somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুবাদ: সাপ

০৪ ঠা জুন, ২০১০ রাত ২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মূল গল্প : The Snake by Mahmoud Badawi

বকর শেখ গ্রামের কয়েকজন বর্গাচাষীদের নিয়ে আসগরের চায়ের দোকানে বসে উনার ট্রাক্টরের ভাড়ার হিসেব করছিলেন, এমন সময় আমি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে দেখে উনি ডাকলেন, বললেন " আইসো রহিম মিঞা, চা খাও এককাপ। আর হিসাবটা একটু দেখোতো। তুমি শিক্ষিত মানুষ, আমার চেয়ে হিসাবনিকাষ ভালা বুঝবা। এইসব অশিক্ষিতের দল সামান্য কয়টা টাকার হিসাব করতে পারেনা। কী সব লিইখ্যা নিয়া আইছে! আমি আবার এত ছোট লেখা ভালো পড়তে পারি না।"

প্রচন্ড গরম পড়েছিল সেদিন। হাঁটতে হাঁটতে আমার পিপাসাও পেয়েছিল খুব। তাই ভাবলাম বসে যাই কিছুক্ষন। চা-ও খাওয়া হবে, ছায়ায় কিছুক্ষন বসাও যাবে। তাছাড়া বকর শেখ এলাকার প্রভাবশালী মানুষ, উনি ডাকলে না যাওয়াটা অভদ্রতা হবে। আমি গিয়ে দোকানে টিনশেডের ছায়ায় বসলাম। উনি আসগরকে আমাকে পানি দিতে বললেন প্রথমে তারপরে চা। আমার হাতে ছিল সেদিনের পেপার। তিনি সেটা নিয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর তোমার কাজকারবার কেমন চলতেছে? আমি উত্তর দিলাম, এইতো আপনাদের দোয়ায় খারাপ না আরকি। উনি তখন গ্রামে একটা সূতার কারখানা দেয়া যায় কিনা আমার সাথে সেই পরামর্শ করতে লাগলেন।

গ্রামের লোকগুলো চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিল। যদিও ওরা আমাদের কথা তেমন বুঝতে পারছিল বলে মনে হয় না। বুঝার চেষ্টাও করছিল না অবশ্য। তাদের কাছে আমরা হচ্ছি "উচুঁস্তরের মানুষ"। হঠাৎ দেখি বকর শেখ উঠে দাঁড়িয়েছেন আর সামনে তাকিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছেন। আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কেউ একজন এদিকেই আসছে। সামনে আসতেই চিনতে পারলাম, রহমান, আরেকজন চাষী তবে ওর নিজের কিছুটা জমিজমা আছে। বকর শেখ জিজ্ঞাসা করলেন, " টাকা আনছো?"
রহমান কিছু টাকা বাড়িয়ে দিল।
বকর শেখ টাকা গুনে বললেন, " বাকিটা কই?"
"আমি আপনার ট্রাক্টর দিয়ে দেড়বিঘা জমি চাষ করছি।" রহমান বললো।
"তুমি দুইবিঘা চাষ করছো, আমার লোক মাইপা দেখছে। প্রত্যেকবারই তুমি আমার সাথে এইটা নিয়া বাহাস কর। যাও, বাকি টাকা নিয়া আসো।"
"আমার কাছে আর নাই, যা আছে দিয়া দিছি।"
"তাইলে এইটাও নিয়া যাও, যখন পুরাটা পারবা, একলগে দিবা।"
"কোনখান থে দিমু? আমি কি আমার বাড়িঘর বেইচা আপনার টাকা দিমু? এইটা চান আপনি?"
"তুমি কোনখান থেইক্যা টাকা দিবা সেইটা তোমার বিষয়। ক্যান, তুমি কিছু ধান বেচো অথবা দু'একটা গরু ছাগল যেগুলা অন্যের জমিতে সারাদিন চইড়া বেড়ায় সেগুলা বেইচা টাকা যোগাড় কর।"
"আমার কাছে যা ছিল আমি তা দিছি। আর কিছু দিবার পারুম না। আর তাছাড়া যা দিছি বেশিই দিছি।"
"কী বললা তুমি? আবার বলতো।"
"আমি বলছি, আপনার যা পাওনা তার থেইকা বেশিই দিছি।"
"ঠিকাছে। তোমার বেশি বাড় বাড়ছে। কাইলকা সকালেই তোমার ধান আর গরুছাগল যাইয়া নিয়া আসুমনে। তখন দেখুম তুমি কী কর।"
"আপনি আমাগোরে আপনার চাকরবাকর মনে করেন আপনার জমি আর ট্রাক্টর কাজে লাগাই দেখে? আর কত চাই আপনার? বয়স হইছে, এখন আল্লাহ খোদার নাম নেন ভাল কইরা।"
" হারামীর বাচ্চা, আমারে জ্ঞান দেস, তোর এত্ত বড় কইলজা" এই বলে বকর শেখ রহমানকে তার হাতের লাঠিটা দিয়ে পেটাতে লাগলেন। আমরা কয়েকজন উনাকে ধরে সরিয়ে আনলাম। উনি গিয়ে যেখানে আগে বসে ছিলেন সেখানে আবার বসে পড়লেন আর রাগে গর্জাতে গর্জাতে রহমানকে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি দিতে লাগলেন। রহমান ততক্ষনে সেখান থেকে চলে গেছে।

