এক-
হেজাজের এ অঞ্চলটা একটু বেশীই গরম! খালি পায়ে হাটা তো অসম্ভবই এমনকি ছেচড়া মার্কা জুতা হলে মুড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তীব্র । না হেটে যদি ঠায় দাঁড়িয়েও থাকা হয় তারপরেও বুকের ছাতি ফেটে যায় যায়। দেশেভেদে ছয় বা চার ঋতু থাকলেও আরব মরুতে যে ঋতুই আসুক গরম হাওয়া এক স্বাভাবিক বিষয়। ঠা ঠা গরমকে পায়ে মাড়িয়ে হেজাজের বুক চিরে এগিয়ে যায় বণিকের দল। ফল দাঁড়িযেছে এই এখন এ অঞ্চল ছেড়ে অন্য কোন কম গরমের দেশে গেলে অস্বস্তি লাগে! বণিক-বণিক ভাবটা তেমন লাগে না। মুসাগির বণিকদেরই একজন। নয় বছর থেকে বণিক দলের সাথে পারস্যে যাওয়া আসা তার। পথ-ঘাট অনেকটা নখে-দর্পণে। তখন বাণিজ্যে যেত শুধু শেখার জন্য ;কিন্তু আজ এই পরিণত বয়সে সে নিজেই এক মস্ত বণিক। সিরিয়া থেকে কুরাউল গামিম অভিমুখে যাচ্ছিল মুসাগির। যথারীতি উত্তপ্ত মরুর পথ। আগুনে মাটি তা’ দেয়ার জন্য যেমন ইটখোলা আরব মরু পুরোটাই যেন বালি পোড়ানোর কারখানা। আজকের দিনটাতে মুসাগিরকে অনেক অসহায় লাগছিল। একে তো একা, সাথে বাহনের উটটিও মনের মত পা চালাতে পারছে না। অথচ কুমামে নিজেদের আবাসস্থল থেকে ব্যাবসায়র চুক্তিপত্র নিয়ে তাকে সিরিয়া পৌছতে হবে দ’ু দিনের মধ্যে। পথ পড়ি দিতে দিতে জাবালে আরকানের পাদদেশ এসে থেমে গেল উট! নাহ! আ--র এগুতে
পারছে না এটি। কী আর করা , পুনরায় বাহনে চড়ার আগে নিজেকে
সতেজ করতে চাইল সে। চাতক
পাখির মত চারপাশে তাকাল কয়েকবার। হতেও পারে কোন পানির সন্ধান মেলবে। উটকে দাঁড় করিয়ে বেরিয়ে পড়ল । পাহাড়টার
ঠিক পশ্চিম পাশে কিসের যেন শব্দ হচ্ছিল। কোন ঝর্ণা থেকে পানি পড়ছে ভাবল । অনেক চড়াই
উৎরাই পেড়িয়ে সেখানে যেতে যেতে আওয়াজটাও মিলিয়ে গেল। পরক্ষণে ভাবল সাইমুমের সময় এরকম শো-শো শব্দ হয়। হয়ত লু-হাওয়া এখানটা দিয়ে বয়ে গেছে। কী আর করা! চড়াই –উৎড়াই করে আবার নিচে নামা। আবার পানির সন্ধানে বেড়িয়ে পড়তে হল। কিছুদূর এগুতেই দূর থেকে ছোটাকৃতির একটি দলকে দেখা যাচ্ছিল। আবছা চোখে উটের বহর না কোন কাফেলা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। যতই কাছে আসছে মুসাগিরের মনে কাফেলাই হউক-এমন একটা ইচ্ছা জাগছিল। আরে ঐত! এ যে তার একসময়কার ব্যাবসায়র সাথী উজাবের কাফেলা। কয়েকজন তাকে চিনতেও পেড়েছে। তরবারীর ইশারায় থামতে বলল তাদের। মুসগিরই যেচে বল্ল,
-কী খবর ভায়েরা? সিরিয়া যাচ্ছ নাকি?
-না, মুতায় যাব। তা এ সময়ে আপনি ফেরছেন কেন? ইয়ামুস সাবতে না আপনি কাফেলাসহ বেড়িয়েছিলেন।
-সে অনেক কথা,পড়ে শুন। আচ্ছা তোমাদের কাছে পানি হবে?
- উটবোঝাই মালামাল তার উপর পানির ঘানি টানতে যাব কেন বাপু?
পানি আমরা সামনের কাবিলা থেকেই চেয়ে নেব। ওখানে বেশ কয়েকটি সূপেয় পানির ক’প আছে তাতো জানোই। এ জন্য কাফেলার
সাথে পানি নেই নি । চাইলে সাথে যেতে পার।
- না থাক,পথ পিছিয়ে কাজ নেই । আমি দেখি সামনে কোন উৎস পাই কিনা।
-ফি আমানিল্লাহ!
