর পরিকল্পনাবিদ"। ছাত্র হিসাবে আমি মধ্যম মানের একজন বুয়েটিয়ান আর চাকরি করার আমার দেড় বছরের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে (৩ টা চাকরি করেছিলাম)। আর আছে 'জার্মানি', 'পর্তুগাল' ও 'স্পেন' থেকে একটি যৌথ বিদেশের ডিগ্রী। এই সকল যোগ্যতার বিচারে ঠিক করলাম, আমি মাসিক ৩০ হাজার টাকার নিচের বেতনে কোনো চাকরি করব না। শুরু হলো অনেক আশা নিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন পূরণের যুদ্ধ !
কাহিনী ১
বায়েস, "তুমি না বাইরে থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসলে"। "জ্বি স্যার, জার্মানি থেকে"। তাহলে তুমি আমাদের এইখানে জয়েন কর। মাসিক বেতন ৩৪ হাজার টাকা আর ট্যাক্স বাদে থাকবে ২৯ হাজার ৯০০ টাকা। দেড় বছরের চুক্তি। আমি বললাম, রাজি !
বলে রাখা ভালো, এই চাকরির জন্য আমি কিছুই করি নাই। আমার একজন ম্যাডাম ও স্যার, আমাকে দেখেই এই কথাগুলা বললেন। তখন মনে হলো, ওরে বাবা, এ যে দেখি "মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি"। তো চাকরি নিশ্চিত জেনে, মনের আনন্দে বাড়ি গেলাম।
কিন্তু হায়রে, ২ সপ্তাহ পরে ম্যাডাম আমাকে ডেকে বললেন যে, ওই চাকরিটা আরেকজন সিনিয়র ভাইকে দেয়া হয়েছে। আর বলা হলো, আমি নাকি ওই চাকরিটা সামলাতে পারব না। এমতাবস্থায়, আমাকে বলা হলো ২২ হাজার টাকার আরেকটা চাকরিতে জয়েন করতে। আমি "না" করে দিয়ে চলে আসলাম।
পরে আমাকে আরেকটা বড় ভাই ফোন দিয়ে বলল যে, ওই চাকরিটা নাকি আরোও ২ জন বড় ভাই এর লবিংয়ের ফলে আমি পেলাম না। এরপর আরেক বড় ভাই বললেন, কিছু জুনিয়র বলেছে যে, আমি নাকি ম্যাডাম এর কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেছি, তাই আমাকে বাদ দেয়া হয়েছে।
এইসব শুনে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
১) আমাকে কথা দিয়েও কথা রাখা হলো না।
২) উল্টা আমার নামে মিথ্যা প্ররোচনা ছড়ানো হলো।
আমি কিছু না করেই হয়ে গেলাম একজন হাসির পাত্র। বুঝতে পারলাম যে, দেশে অনেক দিন ছিলাম না তাই দেশের ভাবমূর্তি আমি এখনো বুঝে উঠতে পারি নাই!!
কাহিনী ২
বিদেশে থাকাকালীন, দেশের একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে আবেদন করেছিলাম। মাত্র একজনকে নিবে। দেশে এসে শুনলাম কোন এক বড় ভাইয়ের ঐ পোস্ট নিশ্চিত!! চাকরির 'ভাইভা' হয় নাই, সেইখানে চাকরি নাকি আরেকজনের নিশ্চিত হয়ে গেছে। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন সিনিয়র প্রভাষক আমাকে ২ জন সিনিয়র প্রফেসরের নাম বললেন। বললেন, তাদেরকে গিয়ে যেন আমি সরাসরি বলি যে আমি এইখানে চাকরি করতে ইচ্ছুক। আর আমি যেন আমার মাস্টার্স এর থিসিসের একটা করে কপি তাদেরকে পাঠিয়ে দেই। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলুম ! তখন আমার কাছে পানির মত পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এই ভাই ক্যামনে এইখানে ঢুকেছেন !
আরেকজন বড় ভাই বললেন, "তোমার কোনো ভালো লিঙ্ক থাকলে চেষ্টা কর"। এইসব থেকে শিক্ষা পেলাম, ভালো লবিং/ লিঙ্ক না থাকলে বাংলাদেশে ভালো চাকরি সম্ভব নয়।
আরো এক মাস পরে এই চাকরির 'ভাইভা'। ভাবছি, নিজের স্বকীয়তা ত্যাগ করে ঐ ২ জন প্রফেসরের পা দুইটা জড়িয়ে ধরব কিনা ¿¿ এইভাবে পদলেহন করলেও যদি আমার একটা গতি হয়ে যায়, তবে দোষ কি তাতে ??
