somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কম্বোডিয়ার গনহত্যা: খেমার রুজ শাসনের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়।

২২ শে নভেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৫:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোট্ট এই মেয়েটিকেও খেমার রুজ গেরিলারা রেহাই দেয়নি।

রুজ শব্দটা ফরাসী; অর্থ লাল। কাজেই খেমার রুজ শব্দের অর্থ: লাল খেমার। কম্বোডিয়ার ৯৫% লোকই খেমার জনগোষ্ঠীর। খেমার রুজ বলতে কম্বোডিয়ার কমিউনিষ্ট গেরিলাদের বোঝায়।
কিন্তু, ফরাসী নামের কি কারণ?
১৮৬৩ থেকে ১৯৫৩ অবধি কম্বোডিয়া শাসন করেছিল ফ্রান্স । কাজেই, ফরাসী শাসনাধীন কম্বোডিয়ায় খেমার ভাষার পরই ফরাসী ভাষার স্থান।
স্বাধীনতাউত্তর কম্বোডিয়ার প্রথম শাসক ছিলেন প্রিন্স নরোদম সিহানুক। তিনিই কম্বোডিয়ার কমিউনিষ্ট গেরিলাদের ঐ “লাল খেমার” নাম দিয়েছিলেন।
১৯৭৫। এপ্রিল মাস। সরকারী বাহিনীকে বিধস্ত করে লক্ষ লক্ষ খেমার রুজ গেরিলারা কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে প্রবেশ করে। সেই ষাটের দশক থেকেই কম্বোডিয়ার কমিউনিষ্ট গেরিলারা কম্বোডিয়ার শাসন ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে জোর তৎপরতা চালিয়ে আসছিল। ১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল তারা সে লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়। খেমার রুজ গেরিলাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পলপট। খেমার রুজ গেরিলারা নমপেন দখল করার পলপট সরকার কম্বোডিয়ার নামকরণ করে “ডেমোক্রেটিক কাম্পূচিয়া”। তারপর নানাবিধ সংস্কারে নামে পলপট সরকার ভয়ঙ্কর এক হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়।
যে গনহত্যা চলাকালীন সময়ে নমপেন শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মেকঙ নদীটার জল হয়ে উঠেছিল রক্তাক্ত।
গনহত্যা কারণ?
নমপেনবাসীর ওপর খেমার রুজ গেরিলাদের ছিল ভয়ঙ্কর ক্রোধ। খেমার রুজ গেরিলাদের চোখে নমপেনবাসী ছিল পাতি বুর্জোয়া: যারা সব সময় শস্তা ভোগ বিলাসে ডুবে থাকে, মদ খায়, নাইট ক্লাবে নাচে; যারা আমেরিকান কালচারে আসক্ত, খেতে পছন্দ করে বার্গার ও কোক; দেশের প্রতি যাদের বিন্দুমাত্র টান নাই, যারা বিপ্লবে যোগ দেয়নি, যারা সব সময় কেবল আমেরিকার যাওয়ার ধান্দায় থাকে, গ্রামে যেতে চায় না; গ্রামের মানুষের দারিদ্র নিয়ে ভাবে না, কোনওমতে পাশ করে একটা চাকরি পেলেই যারা খুশি।
খেমার রুজ গেরিলারা নমপেনবাসীর নাম দিয়েছিল: “মেকঙ নদীর বেশ্যা।”
কাজেই অস্ত্রের মুখে আমেরিকা-আসক্ত পাতি বুর্জোয়া নমপেনবাসীকে নিয়ে যাওয়া হল গ্রামের দিকে । হাঁটিয়ে। রাস্তার ওপর হাজার হাজার নারীপুরুষশিশুবৃদ্ধবৃদ্ধা হাঁটছে। এপ্রিল-মে মাসের কড়া রোদ। তৃষ্ণা। ক্ষুধা। বিলাসী জীবনযাপসের জন্য মুটিয়ে গিয়েছিল অনেকেই। হাঁপাতে-হাঁপাতে পথেই মরল অনেকেই । উৎকন্ঠিত তাদের চকচকে হলুদ মুখ। দু’পাশে কারবাইন উঁচিয়ে খেমার রুজ গেরিলারা। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই ঠা ঠা ঠা।
মাঝে মাঝে একটা কালো ট্রাক এসে থামত রাস্তার পাশে। বেছে বেছে খেমার রুজ গেরিলার লোকজনকে তুলে দিত সেই ট্রাকে। তারপর ট্রাকটা চলে যেত কোনও নির্যাতন কেন্দ্র। হয়তো টুঅল স্লেঙ্গ-এ। টুঅল স্লেঙ্গ-এ বন্দিদের প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হত । জিজ্ঞাসাবাদের সময় টর্চার।
টুঅল স্লেঙ্গ থেকে মৃতপ্রায় বন্দিদের আবার ট্রাকে তোলা হত।
ট্রাক একাব ছুটত চোয়েয়ুঙ্গ এক-এর দিকে।
চোয়েয়ুঙ্গ এক ছিল খেমার রুজ গেরিলাদের অন্যতম বধ্যভূমি।



