somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হারুকি মুরাকামি : দ্য উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল: দ্বিতীয় অধ্যায়

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পূর্ণিমার রাত ও সূর্যগ্রহণ
আস্তাবলে ঘোড়াদের মৃত্যু

চুড়ান্ত বিচারে কোনো একজন মানুষের পক্ষে কি অন্য কাউকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব? আমরা না হয় অন্য কোনো মানুষকে জানার উদ্দেশে অফুরন্ত সময় ও শক্তি লগ্নি করতে পারি। কিন্তু শেষমেশ আমরা ওই লোকটার এসেন্সের কতটা কাছাকাছি পৌঁছাতে পারি?
নিজেদের এই বলে সান্ত¦না দিই যে, অন্য ব্যক্তিদের আমরা ভালোভাবে চিনি, কিন্তু ওই ব্যক্তি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু আমরা সত্যিই কি জানতে পারি? ল ফারমের চাকরি ছাড়ার এক সপ্তাহ পর থেকে এসব বিষয়ে আমি সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করি।
এর আগে আমার জীবনে এসব বিষয়ে এভাবে ভেবে দেখিনি। দেখিনি কেন? সম্ভবত আমার দুহাত কেবল জীবন-যাপনেই পরিপূর্ণ ছিল। হয়তো আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতেই বেশি ব্যস্ত ছিলাম। যাক, আমি ছোটখাট বিষয়ে মনযোগ দিতে থাকি। ভেবে দেখি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোরও শুরুটা অতি ক্ষুদ্র।


একদিন সকালে কুমিকো তাড়াহুড়া করে নাস্তা খেয়ে কর্মস্থলের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। এরপর আমি ওয়াশিংমেশিনে কাপড় রাখি, থালাবাসন পরিষ্কার করি। বারান্দা গিয়ে বসি, বিড়ালটাও আমার পাশে বসেছিল। আমি চাকরির ও বিপণনের বিজ্ঞাপন খুঁজি। দুপুরের খাবার খেয়ে সুপারমার্কেটে যাই। সেখানে রাতের জন্য খাদ্যসামগ্রি, ডিটারজেন্ট, টিসু ও টয়লেট পেপার কিনি। বাড়ি ফিরে রাতের খাবার তৈরির প্রস্তুতি নিই। সোফায় শুয়ে বই পড়ি, আর কুমিকোর বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষায় থাকি। সবে চাকরি ছেড়েছি। নিজেকে কেমন ফুরফুরে লাগে তখন। সকালে উঠে অফিসের উদ্দেশে ছুটতে হয় না। আমি পছন্দ করি না, এমন লোকজনের সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করতে হয় না। চাকরি ছেড়ে দিয়ে সবচেয়ে ভালো হলো, আমি যে বই পড়তে চাই, যে কোনো সময় তা পড়তে পারি। এ রকম আয়েশ করে কয়দিন চলা যায়, আমার জানা নেই। কিন্তু তখন চাকরি ছেড়ে দেবার অন্তত এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত, আমি খুবই উপভোগ করছিলাম। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করছিলাম।
এসময়টা আসলে আমার জীবনের এক অপূর্ব আনন্দময় ছুটির পর্ব। জানি, এক সময় এই পর্বেরও শেষ হবে। তবে এর আগ মুহূর্ত পযন্ত তা উপভোগ করার ব্যাপারে আমি মন স্থির করি। কিন্তু ওই বিশেষ সন্ধ্যায়, আমি পড়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম, কারণ সে দিন কুমিকো কাজ থেকে বাসায় ফিরতে দেরি করছিল। এর আগে সে কখনোই সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার পর বাসায় ফিরত না। কোনো দিন মাত্র দশ মিনিট দেরি হবে এটা টের পেলেও সে সব সময় আমাকে জানিয়ে দিত।
কুমিকো এমনই ছিল: এতটা সচেতন। কিন্তু ওই একটা দিন, সন্ধ্যা ছিল ব্যতিক্রম। ওই দিন থেকে নিয়মিত সাতটার পর সে বাসায় ফেরা শুরু করে। এবং আসতে দেরি হতে পারে, একথা সে আমাকে ফোন করে জানানোর প্রয়োজন মনে কওে না। মাংস ও শাকসব্জি কাটাবছার কাজ শেষ। তাই ও আসার আগেই আমাকে রান্না সেরে ফেলতে হবে।
