তিনটি কারণ সামনে রেখে স্থপতি ও ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দার শোভন হত্যাকান্ডের বিষয়টি তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি)। হত্যাকান্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে ডিবির তিনটি দল মাঠে নেমেছে। রাজিব হত্যায় জড়িত সন্দেহে ছয় জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি।
এদিকে গতকাল রবিবার বিকালে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার সরষপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাদী রাজিয়া বেগমের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন রাজিব। এর আগে কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বাদ জোহর তৃতীয় এবং সরষপুর গ্রামের বাড়িতে বাদ আসর রাজীবের চতুর্থ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নামে। ঢাকা থেকে গতকাল সকাল ১০টায় রাজিবের মরদেহ কাপাসিয়ায় পৌঁছায়। তার লাশ এক নজর দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে। ভিড় সামলাতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়েছে। রাজিবের স্ত্রী আনিকা, পিতা ডা. নাজিম উদ্দিন হায়দার, মা নার্গিস হায়দার ও ছোট ভাই স্থপতি শাহনাজ হায়দার নোবেল রাজিবের কফিন জড়িয়ে ধরে বুক ফাঁটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। একই সঙ্গে এ ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের ঘটনায় হাজার লোক বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। মুহুর্মুহু ধ্বনিতে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। শ্লোগানে শ্লোগানে তারা বলেন, রাজিবের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না। গোলাম আজম ও কাদের মোল্লাসহ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিও ওঠে এসময়। একে অপরকে জড়িয়ে কান্নার এক হূদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, রাজিব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ পাঁচজনকে আটক করেছে।
তিনটি কারণ সামনে রেখে তদন্ত শুরু
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদের নির্দেশে রাজীব হত্যা মামলার তদন্ত ভার গত শনিবার রাতে পল্লবী থানা থেকে ডিবিতে ন্যস্ত করা হয়। ঘটনার পর থেকে ডিবি রাজিব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান ও তদন্ত শুরু করে। ডিবির তদন্ত কর্তৃপক্ষ রাজিবের প্যান্টের পকেট থেকে উদ্ধারকৃত তার ২টি মোবাইল ফোনের কললিস্ট ধরে সন্দেহভাজনদের সনাক্তকরণে কার্যক্রম শুরু করে দেয়। গতকাল পর্যন্ত ৬ জনকে আটক করে কললিস্ট অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি। রাজিবের স্ত্রী আনিকাকেও ডিবির কর্মকর্তারা আজ সোমবার জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বলে জানা গেছে। ডিবির কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, শাহবাগে গণজাগরণ আন্দোলনের অন্যতম রূপকার হিসেবে জামায়াত শিবির টাগের্েট পরিণত হন রাজিব। অনলাইনে দিন রাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে তথ্য সরবরাহ করে আসছিলেন তিনি। কর্মকর্তারা জানান, জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় তাকে কয়েক দফা হত্যার হুমকিও দেয়া হয়। তবে কর্মকর্তারা হত্যাকান্ডের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিষয়টি এ মুহুর্তে জানাতে রাজী হননি। খুনিদের গ্রেফতারে ডিবির তিনটি দলের নেতৃত্বে আছেন ডিসি (নর্থ) মোল্লা নজরুল ইসলাম, এডিসি (নর্থ) মশিউর রহমান, ও সহকারি পুলিশ কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম।
ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তা আটক
মিরপুর ইসলামী ব্যাংক শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল ইসলামকে গতকাল আটক করেছে পুলিশ। তাকে মিরপুর থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মিরপুর থানার ওসি সালাহ উদ্দিন বলেন, তার বিরুদ্ধে জামায়াত শিবিরকে আর্থিক সহায়তা ও নাশকতার সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ব্লগার রাজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার যোগসাজোশ থাকতে পারে। পল্লবী পলাশনগর আবাসিক এলাকায় ৫ জন ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা থাকেন। শুক্রবার রাতে হত্যাকান্ডের আগে খুনিরা কারো বাসায় আশ্রয় নিযেছিল কি না এ ব্যপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে ওসি জানান। গতকাল রাত ৮ টা পর্যন্ত শহীদুল ইসলাম মিরপুর থানা পুলিশের কাছেই ছিলেন।