তখন বলছিলাম যে-খেমার রুজ গেরিলাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পলপট। পলপট ছদ্মনাম। ফ্রান্সে থাকাকালীন সময়ে নেওয়া। আসলে পলপট শব্দের কোনও নির্দিষ্ট মানে নেই। পলপটের আসল নাম- সালথ সার। জন্ম ১৯২৫ সালে কম্বোডিয়ার এক অভিজাত পরিবারে। পরিবারটি ছিল বৌদ্ধ। কাজেই সালথ সারের ছেলেবেলায় শিক্ষার অন্যতম ভিতটি ছিল অহিংস বৌদ্ধ দর্শন ছিল । বালক সালথ সার পাঠ করেছিল ধর্মপদ থেকে বুদ্ধের বানী।

Let go of anger.
Let go of pride.
When you are bound by nothing
You go beyond sorrow.
Anger is like a chariot careering wildly.
He who curbs his anger is the true charioteer.
Others merely hold the reins.
With gentleness overcome anger.
With generosity overcome meanness.
With truth overcome deceit.
Speak the truth.
Give whenever you can,
Never be angry.

ভাবলে অবাক হতে হয়-পরে এই পলপটেরই নির্দেশেই লক্ষাধিক নিরীহ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করা হয়েছিল।
১৯৪৮ সাল। রেডিও ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়তে ফ্রান্সে যায় সালথ সার। সেই সময়টায় গোটা ইউরোপ ছিল মাকর্সবাদ নিয়ে উত্তেজিত। সেই সময়ককার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবি মনে করতেন: মাকর্সবাদ সর্ব প্রকার সামাজিক রোগের একমাত্র প্রতিষেধক। এমন কী সার্ত্রর মতন নিরাসক্ত মানুষও মাকর্সবাদের আকর্ষন এড়াতে পারেন নি। প্যারিসেই মাকর্সবাদে দীক্ষা সালথসারের। সম্ভবত সার্ত্রর সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। কম্বোডিয়ায় তখন ফরাসী শাসন। সার্ত্র উপনিবেশগুলোয় ফরাসী শাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন।
পলপট কম্বোডিয়ায় ফেরেন ১৯৫৩ সালে। ফিরেই স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভিয়েতনামও লড়ছিল ঔপনেবেশিক ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। ভিয়েত কংদের সঙ্গে যোগাযোগ হল পলপটের।