বিয়ের আগে আমি কয়েক পদের তরকারি রান্না শিখেছিলাম। কোনো রকম চালিয়ে নেওয়ার মতো করে। ভাত রান্না হয়ে গেছে। সবজি কাটার কাজও শেষ। কিন্তু কুমিকো এখনো এলো না। খিদেয় আমার পেটে মুচড় দিচ্ছ। একবার ভাবি, আমার অংশটা রান্না করে খেয়ে নিই।

কিন্তু এজন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমার কাছে বিষয়টা মোটেও ঠিক বলে মনে হচ্ছিল না। তাই রান্নার টেবিলে বসে বসে কুমিকোর ফেরার প্রতীক্ষা করি। খিদে মেটানোর জন্য কিছু ক্র্যাকারস খাই আর বিয়ার পান করি। ঘড়ির ছোট্ট কাঁটার ধীর গতিতে ঘুর্ণন লক্ষ্য করি। এক সময় সাড়ে সাতটা পার হয়।
রাত নয়টার পর ফিরে এল সে। ওকে দেখে উদভ্রান্তের মতো লাগল। চোখ দুটো কেমন লালচে : লক্ষণ সুবিধার মনে হচ্ছে না। ওর চোখ যখনই লাল হয়ে ওঠে তখন কোনো না কোনো সমস্যা হয়। আমি নিজেকে বললাম, ঠিক আছে, শান্ত থাক, সব কিছু সহজে গ্রহণ কর আর প্রকৃতস্থ হও। উত্তেজিত হয়ো না।
সরি, বলল কুমিকো। তোমাকে ফোন করার কথা চিন্তা করেছিলাম, কিন্তু একের পর এক কাজ করতে গিয়ে আবার ভুলে গেলাম।
কোনো অসুবিধা নেই, ঠিক আছে। এই নিয়ে ভেবো না তো, বললাম তাকে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। আর সত্যিই এ নিয়ে আমার মনে তখন বাজে অনুভুতির জš§ হয়নি। কাজে যেতে-আসতে কতটা ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়, এই অভিজ্ঞতা আমার আছে। কর্মস্থলে যাওয়া নিজের বাগান থেকে সুন্দরতম গোলাপ তুলে দুটি গলি পার হয়ে আপনার অসুস্থ দাদিমাকে দেখতে যাওয়া এবং তাঁর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর মতো সুখকর কিছু নয়।
কখনো কখনো আপনাকে অপ্রিয় মানুষদের সঙ্গে আনন্দহীন কাজ করে যেতে হয়, তখন বাড়িতে ফোন করার সুযোগ নাও পেতে পারেন। অথচ আমার বাসায় ফিরতে দেরি হবে, এই কথাটা জানাতে বড়জোড় ত্রিশ সেকেন্ড সময় নেবে। যত্রতত্র টেলিফোন আছে। অথচ ওই কয়েক সেকেন্ড ব্যয় করে আপনি ফোন দিতে পারেন না।

আমি রান্নাবান্না শুরু করি: গ্যাসের চুলা ধরাই, কড়াইয়ে তেল ঢালি।
কুমিকো ফ্রিজ খুলে একটা বিয়ার বের করে এবং কাপবোর্ড থেকে গ্লাস নেয়। আমি কাটা সব্জির দিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে কোনো কথা না বলে তা চুলায় বসাই। কুমিকোর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো বিয়ারে সে মজা পাচ্ছে না।
আমার জন্য বসে না থেকে তুমি খেয়ে নিলেই পারতে, বললো সে। উত্তরে আমি বলি, আমার এত খিদে লাগেনি।
আমি মাংস ও শাক ভাজি করি। কুমিকো হাতমুখ ধুতে বাথরুমে যায়। ওর মুখ ধোয়া ও দাঁত ব্রাশ করার শব্দ টের পাই। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে সে।
ওর হাতে টয়লেট পেপার ও টিস্যু। যেগুলো আমি সুপারমার্কেট থেকে কিনে এনেছিলাম।
এগুলো কেন কিনেছ? বিরস গলায় জিজ্ঞেস করে।
আমি প্রথমে ওর দিকে তাকাই। পরে দৃষ্টি ফেরাই ওর হাতের টিস্যুর বাক্স ও টয়লেট পেপারের দিকে। সে কী বলার চেষ্টা করছে, বুঝতে পারছি না।
কী বলতে চাও, এগুলো তো ¯্র্েরফ টিস্যু ও টয়লেট পেপার। আগেরগুলো এখনো একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, এটা ঠিক। কিন্তু এগুলো তো আর কাঁচামাল নয় যে, ঘরে থাকলে পচন ধরবে।
তা ঠিক। পচবে না। কিন্তু তোমাকে কেন নীল রঙের টিস্যু আর ফুল-ওয়ালা টয়লেট পেপার কিনতে হলো?