চারপাশে খানিকটা বাতাস হচ্ছে বলে মনে হল। তবে ইয়া বড় জুব্বা
পড়ায় ধুলো দেহকে কাবু করতে পারছে না। তার উটটিকে কান্ত দেখালেও আশা করা যায় সে মনিবের দু:খ বুঝতে পারছে। করবে না ! তাকেও যে সে অনেক আদর করে। দামী ইয়েমেনী চাদর জড়ায়েছে পিঠের উপর। যাই হউক
উদ পাহাড়ের কাছাকাছি আসতে দেখা মিল্ল একটা কৃত্রিম ক’পের। কাছে যেতেই নাকে ঢুকল পঁচা দুর্গন্ধ। পানির রঙও বেঢপ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছ পরিত্যাক্ত কোন ক’প হবে। পানি পঁচেই এ হাল দাঁড়িয়েছে।‘ আমি যদি যাই লোহিতে, দুখ যায় আমার সহিতে’- এ রকম ভাবনা আসে তার মাথায়। যদিও মেহরাশের পানিও সে অনেক বেদুইনকে খেতে দেখেছে তাই বলে বেদুঈনদের মত তো আর ঢকাঢক পেটে নিতে পারছে না। বড়ও হয়েছে মোটামুটি শহুরে পরিবেশে তাই রুচিবোধ তার সবসময়ই ছিল। পানি খুজতে খুজতে এবার ক’প একটার খোজ মিলল। জায়গাটা চিনে রাখা দরকার। সময়ে অসময়ে এখান থেকে পানি নেয়া যাবে- মনে মনে বল্ল সে । পাহার চিরে পানি বইছে অফুরন্ত। মরুভ’মির মত জায়গায পানির এরকম উৎসের খোজ প্রথম প্রথম তার কাছে আবিষ্কার বলেই মনে হয়। পানিগুলো যেমন স্বচ্ছ তেমন শীতল। কিন্তু এখানে ওখানে অচেনা কয়েকটি মরা পাখি দেখে খটকা লাগল তার। পাখি মারার কোন ফাঁদ তো এখানে থাকার কথা নয় তবে এমন হল কেন? পরক্ষণেই ভাবান্তর হল। দূর, কী আবল তাবল ভাবছি। পাখি তো রোগেও মরে,তা ভেবে আমার কাজ কী? আল্লাহর শুকরিয়া জানিয়ে সে পাহারের ঠিক পেটের দিকটায় বসল। এ জায়গাটা অন্য যে কোন অংশের চেয়ে কিছুটা সমতল মনে হল তার কাছে। তাছাড়া এখানটার পানিও খুব খড়স্রোতা নয় যে তুলতে সমস্যা হবে। কোমর থেকে মশক বের করল মুসাগির। চারপাশে চামড়া দিয়ে মুড়ানো এমনকি হাড়ের ব্যাবহারও আছে এটিতে। খুব সহজেই পানি তোলা গেল। সাথে থাকা থলের উপর বসল আয়েশ করে। কিন্তু মশকে মুখ লাগিয়ে পানির চুমক নিতে গেলেই ঘটল বিপত্তি।
দুই-
আরে! হুলা পাখিটি এভাবে ঝাপ মেরে মশকে পা দিল যে? কোত্থেকে সব উৎকট সমস্যা এসে হাজির হচ্ছে আজ । গায়ের রঙ একে তো হাড়ি-কালো তারপর বিদগুটে চুট মাথায় । পায়ের খানিকটাও লেগেছে পানিতে টইটুম্বুর মশকে। ঘেন্নায় মশকের বাকী পানিটুকুন উপর করে ফেলে দিল সে। আড় চোখে দেখল কালো-চুটে পাখিটাকে । ‘বা--বা! একেবারে রক্ষীদ্বারের মত পাশের টিলাটাতেই বসেছে দেখছি । ভাবখানা এমন যেন উনি আবারও কাণ্ডটা ঘটাবেন। দাঁড়া বেটা, এবার আসলে ঠেঙ ভেঙে দেব।’ ভাবতে ভাবতে পানি মশকে পুড়ে নেয় সে। পানির তেষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে । তরিঘরি করে পানি মুখে দিতে গেল। আশঙ্কাই সত্যি হল । প্রায় মুখে পানি নেবে এমনি সময় কাছের টিলায় বসে থাকা হুলাটি আবার এসে মশকে পা দিল। ডান পাটি প্রায় ধরেই ফেলেছিল মুসাগ; কিন্তু দুরন্ত বলে ছো মেরে দৌড় লি। তবে খুব স্বাচ্ছন্দে যে গেল তা বলা যাবে না। অনেকটা ছেড়ে দে মা কেন্দে বাঁচি অবস্থা। যাই হউক এ যাত্রায়ও রক্ষা পেল সে। এবার যারপরনাই ুব্দ হল মুসাগ। জীবনে কোন দিন এমন ছেওড়ামার্কা পাখির কবলে পড়ি নি তো- কিছুটা হুসহুস করেই বল্ল। মনে আছে এক সন্ধ্যায় উট রেখে নামাজে দাড়িছেলাম ,তখন আমার মাথাকে গম্বুজ ভেবে আবাবিল জাতীয় একটা পাখি বসেছিল। তবে মাথা নাড়তেই উড়ে গিয়েছিল সেটি।
