মেয়েটির সাথে প্রথম দিনের পরিচয়ের পর থেকেই মোটামুটি সে আমার কঠিন ভক্ত হয়ে যায়...ভক্ত মানে একেবারে সুপার গ্লু। তার সকল কিছুর পরামর্শদাতা আমি...ডানে যাবো নাকি বামে, এটা করবো নাকি সেটা.... দিনে কম করে হলে ও ৬ বার ফোন।
পর্দা কিনবো কোথা থেকে?
প্রাইস চিন্তা করলে ওয়ালমার্টে থেকে কিনো আর কোয়ালিটি চিন্তা করলে হোমসেন্স থেকে।
কি কালার কিনবো?
(হাধা) ফার্নিচারের সাথে ম্যাচ করে কিনো।
আমার ফার্নিচারতো ব্লাক তাই পর্দা ও কি ব্লাক কিনবো?
(গাধা) ব্লাক পর্দা কিনে কি ঘরে ছবি ওয়াস করবা????
পর্দা রড কিনবো কোথা থেকে?
একই জিনিস বেশী দাম দিতে চাইলে হোমসেন্স থেকে কিনো।
এভাবে দশবার ফোনের পর, ওয়ালমার্টে দাড়িয়ে কল দেয় যে, রডতো কালো আর সাদা রং এর আছে, আমি কোনটা কিনবো?'
তাই বলে তাকে গাধা বলার কোনই কারন নেই, ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে ভালো চাকরী করে।
প্রায় ইউকএন্ডে সে তার দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমার বাসায় সারাদিন সময় কাটায়, যেকোন ইস্যুতেই আমার বাসায়,দরকারী বা অদরকারী সেটা কোন বিষয় না। খুব হাসিখুশী, প্রচন্ড পরিশ্রমী, অসম্ভব সুন্দরী। আমার বাচ্চারা শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করবে আজ কি আন্টি আসবে? কারন আন্টি মানেই অনেক মজার কেক, আইসক্রিম আর গিফ্ট।
মাঝে মাঝে একটু চিন্তা করি, এখানে তো কেউ কারো বাসায় সহজে আসে না আর সে প্রায় ফোন না করেই চলে আসে। কিন্তু কিছুতো বলা যায় না, সারাদিন বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটায়। আমরা প্রতিদিন নামাজ পড়ি দেখে প্রায় বলে, ''তুমি একটু আমার ছেলে-মেয়েদের ধর্ম নিয়ে কিছু বলো, ওরা জানুক ধর্ম পালনের উপকারিতা''। যদিও সে কোন ধর্মে বিশ্বাসী না কিন্তু সে চায় তার ছেলে-মেয়েরা একটা ধর্ম বেঁছে নিক।
একদিন বললো, আমি তোমার বাসায় প্রায় না বলে চলে আসি তুমি কি মাইন্ড করো?
আরে মাইন্ড করবো কেনো, আমার সহ বাচ্চাদের ভালো সময় কাটে।
ও বললো, ''ইউ আর সো হ্যাপি কজ ইউ হ্যাব এ লাভলি ফ্যামিলি।''
আমি হাসলাম, সবারইতো ফ্যামিলি আছে, এই তোমার ছেলে-মেয়ে, স্বামী সংসার চমৎকার ফ্যামিলি।
না, তুমি যা দেখছো তা ঠিক নয়। আমি তোমার বাসায় আমার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে প্রায় আসি কারন আমি শেখাতে চাই সত্যিকারের পরিবার কি? আমি কখনই আমার বাবাকে দেখিনি, আমি বড় হয়েছি আমার সৎ বাবা আর মায়ের কাছে। খুব চাইতাম বাবার আদর কিন্তু সৎ বাবা কখনই আমাকে কাছে টেনে নেয়নি। আমার যখন বয়স ১৭ তখন আমার ক্লাসের একটি ছেলের সাথে সম্পর্ক হয়। ওর ঘরে আমার বড় ছেলের জন্ম আমার ১৯ বছরে, আমাদের সম্পর্ক তারপরে এক বছর টিকে ছিল। বড় ছেলে বয়স যখন পাচঁ তখন ছোট মেয়ের বাবার সাথে পরিচয়। মেয়ের জন্মের পর ওর সাথে সম্পর্ক তিন বছর টিকে ছিল। হেনরীর সাথে পরিচয় বছর কয়েক, ওকে আমি ভীষন ভালোবাসি। কিন্তু সে তো আমার বাচ্চাদের বাবা না, হেনরীও সেভাবে ও তাদের কাছে টেনে নেয় না।
দেখো, আমারও পরিবার আছে কিন্তু আমার বাচ্চারা তাদের বাবাদের চিনে না, কখনো বাবার ভালোবাসা পায়নি। আমি সারা জীবন একটা চমৎকার পরিবারের জন্য মুখিয়ে আছি, একটি সত্যিকারের পরিবার, বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী নিয়ে সত্যিকারের পরিবার। কিন্তু আমি পাইনি, আমার মাও পায়নি আর আমার সন্তানরা ও পাবে কিনা জানি না। তাই তাদের আমি এ বয়স থেকে বোঝাতে চাই পরিবার কি, সত্যিকারের পরিবার কেমন হয়, পরিবারের ভালোবাসা কেমন হয়।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। সত্যিই তো, আমরা বাবা-মা ভাই-বোন চাচা-মামা দাদী-নানী নিয়ে বিশাল পরিবারের মাঝে বড় হয়েছি। আমরা কখনই পরিবারের শূণ্যতা অনুভব করিনি। আদর, শাসন, দুস্টুমি, মারামারি, রাগ, অভিমান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা...... সবকিছুই শিখেছি পরিবার থেকে। এই পরিবারের কারনে আমরা হারিয়ে যাইনি জনসমু্দ্রে, বিপদে হতাশ হয়নি, কষ্টে ভেঙ্গে পড়িনি। পরিবার একটি ভীষন শক্তিশালী মাধ্যম।
শুধু তাই নয়, শুধুমাত্র পরিপূর্ণ একটি পরিবারই দিতে পারে একটি শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ। সে যদি দেখে আদর ভালোবাসার একটি পরিবেশ তাহলে সে ও তার সন্তানদের দিবে এমনি একটি পরিপূর্ণ পরিবার।
ঠিক তার বিপরীতে যে শিশুটি দেখে পরিবারে অশান্তি, মা-বাবা একজন আরেকজনের প্রতিপক্ষ, সন্মান-ভালোবাসা অনুপস্থিত। তাহলে সেও শিখবে হিংস্রতা, সে ও পারবে না সন্মান দিতে, ভালোবাসতে।
এমন পরিবেশ কি আমাদের সন্তানদের জন্য রাখা উচিত?
আমরা কি পারি না সন্তানদের জন্য আমাদের রাগ-দু:খ, হিংসা-প্রতিহিংসা, উপহাস, অপমান, অসন্মান একটু সরিয়ে রাখতে? ওদেরকে একটা সুন্দর পরিবার উপহার দিতে?
সবাই ভালো থাকুন।
সোহানী
নভেম্বর ২০২৩
ছবি: গুগুল মামা
বি:দ্র: অনুরোধ উপরোধে লিখা-লিখির ঢেঁকি গিলেছি খায়রুল আহসান ও শেরজা তপন ভাইদের জন্য। এ লিখাটার মূল অংশ আমার অন্য লিখা থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:৩৭