অন্যগুলো পাইনি তাই, নিজেকে সংযত করে বলি। এগুলোই বিক্রি হচ্ছিল, নীল টিস্যু নিশ্চয়ই তোমার নাককে নীল করে দেবে না। এত ভাবনার কী আছে?
আছে। আমি নীল টিস্যু ও ফুল-ওয়ালা টয়লেট পেপার ঘৃণা করি। এটা কি তুমি জান না?
না, এটা আমি জানতাম না। এগুলো কেন ঘৃণা কর?
কী করে জানব যে এগুলো আমি ঘৃণা করি? শুধু জানি যে, এগুলো আমার অসহ্য লাগে। তুমি ফুলের নকশা আঁকা টেলিফোন কভার ও ফ্লাস্ক এবং বেল-বটম জিন্স অপছন্দ কর। আমার নখে পলিশ করি সেটাও ঘৃণা কর। কিন্তু কেন কর, তা তুমিও বলতে পার না। এটা রুচির ব্যাপার।
আমি কেন এগুলো অপছন্দ করি, এর ব্যাখ্যা আমার জানা। কিন্তু কুমিকোকে তা বলিনি। আমি ওকে বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে, ধরে নিচ্ছি এটা রুচির ব্যাপার। আমরা বিয়ে করেছি ছয় বছর চলছে। তুমি কি বলতে চাও, এ সময়ের মধ্যে একবারও তুমি নীল রঙের টিস্যু ও ফুল-ওয়ালা টয়লেট ব্যাপার কিনে আননি?
না, একবারও না।
সত্যি?
হ্যাঁ, একদম সত্যি। আমি সাদা, হলুদ কিংবা বেগুনি রঙের টিস্যু কিনি। আর ফুলের নকশা করা কোনো টয়লেট পেপার কখনোই কিনি না। আমি আহত বোধ করছি, এই ভেবে যে, এত বছর আমরা একসঙ্গে ঘর করছি, বিবাহিত জীবন-যাপন করছি আর তুমি কিনা এতদিনেও বিষয়টা খেয়াল করনি।
এবার আমিও আহত বোধ করি, এই ছয় বছরে কখনোই নীল টিস্যু কিংবা নকশা করা টয়লেট পেপার ব্যবহার করিনি।
কথা যেহেতু শুরু করেছি, তাহলে আরও বলি। চালিয়ে যায় কুমিকো। এই যে, আজ তুমি কাঁচা মরিচ দিয়ে গরুর মাংশ ভেজেছ এটা আমার একদম অসহ্য লাগে। এটা জান কি?
না, আমার জানা ছিল না, বলি তাকে।
কিন্তু এটাই সত্য। এবং দয়া এর পেছনের কারণ জানতে চেয়ো না। দুটির গন্ধ আমার অসহ্য লাগে।
এর মানে তুমি বলতে চাচ্ছ, এই ছয় বছরে একবারও কাঁচা মরিচ দিয়ে গরুর মাংস রান্না করনি?