আমরা অনেক চেষ্টা করে বকর শেখকে কিছুটা শান্ত করলাম। ততক্ষনে দুপুর হয়ে গেছে। চৈত্র মাস, বাতাসের সাথে মনে হচ্ছিল যেন আগুনের হলকা এসে লাগছে গায়ে। দোকানের কাছেই একটা ছোট নদী, তবে দোকানটা কিছুটা উঁচুতে। গ্রামের লোকজন নদীর পানি খায়, পানিতে গরুমহিষ গোছল করায়, নিজেরাও করে। মানুষ আর গরুমহিষ চলাচলের কারণে নদী পর্যন্ত একটা সরু মেঠো পথ তৈরি হয়ে গেছে।
বকর শেখের ছোট ছেলে, হাসান, আরো কয়েকটা ছেলের সাথে নদীর পাড়ে খেলছিল কাদা দিয়ে। ওরা কাদা দিয়ে ঘরবাড়ি বানাচ্ছিল। বকর শেখ দেখেও মানা করেনি কেননা এমনিতে ছেলেটা বাসায় একা একা থাকে। এখানে খেলছে, খেলুক।
কিছুক্ষনের মধ্যেই হিসাব শেষ করে বকর শেখ নামাজের জন্য উঠে দাড়াঁলেন। এমন সময় আমরা একটা ছেলের চিৎকার শুনলাম, " জলদি আসেন। এটা হাসান, বকর শেখের ছেলে।"
আমরাতো ভাবলাম, মনে হয় ডুবে যাচ্ছে হাসান। তাড়াতাড়ি দৌড়ে নদীর পাড়ে গেলাম আমি, পেছনে বকর শেখ। আরো অনেকেই আসছে যারা চিৎকার শুনেছে। গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ। ভয়ে আমি নড়তেও ভুলে গেলাম। দেখলাম হাসানের একটু সামনেই একটা সাপ, গোখরা সাপ, ফনা তুলে আছে। মনে হয় গরমে সাপটা গর্ত থেকে বেরিয়ে পানির দিকে যাচ্ছিল আর হাসান তখন পানি থেকে উঠছিল। হাসান পানিতেও নেমে যেতে পারছে না কেননা ওর ঠিক পেছনেই একটা গরু পানিতে দাড়িঁয়ে আছে।
হাসান সাপটা দেখে ভয়ে শক্ত হয়ে গেছে, কোন নড়াচড়া নাই। সে যে দৌড়ে সরে যাবে সেরকম কোন লক্ষন নেই। গরুটা পানিতে ছিল, আমরা ভয় পাচ্ছিলাম যে যদি ওটা নড়ে তাহলে হয়তো সাপটা ভয় পেয়ে হাসানকে ছোবল মারতে পারে। আমরা সবাই অসহায়ের মত দাড়িঁয়ে ছিলাম। সাপটা ছিল বেশ বড়, সুন্দর, ভয়ংকর সুন্দর, আমি আমার জীবনে এত বড় সাপ দেখিনি।
আমরা কেউই বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে সাপটাকে মারা যায়। কেউ যদি মারতে যায় তাহলে ওটা হাসানকে ছোবল দিতে পারে। আমার ভয়ে শরীর শিরশির করতে লাগলো, মনে হচ্ছিল সাপটা আমার পা বেয়ে উঠছে। আমি ভয়ে পা ঝাকাতে লাগলাম আর আশেপাশে ভয়ার্ত চোখে তাকাতে লাগলাম। আমার মনে হতে লাগলো, সাপটা আমার গলা পেঁচিয়ে আছে।
এরকম সময়ে একজন একটা পাথর ছুড়লো সাপটার দিকে কিন্তু লাগাতে পারলো না। আমি ভাবলাম যদি সে পাথরটা না ছুড়তো তাহলে হয়তো কিছুক্ষনের মধ্যেই সাপটা নিজের গর্তে চলে যেত কিন্তু এখন ওটা হাসানের দিকে এগোতে লাগলো। আমরা সবাই ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, বকর শেখ কেঁদে উঠলেন। উনি উনার এই ছেলেটাকে খুবই পছন্দ করেন। একজন চেঁচিয়ে হাসানকে দৌড়াতে বলল, আরেকজন আরেকটা পাথর ছুড়লো কিন্তু এবারও লাগাতে পারলো না। হঠাৎ দেখি একটা ছুরি গিয়ে সাপটার মাথায় লাগলো আর সাপটাকে মাটিতে গেঁথে ফেললো। তাকিয়ে দেখি, রহমান। ও ছুরি ছোড়ায় ওস্তাদ লোক, প্রায়ই হাঁটে খেলা দেখায় কিন্তু এতদূর থেকে একটা সাপ এভাবে গেঁথে ফেলতে পারে কেউ এটা আমরা তখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