১৯৫৩ সালেই ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিল কম্বোডিয়ার স্বাধীনতাকামী জনগন। নরোদম সিহানুক হলেন রাজা। স্বাধীনতার পরপরই পলপটসহ অন্যদের তৎপরতায় কমিউনিষ্ট আন্দোলন দানা বাঁধছিল কম্বোডিয়ায়- যে আন্দোলনের পিছনে ভিয়েতনামের শ্রমজীবি শ্রেনির অগ্রনায়ক হো চি মিন-এর প্রত্যক্ষ ইন্ধন ছিল। প্রিন্স নরোদম সিহানুক ছিলেন প্রাচীনপন্থি। তিনি মাকর্সবাদ বুঝতেন না। বুদ্ধের দানশীলতায় আস্থা ছিল। তিনি নির্মম উপায়ে কমিউনিষ্ট দমন করতে লাগলেন বটে - তবুও পলপটের নেতৃত্বে ষাটের দশকে কমিউনিষ্ট আন্দোলন আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকে কম্বোডিয়ায়। ভিয়েতনামের ভিয়েত কংরা তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিচ্ছিল। দুটি প্রতিবেশি দেশের অবস্থা তখন ভয়ানক জটিল। থেকে থেকে মার্কিন বিমান হামলা চলছিল ভিয়েতনামে; সীমান্ত পেরিয়ে এমন কী কম্বোডিয়াতেও বোমা বর্ষন করছিল মার্কিন বোমারু বিমানগুলি । কেননা, মার্কিন প্রশাসন ইন্দোচিনে কমিউনিষ্ট তৎপরাতার মূল শিকড় উপড়ে ফেলতে চায়! অবস্থা এমনই ভয়ানক।
১৯৬৭ সাল। পলপটের নেতৃত্বাধীন কম্বোডিও কমিউনিস্টরা একের পর এক সিহানুক নিয়ন্ত্রিত সরকারী বাহিনীকে আক্রমন করে করে পযুদর্স্ত করতে থাকে ।
প্রিন্স নরোদম সিহানুক ঠিক ঐ সময়টায় কম্বোডিয়ার কমিউনিষ্টদের নাম দিয়েছিলেন খেমার রুজ । অর্থাৎ, লাল খেমার।
১৯৭৫। ৮ বছর গেরিলা যুদ্ধের পর ট্যাঙ্ক বহর নিয়ে লক্ষ লক্ষ খেমার রুজ গেরিলারা নমপেন শহরে প্রবেশ করে। তারপর ১৯৭৯ সাল অবধি প্রায় ৩০ লক্ষ কম্বোডিয় জনগনের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯। এই সময়টায় পলপট সরকার কম্বোডিয়ায় শুদ্ধি অভিযানের নামে নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এককালের সুহৃদ ভিয়েতনামের সঙ্গে পলপটের সর্ম্পকে ফাটল ধরেছিল। খেমারুজরা ভিয়েতনাম সীমান্তও আক্রমন করছিল। ভিয়েনাম নাকি কম্বোডিয়ার পূর্বাঞ্চলের সীমানা গ্রাস করে নিয়েছিল-এই অজুহাতে। আসলে সেই সময়টায়, ঐতিহাসিকদের মতে, পলপট সরকার ভুগছিল উগ্র জাতীয়তাবোধে।
১৯৭৮ সাল। ভিয়েতনামী সৈন্যরা কম্বোডিয়ায় অনুপ্রবেশ করে। অনুপ্রবেশের অবশ্য অন্য কারণও ছিল। পলপট সরকার কর্তৃক পরিচালিত অমানবিক গনহত্যা ।
অপ্রতিরোধ্য ভিয়েতনামী সৈন্যরা দ্রুত নমপেনের দিকে এগিয়ে আসছিল।
১৯৭৯। পলপটসহ খেমার রুজরা গেরিলারা থাই সীমান্তের পালিয়ে যায়।
ভিয়েতনাম ছিল আমেরিকার শক্র। কাজেই, গনহত্যার অভিযোগ সত্ত্বেও আমেরিকা খেমার রুজ গেরিলাদের বিচার না-করে বরং সাহায্যই করেছিল।