ইা, মাথা নাড়ে সে। আমি স্যালাডের সঙ্গে কাঁচা মরিচ খাই। গরুর মাংস ভাজি পেঁয়াজ দিয়ে। কিন্তু আমি কখনো কাঁচা মরিচ দিয়ে গরুর মাংস ভাজব না।
আমি লজ্জিত বোধ করি।
তুমি কি একবারও ভাবলে না, এটা অদ্ভুত? জিজ্ঞেস করে সে।
আমি আসলে লক্ষ করিনি, বললাম তাকে। বিয়ের পর থেকে কোনো দিন কাঁচা মরিচ দিয়ে মাংস ভাজা খেয়েছি কিনা সত্যি মনে করতে পারছি না। তা স্মরণ করা প্রায় অসম্ভব।
এতগুলো বছর তুমি আমার সঙ্গে আছ, বলল সে। অথচ আমার প্রতি প্রায় কোনো মনোযোগই দাওনি। তুমি সব সময়ই তোমার নিজেকে নিয়ে ভেবেছ, ব্যস্ত থেকেছ।
দাঁড়াও এক মিনিট, বললাম তাকে। এরপর চুলা নিভিয়ে দিয়ে কড়াই নামালাম। ওকে বললাম, তোমার কথাই ঠিক, হতে পারে আমি টিস্যু ও টয়লেট পেপার এবং গরুর মাং ও কাঁচা মরিচের মতো বিষয়-আসয় খুব একটা খেয়াল করিনি। কিন্তু এতে প্রমাণিত হয় না যে, আমি তোমার প্রতি খেয়াল রাখিনি। আমি কখনো ভেবে দেখি না, কখন কোন রঙের টিস্যু ব্যবহার করছি। ধরি যে, কালোতে হয়তো আমার সামান্য অসুবিধা হতে পারে, কিন্তু সাদা, নীলে কোনো সমস্যাই নেই। গরুর মাংসের সঙ্গে কাঁচা মরিচ মিশানোর ঘটনাও অনেকটা এরকমই।
একসঙ্গে কিংবা আলাদা, এতে কী এমন আসে যায়? কাঁচা মরিচ দিয়ে মাংস রান্নার এই কা- হয়তো পৃথিবীর মুখ থেকে মুছে যাবে। এটা আমার কাছে কোনো ঘটনাই না। তোমার এসেন্স যা কুমিকোকে কুমিকো করে তুলেছে, এই নিয়ে তুমি কী করবে। আমি কিছু ভুল বলছি কি?
আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে সে গব গব করে বিয়ার শেষ করে। এরপর বিয়ারের খালি বোতলের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু আগে রান্না করা বিতর্কিত সেই তরকারি ময়লার ঝুরিতে ফেলে দিলাম। মাংস, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে এতক্ষণ ধরে তৈরি করা খাবার এক মিনিটে ময়লার ঝুড়িতে, উচ্ছিষ্টে পরিণত হলো। এরপর আমিও একটা বিয়ারের বোতল বের করে পান শুরু পান করি।
এটা কেন করলে? জিজ্ঞেস করে কুমিকো।
তোমার খুব ঘেন্না হচ্ছিল তো তাই ফেলে দিলাম।
তুমি তো খেতে পারতে।
আমার তাৎক্ষণিকভাবে মনে হলো, আর কোনো দিন গরুর মাংস ও কাঁচা মরিচের আর প্রয়োজন নেই।
যা খুশি কর। টেবিলের ওপর দুহাত রাখল সে। এরপর হাতের ওপর মুখ নামাল। কতক্ষণ এভাবে থাকল সে। আমি দেখলাম কুমিকো কাঁদছে না, কিংবা ঘুমানোর চেষ্টাও করছে না। একবার সেই শূন্য পাত্রের দিকে, আরেকবার কুমিকোর মুখের দিকে তাকাই। এরপর বিয়ার শেষ করি। পাগলামী। কে আমাকে টয়লেট পেপার ও কাঁচা মরিচের কথা বলেছিল?