এবার মুসাগের রুদ্রমূতি।র্ গোল্লায় যাক পানি খাওয়া । তোকে খতম করেই পানি খাব। ্ এপালায় পানি খাওয়া নয় বরং পানি খাওয়ার ভান করল সে। আসা মাত্রই ধরে ফেলবে। পাখিটি উড়ে আসছে দেখেই গাফ করে ধরতে গেল সে। কিন্তু এতেই সব প্লান মাঠে মারা পড়ল। কারণ কাছে আসার আগেই হাত বাড়ানোতে সব বুঝে গেছে ধূর্ত পাখিটি। ব্যার্থ হওয়ায় ‘খামুশ!’ শব্দটা অসচেতনভাবে বেড়িয়ে পড়ল তার মুখ থেকে। সাদা -কালচে মিশেল রঙের পশম দু-চারটি হাতে আটকে আছে । ইশ! আরেকটু হলে পাখি,তোর চৌদ্দগুষ্ঠী ধরা পড়তি। কিছুটা বেশামাল হয়ে পড়ল সে। দেখল পাখিটা ঐ পাহাড়েরই একটু তপাৎে বসে আছে। ক্ষণে ক্ষণে কবুতরি-উড়াল দেয় এই যা। ভালো সুযোগ সন্দেহ নেই। আলগোছে মুষ্ঠিসমান একটা পাথর হাতে গুঁজে নেয় সে। ভাবটা এমন যেন পাথরটা সে বেহুদা ধরেছে। আড়চোখে একবার তাকিয়ে নিল । দারুন! বেটা যে ঠায় বসে আছে। আচমকা তীব্র গতিতে পাখির দিকে পাথরটি ছুড়ে মারল । নিশানা সই! একেবারে মাথায় লেগেছে। ধপাস করে ভুপাতিত হতে দেখা গেল সেটিকে। খানিক সময় ছটপট করতে করতে একসময় শান্ত হয়ে এল। এতক্ষণ একপলকে সব দেখছিলেন মুসাগ সাহেব। এভাবে কাছ থেকে ছটপট করে মারা যাওয়ার দৃশ্য তার চোখ আদ্র করে তুল্ল। আনমনেই পাখিটির কাছে গিয়ে হাতে তুলে নিলেন। আহা রে... মাথাটা একেবারে থেতলে গেছে! কালো চুলের ফাকে ফাকে তাজা ছোপ ছোপ রক্ত । যত যাই হউক এভাবে মারাটা ঠিক হয় নি। পাখিটাকে পাথর চাপা দিয়ে রাখ দরকার ভাবল সে। একটু উপরে গিয়ে মাঝারি আকারের পাথর আনতে হবে । পাথর জড়ো করতে করতে হঠাৎ যে জিনিসটি চোখে পড়ল তাতে তা চড়কগাছ হওয়ার উপক্রম। একি! ম¯ত বড় মেরুল সাপ দু খণ্ড হয়ে পাথর গুলোর নিচে চাপা পড়ে আছে। তবে কি অন্য কেউ সাপটিকে মারার পর এভাবে পুতে রেখেছে। এ সাপ তো মরুভ’মির সবচে বিষধর । ভালো করে খেয়াল করে মুসাগ দেখল সাপটির মাথার অর্ধেকটা সেই বেয়ে পড়া পানির মধ্যে ডুবানো। যার বিশ পানির সাথে মিশে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো স্রোতধারায়। তাহলে তো এ পানি খেলে আমি নির্ঘাত মারা পড়তাম। হায় ! হায় যে প্রাণ দিয়ে আমার প্রাণ বাঁচাল আমি কিনা তাকেই মেরে ফেল্লাম। আমার থেকে কৃতঘœ আর হয় না। ওকি আমাকে ক্ষমা করবে? প্রশ্নটি বিড়বিড় করে বলে আরেকবার পাখির দিকে তাকাল । এবার নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না মুসাগ। টলটল চোখ থেকে চিবুক বেয়ে কয়েক ফোটা গরম-জল নামল। পড়ল কালো-রঙে সেই পাখিটির মাথার উপরেই। এ পানি যেন তার মাথার কাছ থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ উটের আওয়াজে ধ্যানে ছেদ পড়ল । এতক্ষণে সে হয়ত মনিবের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে। পাখিটি আর প্রেথিত করতে পারল না মুসাগ। নিচে ফেলে হনহন করে ছুটে চল্ল বাহনের দিকে। দৃঢ়পদে এগিয়ে চলছে উট, সাথে তার মনিব। সামনের দিনে হয়ত নতুন কোন বণিকের পা পড়বে এখানটায়। ততদিনে পাখিটির জৈবের উপর নতুন গুল্মও জন্মাবে। কিন্তু পাখি আর মুসাগের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিস্মৃতিটুকু কজনেরই বা জানা হবে!!!!!!!!
সহকারী সাহিত্য সম্পাদক: মাসিক ‘আলোর দ্বীপ’
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:৫৪