নমপেন শহরের একটি হাই স্কুল। নাম: টুঅল সাভি প্রেই। স্বাধীনতা উত্তর কম্বোডিয়ার প্রথম শাসক প্রিন্স নরোদম সিহানুক-এর নামে নাম। সাদা রং করা ৫টি দালান মিলে তিন তলা স্কুল। সামনে খেলার মাঠ । মাঠের কিনারে কিনারে নারকেল গাছ। নারকেল গাছ গোড়ায় সাদা রং করা । রাস্তা থেকে দোতলার বারান্দা ও পিলার চোখে পড়ে। আজ ঐ স্কুলটাকে দেখে কে বলবে ঐ স্কুলেই চার বছর ধরে প্রায় ২০,০০০ মানুষকে বন্দি করে অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছিল।
১৯৭৫। আগস্ট মাস। পলপট সরকার সিদ্ধান্ত নিল টুঅল সাভি প্রেই স্কুলটাকে নির্যাতন কেন্দ্র করে তুলবে। স্কুলটার বাউন্ডারি কাঁটাতারে ঘিরে ফেলা হয়। প্রবাহিত করা হল বিদ্যুৎ। নাম দিল Security Prison 21 (S-21) Tuol Sleng ও বলা হল। Tuol Sleng শব্দটি খেমার। মানে, "বিষাক্ত বৃক্ষের পাহাড়।"
স্কুলটার ক্লাসরুমগুলিই হয়ে ওঠে প্রিজন সেল আর টর্চার চেম্বার। কখনও ১০০০ থেকে ১৫০০ বন্দি থাকত টুঅল স্লেঙ্গ-এ। অনেকেই নির্যাতন সইতে পারত না। মরে যেত। যারা বেঁচে থাকত-তাদের পাঠানো হত চোয়েয়ুঙ্গ এক নামে বধ্যভূমিতে।
নমপেনের ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে চোয়েয়ুঙ্গ এক।
১৯৭৫ সালের আগে চোয়েয়ুঙ্গ এক ছিল ফাঁকা মাঠ। মাঠে নানা রকম গাছ। একপাশে চিনেদের কবরখানা। ১৯৭৫ সালের পর ঐ চোয়েয়ুঙ্গ এক-ই হয়ে উঠেছিল খেমার রুজদের বধ্যভূমি। প্রায় ২০, ০০০ মানুষকে ওখানে মেরে ফেলা হয়েছিল। একটি ১৯৮০ সালের পর ওখানকার একটি গনকবরে প্রায় সাড়ে আট হাজার মৃতদেহ পাওয়া গেছিল। মৃত্যুর আগে প্রায় সবাই টুঅল স্লেঙ্গ এ ছিল। বন্দিরা প্রথমে মাঠের ওপর একটা গর্ত খুঁড়ত। গর্ত খোঁড়া শেষ হলে বন্দিদের গর্তের পাশে দাঁড়াতে বলত খেমার রুজরা। হত্যাযজ্ঞের সময় পলপট সরকার বুলেট খরচ করত না। যে কারণে, খেমার রুজদের হাতে থাকত রড, কখনও - কখনও কোদাল নিড়ানির মতো ভোঁতাও ব্যবহার করত তারা । খেমার রুজরা বন্দিদের পিটিয়ে পিটিয়ে মারত।
গাছের গুঁড়িতে আছড়ে মারত শিশুদের ।
আশির দশকে একটি বৌদ্ধ স্তুপ নির্মান করা হয়েছে চোয়েয়ুঙ্গ এক-এ। সাদা রঙের ছোট্ট একটা বাড়ি। চারিদিকে কাচে ঘেরা। বাইরে থেকে দেখা যায় ভিতরে কী আছে। ভিতরের পরপর কয়েকটা প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মের ওপর খুলির পাহাড়। সর্বমোট ৫০০০ খুলি রয়েছে! নানা বয়েসী মানুষের খুলি। নারীর, পুরুষের, শিশুর। বেশির ভাগ খুলিতেই ফাটল। আঘাতের চিহ্ণ ...