উঠে গিয়ে কুমিকোর কাঁধের ওপর হাত রাখি। বলি, এখন আমি বুঝতে পেরেছি। আর কোনো দিন নীল টিস্যু কিংবা ফুলের নকশাওয়ালা টয়লেট পেপার কিনব না। প্রতিজ্ঞা করছি। কাল সকালে সুপার মার্কেটে গিয়ে এগুলো ফেরত দেব। ওরা যদি পাল্টে না দেয়, তো উঠানে এনে পোড়াব। এর ছাই সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে আসব। গরুর মাংসের সঙ্গে আর কোনো দিন কাঁচা মরিচ মেশাব না। কখনো এমনটি হবে না। কিছুক্ষণ পরই ওই তরকারীর গন্ধ হাওয়া মিলিয়ে যাবে। আমরা আর এই নিয়ে ভাবব না। ঠিক আছে? কিন্তু এখনো কথা বলে না সে। চুপ মেরেই থাকে।
এক ঘণ্টার জন্য বাইরে থেকে হেঁটে আসার চিন্তা করি। ফেরার পথে কুমিকোর জন্য চেরি নিয়ে আসব। কিন্তু এতেও ওর মানভঞ্জন হবে বলে মনে হয় না। আমাকে পরে সামলে নিতে হবে। দেখ, তুমি ক্লান্ত, বলি তাকে। একটু বিশ্রাম নাও। এরপর চলো দুজনে বাইরে গিয়ে পিৎজা খেয়ে আসি। আমরা সর্বশেষ কবে পিৎজা খেয়েছিলাম? এক বেলা বাইরে খেলে কিচ্ছু হবে না। কিন্তু এতেও কাজ হলো না। কুমিকোর মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা দিল না। চুপ করেই থাকল সে।
হাতের ওপর মাথা ঠেকিয়েই রাখল। এখন কী বলা যায়, ভেবে পাই না।
ওপর পাশে চেয়ারে বসি। ওর ছোট চুলের ভেতর থেকে একটা কান উঁকি দিচ্ছে। ওই কানে একটা সোনার দুল। মাছের আদলে গড়া। এই দুল এর আগে কোনো দিন দেখিনি। কোথা থেকে কিনেছে সে এই দুল? সিগারেট ফুঁকতে ইচ্ছে করছে। কল্পনা করি, পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করেছি। একটা সিগারেট ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে এতে আগুন ধরিয়েছি। ফুসফস ভরে ধোয়া নিচ্ছি।
বাতাসে তখনো মাংসের সুবাস। আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, পেটে খিদে। দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারে দৃষ্টি পড়ে। ক্যালেন্ডারে চাঁদের হিসাবও দেওয়া আছে। পূর্ণিমার রাত এলো বলে। কুমিকোর পিরিয়ডের সময় ঘনিয়ে এসেছে।

কেবল বিয়ের পরই সত্যিকার অর্থে বুঝতে শুরি করি যে, আমিও এই পৃথিবীর-সৌরজগতের তৃতীয় গৃহের একজন বাসিন্দা। আমি বাস করি এই পৃথিবীতে। আর পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরপাক খায়। চাঁদ ঘুরে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে।
আপনি পছন্দ করুন আর নাই বা করুন জগতের এই নিয়ম চলছে এবং চলবে চিরকাল (অথবা বলা যায়, আমার সারা জীবন ধরে তা চলতে থাকবে)।
আমার স্ত্রীর ২৯ দিনের মাসিকচক্র আমাকে এভাবে ভাবতে উৎসাহিত করেছে। এই চক্রের সঙ্গে চাঁদের যথাযথ যোগ রয়েছে। কুমিকোর পিরিয়ড সব সময়ই কঠিন। মাসিক শুরুর কয়েক দিন আগে থেকেই সে অস্থির ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