বকর শেখ দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। হাসান মনে হয় তখনো কি হচ্ছে ঠিক ঠাহড় করতে পারছিল না। একটুপরে উঠে রহমানের সামনে এসে বকর শেখ কিছুক্ষন আগের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইলেন আর বললেন, "তোমার টাকা দেয়া লাগবে না। আর এটা রাখ" বলে ওকে কিছু টাকা দিলেন। রহমান কিছুই না বলে সাপটা থেকে তার ছুরিটা খুলে মাটিতে মুছে, টাকাটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে কিছুই করেনি এমন ভাব করে ঘুরে চলে গেল।
বকর শেখকে দেখে আমার মনে হল তিনি লজ্জায়, অপমানে মাটির সাথে মিশে যাবেন। আমি তাকে কখনই এরকম অপমানজনক পরিস্থিতিতে পড়তে দেখিনি।

মূল লেখক পরিচিতি:
মাহমুদ বাদাওই (১৯১০-১৯৮৫) ছিলেন মিশরীয় ছোট গল্পকার। উনি মিশরের প্রথমদিককার লেখক যিনি পাশ্চাত্যের বিশেষ করে রাশিয়ান সাহিত্যের মূলত চেকবের লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে আরবী এবং পাশ্চাত্যের সংমিশ্রনে সাহিত্য রচনা করেন। যদিও তিনি তার সমকালীন মাহমুদ তৈমুরের মত আরবে এত বিখ্যাত ছিলেন না কিন্তু তিনি তার অকপট প্রকাশভংগী আর অভিজ্ঞতা এবং কাজ দিয়ে আরবী সাহিত্যে ছোটগল্পের সীমানা বৃস্তিত করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে The First Sin (1959), A Room on the Roof (1960, The Guardian of the Orchid (1960), Sad Beauty (1962), The Falcon of the Night (1970), The Golden Ship (1971) এবংThe Other Door (1977) অন্যতম।
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×