মানুষের এমন অসহায় মৃত্যু!
যে মৃত্যু খেমার রুজ পলপট সরকারের ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা। পলপট সরকার যে কোনও সন্দেহভাজনকে প্রথমে দু-বার সতর্কবানী পাঠাত । তারপর তাদের আসতে বলা হত কোনও গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলত- দোষ স্বীকার কর। তা হলে তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। বল তুমি বিদেশিদের চেন, তুমি কি আমেরিকানদের চেন?। বল। বল, নইলে তোমার স্লেট ক্লিন করে দেব। তার মানে এখন তুমি প্রথমে যাবে টুঅল স্লেঙ্গ। সেখানে তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সামান্য উত্তম মধ্যম দেওয়া হবে। পরে তোমাকে পাঠানো হবে চোয়েয়ুঙ্গ এক। মেরে ফেলার জন্য। তোমার মাথায় মোটা শক্ত কাঠ দিয়ে আঘাত করা হবে। ভবিষ্যতের মানুষ দেখবে তোমার মাথায় ফাটল, আঘাতের চিহ্ন ...
মানুষের এমন অসহায় মৃত্যু!
টুঅল স্লেঙ্গ-এ সন্দেহভাজন বন্দিদের ২ থেকে ৩ মাস রাখা হত। গভীর সন্দেজভাজনদের আরও বেশি। টুঅল স্লেঙ্গ এ প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হত। জিজ্ঞাসাবাদের সময় মারা হত, দেওয়া হত ইলেকট্রিক শক; লোহার তার গরম করে ঢোকানো হত শরীরের নানা জায়গায়। সিলিং থেকে উলটো করে ঝুলিয়ে রাখত- নিচে ড্রাম ভরতি পানি, পানিতে বন্দির মুখ। একজন দড়ি ধরে টানছে। বন্দির মুখ ড্রামের পানিতে ডুবছে, ভাসছে। কখনও মাথায় প্লাস্টিকের ব্যাগ ভরে মানুষটার নিঃশ্বাস আটকে রাখা হত। কিংবা ধারালো ছোরা দিয়ে ফালি ফালি করে কাটা হত অঙ্গপ্রতঙ্গ; তুলে ফেলা হত নখ । নখের ক্ষতে ঢালা হত অ্যালকোলহল। বন্দির মাথা পানির তলে চুবিয়ে রাখা হত। অনেকক্ষণ। মেয়েদের করা হত ধর্ষন।
সবশেষে মেরে ফেলার জন্য পাঠানো হত চোয়েয়ুঙ্গ এক।
আগেই বলেছি- চোয়েয়ুঙ্গ এক রয়েছে খুলিতে ভরা একটি সাদা রঙের কাচের বাড়ি। বৌদ্ধ স্তুপ। নানাদেশ থেকে লোকে যায় ওই সাদা রঙের বাড়িতে । নানা বয়েসী মানুষের খুলি। নারীর, পুরুষের, শিশুর। বেশির ভাগ খুলিতেই ফাটল। আঘাতের চিহ্ণ ... খেমার রুজ দের বর্বরতা দেখে শিউরে ওঠে তারা।
টুঅল স্লেঙ্গও এখন গনহত্যা যাদুঘর। নানাদেশ থেকে লোকে যায় ওখানে। খেমার রুজ দের বর্বরতা দেখে শিউরে ওঠে।