কাপাসিয়া সংবাদদাতা এম. আসাদুজ্জামান সাদ জানান, সকাল ১০টার দিকে রাজিবের লাশ কাপাসিয়ার বাসায় আনা হয়। জাতীয় পতাকা মোড়ানো রাজিবের লাশবহনকারী অ্যামু্বলেন্সটি পুলিশ প্রহরায় কাপাসিয়া পৌঁছলে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বেলা ১১ টায় উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন এবং সর্বস্তরের মানুষ রাজিবের বাসার সামনে থেকে হত্যাকান্ডের বিচার দাবিতে কালো পতাকা হাতে বিশাল শোক শোভাযাত্রা করেছে। শোভাযাত্রা উপজেলার প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে বাসস্ট্যান্ড এসে সড়ক অবরোধ করে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
কাপাসিয়া বাজারের সকল দোকানে গতকাল কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এলাকার লোকজন কালো ব্যাজ ধারণ করেছে। সকাল ১০টায় উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একযোগে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।
দুপুর ১২টার দিকে কাপাসিয়ায় রাজিবের বাড়িতে রাজিবের স্ত্রী আনিকাকে সাথে নিয়ে আসেন রাজিবের শ্বশুর রশিদ, শাশুড়ি বিলকিছ বেগম ও বড় জামাতা আজাদ। এসময় রাজিবের শ্বশুর আব্দুর রশিদ জানান, রাজিবের নিহত হবার খবর আমরা পাই রাত ১২টার দিকে টেলিভিশনের খবর দেখে। পরে আমি রাজিবের পিতাকে ফোন করে ঘটনাটি জানাই।
রাজীবের মা নার্গিস হায়দার বলেন, আমার ছেলেকে দেশের জন্য উত্সর্গ করলাম। আমার ছেলে যে কারণে শহীদ হয়েছে তা যেন সফল হয়। সকল রাজাকারদের বিচার করে দেশ যেন রাজাকার মুক্ত হয়। আমি সরকারের কাছে আমার পরিবারের নিরাপত্তা দাবি করছি।
বেলা আড়াইটায় কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তৃতীয় জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এ বিদ্যালয়েই রাজিব ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণী পড়েছে। জানাজায় উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবি সংগঠনের নেতাসহ হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। পরে গাজীপুর জেলা ও কাপাসিয়া উপজেলা প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবি সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজারো মানুষ কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জড়ো হয়।
জানাজার নামাজে আলহাজ্ব মোতাহার হোসেন মোল্লা, মোমতাজ উদ্দীন আহমেদ মেহেদী, মতিউর রহমান, ফজলুর রহমান, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আনিছুর রহমান আরিফ, আমানত হোসেন খান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আলাউদ্দীন আলী, গাজীপুর জেলা প্রশাসনের এনডিসি সাজ্জাদ হোসেন প্রমুখ অংশ নেন। পরে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শাহনাওয়াজ খান, গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায়সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবি সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
জানাজার পূর্বে নিহত রাজিবের পিতা ডা. নাজিম উদ্দীন আবেগ তাড়িত কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে কোন অপরাধ করেনি। ৭১ এর ঘাতকরা আমার ছেলেকে নির্মমভাবে খুন করেছে। আমাকে সান্ত্বনা দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার বাসায় গিয়েছিলেন। আমি তাকে বলেছি, কয়েকজন রাজাকারের ফাঁসি দিলে হবে না। দেশের সকল রাজাকারের বিচার করতে হবে। একইসাথে রাজাকারদের সন্তানদেরও বিচার করতে হবে। রাজাকারের বংশ নির্বংশ করতে হবে। আমার ছেলেকে গোলাম আজম হত্যা করেনি। তার উত্তরসুরীরাই হত্যা করেছে। তাই তাদেরও দেশ থেকে বিতারিত করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, বিষয়গুলো আমরা ভাবছি।
বিকালে লাশ দাফনের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয় কাপাসিয়া উপজেলা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে রাজিবের দাদার বাড়ি উপজেলার তরগাও ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামে। আঘাতের কারণে লাশ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় এবং লাশ নষ্ট হবার আশংকায় রাজিবের লাশ কফিন থেকে বের করা হয়নি। দাফনের জন্য লাশ কফিন থেকে বের করে লাশ বহনের খাটে রাখার সময় প্রথমবারের মতো লাশ দেখার ব্যবস্থা করা হয়। এসময় রাজিবের স্ত্রী দীর্ঘ প্রায় ৫ মাস পর প্রিয় স্বামীকে শেষবার দেখার সুযোগ পেলেন।
বিকাল ৫টায় তার দাদার বাড়ীর পাশ্ববর্তী সরষপুর গ্রামে ঈদগাঁহ মাঠে চতুর্থ জানাজার নামায অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় এলাকার শত শত বৃষ্টিতে ভিজে মানুষ অংশ গ্রহণ করেন। শেষে পারিবারিক কবর স্থানে দাদী রাজিয়া বেগমের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। এ সময় বৃষ্টি হচ্ছিল। স্বজনদের চোখের পানি আড়াল করার জন্যই যেন এ বৃষ্টি।