তাই তার এই চক্র আমারও চক্র হয়ে গেছে। অহেতুক ঝামেলা সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে মাসের এই সময়টায় আমি অতিরিক্ত সতর্ক থাকি। বিয়ের আগে আমি প্রায় কখনো চাঁদের চক্রের দিকে এভাবে খেয়াল করিনি।
এর আগেও কখনো কখনো রাতের আকাশে চাঁদকে আলো ছড়াতে দেখেছি। কিন্তু চাঁদ কোন দিন কোন আকৃতি ধারণ করে, খুঁটিয়ে দেখিনি। কিন্তু এখন আমার মাথায় চাঁদের চক্র, কাস্তের আকৃতি থেকে ধীরে চাঁদেও পূর্ণরূপ লাভ করা, আমার মাথায় চক্কর খায়।
কুমিকোর আগেও আমার জীবনে বেশ কয়েকজন নারী এসেছে। আর হ্যাঁ, তাদেরও মাসিক হতো। কারও কারওটা ছিল কঠিন, কারওটা বা সহজ। কোনো কোনো নারীর মাসিক শেষ হতো মাত্র তিন দিনে। কারও চলত সাত দিন ধরে। কোনো কোনো নারীর নিয়মিত মাসিক হতো। আবার কারওটা অনিয়মিত। নির্ধারিত সময়ের দশদিন পর। এই চক্রের জ্বালায় আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠতাম। মাসিক চলাকালে কোনো কোনো নারীর মুড খুবই খারাপ থাকে। কেউবা স্বাভাবিক আচরণ করে।
কুমিকোকে বিয়ের আগে আমি অন্য কোনো নারীর সঙ্গে বসবাস করিনি। এর আগে আমার কাছে মাসিকচক্রকে ঋতুর পরিবর্তন বলে মনে হতো। শীতকালে আমাকে কোট পরতে হয়, আর গ্রীষ্মে পায়ে দিই স্যান্ডেল। বিয়ের পর নারী-পুরুষের একত্র বাসের বাইরেও আমি এই মাসিকচক্রের বিষয়ে, চাঁদের চক্র সম্পর্কে নতুন ধারণা লাভ করেছি।
কোনো নারী অন্তঃসত্ত্বা হলে, সন্তান জš§ দেওয়ার আগ পর্যন্ত মাসিকচক্র থেকে বিরত থাকে।
আমি দুঃখিত, মাথা তুলে বলল কুমিকো। তোমাকে এসব কথা বলতে চাইনি। জান তো আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আমার মুডও খারাপ যাচ্ছে।
ঠিক আছে, বললাম তাকে। এই নিয়ে ভেবো না তো। তুমি যখন ক্লান্ত এর জের কারও ওপর ঢালতেই পার। এতে তুমি কিছু স্বস্তি পাও।
ধীরে লম্বা দম নিল কুমিকো, কিছুক্ষণ আটকে রেখে আবারও ধীরে ধীরে ছাড়ল।
তুমি কেমন আছে? এবার কুমিকো জানতে চায়।
আমি কেমন আছি?
তোমার মুড খারাপ হলে তা অন্যের ওপর দেখাও না। কিন্তু আমি এমন করি কেন?
বিষয়টা খেয়াল করিনি কখনো, বলি তাকে। তবে নিসন্দেহে মজার।
হয়ত তুমি তা মনের গভীরে চেপে রাখ, সেখানেই চিৎকার করে মর। রাজা পেলেন গাধার কান! আর তখন সব কিছু ঠিক ঠাক।
খানিকক্ষণ ভেবে বলি, হতেও পারে। বিয়ারের খালি বোতলের দিকে আবার তাকাল কুমিকো। বোতলের গায়ের মোড়কের দিকে দৃষ্টি দেয় সে। এরপর মুখের দিকে, শেষমেশ ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের আঙ্গুলের দিকে।
আমার পিরিয়ড হতে চলেছে, বলল সে। মনে হয়, এ কারণেই মেজাজ এমন বিগড়ে আছে।
আমি জানি, আশ্বস্ত করি ওকে। আর তুমি একা নও। পূর্ণিমা রাতে টন টন ঘোড়ার মৃত্যু হয়। বোতলের ওপর থেকে হাত সরিয়ে আনে, মুখ খোলে, আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়।
হঠাৎ তা কোত্থেকে আসে?