১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯। অসংখ্য নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি গড়ে উঠেছিল কম্বোডিয়া জুড়ে। প্রায় প্রতিদিনই হাজার হাজার লোককে মেরে ফেলা হত। ১৯৭৫ সালে কম্বোডিয়ার জনসংখ্যা ছিল ৭০ লক্ষ। যার মধ্যে ৩০ লক্ষই নিহত হয়েছিল খেমার রুজ গেরিলাদের পরিচালিত নির্মম গনহত্যায়।
খেমারদের পরিবার সাধারনত বড় হয়। একেকটা পরিবারের লোকসংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ জনের কম না। ওদের অস্ত্রের মুখে কোনও নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া হত। কাপড় দিয়ে চোখ বাধা হত, হাত বাধা হত। তারপর রড দিয়ে আঘাত করে করে ৭০ ৮০ জনকেই মেরে ফেলা হত।
অনেক খুনিরাই ছিল কিশোর। খেমার রুজরা এদের ডাবের পানিতে রক্ত মিশিয়ে খাইয়ে খুনিতে পরিনত করেছিল কম্বোডিয়ায় ক্ষমতা দখলের পর।



পলপট সরকার হত্যাযজ্ঞে মেতেছিল কেন?
কমিউনিষ্ট পলপট সরকার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিল। নতুন এক সমাজ গড়তে চেয়েছিল খেমার রুজ গেরিলারা। গ্রামভিত্তিক, শ্রেণিহীন।ছেলেবেলায় কম্বোয়িায়ায় অপরিসীম দারিদ্র দেখেছিল পলপট। দেখেছিল ফরাসী শাসনশোষনের নির্মম ফল। বুদ্ধের মিঠে কথায় যে দারিদ্র দূর হয়নি টের পেয়েছিল। ইউরোপে গেলেন পলপট। মার্কসবাদ তখন নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দরিদ্র রাশিয়াকে বদলে দিচ্ছে সোভিয়েতরা । মাসর্কবাদী তত্ত্বমতে: সমাজের রুপ (form)আছে। একে সচেতন ভাবে বদলানো যায়। কাজেই পলপটের নির্দেশে অস্ত্রের মুখে পাতি বুর্জোয়া আমেরিকা-আসক্ত নমপেনবাসীকে নিয়ে গেল গ্রামের পথে। হাঁটিয়ে। দু’পাশে খেমার রুজ গেরিলারা কারবাইন উঁচিয়ে। সামান্য এদিক ওদিক হলেই ঠা ঠা ঠা। এপ্রিল-মে মাসের গরম। তৃষ্ণা। পথেই মরল অনেকে। মাঝে মাঝে একটা কালো ট্রাক এসে থামত। লোকজনকে তুলে নিত। তারপর ট্রাকটা থামত কোনও নির্যাতন কেন্দ্র। হয়তো টুঅল স্লেঙ্গ-এ।
টুঅল স্লেঙ্গ থেকে চোয়েয়ুঙ্গ এক।



অনেকের মতে বাংলাদেশেও সমাজকাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন। কথাটা অস্বীকার করব না। তবে সে উদ্যেগে একজন মানুষও যেন নিহত না হয়। সমাজকাঠামোর পরিবর্তন হতে হবে রক্তপাতহীন।
আমাদের কম্বোডিয়ার স্বৈরাচারী পলপট শাসনের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
ষাট ও সত্তুরের দশকে মার্কিন আগ্রাসন ঠেকাতে ২০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিল ভিয়েতনাম । ভিয়েতনামী তরুনতরুণীরা সে ইতিহাস জানেই না।আজ তারা ঠিকই কোক খাচ্ছে, বার্গার খাচ্ছে, কিনছে আইপড ন্যানো।
তাহলে কী লাভ হল ঐ ২০ লক্ষ মানুষের আত্মদানে?
নেপালের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী থেকেও আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু ।



শেষমেশ কি হয়েছিল পলপটের?
মনে থাকার কথা। ১৯৭৮ সাল। কম্বোডিয়ায় গনহত্যা ঠেকানোর জন্য ভিয়েতনামী কমিউনিস্টরা কম্বোডিয়ায় অনুপ্রবেশ করে। পলপটসহ খেমার রুজরা গেরিলারা থাই সীমান্তের দিকে পালিয়ে যায়। তবে, খেমার রুজ গেরিলাদের ওপর পলপট তার আধিপত্য দীর্ঘকাল বজায় রাখতে পারেনি। একদল খেমার রুজ গেরিলা বিদ্রোহ করে পলপটকে বন্দি করে। তার বিচার চলছিল। বিচার করছিল খেমার রুজরাই। বিচার চলাকালীন সময়ে থাইকম্বোডিয়া সীমান্তের কাছে গহীন অরণ্যে একটি কাঠের বাড়িতে। পলপট মারা যান ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে । পলপটের জীবনীকার লিখেছেন- মৃত্যুর সময় পলপটের নাকি তেমন মৃত্যুযন্ত্রনা হয়নি। ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন পলপট!
পলপট প্রথম বিবাহ করেছিলেন ফ্রান্সে। ২য় একটি বিবাহ করেছিলেন নাকি মৃত্যুর ঠিক আগে ।

তথ্যসূত্র:

http://en.wikipedia.org/wiki/Cambodia

Chandler, David, and Rooney, Dawn F. "Cambodia." Microsoft® Student 2008 [DVD]. Redmond, WA: Microsoft Corporation, 2007. Microsoft ® Encarta ® 2008. © 1993-2007 Microsoft Corporation. All rights reserved.

Tuol Sleng-এর বন্দিদের ছবি দেখতে চাইলে-

http://www.tuolsleng.com/photographs.php



সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:২৭
২২টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×