খুচরা কাহিনী
আরেক বড় ভাই এর অফিসে গেলাম। উনি কাকে যেন ফোন দিলেন। "ঐ শুনছিস, বিলাত ফেরত একজন বিশিষ্ট প্ল্যানার আছে, ওকে পারলে একটা চাকরি খুঁজে দে"। উনি পাঠালেন আরেক বড় ভাই এর অফিসে। ঐখানে গেলাম, "আসলে তোমার তো এখন চাহিদা অনেক, এই লেভেল এর কাজ তো আমাদের এখন নাই, তুমি অন্য কোথাও চেষ্টা কর"। উনি অপ্রত্যক্ষভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, এইসব ডিগ্রির কোনো মূল্য নাই।
আরেক বড় ভাই আমাকে ফোন দিলেন, "কিরে কাজ-কাম কি কিছু পাইছস?"। "না"। "একটা কাজ আছে, ১৬ হাজার টাকা বেতন। করবি নাকি?"। "না"।
এইভাবেই চলছে....আর কতদিন চলবে জানি না, জুলাই মাসে একটা ভালো চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, আমার একটা স্যার কথা দিয়েছেন, উনার পথপানে চেয়ে আছি.....আশা রাখি এর মাঝখানে লবিং এর মাধ্যমে অন্য কোনো বড় ভাই এর আগমন ঘটবে না.........
__________________________________________________________
সবশেষে আমি বুঝতে পারলাম না, কোথায় আমার ভুল হচ্ছে ? আমার ৩০ হাজার টাকার চাকরি পাওয়ার আশা করা নাকি আমি এত্ত টাকার যোগ্য নয়, নাকি আমার ভালো লবিং নেই ?? সদ্য মাসিক ২ লাখ টাকার বেতন থেকে এসে মাসিক ৩০ হাজার টাকা চাওয়াও কি আমার জন্য অভিশাপ ¿¿
আপনারা অনেকেই হয়তবা ভাবছেন, এই দুর্দিনের বাজারে যেখানে একটা চাকরি পাওয়াই দুরহ ব্যাপার, সেইখানে আমার ৩০ হাজার টাকা দাবি করা বিলাসিতা নিছক কিছুই না। আবার অনেকেই বলবেন, মাত্র ২ মাসেই এমন একটা চাকরি পাওয়া সহজ কথা নয়, আরোও অপেক্ষা করতে। আমি বলব, "হাড়ির একটা ভাত টিপলেই বলা সম্ভব, হাড়ির ভিতরের কাহিনীটা কী"। কাহিনী আরোও আছে, কিন্তু আজকে এইখানেই থামিয়ে দিলাম।
আসলে আমি নিজেকে নিয়ে না যত বেশি চিন্তিত, তার চেয়ে আমি বেশি চিন্তিত অন্যদেরকে নিয়ে। তাহলে যারা দেশে আছেন, তাদের কী অবস্থা ¿¿ হয়তবা আজ না হোক কাল, আমার কিছু না কিছু একটা গতি হবেই। কিন্তু এইরকম আরোও অনেকেই ফিরে আসবেন অথবা ফিরে আসার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু দেশে ফিরে আসার পরে যদি এইভাবে পদে পদে অপমান করা হয় অথবা অন্যের পদলেহন করতে হয় অথবা দুর্নীতির পথ বেছে নিতে হয়....তবে সেই ক্ষেত্রে দেশপ্রেমের চেয়ে আত্মপ্রেম বেড়ে গেলে আমি খুব একটা অবাক হব না !!
__________________________________________________________
আজকের সকালটা খুব সুন্দর, ঘন-কালো মেঘে সারা আকাশটা ছেয়ে গেছে.....দুপুর থেকেই ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে......বাসার পাশের লেকটাকে যেন দ্বিগুন সুন্দর লাগছে.....এপারের মানুষ ওপারে যাবে, লেকের মাঝ দিয়ে ডিঙ্গি নৌকা ভেসে যাচ্ছে......মনের অজান্তেই ভেসে উঠে:
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় — হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;
[আবার আসিব ফিরে – জীবনানন্দ দাশ]
কিন্তু বাস্তবতা আসলে নিষ্ঠুর, তাইত কবি বলেছিলেন:
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি॥
[হে মহাজীবন – সুকান্ত ভট্টাচার্য]
*** অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, আমার সাধারণ পাসপোর্টটা "মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (MRP)" করতে দিয়ে আসলাম..........
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১১ রাত ১১:৩৪