কয়েক দিন আগে একটা পত্রিকায় পড়েছিলাম। তোমাকে বলব ভেবেছিলাম, পরে ভুলে গিয়েছিলাম। লেখাটি ছিল আসলে একজন পশুবিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার। চাঁদের চক্র ঘোড়ার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পূর্ণিমার আগে থেকেই ঘোড়াদেও মস্তিস্কের স্তরে বিশেষ পরির্তন দেখা দেয়। এদের মধ্যে বুনোভাব চাগাড় দিয়ে ওঠে। পূণিমারাতে অনেক ঘোড়া অসুস্থ হয়ে পড়ে, অসংখ্য ঘোড়ার মৃত্যু হয়। কেন এ ঘটনা ঘটে তা কেউ জানে না। তবে পরিসংখ্যান বলছে, এটা ঘটে।
দারুন মজার তো, বলল কুমিকো।
সূর্যগ্রহণের দিন আরও ভয়াবহ। পূর্ণসূর্যগ্রহণকালে সারা বিশ্বে কত ঘোড়ার মৃত্যু হয় তুমি কল্পনাই করতে পারবে না।
সেই যাই হোক, আমি যা বোঝাতে চাই, তা হলো সারা বিশ্বে অসংখ্য ঘোড়া মারা যাচ্ছে, তোমার ক্ষোভ ও হতাশা অন্যের ওপর ঝাড়া সেই তুলনায় কত তুচ্ছ। তাই এ নিয়ে বিরক্ত বা বিব্রত হওয়ার দরকার নেই। ঘোড়াগুলোর মৃত্যু মুখে পতিত হওয়ার দৃশ্য একবার কল্পনা কর। পূর্ণিমার রাত। চারদিক ফকাফকা আলো। এরমধ্যে আস্তাবলে খড়ের গাদার ওপর ঘোড়াগুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে। মৃত্যুর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে।
ঘোড়াগুলোর মৃত্যু মুখে পতিত হওয়া দৃশ্য কল্পনা করতে গিয়ে কুমিকো কয়েক মুহূর্ত ভাবে। এর বলে, আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে, তুমি যে কোনো পণ্য বিক্রি করতে চাইলে, যে কাউকে তা গছাতে চাইলে, সহজেই তা পারবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে, এবার কাপড় পাল্টে চলো দুজনে পিৎজা খেতে যাই।
ওই রাতে আমাদের অন্ধকার শয়নকক্ষে কুমিকোর পাশে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি এই নারী সম্পর্কে সত্যি কতটুকু জানি আমি? রাত দুইটা। কুমিকো গভীর ঘুমে। ঘন অন্ধকারে আমি নীল টিস্যু ও নকশা করা টয়লেট পেপার এবং গরুর মাংস ও কাঁচা মরিচের মিশেলের কথা চিন্তা করি। কুমিকোর সঙ্গে প্রায় ছয় বছর ধরে আছি। কিন্তু এসব জিনিস সে কত ঘৃণা কওে, আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি!
ঘটনাগুলো কত তুচ্ছ। আর স্টুপিড। হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায়। কয়েক দিন পর আমরা এসব অতিতুচ্ছ ঘটনা বেমালুম ভুলে যাই।
কিন্তু এবারের ঘটনা ভিন্ন। অদ্ভুত রকমে আমার মনে পীড়ন সৃষ্টি করছে, গলায় আটকে থাকা কাঁটার মতো যন্ত্রণা দিচ্ছে।
হয়তো যতটা মনে হয়েছিল, ঘটনাটি এর চেয়েও সংকটপূর্ণ। হয়তো এটা ছিল প্রাণঘাতী। কিংবা সূচনা পর্ব, যা ক্রমে প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে।
হবে হয়তো, আমি বিশাল কোনো কিছুর প্রবেশ মুখে দাঁড়িয়ে আছি। এর ভেতরে একটা বিশ্ব আছে। যা শুধু কুমিকোর, একান্ত। একটা বিশাল বিশ্ব, যার সঙ্গে আমার কোনো দিন পরিচয় হয়নি। আমি এটিকে দেখি একটা বিরাট, অন্ধকার কক্ষ হিসেবে।
সিগারেট হাতে সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। সিগারেটের এতটুকু আলোতে ওই অন্ধকার কক্ষের ছোট্ট একটা অংশ চোখে পড়ছে। ওই কক্ষের বাকি অংশ কি কোনো দিন আমার দৃষ্টি গোচর হবে? আমি কি সত্যি কুমিকোকে জানার আগে বুড়িয়ে যাব ও মরে যাব?
আমার জন্য মজুদ রাখা এই যদি হয় সব, তাহলে এই বিবাহিত জীবন-যাপনের অর্থ (পয়েন্ট) কী? একজন অচেনা নারীর সঙ্গে বিছানায় শুয়ে জীবন কাটানোর মানে কী?
ওই রাতে আমি এসব ভেবেছি। এরপর অনেক দিন, সময় সময় আমি বিষয়টি ভেবে দেখি। এরও অনেক দিন পর আমি এই সমস্যার মর্মে পৌঁছার পথ খুঁজে পাই।

১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×